কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ১২
#বিড়ম্বনা
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
ফুটেজ চেক করার রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন ইশারা। তিনি রেকর্ডিং দেখবেন মানে দেখবেন। ছেলের বার বার মানা করার কারণেই আরো জেদ ধরছেন তিনি।
ইশারার এক ধমকে ভিডিও অন করে দিলো ম্যানেজার। বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে একহাতে কপাল স্লাইড করলো ইভান।
ম্যানেজারকেসহ যার যারা ছিলো তাদের বাহিরে যেতে বলল। প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমতাআমতা করে সবাই বেরিয়ে গেলো।
ক্যান্ডেল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ইভানের অস্বস্তি। এমন কী আছে ভিডিওতে যে বার বার মানা করছে!(লেখিকা লাকি নোভা)
ভিডিও টেনে টেনে কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তে এনে ইশারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একপলক তাকালেন ইভানের দিকে।
রাগে ফুলে ফেঁপে দেখতে লাগলেন তিনি।
ইভান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। এটা দেখার পরে ভুলবোঝাবুঝির আর কোনোকিছুই বাকি থাকবে না। মোটেও আর বিশ্বাস করানো যাবে না ইশারাকে।
রাত আনুমানিক বারোটা ছিলো। ক্যান্ডেলকে কোলে করে দরজা অব্দি এনে নামিয়েছিল ইভান। দরজাটা খোলার জন্য। দাঁড়াতে পারছিলো না বলে দেয়ালে সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে চেয়েছিলো ক্যান্ডেলকে।
ঠিক তখনই শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে নিজের খুব কাছে টেনে নিয়ে আপত্তিজনক কাজ করে বসেছিলো ক্যান্ডেল।
ব্যাকসাইড থেকে করা ভিডিও হলেও বিষয়টা বুঝতে সমস্যা হলো না ইশারার। থমকে গেলেন তিনি। রাগে, লজ্জায় শরীর ঝিম মেরে গেলো তার। লজ্জার কারণেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত রুমটা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ক্যান্ডেল লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। স্ক্রিনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেও দৃশ্যটা চোখের সামনেই ভাসতে লাগলো। শরীর অবশ হয়ে যেতে লাগলো।
আড়চোখে একবার ইভানের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো।
হড়বড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো ক্যান্ডেল। রুমটা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইতেই ইভান হাত টেনে ধরে থামালো ওকে।
হকচকিয়ে গেলো ক্যান্ডেল। আবার চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অপ্রস্তুত ভাবটা ফুটে উঠলো মুখ জুড়ে। ঠোঁট নড়িয়েও কিছু বলতে পারলো না। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে রইলো সব কথা।
“এখন পালাচ্ছো কেনো? নাকি শুধু ড্রিংক করলেই আমার কাছে আসতে ইচ্ছে করে?”
চমকে উঠলো ক্যান্ডেল। অপমানে, লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো মুখখানা।
“নিজের চোখে দেখেছো না? এখন বলো, কে pervert আর কে অসভ্য?” কটাক্ষ করে বলল ইভান।
ক্যান্ডেল হাত কচলাতে কচলাতে মেঝের দিকে নতদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নিজের কাছে নিজেকেই ছোটো মনে হতে লাগলো।(লেখিকা লাকি নোভা)
“আমার উচিত ছিলো তোমাকে হেল্পই না করা। তোমার কেয়ারলেসনেসের জন্য এখন পরিস্থিতি কতটা বাজে ভাবতে পারছো?”
ক্যান্ডেল চোখ তুলে তাকালো একবার।
“তোমাকে বলেও বা কী হবে?” ইভান এক ঝটকায় হাত ছেড়ে দিলো ওর।
বিরক্তির সাথে এগিয়ে গিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে একে একে ডিলিট করে দিলো সব ফাইলগুলো।
বিয়ের শাড়ি পরে আয়নায় সামনে নতজানু হয়ে বসে আছে ত্রয়ী। উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কোলের উপর রাখা মেহেদীরাঙা হাতের দিকে।
একটু পরেই বিয়েটা হয়ে যাবে। ও পুরোপুরিভাবে অন্যকারো হয়ে যাবে।
তবে এখন কোনো পিছুটান নেই। বরং সেই জানোয়ারের কাছ থেকে বেঁচে গেছে। নাহলে সারাজীবন পস্তাতে হতো। খুব বাজেভাবে পস্তাতে হতো।
বুকটা কেমন করে উঠতেই চোখ চিপে বন্ধ করে নিজেকে সামলালো ত্রয়ী। কোনো অমানুষের জন্য ও কেনো কষ্ট পাবে! একদম পাবে না।
বড় করে নিঃশ্বাস ফেলতেই কাধে হাত রাখলেন সাবিহা।
একটু চমকে উঠলো ত্রয়ী।
সাবিহা অমায়িকভাবে হাসলেন। মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিতেই ত্রয়ী চোখের জল ছেড়ে দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো মায়ের।
সাবিহা আলতো করে এক হাত পিঠে রেখে অন্যহাত মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
ত্রয়ী সেদিন ফিরে এসেই সবকিছু জানিয়েছিল সাবিহাকে।(লেখিকা লাকি নোভা)
মেয়ে সবকিছু বন্ধুর মতো মায়ের কাছে শেয়ার করলেই নুহাসের বিষয়টা প্রথম থেকেই লুকিয়েছিল। তাই হঠাৎ জানাতে বেশ অবাক হয়েছিলেন সাবিহা।
তবুও এমন খারাপ কারো হাত থেকে ত্রয়ী রক্ষা পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। নাহলে আরো খারাপ কিছুও হতে পারতো।
প্রয়াস বেশ কিছুক্ষণ ধরে তুখোড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সেই আগুন্তককে। যে নিজেকে তিয়াসার পরিবারের লোক হিসেবে জানিয়ে থানা থেকে খোঁজ পেয়ে এখানে এসেছে।
“তিয়াসার কে হন আপনি?” দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন ছুড়তেই লোকটা থতমত খেয়ে গেলো। মিনমিন করার ফাঁকে একটা ঢোক গিললো সে।
“বললাম তো, পরিবারের লোক।” স্বাভাবিক ভাবেই বলার চেষ্টা করলো সে।
প্রয়াস খেয়াল করলো লোকটা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না। এমনকি এসির ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও ঘামছে সে।(লেখিকা লাকি নোভা)
হয়তো বুঝতে পারেনি যে এতো জেরা করা হবে। সাধারণত বাহিরের মানুষকে কেউই রাখতে চায় না। ঝামেলা মনে করে। সেই হিসেবে এতোদিন পর বাড়ির লোককে পেয়ে আপদ বিদেয় হবে মনে করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা উচিত আশ্রয়দাতার।
কিন্তু এখানে হচ্ছে উল্টোটা।
“পরিবারের লোক বুঝলাম। সম্পর্ক জানতে চাচ্ছি।” ভরাট কণ্ঠে বলল প্রয়াস।
লোকটা গলা ঝেড়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “এত প্রশ্নের কী আছে? থানাতেও তো এত প্রশ্ন করে নি।”
প্রয়াসকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিপাকে পড়ে গেলো লোকটা। বুঝলো যে সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর ছাড়া তিয়াসাকে নিয়ে যাওয়াই যাবে না।
লোকটা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। কপটে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার স্ত্রী ও।”
মুখোভাবে প্রকাশ না ঘটলেও বেশ অবাক হলো প্রয়াস। ভ্রুকুটি করে তাকালো সামনের লোকটার দিকে। আরেকবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো নিখুঁতভাবে।
লোকটার বয়স কম করে হলেও তিয়াসার দ্বিগুণেরও বেশি। এত বড়ো একটা লোকের সাথে তিয়াসার বিয়ে হয়েছে! সত্যিই?
কিছুতেই ধাতস্থ হতে পারছে না প্রয়াস। কারণ তিয়াসা তো এবিষয়ে কিছুই বলে নি! কাকি, কাকি আর রুমি নামের এক মেয়ের কথাই সেদিন জানিয়েছিলো। তাহলে!
প্রয়াসকে একভাবে গহন চাহনিতে চেয়ে থাকতে দেখে অপ্রতিভ হয়ে নড়েচড়ে বসলো লোকটা। হালকা গলা ঝেড়ে বলল, “এবার তো নিয়ে যেতে পারি?”
“না।”
সরাসরি মুখের উপর ‘না’ শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সে।
“মানে?” বোকা বনে গেলো লোকটা।
“তিয়াসা আপনার সাথে যেতে চাইছে না। আপনাকে দেখেই তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এসবের কারণ কী?” জহুরি নজরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো প্রয়াস।
লোকটার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়লো খানিক। আমতাআমতা করে বলল, “আরকি বাসায় একটু ঝামেলা হয়েছিলো। আমি ওর সাথে কথা বলে বিষয়টা মিটিয়ে নেবো। আপনি ওকে নিয়ে আসুন তাহলেই হবে। বাকিটা আমি বুঝে নেবো।”
“এমন কী ঝামেলা যে ওর গায়ে হাত তুলতে হতো?”
পিলে চমকে উঠলো লোকটার। তাকালো বিস্ফোরিত চোখে।
“গায়ে হাত মানে? কী বলছেন আপনি!”
“আজই ডক্টরের কাছে নিয়েছিলাম ওকে। রিপোর্ট আছে আমার কাছে। শরীরেসহ মাথাতেও আঘাত করা হয়েছে। বেশ কয়েকবারই।”
ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। কড়া গলায় বলার চেষ্টা করলো, “আপনি বেশি বেশি করছেন। এমন কিছুই নয়। আর তাছাড়া আমাদের পারিবারিক বিষয়ে নিয়ে এত ঘাটাঘাটি কেনো করছেন? পরিচয় দিয়েছি। এখন ভালোয় ভালোয় তিয়াসাকে নিয়ে যেতে দিন। নয়তো…”
“নয়তো?” কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে অত্যন্ত গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল প্রয়াস।(লেখিকা লাকি নোভা)
লোকটা অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হুমকি দেয়ার ভঙ্গিমাতে বলল, “নয়তো পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবো আমি।”
ভ্রু উঁচু করলো প্রয়াস। বুকে হাত গুজে তাচ্ছিল্যের সাথে তাকিয়ে সোফায় পিঠ ঠেকালো। চোরের মায়ের বড়ো গলা হয়তো একেই বলে।
“জানান। এখন মুখে মুখে প্রশ্ন হচ্ছে, তখন প্রশ্নের সাথে সাথে পিঠে লাঠিও পড়বে। বাইদ্যওয়ে, নারী ও শিশু নির্যাতনের শাস্তি জানেন তো, মিস্টার… কী জেনো নাম?”
ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই ভয় পেয়ে গেলো লোকটা। অল্প নয় বেশ ঘাবড়ে গেলো সে।
“নিজে ফোন করবেন নাকি আমি ফোন করবো পুলিশে?” উঠে দাঁড়ালো প্রয়াস।
কী বলবে বুঝতে পারলো না লোকটা। ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে রইলো প্রয়াসের দিকে। ব্যাপারটা এত জটিল হবে বুঝতেই পারেনি সে।
“কী করতে চাচ্ছেন আপনি?” বেশ বিপদে পড়ে গেলো সে।
“সত্যিটা জানতে চাচ্ছি।” দৃষ্টি কঠোর হয়ে এলো প্রয়াসের।
লোকটা অস্থির হয়ে উঠলো।
“আর কোনো সত্যি নেই। আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। তিয়াসাকে নিয়ে আসুন। আমরা চলে যাচ্ছি।”
প্রয়াস কিছুক্ষণ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। কোনো একটা নাম্বার বের করে ডায়াল করতেই হকচকিয়ে গেলো লোকটা।
বিস্ফোরিত চোখে, ঘাবড়ানো গলায় তড়িঘড়ি করে বলল, “কাকে ফোন করছেন আপনি?”
“পুলিশ। আপনার সুবিধার জন্য।”
ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠলো লোকটা। ঘাম ছুটে গেলো দরদরিয়ে।(লেখিকা লাকি নোভা)
“আম..আপনি..।” তোতালাতে লাগলো সে।
প্রয়াস ফোনে ‘হ্যালো’ বলার সাথে সাথে লোকটা একপ্রকার দৌড়েই বেরিয়ে গেলো রুমটা থেকে। অর্থাৎ পালিয়ে গেলো সে।
প্রয়াস সন্দিহান চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ফোনটা কান থেকে নামালো।
মুখোমুখি বসার সময় সময় ত্রয়ী একবারই চেয়েছিলো নীলের দিকে। তবে লোকটার নিষ্পলক ধারালো পুরুষালি চাহনির দিকে একমুহূর্তের বেশি তাকিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি তার। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো। আর তাকায় নি। কবুল বলার সময়ও তাকায়নি। সে তো আর নির্লজ্জ না!
কিন্তু লোকটা যে লাজ শরম ভুলে চেয়েই ছিলো সেটা বুঝতে সমস্যা হয়নি ত্রয়ীর।
অদ্ভুত লোক! শুধুশুধু তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করলো। ত্রয়ী ভেবে পায়না বিয়েটা এত তাড়াহুড়ো করে করার কী ছিলো! অনার্স ফাইনাল হতে এখনো চার মাস বাকি। সেই চার মাস পরেই তো আবার ঘটা করে বিয়ে। ততোদিন তো নিজের বাসাতেই থাকবে ত্রয়ী। বিয়েটা একবারে তখন করলেই তো হতো।(লেখিকা লাকি নোভা)
মিষ্টিমুখ করানোর জন্য নীলের পাশে বসাতেই কাঁচুমাচু করলো ত্রয়ী। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো ত্রয়ী।
নীল মৃদু হাসলো। প্ররোচিত নিচু স্বরে বলল, “বিয়ে নাকি করবা না?”
এহেন প্রশ্নে বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো ত্রয়ী। বড়োবড়ো চোখে একবার তাকালো নীলের দিকে।
নীল হাসির রেশ ধরে রেখে চোখ মারতেই চমকে উঠে হড়বড়িয়ে দৃষ্টি ফিরালো ত্রয়ী। নাক ঘেমে উঠলো ওর।
মিষ্টি খাওয়ানোর পর্ব মিটতেই নীল আলাদাভাবে কথা বলতে চাইলো ত্রয়ীর সাথে। শুনেই হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেলো ত্রয়ীর৷ এখন আবার কী কথা!
এই লোক মুখ খুললেই তো উদ্ভট কথা ছাড়া কিছুই বলে না।
দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে নীলের পিছু পিছু উপরে উঠে এলো ত্রয়ী। হাত কচলাকচলি করতে করতে গুটিগুটি পায়ে ঢুকলো রুমে।
ত্রয়ী ঢোকা মাত্রই দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে লক চেপে দিলো নীল।
(চলবে…)
(গল্প কপি সম্পূর্ণ নিষেধ)
(লেখিকা লাকি নোভা)