কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ২৭
: #ঈর্ষা ( ১ম অংশ )
লেখিকা : #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
বিল পে করে তিয়াসার হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো নিজের হাতে নিলো প্রয়াস। তারপর অন্যহাতে মুঠোবন্দি করলো তিয়াসার হাত।
তিয়াসা মিষ্টি হাসলো। চোখাচোখি হতেই প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে তিয়াসাকে নিয়ে শো-রুম থেকে বের হলো প্রয়াস। দ্বিতীয় তলার একপাশ থাকা বড়ো কসমেটিকস এন্ড কনফেকশনারিতে ঢুকলো।
সেখান থেকে তিয়াসার পছন্দমতো ফাস্টফুড এর মধ্যে দুটো বার্গার প্যাক করতে বলতে বলতেই ফোন এলো প্রয়াসের।
শপিং ব্যাগগুলো রিসিপশনের কাচের গ্লাস বিশিষ্ট টেবিলে রেখে ফোন বের করলো ও। অফিসিয়াল দরকারি কল হওয়ায় তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরো কিছু নিতে চাইলে নেও। আমি কথা বলে আসি।”
তিয়াসা মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ফোন রিসিভ করে একপাশে সরে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল প্রয়াস।
তিয়াসা ওর দিকে একপলক চেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সাজানো খাবারের তাক গুলোর দিকে। প্যাকেটজাত খাবার থেকে শুরু করে ফলফলাদি সবই আছে এখানে।
চোখ বুলাতে বুলাতে একদিকের সাজগোজের জিনিসগুলোর দিকে নজর আটকালো ওর।
সাজগোজে তার অগাধ ভালোলাগা থাকায় ঠোঁটের মিষ্টি হাসিটা প্রশস্ত হলো। সে এগিয়ে গেল দাড়াঁলো সেগুলোর সামনে।
সবচেয়ে উপরের তাকে থাকা আলতার প্যাকেটটার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালো। কিন্তু একদম নাগালে পেল না।
পায়ের পাতায় ভর রেখে চেষ্টা করেও লাভ হলো না। ধারকাছ অব্দি পৌঁছাতে পারলো না ও।
মুখটা করুণ হলো তিয়াসার। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো প্রয়াসের দিকে।
তাকে তখনো ফোনে ব্যস্ত দেখে ঠোঁট উলটালো। চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাতে গিয়েই একটা ছোট টুলের দিকে চোখ পড়লো।
তিয়াসা চোখে হাসলো৷ এগিয়ে গিয়ে সেটা নিয়ে এসে রাখলো দৈত্যসম কাঠের তাকটির সামনে।
সেটার উপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো।
তবুও নাগাল পেতে কিঞ্চিৎ সমস্যা হওয়ায় পায়ের পাতার উপর ভর রাখলো তিয়াসা।
একটা প্যাকেট হাতে আসতে না আসতেই রিসিভশন থেকে এক সেলসম্যান আহাজারি করে বলে উঠলো, “আরে আরে ম্যাডাম, পড়ে যাবেন তো!”
তিয়াসা চমকে গেল। ঠিকঠাক ভাবে বজায় রাখা ভারসাম্যও বিঘড়ে গেল লোকটার আচমকিত আহাজারিতে।
ভীত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর সময়ই পা পিছলে গেল ওর। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেল পেছন দিকে। আশঙ্কায় চোখমুখ কুচকে ফেললো ও।
তবে অদ্ভুতভাবেই পড়ার পরেও একটুকুও ব্যথার অনুভূতি হলো না বলে অবাক হলো তিয়াসা। কুঞ্চিত করা চোখ দুটো আস্তে ধীরে খুলে তাকালো ও। সাথে সাথে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পুরুষ মানুষের চেহারা চোখে পড়তেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। বিস্ময়কর বোকা চাহনিতে চেয়ে রইলো হা করে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বলিত হয়ে পড়লো ইভান নিজেও।
আশেপাশের কয়েকজনও চেয়ে রইলো ফ্যালফ্যালে অবাককর চাহনিতে।
তবে তাদের সবার মধ্যে শুধু একজোড়া চোখেই বিস্ময় দেখা গেল না। বরং মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ততে কপাল খুব বাজেভাবে কুচকে গেল তার।
তার একমাত্র বউটা কিনা অন্য কারো কোলে! এটাও সহ্য করার মতো!
দ্রুতপদে এগিয়ে সামনাসামনি দাঁড়ালো প্রয়াস। নেহাতই রাগ করাটা এখানে অযৌক্তিক বলে নিজেকে সামলালো সে।
কাটকাট স্বরে বলল, “ওকে নামিয়ে দিন।”
চকিতে তাকালো ওরা দুজনে।
প্রচন্ড রকমের অসন্তোষ জড়ানো একজোড়া চোখ আর কঠিন ভাবাপন্ন এক মুখের সাথে চোখাচোখি হলো ইভানের।
সেই শক্ত চোখের অধৈর্য চাহনি আর অধিকারবোধক কণ্ঠের কথায় মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কও আন্দাজে করে ফেললো বোধহয়। আর আঁচ করতে পেরেই বিনাবাক্যে অজ্ঞাত মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো সে।
প্রয়াস দেরি না করেই হাত বাড়ালো। একহাতে তিয়াসার হাতটা খপ করে মুঠোয় টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো সে।
আচমকা এমন টানাটানিতে তিয়াসা ভ্যাবাচেকা খেলো খানিক। চোখ পিটপিটিয়ে তাকালো প্রয়াসের দিকে। কিন্তু চোখাচোখি হলো না। কারণ সে তখন লঘু ভাঁজবিশিষ্ট কপালে চেয়ে আছে সামনের লোকটার দিকে। মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর।
গল্পের নাম : কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ২৭ : ঈর্ষা ( ২য় অংশ)
লেখিকা : Lucky Nova (কপি নিষেধ)
ইভান ভ্রু সংকুচিত করলো। অতঃপর আসন্ন ঝামেলা এড়াতে টানটান স্বরে প্রয়াসের উদ্দেশ্যে বলল, “I didn’t mean to! পড়ে যাচ্ছিলো সে, এজন্যই।”
প্রয়াস পলক ঝাপটালো। নির্বুদ্ধিতা বুঝে ধাতস্থ হলো।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্তপর্ণে ত্যাগ করা নিঃশ্বাসের সাথে অহেতুক অস্বস্তি উড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো ও।
একটা ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেও দিতে গিয়ে আটকে গেল যেন। ভদ্রতা খাতিরে ভরাট স্বরে শুধু বলল, “Yeah, It’s ok.”
ইভান ছোটো ছোটো চোখে তাকালো। বিদ্রুপাত্মক হাসিটা ঠোঁটের প্রান্ত অব্দি এসেও অদৃশ্য হয়ে গেল তার। কারণ কেমন ‘It’s ok’ সেটা তো সে ভালোই বুঝতে পেরেছে এটুকু সময়ে। তবে মুখে কিছু বললো না।
শুধু পালটা ভদ্রতার খাতিরে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসলো। যার প্রত্যুত্তরে প্রয়াস গম্ভীর থাকলেও তিয়াসা স্বভাবসুলভ ভাবের মিষ্টি হাসি হাসলো।
আর সেটা চোখে পড়তেই আরেক বিপত্তি বাধলো যেন। সাধারণ একটা হাসিও মারাত্মক পোড়ালো প্রয়াসকে। আগের চেয়েও অধিকগুন কপাল কুচকে গেল তার।
চাপা আক্রোশে মুঠোয় ধরে রাখা তিয়াসার হাতটা একটু চেপে ধরতেই হকচকালো ও। প্রয়াসের দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাতে না তাকাতেই ওকে সহ রিসিপশনের দিকে পা বাড়ালো সে।
তড়িঘড়ি করে তিয়াসাকেও পা মিলাতে হলো।
রিসিপশনে এসে প্রয়াসকে জলদি করে টাকাপয়সার পাওনা মিটিয়ে ফেলতে দেখে অবাক হলো তিয়াসা। চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিছন পানে।
আলতা তো নেওয়াই হলো না ওর! দিব্যি ওখানেই পড়ে আছে সেটা। নেবে না?
প্রয়াস ফেরত প্রাপ্ত টাকাগুলো মানিব্যাগে ঢুকিয়ে নিতে নিতে একপলক তাকালো তিয়াসার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই যেনো থমকালো।
চোখ ঘুরিয়ে তিয়াসার দৃষ্টি বরাবর চোখ রাখতেই হতভম্ব হয়ে গেল ও। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। তিয়াসা ঠিক সেদিকেই তাকিয়ে আছে যেদিকে কিছুক্ষণ আগের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। যদিও সে ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত।
কিন্তু তিয়াসা কেন তাকাচ্ছে তার দিকে? অদ্ভুত তো!
প্রয়াসের অযাচিত ভয়টা বাড়িয়ে দিতেই তিয়াসা বিনাবাক্যে সেদিকে যেতে উদ্যত হলো। গুরুতরভাবে চমকে গেল প্রয়াস।
খপ করে চেপে ধরলো তিয়াসার হাতটা।
তিয়াসা সচকিত ভঙ্গিতে তাকাতেই অতিশয় ক্ষুব্ধ মুখে চোখ রাঙালো সে।
তিয়াসা বোকা হয়ে পড়লো যেন। চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে।
প্রয়াসের ঈর্ষার দাবানলে পুড়ে যাওয়া পুরুষালি মনটা বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারলো না ও। বরং আরেকবার ফিরে তাকিয়ে পরে থাকা আলতাটার দিকে। ইশারায় বুঝানোর চেষ্টাও করতে চাইলো।
কিন্তু কে বুঝে কার কথা! প্রয়াসের তো এসব বোঝার সময় নেই। উলটো তিয়াসা ওদিকে তাকালো বলেই যেন আকাশসম দুশ্চিন্তায় পরে গেল ও।
মাত্র চারদিনও হয়নি বিয়ে হয়েছে! এরমধ্যেই যদি বউ তার অন্যকারো দিকে তাকায়! তাহলে কি সহ্য হয়!
এজন্যই ঝটপট শপিং ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে ওকে সহ বেরিয়ে গেল শপটা থেকে।
তিয়াসা হড়বড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে তাকালোও কয়েকবার।আলতা কেনা হলো না বলে মুখটা ভার হলো ওর।
একবারে গাড়ির মধ্যে এনে ওকে বসালো প্রয়াস। তারপর পাশের সিটে এসে বসে ভ্রুকুটি করে তাকালো তিয়াসার দিকে। নিতান্তই সংক্ষুব্ধ গলায় বলল, “বার বার ওর দিকে কি দেখছিলা তুমি? বেশি পছন্দ হয়েছে ওকে?”
আচমকিত ধমকানিতে ভেবলে গেল তিয়াসা।
উপরন্তু প্রয়াসের প্রশ্নের আগাগোড়া কিছুই বোধগম্য হলো না বলে বেকায়দা চাহনিতে চেয়ে রইলো প্রয়াসের দিকে।
প্রয়াস ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সামনে ঘুরলো। কপাল কুচকে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো। তারপর তিয়াসার দিকে ফিরে তাকালো গম্ভীর চোখে।
তিয়াসা চুপসানো মুখে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। যেনো সে কিছুই জানেনা!
প্রয়াস রাগ চেপে হালকা ঝুঁকে গেল ওর দিকে। চোখে চোখ রেখে শিথিল শাণিত কণ্ঠে বলতে লাগলো, “তুমি অন্যকারো দিকে তাকাবা না বুঝেছ? শুধু আমার দিকে তাকাবা।
তখন বার বার পিছন ফিরে কী দেখছিলা তুমি? ও কি আমার থেকে বেশি সুন্দর? হ্যাঁ?” ভ্রু কুচকে গেল প্রয়াসের। আরো বলল, “আর ভুলেও অন্যকারো দিকে তাকিয়ে হাসবা না। তখন হাসতে বলেছি আমি তোমাকে? বলি নি তো না? তো! হাসলা কেন ওর দিকে তাকিয়ে? এতো খুশি হয়েছ! আমি…”
কথা শেষ করতে পারলো না প্রয়াস। তার আগেই ওকে শতভাগ হতবাক করে দিয়ে ঝুপ করে জড়িয়ে ধরলো তিয়াসা। বিড়াল ছানার মতো মুখ গুজলো বুকের মাঝে।
প্রয়াস হতবুদ্ধি হয়ে পলক ঝাপটালো কয়েকবার। বিস্ময় কাটিয়ে আস্তেধীরে চোখ নামিয়ে তাকালো তিয়াসার মুখটার পানে।
একপলক দৃষ্টি বিনিময় হতেই মুখটা করুণ করে চোখ নামালো তিয়াসা। যেন তার চেয়ে নিষ্পাপ এই পৃথিবীতে আর কেউই নেই।
এই কাজ সে কিছুদিন হলো শিখেছে। কার কাছ থেকে কে জানে!
এই যেমন প্রতিদিন সকালে আর রাতে নিয়ম করে এক গ্লাস দুধ দেওয়া হয় তাকে। যা তার খুবই অপছন্দের জিনিস। এজন্যই না খেয়ে খুব কৌশলে লুকিয়ে লুকিয়ে ফেলে দেয় সে। তারপর ফাঁকা গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলে খেয়েছে।
একাজ করে প্রথমদিন ফাঁকি দিয়ে ফেললেও দ্বিতীয় দিন যখন হাতেনাতে ধরা পড়লো তখন বকা দেওয়ার আগেই এমন কাজ করেছিল সে।
বকা থেকে বাঁচার খুব সুনিপুণ প্রক্রিয়া এটা। যা মোটামুটি ভালোই কাজ করে। না চাইলেও রাগ উবে যায় প্রয়াসের। আর বকা দিতে পারে না সে।
এবারো বোধহয় তাই হলো। রাগ কমলো।
কিন্তু পুরোপুরি নয়।
ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর, মন্থর স্বরে বলল, “দোষ করে আবার ভুলানোর চেষ্টা করছো!”
তিয়াসা আগের মতোই গুটিয়ে রইলো। শুধু শার্টটা আরো আঁকড়ে ধরলো হাতের মুঠোয়।
মুখ দিয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ফেললো প্রয়াস। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে টানটান স্বরে বলল, “ওর দিকে তাকিয়ে ছিলা কেন তুমি?”
তিয়াসা ভ্রুকুটি করলো। চোখ তুলে তাকালো প্রশ্নাত্মক অবাক দৃষ্টিতে। সে কখন কার দিকে তাকিয়ে ছিল!
মোটামুটি সময় লাগলো বিষয়টার খোলাসা হতে। তিয়াসা কলম আর নোটপ্যাড বের করে প্রয়াসের সব প্রশ্নের উত্তর লিখে দিলো এক এক করে।
আর অবশেষে আসল বিষয়টা জানতে পারলো প্রয়াস। তারপর এতক্ষণে নিজের করা অহেতুক চিন্তাভাবনা আর ঈর্ষা বুঝতে পেরে বোকারাম সেজে গেল সে। পুরোদমে বোকারাম!
“সব এনেছো তো?” ইভানের আনা জিনিস গুলো ঘেটেঘুটে দেখতে দেখতে বলল জয়িতা।
ইভান চোখ তুলে তাকালো। জুতার ফিতা খুলতে খুলতে ছোট করে উত্তর দিলো, “হু”।
জয়িতা নেড়েচেড়ে দেখলো সবটা। তবে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটার কোনো হদিস না পেয়ে কপাল কুচকে ফেললো। যার জন্য অন্য বাহানায় ঠেলেঠুলে দোকানে পাঠানো হয়েছিল তাকে, সেটাই আনেনি সে!
জয়িতা বেজার মুখ করে ইভানের দিকে তাকালো। বলল, “উফফ! কই সব এনেছ? তোমাকে না বলেছিলাম গলার বা হাতের কিছু কিনতে?”
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে জয়িতার দিকে একপলক তাকালো ইভান। নিস্প্রভ স্বরে বলল, “আনিনি।”
চোখ কপালে উঠলো জয়িতার। চাপা স্বরে আহাজারি করে বলল, “আনোনি মানে! কতবার বললাম আমি!”
“সাতবার।” হিসেবি উত্তর দিতে দিতে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।
চোখদুটো আরো সংকুচিত হলো জয়িতার। একটু সময় গমগমে চোখে তাকিয়ে থেকে মুখ লটকিয়ে বলল, “অদ্ভুত তো তুমি ঠাকুরপো! বউকে বাসররাতে কোনো গিফটই দেও নি! বউভাতেও দিচ্ছ না! কী মনে করবে সে! আর এতো আনরোম্যান্টিক হলে হয়!”
ইভান হেয়ালিভাবে মুচকি হাসলো। এসব কথা গায়ে মাখলো বলে মনে হলো না। কারণ ওই গিফট-টিফট নিয়ে সো কল্ড রোম্যান্টিকতা করার মতো ছেলে সে নয়। এসব করা একদমই অসম্ভব তার দ্বারা।
আর ব্যাপারটাও এমন নয় যে সে ক্যান্ডেলের কাছে গিফট নিয়ে যাবে আর সেও খুশি খুশি নিয়ে নেবে!
উল্টো দেখা যাবে ‘Pervert pervert’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে দেবে!
ইভান নিজের মতো উপরে উঠে যেতে নিতেই জয়িতা পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। নবাবি ধাঁচে বলল, “গিফট না কিনে আনলে বউকে আজ আর পাচ্ছ না।”
ইভান ভ্রু উঁচালো। খুব একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। পাশ কাটিয়ে উঠে গেল উপরে।
(ক্যান্ডেলের Ex প্রয়াস নয়। কারা যেনো কমেন্টে বলতেছে ভুলভাল।)
গল্পের নাম : কিছু_জোড়াশালিকের_গল্প
পর্ব ২৭ : (৩য় অংশ)
লেখিকা : Lucky Nova(কপি নিষেধ)
ফ্রেশ হয়ে বের হলো ইভান। আলমারি থেকে শার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতেই ঘরে ঢুকলো ক্যান্ডেল।
চোখাচোখি হলো। সাথে সাথেই অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে চোখদুটো সরিয়ে নিলো ও। কিছুসময়ের জন্য স্বস্থানে থমকে দাঁড়িয়ে থেকে গটগট করে ভেতরে ঢুকলো। কোনোদিকে তাকালো না। সোজা বিছানার কাছে গেল।
খানিকক্ষণ আগে বের করে রাখা নিজের লেডিস টি-শার্ট আর পাজামা নিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে।
ইভান ওকে লক্ষ্য করে বাঁকালো হাসলো। বিছানায় শুয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল তারপর। সেখানেই বালিশের পাশে রাখা একটা সোনালী রাঙা ডায়েরীতে নজর আটকালো ওর।
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে হাতে উঠিয়ে নিলো সেটা।
ক্যান্ডেল ফ্রেশ হয়ে, চেঞ্জ করে বের হলো। তোয়ালে রেখে খুবই আড়নজরে ইভানকে একবার দেখে নিতে গিয়েই চমকালো।
ওর ব্যক্তিগত ডায়রীটা, যেটা জামাকাপড় বের করার সময় ভুলবসত বিছানায় রেখেছিল, সেটা ইভানের হাতে দেখে চোখ ছানাবড়া হলো ওর। হতবিহ্বল হয়ে পড়লো যেনো।
ঠিক তখনি ওর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুড়লো ইভান। ঠোঁটের কোণে তথাকথিত বিদ্রুপাত্মক সুক্ষ্মহাসি সমেত বলল, “Long distance relationship! এত এত ইচ্ছে ছিল তোমার?”
শিউরে উঠলো ক্যান্ডেল। এতদূর পড়াও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে!
ক্যান্ডেল দাঁত কিটকিট করলো। ঝটপট ইভানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্ষুদ্ধ গলায় বলল, “অন্যের ডায়রী পড়া ঠিক না, জানোনা?”
বলেই একহাতে ডায়রীটা টেনে নিতে চাইলেও ডায়রীটা হাতে পেল না ক্যান্ডেল। ইভান সরিয়ে নিলো সেটা।
অবাক হলো ক্যান্ডেল। বিহ্বলিত হয়ে বলল, “অদ্ভুত তো! দেও এদিকে!”
বলে আবার হাত বাড়ালো ও। এবারো ফলাফল শূন্য। রেগে গেল ক্যান্ডেল।
ইভান উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসির সাথে পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বলল, “ওয়েট! এত প্যানিক হওয়ার কী আছে?”
ইভানের ব্যবহারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো ক্যান্ডেল।
ওকে লজ্জায় ফেলে দিতেই বোধহয় এবার জোরে জোরেই ওর ইচ্ছাগুলো পড়তে লাগলো ইভান।
নাস্তানাবুদ হয়ে দাঁত কিড়মিড় করলো ক্যান্ডেল। ইভান যে এটা সহজভাবে দেবে না সেটা ভালোই বুঝলো ও। তাই সরাসরি একপ্রকার ধস্তাধস্তিই শুরু করে দিলো ও। আর ডায়রীটা নিতে কাড়াকাড়ি করতে গিয়েই ও ঝুঁকে পড়লো ইভানের উপর। তবে হাতে তো পেলই না বরং অজান্তেই খুব ঘনিষ্ঠে চলে এলো ওর।
এক পর্যায়ে সেটা খেয়াল হতে ক্যান্ডেলই আগেভাগে হকচকিয়ে গেল। চকিতে তাকালো ইভানের দিকে। ওর দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়লেও ইভানের দৃষ্টি স্থিরই রইলো।
আর সে স্থির দৃষ্টি হঠাৎ অসংযত হতেই চমকালো ক্যান্ডেল। বুকের কাছের শার্টটা খপ করে একহাতে চেপে ধরে বলে উঠলো, “Pervert!”
ইভান ভ্রু সুক্ষ্ণভাবে কুচকে ফেললো। ক্যান্ডেল ওর কাছ থেকে সরে যাওয়ার আগেই ধপ করে ওকে পাশে ফেলে ঝুঁকলো ওর দিকে। এক হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো দুইহাত।
আকস্মিক কাজে থতমত খেয়ে গেল ক্যান্ডেল। বড়ো বড়ো চোখ মেলে ইভানের দিকে তাকাতেই সে কটাক্ষ করলো, “তোমাকে আমি মানা করেছিলাম এই ওয়ার্ড ইউজ করতে।”
ক্যান্ডেল একটু ভ্যাবাচেকা খেলো হয়তো। বলতে বলতে অভ্যাস হওয়ায় মুখ ফসকে গেছে আবারও। যদিও এটা একদমই সঠিক শব্দ তার জন্য, তবুও তর্কে গেল না ক্যান্ডেল। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ সরিয়ে বলল, “আ-র বলবো না। ছাড়ো।”
“সরি বলো আগে।”
ইভানের কথায় মুহূর্তেই ভ্রু একদম বাঁকিয়ে ফেললো ক্যান্ডেল। চট করে ফিরে তাকালো ইভানের দিকে।সত্যি কথা বলায় সরি কেন বলবে ও! তাই মুখের উপর বলে দিলো, “জীবনেও না।”
ইভান চোখ সংকুচিত করলো, “বলবা না?”
“না।”
ইভান কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তারপর হঠাৎই ঠোঁটের বক্র হাসির সাথে বলল, “সিওর?”
ক্যান্ডেল অপ্রস্তুত হলো। এই হাসির অর্থ যে মোটেও সুবিধাজনক নয় তা খুব ভালোভাবেই বুঝলো ও।
“You will regret it now.” বলতে বলতে ওর টি-শার্টের ভেতরে হাত গলিয়ে দিলো ইভান।
চমকে উঠলো ক্যান্ডেল।
রাতের খাবার পরেই আলতার বোতল নিয়ে বসেছে তিয়াসা। প্রয়াস এনে দিয়েছে অফিস থেকে ফেরার পথে।
এটা পেয়ে এক আকাশ পরিমাণ খুশি ও। এজন্যই তো দিনদুনিয়া ভুলে এটা নিয়েই ব্যস্ত।
বোতল থেকে পরতে ঝামেলা হচ্ছিল বলে বাটিতে ঢেলেছে আলতা। তারপর অনেকক্ষণ বসে একটা কাঠির মাথায় তুলো প্যাচিয়েছে।
দুঃখের বিষয় যতবারই কাঠি ডুবাতে যায় তুলোটা বাটির মধ্যেই পড়ে যায়। এই তুলো বার বার হাত দিয়ে তুলে প্যাচাতেই হাত লাল হয়ে এসেছে তার।
প্রয়াস শাওয়ার নিয়ে বের হলো। মাথা মুছতে মুছতে একবার তিয়াসার দিকে তাকাতে না তাকাতেই থমকালো। চোখ আটকে গেল ওর পানে।
মেয়েটা এখনো বুঁদ হয়ে আছে আলতা নিয়ে। চোখমুখ কুচকে তুলোর প্যাচগোচে বিভোর। কপালে আর ঠোঁটের উপর নিচে ঘামের বিন্দু জ্বলজ্বল করছে ওর। শাড়ির আঁচল কাধের উপর তুলে রাখায় নারী শরীরের অপার্থিব সৌন্দর্যে চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে যেন!
প্রয়াস বেশ কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে রইলো। পলকহীন চোখে, অন্যরকম চাহনিতে। হৃদপ্রকোষ্ঠে তোলপাড় হতে লাগলো ওর। তীব্র আকাঙ্ক্ষা শোরগোল শুরু করলো ভেতর ভেতর।
শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিলো প্রয়াস। অতঃপর চোখ সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকটা। এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। হাতে ফোন তুলে নিলো।
অবাধ্য চোখদুটিকে স্থির রাখতে যথাসম্ভব নিজেকে ফোনে মগ্ন রাখতে চাইলো।
কিন্তু হলো না। ঘুরেফিরে তারা তিয়াসাকেই নজরবন্দি করতে চায়। এতো অবাধ্য!
অথচ তিয়াসার আজ তার প্রতি কোনো খেয়ালই নেই। এখন ওই ফালতু আলতা কিনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে ওর কাছে! এসে থেকে সে ওইটা নিয়েই ব্যস্ত। অন্যদিন তো অফিস থেকে আসলে তাকে গুরুত্ব দিতো!
মনে মনে খুব জ্বালতে লাগলো প্রয়াস৷ তবুও কিছু সময় চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো তিয়াসার জন্য।
কিন্তু লাভ হলো না।
তিয়াসা এলো না। এমনকি ঘুরেও তাকালো না।
মাত্র কয়েক মিনিটেই ধৈর্য হারালো প্রয়াস। এত সময় লাগে নাকি আলতা পরতে!
হঠাৎই ঘর অব্দি বয়ে আনা ‘আলতা’ নামক সতিনকে খুব অসহ্য লাগলো প্রয়াসের।
তাই সে নিজেই বিছানা ছেড়ে এসে হাঁটু ভেঙে বসলো তিয়াসার পাশে।
মগ্ন তিয়াসা একদমই টের পেল না দেখে অকপটেই হাত গলিয়ে দিলো ওর কোমড়ের ভাঁজে।
আচমকিত স্পর্শে তিয়াসা একটু চমকালো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো প্রয়াসের দিকে।
অধর ছড়িয়ে মুক্ত হাসি প্রকাশ করার আগেই প্রয়াস ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো, “ইদানীং আমার থেকে অন্যদিকেই তোমার বেশি মনোযোগ!”
তিয়াসা বিহ্বলিত হলো। চোখ পিটপিটালো বোকার মতো। কারণ সে তো বরাবরই মনোযোগ দেয়। তাই না?
প্রয়াস চোখ ফিরিয়ে আলতার বাটিতে তাকালো। অতঃপর বিনাবাক্যে নিজের আঙুল ডুবিয়ে দিলো তাতে। তারপর একে একে পরিয়ে দিলো তিয়াসার পায়ে, হাতে। গম্ভীর মুখে খুব মনোযোগের সাথেই কাজটা করলো সে।
তিয়াসা খুশি হয়ে গেল। এতসময়ে নিজের কাঙ্ক্ষিত কাজটা সম্পন্ন হওয়ায় একঝলক হেসে নিজের পায়ের দিকে তাকালো সে।
ফের ঘুরে প্রয়াসের দিকে তাকাতে না তাকাতেই হুট করে ওকে কোলে তুললো প্রয়াস। চকিতে গলা জড়িয়ে ধরলো তিয়াসা। চোখাচোখি হলো প্রয়াসের গভীর দৃষ্টির সাথে।
প্রয়াস ওকে বিছানায় এনে শোয়ালো। অনুভূতিপূর্ণ গম্ভীর চোখে তিয়াসার দিকে চেয়ে ঝুঁকলো ওর উপর।
তিয়াসা অবাক হয়ে পলক ঝাপটালো। হঠাৎই প্রয়াসের গলার দিকে নজর আটকাতেই ভ্রুকুটি করলো ও।
লাল হয়ে গেছে গলার পাশটায়। একটু আগে গলা জড়িয়ে ধরায় হাতের আলতা লেগে গেছে সেখানে।
তিয়াসা হাত বাড়ালো। গলায় লেগে থাকা আলতা হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুছতে চেষ্টা করলো।
কিন্তু ওঠার বদলে আরো এলোমেলো হয়ে পড়লো রঙটা। অকপটেই হেসে ফেললো তিয়াসা।
এই হাসিতেই যেন আরো একবার খুন হলো প্রয়াস। লোভ সামলাতে না পেরে চট করেই একটা চুমু খেয়ে বসলো ওই ঠোঁটদুটিতে।
তিয়াসা একটু চমকালো হয়তো। হতবিহ্বল হয়ে তাকালো প্রয়াসের দিকে।
প্রয়াস সুক্ষ্ণ হাসলো। একহাত তিয়াসার গালে গলিয়ে দিয়ে দীর্ঘ চুম্বনে লিপ্ত হলো।
তিয়াসা শিহরিত হলো। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতিতে শরীর, মন আলোড়িত হলো ওর।
অতিব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে এসে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে গেল। কুসুম ফুলের মতো লাল হয়ে উঠলো গালদুটো।
প্রয়াস ওর কানে কানে ফিসফিসালো, “তো তুমি লজ্জাও পাও!”
(চলবে…)