কনে বদল পর্ব ৫
একটা মেয়ে বাবার কথায় এমন বিয়ে রাজি হয়ে গেলে। আমি হলে কি পারতাম? মনে হয় পারতাম না। মেয়েরা যা পারে বা মেনে নেয় এতটা মানিয়ে নেয়ার ধর্য আল্লাহ পুরুষদের দেয় নাই!
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিনে রাস্তাঘাটে খুব একটা জ্যাম নাই বলা যায়। শ্যামলি থেকে নীরুদের ডেমরায় পৌঁছাতে সময় বেশি লাগল না।
এই টিনসেড বাড়িতে তিনবার আসা হলো। প্রথমবার একপ্রকার বাধ্য হয়ে। দ্বিতীয় বার সানন্দে, আজ তো বাধ্য হয়েই আসলাম।
বাড়িতে ঢুকে দেখি নীরুর বাবা আমজাদ হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। বিয়ের দিনের মতো মুখে হাসি আছে কিন্তু হাসিতে প্রান নাই! মনে হয় জোর করে হাসছেন। আমি সালাম দিলাম অনেকটা দায়সারাভাবে।
তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,”কেমন আছ বাবা?”
“জি ভালো। আপনি কেমন আছেন? “
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা। আস, ভিতরে আস।”
আমাদের কথা শুনে ভিতর থেকে ছুটে আসলেন নীরুর মা আনোয়ারা বেগম। উনাকে বিয়েরদিন দেখেছিলাম কিন্তু আলাপ করার সুযোগ হয়নি। সামনে এসে কী সুন্দর হাসি দিয়ে বললেন, “কেমন আছ বাবা?” কী মায়া জড়ানো মুখ!
একটা রুমে আমাকে নিয়ে গেল নীরু। আমার ছোটোবোন রুবিনাকে নীরুর মা সাথে করে নিয়ে গেলেন।
কোনারদিকে একটা ঘরে আমরা আসলাম। নীরুকে এ বাড়িতে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী লাগছে! রুমে এসে আমাকে বলল,” এখানে আপনার একটু কষ্ট হবে। আপনাদের বাড়ির মতো এত সুবিধা নেই।”
আমি কিছুই বললাম না। একটু হাসলাম। দেয়ালঘেরা টিনসেড বাড়ির টিনের নিচে বোর্ড দেয়া ভিতর ঢুকলে টিনের ঘর বুঝা যায় না। এটা মনে হয় নীরুর ঘর ছিল। একটা খাট, একটা কাঠের টেবিল দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার ছাড়া তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই। রুমের সাথে বাথরুম আছে।চারু যেহেতু হলে থাকে তাই ওর কোনো ঘর নেই! কখনো আসলে দুবোন এ ঘরেই থাকত।
জানালা খুলে দিলাম। জানালা দিয়ে ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে। ফুলের একটা সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে। কী ফুল এটা বুঝতে পারছি না। হাসনাহেনা না কি বেলি?
একটু পরে আনোয়ারা বেগম লেবুর শরবত একটা ট্রেতে নানা ধরনের পিঠা নিয়ে এলেন। টেবিলে রেখে বললেন, ” একটু পিঠা খাও বাবা।”
উনি কথা বলার সময় খুব সুন্দর করে হাসেন। দেখলেই কেমন মায়া মায়া লাগে! বাবা বলেন খুব আন্তরিকতা নিয়ে! উনি চলে গেলেন! সাথে সাথে নীরু আসল রুমে। এখানে এসে প্রথমে একটু বিরক্তি লাগছিল এখন কেমন লজ্জা লাগছে!
আমি খাটে বসে আছি। নীরু একটা চেয়ার টেনে সামনাসামনি বসল। দুজনে কোনো কথা বলছি না। নীরুই প্রথম কথা বলল, “মায়ের পিঠা খুব স্বাদ হয় খেয়ে দেখেন? আমরা দুবোন মায়ের কাছ থেকেই পিঠা বানানো শিখেছি।”
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। খাব না বলতেও খারাপ লাগছে! অনিচ্ছা থাকা শর্তেও একটা পিঠা তুলে নিলাম। “আপনিও নিন।”
নীরু হালকা করে একটু হাসল। “আপনি কী এক্ষুনি কফি খাবেন না পরে?”
নীরু কি ভেবেছে আমার কফির নেশা আছে! বাসর ঘরে কফির পট দেখে মনে হয় ওর এমন ধারনা জন্মেছে। আমি কফি খাই সেটা মাঝেসাঝে নেশা অবশ্যই না। ” কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আমাদের বাড়িতে এসে খুব খারাপ লাগছে বুঝি?”
এসব প্রশ্নের উত্তরে কখনো হ্যাঁ বলতে হয় না। এটা সাধারণ ভদ্রতা। “না,খারাপ লাগছে না।”
আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছে চারু থাকলে আমি কেমন আচরণ করতাম? এখন যেমন করছি তেমনই নাকি অন্যরকম। তখন মনে হয় একটা ভালোলাগা কাজ করত! যেটা এখন অনুপস্থিত!
নীরু বারবার চাচ্ছে গল্প করতে আমার কেন জানি ইচ্ছে করছে না। আমি আছি এমন একটা পরিস্থিতিতে যার সমাধান আমার জানা নেই। কাকে দোষীও করবো বুঝতে পারছি না!
রাতের খাবারের জন্য নীরুদের আলাদা একটা ঘর আছে। সেখানেই সবাই একসাথে খায়। রুবিনা আমি পাশাপাশি বসেছি। নীরু আর আনোয়ারা বেগম খাবার পরিবেশন করছেন। আমজাদ সাহেব আর কয়েকজন আত্মীয় স্বজন খেতে বসেছে। অনেক পদের খাবার টেবিলে রাখা হয়েছে!
নীরু রুবিনার প্লেটে খাবার দিচ্ছে। আমাকেও জিজ্ঞেস করছে,” কোনটা খাব?” বুঝা যাচ্ছে রুবিনার সাথে নীরুর বেশ খাতির হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। আমি অল্প খেয়ে উঠে গেলাম। আনোয়ারা বেগম বলছেন, “তুমি তো বাবা কিছুই খেলে না! রান্না ভালো হয়নি বুঝি?”
নীরু বলল, “মা ও একটু কমই খায়।”
কথাটা কেমন আমার মাথায় গেথে গেল! ও একটু কমই খায়।
রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা কী একই খাটে নীরুর সাথে ঘুমাতে হবে নাকি! এই রুমে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নাই? এ মেয়ে সবার সামনে আমাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা বুঝাচ্ছে! আমার ভালো লাগছে না!
নীরু রুমে এসে বলল, “আপনি শুয়ে পড়েন।”
“আর আপনি?”
“চিন্তা করবেন না।”
নীরু বাহিরে চলে গেল। তারমানে নীরু অন্যরুমে ঘুমাবো?
চোখে ঘুম আসছে না। উঠে বাহির হলাম। এখন রাত কত হয়েছে কে জানে। মোবাইলে দেখা যায়। মোবাইল রয়েছে খাটে। আবার যেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ চোখ পড়ল বাগানে বাপ-মেয়ে বসে আছে।
আমজাদ সাহেব নীরুকে বলছে, “আমার ওপর রাগ রাখিস না মা।”
“না,বাবা তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নাই।”
“রায়হান কি তোর ওপর খুব রাগ করেছে রে মা?”
“না, বাবা রায়হান খুবই ভালো ছেলে! ওর মতো এমন মানুষ হয় না। ও খুব কষ্ট পেয়েছে বাবা।”
“হ্যাঁ রে মা। কষ্ট পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সব ঠিক হয়ে যাবে তুই একটু ধর্য ধর মা।”
বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নীরু। রাতের নীরবতায় কথা এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে। আমি রুমে ফিরে আসলাম।
অনেক সময় পর নীরু রুমে আসল।
দরজা লাগিয়ে ফ্লোরে ঘুমাতে যাচ্ছে! আমি খাটে ঘুমাতে বললাম। কোনো আপত্তি না করে একপাশে শুয়ে পড়ল।
ঘুম থেকে উঠে দেখি নীরু নাই। আমার আগেই উঠে গেছে। শশুর বাড়িতে প্রথমদিন নাকি বাজার করতে হয়। এমন একটা নিয়ম প্রচলিত আছে। মামা ফোন দিয়ে বলল, “বড়ো দেখে একটা মাছ কিনবি।”
এলাকার বাজারঘাট কিছুই তো চিনি না! নীরুই ওর এক দূর সম্পর্কের ভাই কে সাথে পাঠাল। বাজার থেকে বড়ো দেখে কাতল মাছ কিনলাম। আমি মাছ ভালো চিনি না। নীরুর ভাই রুয়েলেই সব বাছাই করে নিলো।
সকালে নাস্তার পর আমজাদ সাহেব আমাকে ডাকলেন ওনাদের বাগানে। গিয়ে দেখি চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে পাশের চেয়ারে বসতে বললেন।
উনি নীরু ডেকে এখানে চা দিতে বললেন।
“তা কেমন লাগছে বাবা?”
“জি ভালো।” হালকা একপা হাসি দিলাম।
“বাবারে জানি তোমার সাথে অনেক বড়ো অন্যায় করেছি আমরা! ” ওনার ধরে আসা গলার কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছে!
“না,না, আপনি এ সব কী বলছেন!”
“জানি বাবা তোমার মতো এমন সোনার টুকরো ছেলে হয় না। চারুটা এমন কান্ড করবে ভাবতে পারেনি বাবা।” একটা গভীর শ্বাস নিলেন!
কী বলব বুঝতে পারছি না।
উনি আবার বলা শুরু করলেন, মেয়ে দুটি আমার বড়ো আদরের বাবা। চারু আর নীরু অন্যের কাছে আলাদা হতে পারে আমার কাছে দুইজনই সমান। নীরুকে আমিই অনেক অনাদর করেছি। মেয়েটা আমার মানসম্মানের কথা ভেবে এক কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে। বাবা তুমি ওরে অবহেলা করো না বাবা। ভুল যা করেছি আমি! ওর কোনো দোষ নেই বাবা।
বাবার মতো একজন মানুষের এমন আচরণে আমার খুব খারাপ লাগছে! “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। নীরুর কোনো অযত্ন হবে না।”
এ সময় দেখলাম ট্রে হাতে নীরু আসছে। নীরুকে দেখে দুইজনেই নীরব হয়ে গেলাম। ট্রেটা ছোটো টেবিলে রেখে। কাপ তুলে দিলো। “বাবা নেও তোমার চা।”
আরেকটা কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল আমি হাত থেকে কাপটা নিলাম।
“এখানে বস রে মা।” নীরু ওর বাবার পাশে বসল। “কী নিয় এত কথা হচ্ছে বাবা?”
“কিছু না মা। এমনি রায়হানের সাথে আলাপ করছিলাম।”
তেরছা চোখে নীরু আমার দিকে তাকাল। আমি দৃষ্টি মাটির দিকে সরিয়ে নিলাম।
আমজাদ সাহেব হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” তোমরা কথা বলো আমার একটা কাজ আছে।” বলেই হেঁটে চলে গেলেন।
নীরু আর আমি বসে আছি। নীরু বলল, “আমাদের বাড়িতে খুব বাজে লাগছে তা-ই না?”
“না, খারাপ লাগবে কেন! আপনাদের বাগানটা খুব সুন্দর! “
“শুধুই বাগানটা সুন্দর! “
আমি নীরুর দিকে তাকাচ্ছি না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,” বাগানের ফুল গাছগুলো আপনি লাগিয়েছেন? “
“হ্যাঁ,”
“রুবিনারাও বাগানের খুব শখ। আমাদের ছাদের গাছ তো সব ও-ই লাগিয়েছে।”
নীরুদের বাড়ি থেকে বাড়িতে এসেছি। মা চাচ্ছে বড়ো করে বউ ভাত করতে। আমি পরে কথা বলে আপাতত থামিয়ে রেখেছি। মা নীরুকে নিয়ে হানিমুনে যাওয়ার জন্য জোর করছেন। মামা টিকিট কেটে রেখেছেন। নীরুকে নিয়ে কক্সবাজার যেতে হবে। আমার ইচ্ছে করছে অফিসে যেতে। মনে হচ্ছে কক্সবাজার যেতেই হবে। আমি ছাড়া সবাই নীরুকে নিয়ে খুশি! ছোটোবোনটাও নীরুর ভক্ত হয়ে গেছে!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ