#গল্প
#একটি ডিভোর্স লেটার
পর্ব ৩
তিন্নির সাথে দেখা
তিন্নির ভীষণ রাগ হচ্ছে, তওসিফ বলেছিল ডিভোর্স লেটারটা নাকি পাঠিয়ে দিয়েছে আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই নাকি কাজটা হয়ে যাবে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তা না। এই তো আজ একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে ইচ্ছে না থাকলেও এই ব্যাপারটা নিয়েই বসতে হয়েছে। মেয়েটার নাম শুনে প্রথমে চমকে গেলেও পরে বুঝতে পেরেছে এটা সেই মায়মুনা না। প্রথমে ও দেখা করতে চায়নি, কিন্তু যখন বলল তাতে নাকি ঝামেলা বাড়বে, কেস করবে ওরা, তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখা করতে হচ্ছে। নাহ, তওসিফ সব ঠিক সামলে নিতে পারছে না।
দুপুরের পর শহরের এই গ্লাস ভিউ রেস্টুরেন্টটা খালিই থাকে। মায়মুনা তিন্নিকে এখানেই আসতে বলেছিল। মেয়েটা আসলেই সুন্দর, স্মার্ট, যেমনটা বলেছিল মুনা। মায়মুনা নিজের পরিচয় দিতেই তিন্নি সরাসরি ওর চোখে দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বলুন, আপনি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন?’
মায়মুনা ওর গলায় একটা রাগ টের পায়, এমনটা হবারই কথা। এমন পরিস্থিতিতে ও নিজেও তাই করত৷ একটু চুপ থেকে ও বলে, ‘আপনি কী তওসিফকে বিয়ে করছেন?’
তিন্নি ধারালো চোখে তাকায়, উষ্ণ গলায় বলে, ‘করতেই পারি, আর সেটা সব আইন মেনেই করব, কোনো সমস্যা তাতে?’
মায়মুনা মাথা নাড়ে, বলে, ‘না, কোনো সমস্যা নেই। আপনারা তো আইনের সব দাবি মিটিয়েই তারপর বিয়েটা করবেন, কিন্তু মুনা, জারিফের মনের দাবিটা কী মিটল তাতে? আপনার জন্য একটা সংসার ভেঙে যাচ্ছে, একটা ছোট্ট ছেলে বাবার স্নেহ হারাচ্ছে, মুনার মতো একটা মেয়ে নদীর পাড় ভাঙার মতো কষ্ট পাচ্ছে, সেটা বোঝেন?’
তিন্নি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘মায়মুনা, এটা জানেন তো নদীর এক পাড় ভাঙে আরেক পাড় গড়ে ওঠার জন্যই। এই যে আমি একটা সংসার পাচ্ছি, আমার যে একটা অবলম্বন হচ্ছে সেটা আপনার চোখে পড়ছে না? তওসিফের সাথে আমার বোঝাপড়াটা দারুণ, ও নিজেই এগিয়ে এসেছে এই সম্পর্কে। মুনার সাথে ওর কোনোভাবেই আর যায় না, আমিই ওর পাশে থাকার যোগ্য।’
মায়মুনা হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, তওসিফের হয়ত আজ মনে হচ্ছে মুনার জায়গায় আপনিই যোগ্য। কিন্তু একটা সময় যদি ওর আবার মনে হয় আপনি আর ওর যোগ্য না, নতুন কাউকে ওর ভালো লেগে গেল? তওসিফ কিন্তু একজনকে ছেড়ে মোহের বশে আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কে জানে, কাল ওর মোহ না আবার ভেঙে যায়, নতুন কারো মোহে পড়ে আপনাকেও ছেড়ে গেল। এই দিকটা নিশ্চয়ই ভেবে দেখেছেন।’
তিন্নি একটু থমকে যায়, এটা তিক্ত সত্য কথা। ভাবনাটা ওর মাথাতে যে আসেনি তা নয়। তওসিফ ওর রূপের মোহেই অন্ধ হয়ে বিয়ে করছে, আর তাতে ও দোষের কিছু দেখছে না। তওসিফের সাফল্যগুলো ও উপভোগ করতে চায়। জীবনের প্রথম দিকে অনেক কষ্ট করেছে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দারিদ্রতার কষাঘাতে তখন তওসিফের অফিসেই চাকরিটা হয়। তাও হতো না যদি না ইন্টারভিউ বোর্ডে তওসিফ সেদিন উপস্থিত না থাকত। যে পোস্টের জন্য ডাকা হয়েছিল তাতে কম্পিউটারের কিছু এপ্লিকেশন সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হয় যেটা ওর ছিল না। কিন্তু তওসিফ সেটা এড়িয়ে গিয়েছিল, সুযোগ দিয়েছিল। প্রথম দিনেই তওসিফের চোখে ও মুগ্ধতা দেখেছে। এরপর যতই দিন গিয়েছে তিন্নি ওর কঠোর পরিশ্রম দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে ও নিজের কাজটা বেশ ভালোই পারে। এতে তওসিফের মুগ্ধতা দিন দিন শুধু বেড়েছেই।
একদিন ও যখন বিয়ের কথা বলেছিল তখন অবাক হয়েছিল। প্রথমে ও নাই করেছিল, কিন্তু এরপর কয়েকটা মাস তওসিফ এতটাই মন খারাপ করে থাকত যে ও আর পারেনি। ওদের এই ঘনিষ্ঠতার খবর একটা সময় ছড়িয়ে যায়। ততদিনে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বিয়ে করবেই। তিন্নিই বলেছিল যে মুনা ওর মতো থাকুক, শুধু দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিটা দিয়ে দিক। কিন্তু মুনা নাকি রাজি হয়নি তাতে। সেক্ষেত্রে ডিভোর্স ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটা বোকা, একটা সুযোগ তো ওকে দিয়েছিল।
তিন্নি মাথা নেড়ে ভাবনাগুলো সরিয়ে দেয়, হ্যাঁ, মেয়েটা যেনো কী বলছিল? ওহ, তওসিফ যদি ওকেও ছেড়ে চলে যায়। তিন্নি শান্ত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আপনার এই যুক্তিটা ফেলে দেওয়া যায় না। যে একবার এমন করেছে সে আবার এমন করতেই পারে। কিন্তু আমিও তো এমন করতে পারি? এই কথাটা আমি ওর সাথে বলেছিলাম। জানেন তো ও কী বলেছে? আমার নিরাপত্তার জন্য ওর কোম্পানির একটা অংশ আমার নামে লিখে দেবে, আমাকে পার্টনার করে নেবে। আর এরপর ও যদি চলেও যায় তাতে আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি একটু আর্থিক নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম, সেটা তো পাচ্ছি।’
মায়মুনা একটা করুনার হাসি হেসে বলে, ‘তওসিফের কোম্পানির অংশীদারত্বের নিশ্চয়তা আপনি পেয়েছেন, মনের অংশীদারিত্বটুকু পাননি। আর ওদিকে মুনা মেয়েটা দেখি কিছুই পেল না। যাই হোক, আমি শুধু আপনাকে জীবনের আরেকটা দিক দেখাতে এসেছিলাম যেখানে মুনার মতো একটা সংসার আঁকড়ে থাকা মেয়ে আছে, একটা কচি মুখ, জারিফ আছে, যে কিনা এখনো বিশ্বাস করে এক বিকেলে তার বাবা ফিরে আসবে, তার সাথে খেলা করবে। এই ছবিটা অন্তত আরেকবার ভাবুন।’
তিন্নি একটু বিরক্ত হয়, এই মেয়েটা ওকে মায়ার জালে ফেলতে চাচ্ছে, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। তওসিফের সাথে ও এতটাই জড়িয়ে গেছে যে ওর আত্মীয় স্বজনরা, বন্ধুরা সবাই জেনে গেছে। এখন ও ইচ্ছে করলেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। এই সম্পর্কটা নিয়ে কথা উঠবেই। তাই তওসিফের কাছ থেকে এখন আর পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। এই মেয়েটাকে একটা কিছু বলে এখন ও বিদায় নেবে।
হালকা করে ঘাড় কাৎ করে বলে, ‘ধন্যবাদ মায়মুনা। আপনি আমাকে জীবনের একটা দিক দেখালেন, আমিও আমার দিকটা দেখালাম। জানেন তো, আমি তওসিফের সাথে এত মিশেছি যে আমি ইচ্ছে করলেই আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করতে পারব না। তাতে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমার সত্যিই আর পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। আমি অন্তত এটুকু করতে পারি যে মুনা ওর জায়গায় থাকুক, ডিভোর্সের দরকার নেই। শুধু ও দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিটা দিয়ে দিক।’
মায়মুনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তিন্নির দিকে, হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে। নাহ, এই মেয়েটা তো বিয়ে করেই ছাড়বে। আর মুনার তো দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেবার প্রশ্নই আসে না। তাহলে ও কী করবে এখন?
************
সেদিন বাসায় ফিরে এসে ফয়সালকে ও সব খুলে বলে। মুনার কথা, তিন্নির কথা। ফয়সাল সব শুনে বলে, ‘আসলে তুমি একটা অসম্ভবের পেছনে ছুটছ। কারো মন তো এমন জোর করে পরিবর্তন করে দিতে পারবে না। লোকটা একটা মোহে আছে, সেটা কাটতে একটা সময় লাগবে অথবা একটা কিছু হতে হবে যাতে মেয়েটা সম্পর্কে ওর ধারণাটা পরিবর্তন হয়। কিন্তু ভয় শুধু একটা জায়গাতেই, মোহ জিনিসটা খুব ভয়ংকর। মানুষ তখন সব বাস্তব জীবনের ভালো মন্দের পার্থক্যটুকু গুলিয়ে ফেলে। সহজ সত্যটাও চোখে ধরা পড়ে না।’
মায়মুনা ফয়সালের কথাগুলো শুনছিল, হঠাৎ ওর চোখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে, ‘তুমি একটা দারুণ কথা বলেছ। তিন্নির কোনো নেগেটিভ কিছু যদি পাওয়া যায় যেটা তওসিফ জানে না, সেটা জানতে পারলে নিশ্চয়ই ওর মোহটা কাটবে।’
ফয়সালের খুব মায়া হয়, মায়মুনাকে টেনে নিয়ে বলে, ‘তোমার মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? আচ্ছা, তুমি তোমার মতো করে চেষ্টা করো। আমার সাহায্য লাগলে বলো।’
মায়মুনা ফয়সালের বুকে মুখ রেখে শুধু এটাই ভাবে কী করে মুনাকে ওর জায়গাটুকু ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
পরদিন সকালে মায়মুনা ফোন করে মুনাকে আসতে বলে, সাথে জারিফকেও। ওকে একটু জানাতে তো হবে। মায়মুনা একটা চকলেট কেক বানায়, মুনার ছেলেটা আসলে দিতে হবে।
মুনা ঘন্টাখানেক পরেই চলে আসে, সাথে জারিফ। মেয়েটার মুখটা দেখেই ভেতরের দুঃখটা টের পাওয়া যায়। ওদের বসতে দিয়ে মায়মুনা কেক আর চা নিয়ে আসে। বাচ্চাটা খুব মজা করে খায়। মুনা আনমনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘মায়মুনা, ডিভোর্সের ব্যাপারটা বাসায় তো জানাতে হবে। আর দেরি না করাই ভালো।’
মায়মুনা বোঝে, এমন একটা খবর মেয়েটা যে এখনো বলেনি সেটাই আশ্চর্য। ও চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আর ক’টা দিন পর জানাও। আচ্ছা, তুমি আমাকে বলো তো, তোমাকে যে লোকটা ফোন দিয়ে তওসিফ আর তিন্নির সম্পর্কটা জানিয়েছিল, ওকে একটু দরকার। তুমি তো বলেছিলে ও তোমাদের অফিসের পুরনো পিয়ন বাবুল।’
মুনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কিন্তু ওকে কেন দরকার?’
মায়মুনা চিন্তিত গলায় বলে, ‘দেখি ওকে দিয়ে তিন্নির ব্যাপারে কিছু খোঁজ খবর নেওয়াব। নিশ্চয়ই ওই মেয়ের কোনো গোলমাল আছে। একবার যদি একটা নেগেটিভ কিছু পাওয়া যায় তাতে তওসিফের মোহটা কাটত।’
মুনা ম্লান হাসে, ‘এসব করে কী হবে মায়মুনা? ও আর আমাদের ভালোবাসে না। আচ্ছা, তুমি চাচ্ছ যখন আমি ওকে বলব যে তুমি ফোন দেবে।’
সেদিন আর কথা আগায় না তেমন। মায়মুনা ইচ্ছে করেই তিন্নির সাথে ওর দেখা হবার কথাটা বিস্তারিত বলে না। যদি বলে তিন্নি মেয়েটা কিছুতেই ওর পথ থেকে সরে আসবে না, তাতে মুনার কষ্টটা বাড়বে বই কমবে না।
এর কিছুদিন পর মায়মুনা সেই পিয়ন বাবুলের কাছ থেকে কাংখিত ফোনটা পায়। জানতে পারে তিন্নি যে এলাকায় থাকে বাবুল সেখানে গিয়েছিল, ওর পরিচিত একজন ওই এলাকাতেই থাকেন। বিয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার ছলে তার কাছ থেকে ও সব জেনে এসেছে। সবই ভালো, তবে মেয়েটার নাকি আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। মায়মুনার বুকটা চলকে ওঠে, এই তিন্নি মেয়েটার যে আগে বিয়ে হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই তওসিফকে বলেনি, লুকিয়েছে। যাক একটা কিছু তো পাওয়া গেল। কালই ও দেখা করবে এই ভাঙনের যে মূল কারিগর তওসিফের সাথে, সাথে এটাও মায়মুনা দেখতে চায় একটা মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হয়!
চলবে………
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর