#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১১
তুলি বড্ড ঘুম কাতুরে। বেশি রাত জাগা তুলির পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হয়নি। তুলি হচ্ছে ভোরের পাখি। পড়াশানা যা করার সব সকালেই করে। রাত মানেই তুলির কোলবালিশ নিয়ে আরাম করে ঘুম। গতকাল শুভ্রদের বাসা থেকে ফেরার পর আর আধা ঘণ্টাও চোখ খুলে রাখতে পারেনি তুলি। খাওয়া দাওয়া করে আসায় বাসায় এসেই দরজায় খিল তুলে ঘুমিয়ে পরেছে। সবে ঘুমিয়েছে ছ ঘণ্টা। আজও তেমন ঘুমাতে পারেনি। ছ ঘণ্টা পরপর টানা দুদিন ঘুমিয়ে তুলির তেমন আরাম মিলেনি। সাজেকের উদ্দেশ্যে ওদের বেরোনোর কথা সকাল ৭ টার মধ্যে। অথচ ৭:৩০ টায় তুলি এখনও ঘুম। ঘুমের মধ্যেই সকাল সকাল তুলির ফোনে কল এলো। ঘুমে কাতর তুলি বিরক্ত হয়ে মুখ কুচকালো। এদিক ফিরে শুতেই আবার কল এলো। বাধ্য হয়ে তুলি ফোন ধরলো। হ্যালো বললে, ওপাশ থেকে কারও ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হল। নিঃশ্বাসের শব্দ শুভ্রর ছিলো। ঘুমন্ত তুলির কণ্ঠ তার ভীষণ ভালো লেগে গেলো। শুভ্র তৃষ্ণার্থ বোধ করে নীরব থাকলো। তুলি আরেকবার কথা বলুক, শুভ্র শুনবে।
তুলি ওপাশে কাউকে কথা বলতে না দেখে তুলি ঘুমের মধ্যে বিরক্ত হল, বললো,
‘কথা বলেন না কেন? কাকে চাই।’
শুভ্র মৃদু হেসে নিজেকে সামলালো। গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘ঘুম ছাড়েনি এখনো, তুলি? না ছাড়লেও, উঠতে যে হচ্ছে। আমাদের আজকে সাজেক যাওয়ার কথা না?’
শুভ্রর কথা শুনে একলাফে উঠে বসল তুলি। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার নাম্বার দেখে নিলো। শুভ্র লাইনে দেখেই তুলি চটজলদি সালাম করে বসলো। শুভ্র সালামের উত্তর দিল। তুলি একবার ঘড়ি দেখলো। ইস, তাদের অলরেডি লেইট হয়ে গেছে। তুলি জিহ্বা কামড়ে বললো,
‘সরি। দেরি হয়ে গেছে না? দশ মিনিট টাইম দিন আমাকে। আমি ঝটপট রেডি হয়েই বেড়িয়ে যাচ্ছি। বাস স্টেশন কোনটা?’
শুভ্র বললো,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। বাস স্টেশন হলো শুভ্র বাস স্টেশন। চলে যাও দ্রুত।’
কৌতুক করে বললো শুভ্র। তুলি ভ্যাব্যাচেকা খেয়ে গেলো। কী বলল শুভ্র ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝলো না তুলি।বোকার মতো বলে বসলো,
‘অ্যাহ! শুভ্র বাস স্টেশন?’
শুভ্র হাসল এবার। বললো,
‘ইয়েস, ইউর পারসোনাল বাস স্টেশন। শুভ্র বাস স্টেশন আর দশ মিনিটের মধ্যে তোমার বাসার নিচে থাকবে। ঝটপট ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাও।আমি কিন্তু উপরে উঠব না। ওই টাইম এখন নাই আমাদের।’
তুলি বুঝলো এবার। হেসে ফেললো ও। বললো,
‘ওকে!’
তুলি ফোন কেটে একলাফে উঠে বসলো বিছানা থেকে। বিছানা ঝটপট গুছিয়ে মায়ের রুমে গেলো। ইয়াসমিন জোবায়েরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছেন।তুলি অন্ধকারে আলগোছে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে ডাকলো।
‘আম্মু? ও আম্মু? উঠো, আমি চলে যাচ্ছি।’
ইয়াসমিন কয়েকবার ডাকার পর চোখ খুললেন। তুলিকে মাথার পাশে এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে উঠে বসলেন। তুলি বললো,
‘শুভ্র স্যার এসেছেন। আমাকে নিচে নামতে বলেছেন।’
ঘুমের ঘোরে ইয়াসমিন ভুলেই বসলেন তুলির যাওয়ার কথা। বললেন,
‘তুই আবার কই যাবি?’
তুলি বিরক্ত হল। টি টেবিল থেকে ইয়াসমিনের চশমা নিয়ে চোখে পরিয়ে দিলো। তারপর বললো,
‘সাজেক যাচ্ছি। আমি রেডি হচ্ছি, তুমি এসো। দরজা লাগাবে।’
তুলি কথাটা বলেই দৌঁড় দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। একটুপর ইয়াসমিন ঘুমের ঘোরে হেলেদুলে একটা সেদ্ধ ডিম নুন দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে এসে তুলির ঘরে বিছানায় বসলেন। তুলি গোসল করে নতুম জামা পরে বের হলো। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে, এই ফাঁকে ইয়াসমিন ডিমটা মুখে তুলে তুলিকে খাইয়ে দিলেন। তুলি কোনরকম ডিমটা খেয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে চুলে কাটা বেঁধে নিলো। মুখে সাধারণ সাজ দিল। এসবের মধ্যেই শুভ্রর কল এলো,
‘হ্যালো, শেষ তোমার?’
তুলি জবাব দিলো,
‘হ্যাঁ, বের হবো?’
‘হ্যাঁ, নিচে আছি আমি।’
তুলি কল কেটে ব্যাগ নিয়ে বাইরে গেল। ইয়াসমিন দরজার সামনে তুলির শরীরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,
‘সাবধানে যাবি। আর শুভ্রর সঙ্গে কোনোপ্রকার বেয়াদবি করবি না। ওখানে গিয়ে তোর শাশুড়িকে কল দিয়ে জানাবি যে, তোরা পৌঁছেছিস। শুভ্রর খেয়াল রাখবি, শাশুড়িকে কল করে করে বারবার জিজ্ঞেস করবি, মায়া বাড়বে তার। খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক মতো করবি,ব্যাগে মেডিসিন আছে। অসুস্থ হলে মেডিসিন নিবি।বারবার করে বলে দিচ্ছি শুভ্রকে নারাজ করবি না। চিল্লাপল্লা, দৌঁড়ঝাপ করবি না একদম।
তুলি এতসব উপদেশ শুনে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো,
‘শুভ্র স্যারকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা আম্মু, কই আমাকে নিয়ে তো এত চিন্তা নেই?’
ইয়াসমিন হেসে বললেন,
‘যখন নিজের মেয়ে বিয়ে দিবি, তখন বুঝবি।’
তুলি পায়ে জুতো পরতে পরতে বললো,
‘সে অনেক দেরি। আচ্ছা আসি এখন। ভালো থাকবে। বাই!’
তুলি গাড়ির সামনে এলে শুভ্র ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে তুলির জন্যে দরজা খুলে দিল। শুভ্রর এই ছোট্ট কাজে তুলি খুশি হলো ভীষণ। মৃদু হেসে গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলছে। শুভ্র বললো,
‘আমরা এখন আরিফের বাসায় যাচ্ছি। ওখান থেকেই মেইনলি বড় গাড়ি করে যাবো সবাই।’
‘ঠিকাছে।’
সকালের তীব্র বাতাসে তুলির চুল উড়ছে। বারবার শুভ্রর মুখের উপর পরছে। তুলির চুল থেকে বেশ সুন্দর এক স্মেল আসছে। আজ বোধহয় শ্যাম্পু করেছে তুলি।শুভ্র চোখ বন্ধ করে নাক টেনে ঘ্রাণ নিলো কিছুসময়।আরও কিছুসময় নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু চুলের খোঁচার জন্যে ড্রাইভিং করা যাচ্ছে না। তাই শুভ্র নিজেকে সামলে বললো,
‘তুলি, তোমার চুল?’
তুলি জানালার থেকে মুখ সরিয়ে পাশে চাইল। শুভ্রর মুখে সব চুল উড়ছে দেখে তুলি অপ্রস্তুত হয়ে সব চুল ঠিক করে খোঁপা করতে করতে বললো,
‘সরি, আসলে আমার চুল অনেক সিল্কি। বাঁধলেও ঠিক জায়গায় থাকে না।’
শুভ্র ডান হাতে ড্রাইভ করতে করতে তুলির দিকে তাকাল। বললো,
‘আমার মন্দ লাগেনি। পার্সোনালি আমার সিল্কি চুল ভালো লাগে।’
তুলি লজ্জা পেয়ে হাসলো। শুভ্র ড্রাইভ করছে। তারা এখন মহাখালির দিকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে তুলির নজর শুভ্রর হাতের দিকে চলে গেলো।সাদা শার্টের হাতা ফোল্ড করে কনুই অব্দি তুলে রাখা। দৃষ্টিগত হচ্ছে শুভ্রর হাতের পুরুষালি লোম। এক হাতে ড্রাইভ করার কারণে হাতের পেশি ফুলে আছে। আলাদা রকমের সুন্দর লাগছে শুভ্রকে ড্রাইভিং অবস্থায়। শুভ্র লক্ষ্য করল তুলি শুভ্রর হাতের দিকে চেয়ে আছে। শুভ্র বারণ করলো না। শুধুমাত্র মৃদু হাসলো।
————
শুভ্র আর তুলি দাঁড়িয়ে আছে এই মুহূর্তে ডাক্তার আরিফের নিজস্ব মহাখালি ফ্ল্যাটের সামনে। ডাক্তার ফারহান এবং তার ওয়াইফও এখানেই। তুলিকে তারা আজ প্রথম দেখবেন। ছাত্রী হিসেবে নয়, শুভ্রর বউ হিসেবে। আরিফ এবং ফারহান দুজনেই শুভ্রর খুব ক্লোজ। কাবিনের দিন এদের বলা হয়েছিল আসার জন্যে, দুজনেই শহরের বাইরে থাকায় আসতে পারেনি। আজ তুলিকে দেখে তারা কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে ভাবলে শুভ্র নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। মেডিকেলের মোস্ট এরোগেন্ট, ইগোইস্টিক ডাক্তার উমায়ের হোসেন শুভ্র শেষ অব্দি তার ছাত্রীকে বিয়ে করল। পুরো ব্যাপারটাই তো লজ্জার। শুভ্র মনেমনে নিজেকে প্রস্তুত করছে কিভাবে তুলিকে তাদের সঙ্গে পরিভিয় করিয়ে দিবে।
শুভ্র কলিং বেল বাজানোর আগে তুলিকে বললো,
‘তুলি?’
তুলি শুভ্রর দিকে তাকাল। তারপর শুভ্র কিছু বলার আগেই তুলি বললো,
‘স্যাররা কী রিয়েকশন দিবেন ভাবলে ভয় লাগছে আমার। আমি এভাবে-‘
‘কিছু হবে না। ভয় পেও না। তুমি সুন্দর করে জাস্ট সালাম দিবে, বাকিটা আমি সামলে নিব।’
তুলি আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়লো। শুভ্র কলিং বেল বাজাল।তারপর আরও একবার তুলির দিকে চেয়ে বললো,
‘ডোন্ট ওরি, আমি আছি না?’
তুলি এবার হাসলো। শুভ্র যখন এভাবে ম্যাজিক ভয়েজে কথা বলে, তুলি হারিয়েই যায়। তখন মনে হয়, তুলি এই পৃথিবী, উহু মহাকাশ অব্দি জয় করতে জানে।
দরজা খুললো ডাক্তার আরিফ। তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার ফারহান। তারা শুভ্রকে দেখে ‘হাই-হ্যালো’ করবে তার আগেই দুজনেরই চোখ গেলো পাশে নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তুলির দিকে। তুলি হালকা আওয়াজে দুজনকেই সালাম করলো। শুভ্র এগিয়ে এসে দুজনকে ম্যানলি হাগ করল।তবে তুলিকে একবার দেখেই দুজনের কারোরই এই জড়িয়ে ধরার দিকে মন নেই। দুজনেই অবিশ্বাস্য চোখে তুলির দিকে চেয়ে আছে। শুভ্র সরে এসে তুলির কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে প্রথম কোন পুরুষের স্পর্শে তুলি চোখ তুলে চাইল। দুচোখে ভেসে উঠে শুভ্র নামক এক দায়িত্ববান সুপুরুষ! শুভ্র তুলিকে নিজের কাছে হালকা করে টেনে আনল। তারপর মৃদ্যু হেসে দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো,
‘ওকে, মিট ম্যাই ওয়াইফ। মিসেস প্রত্যাশা হোসেন তুলি।’
#চলবে
কেমন লাগলো জানাবেন