#মেঘে ঢাকা আকাশ
পর্ব ৩
#আমিনুর রহমান
মিলি আবার আমাকে ফোন দিলো। এবার সে কিছুটা নরম হলো আমার প্রতি। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি ভালো নেই। মিলি আমাকে জিগ্যেস করলো,”কি হয়েছে তোমার?”
আমি কিছু বললাম না। মিলি আবারও জিগ্যেস করলো আমি এড়িয়ে গেলাম। মিলি আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম।
“তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি সত্যি সত্যি মন থেকে উত্তর দিবে? যদি মন থেকে উত্তর দাও তাহলে আমি কথাটা বলবো না হলে বলবো না।”
তখন মিলি বলল,কি এমন জানতে চাও যে আমাকে এভাবে শপথ করিয়ে নিচ্ছো? খারাপ কিছু নাতো?”
তখন আমি হেসে বললাম।
“ধরে নাও তাই,খারাপ কিছুই জানতে চাইবো।”
আমার হাসি শুনে মিলি খুশি হতে পারলো না। কারণ আমার হাসি সুন্দর না। তাই হয়তো মিলি মন খারাপ করে বলল,
“তোমার হাসিটা আগের মতোই আছে। একটা মানুষ এতো বিশ্রী ভাবে হাসতে পারে তোমার হাসিটা না শুনলে বুঝতাম না।”
আমি আবারও আমার বিশ্রী হাসি হেসে বললাম।
“মিলি এই দুই বছরে কি তুমি কখনো আমাকে মনে করেছো? কিংবা আমার জন্য চোখের জল ফেলেছো?”
মিলি খুব সহজেই বলল।
“তোমাকে মনে করেছি ঠিকই তবে তোমার জন্য কখনো চোখে জল আনিনি।”
আমি অবাক হলাম না কারণ আমি জানতাম মিলির ওতোটা কাছের মানুষ আমি কখনো হতে পারিনি যে আমি তাঁর জীবন থেকে চলে আসাতে সে চোখের জল ফেলবে। কিছু মানুষকে ভালোবাসলেও তাদের কাছের মানুষ হওয়া যায় না,আমিও হয়তো তেমন একজন মানুষকে ভালোবসেছিলাম। আমি কিছুটা সময় নীরব থাকলাম তারপর বললাম।
“আমি চলে যাওয়ার পর কি তোমার জীবনে বিশেষ কেউ এসেছিলো? কিংবা কারো সাথে খুব ভালো থাকার মতো সম্পর্ক হয়েছিলো তোমার?”
আমার এমন কথা শুনে মিলি অনেকটা সারপ্রাইজড হলো,তবুও সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল।
“তুমি চলে যাওয়ার পর একটা ছেলে আমার জীবনে এসেছিলো। ঠিক তোমার মতো করে হাসতো,তোমার মতো করে কথা বলতো,তোমার মতো করে অভিমান করতো। ওর মাঝে যেনো আমি তোমাকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু একসময় ও আমার জীবন থেকে চলে গেলো। কি কারণে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সেটা আজও আমার কাছে অজানা।”
মিলির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অনেক বেশি খারাপ লাগলো আমার। বুকের বামপাশে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। মনে হলো বুকের ভিতর থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে কোনো কিছু বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজের এক সময়কার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এরকম কিছু কথা শুনলে কার না খারাপ লাগবে? আমরা ভাবি আমাদের ভালোবাসার মানুষটা হয়তো আমাদেরকে এখনো ভুলতে পারেনি,আমাদের জন্য এখনও মাঝরাতে একাকী নীরবে চোখের জল ফেলে। কিন্ত বাস্তবতা হলো আমাদের প্রিয় মানুষটা আমাদেরকে মনে রাখে না,আমাদের জন্য কাঁদে না। সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,অন্য কারো চোখের জল মুছে দেওয়াটাকেই জীবনের সার্থকতা মনে করে,আমাদেরকে মনে করার সময় তাঁর হয় না।
আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মিলিকে বললাম।
“ছেলেটা বুঝি আমার থেকেও অনেক সুন্দর ছিলো? তোমাকে অনেক ভালো রাখতো?”
তখন মিলি বলল।
“সেটা জানি না,তবে তাঁর সাথে যতদিন ছিলাম ততদিন তোমাকে খুব একটা মনে হয়নি আমার। মনে হয়নি বললে ভুল হবে। ও আমাকে তোমার কথা মনে করতে দেয়নি। এর জন্যই হয়তো বা তোমাকে ফোন না দিয়ে থাকতে পেরেছি।”
“তার মানে ওই ছেলেটা যদি তোমার জীবন থেকে চলে না যেতো তাহলে আমাকে কখনো ফোন দিতে না,আমার সাথে যোগাযোগ করতে না। তোমার বিচ্ছেদটাই আমার সাথে যোগাযোগ করতে তোমাকে বাঁধ্য করেছে?”
“হ্যাঁ,এমনটা ধরে নিতে পারো।”
“আচ্ছা বলো তো। আমাদের দুজনের মাঝে এখন তোমার কাকে বেশি মনে পড়ে?”
“তোমাকে মনে পড়ে,ও চলে যাওয়ার পর তোমাকে অনেক মনে হতো,তোমার সাথে অনেকবার যোগাযোগ করতে চেয়েও পারিনি। তোমার নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি।”
“শুনে ভালো লাগলো আমি চলে যাওয়ার পর তুমি অনেক ভালো ছিলে।”
“আমার সাথে ব্রেকআপের পর তোমার জীবনে কোনো মেয়ে আসেনি?”
“সেটা তো তুমি জানো। একারণেই তো আজ আমি নিঃস্ব। যাইহোক এসব কথা বলে নিজের কষ্টটাকে বাড়াতে চাই না। তোমাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করি। তোমার জীবনে দুইজন ছেলে এসেছিলে,না? আমি আর ওই ছেলেটা যাকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। তুমি কি বলতে পারবে,এই দুজন মানুষের মধ্যে তুমি কাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলে,মন থেকে নিজের করে চেয়েছিলে?”
“তোমাকে। আমার এখন ওই ছেলেটাকে মনে হয় না কিন্তু তোমাকে মনে হয়। ওই ছেলেটাকে আমি ভুলে গেলেও তোমাকে ভুলতে পারিনি।”
“মিলি,তোমার মন অনেক মিথ্যা বলে। মনকে বুঝাও এতো মিথ্যা বলা ভালো না। সত্য কি জানো? তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসোনি,যদি বাসতে তাহলে কখনোই তুমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারতে না,দ্বিতীয় কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আমাকে ভুলে যেতে না।”
“মানুষ কি একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় না? আমি একটা মেয়ে হয়ে বলছি,তুমি হয়তো জানো না কতো শত মেয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে না পেরেও পরিবারের কথা চিন্তা করে অন্য একজন মানুষের সাথে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তারা কি একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো সাথে চিরদিনের জন্য নিজেকে জড়ায়নি?” আমি না হয় রিলেশনে জড়িয়েছি কিন্তু তুমি কি করেছো? তোমার থেকে বয়সে বড় একটা মহিলার সাথে অবৈধ সেক্সুয়াল সম্পর্কে জড়িত হয়েছো। তাহলে বলো তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসতে? যার জন্য এরকম একটা অবৈধ ফিজিক্যাল রিলেশন করতে পেরেছো?”
“আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চাই না কিংবা বিশ্বাসও করাতে চাই না আমি নির্দোষ। যেখানে আমার বাবা মাকেই বিশ্বাস করাতে পারিনি সেখানে তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে কি লাভ? এমন না তো যে তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলে সারা দুনিয়ার কাছে আমি আবার আগের মতো বিশুদ্ধ হয়ে যাবো।”
মিলি ফোনটা রেখে দেয়। কেনো এমন করলো জানি না। পরে যখন ফোন দিলাম তখন তাঁর ফোন বন্ধ পেলাম।
এখন প্রায় রাত একটা বাজে। ফুটপাতের মানুষগুলো ঘুমিয়ে গিয়েছে। জনমানবশূন্য স্থানে যেমনটা নীরবতা বিরাজ করে ঠিক সেরকমই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এখন। দুই একটা কুকুর মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ শব্দ করে উঠছে। এছাড়া আর কোনো শব্দ আমার কানে আসছে না। আমার একটু ভয় হতে লাগলো। এতো রাতে একা কখনো এমন অবস্থায় পড়িনি,তাই ভয় হওয়টা অস্বাভাবিক কিছু না। হঠাৎ করেই দূরের একটা বেঞ্চিতে আমার চোখ আটকে গেলো। হলুদ শাড়ী পড়া একটা মেয়ে বসে বসে মোবাইল টিপছে। ভয়টা যেনো আরও তীব্রতর হতে লাগলো। এতো রাতে কোনো মেয়ে তো এখানে থাকার কথা না। তাহলে কি কোনো ভূত পেত্নী? পেত্নীরা কি হলুদ শাড়ী পড়ে? নাকি সাদা শাড়ী পড়ে? পেত্নী হলে নিশ্চয় হলুদ শাড়ি পড়তো না। আমি ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম পা মাটির সাথে লাগানো। তাঁর মানে ভূত হওয়ার কোনো চান্স নেই। ভয়টা কিছুটা হলেও কেটে গেলো।
আমাকে দেখে মেয়েটা দূরে সরে বসল। একটা মেয়ে এতো রাতে একটা ছেলেকে দেখে যতোটা ভয় পাওয়ার কথা মেয়েটা তাঁর বিন্দু পরিমাণ ভয়ও আমাকে দেখে পেলো না। বরং খুব সাহস নিয়ে জিগ্যেস করলো?
“কিছু বলবেন?” এতো রাতে এখানে কি করছেন?”
আমি মেয়েটার এমন প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম। আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম।
“আমি তো একটা ছেলে,তাই এতো রাতে একা ঘোরাটা খুব কমন বিষয়। কিন্তু আপনি একটা মেয়ে হয়ে এতো রাতে এখানে কি করছেন? তাও আবার গায়ে হলুদ শাড়ী।”
তখন মেয়েটা যা বলল তা শুনে কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। মেয়েটা বলল।
“আসলে আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছি। ওর আসার কথা বারোটার সময়। কিন্তু এক ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো এখনও আসলো না। তাই বাঁধ্য হয়ে বসে আছি। ও আসলেই ওর সাথে চলে যাবো।”
আমি তাঁর ব্যাপারে ক্লিয়ার হওয়ার জন্য বললাম।
“বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন?”
তখন মেয়েটা কপাল কুচকে বলল।
“এটাও বলতে হবে? কাপড়চোপড় দেখে বুঝতে পারছেন না? বাবা মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো তাই যাকে ভালোবাসি তাঁর সাথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের আসর থেকে চলে এসেছি।”
আমি জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।
“ওহ! আপনার বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করেন। দেখেন কোথায় আছে। তাহলেই তো হয়।”
তখন মেয়েটা আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল।
“ফোন খোলা থাকলে কি আর এভাবে বসে থাকতাম। সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আমার কথা বাদ দিন। আপনি এতো রাতে এখানে কেনো? আপনারও কি আমার মতো সেম কেইস নাকি? গার্লফ্রেন্ডকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবেন?”
আমি বললাম,
“না না,এমন কোন কিছু না।”
তখন মেয়েটা বলল।
“তাহলে কেমন কিছু? মানে কি জন্য এতো রাতে এখানে এভাবে তলপাতলপি নিয়ে ঘুরতেছেন?”
আমি যখন মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবো। ঠিক তখনই কিছু মানুষ এসে আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলে। একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক আমার কলার চেপে ধরে। মেয়েটাও প্রচন্ড ভয় পেতে লাগলো।
চলবে……………