#মেঘে ঢাকা আকাশ
পর্ব ৫
#আমিনুর রহমান
আমি কোলবালিশের সাথে বাসর না করে আমার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোলবালিশের সাথে বাসর করলে হয়তো গ্রিচিন বুকে আমার নাম লেখা হতো। চাঁদে যেমন প্রথম মানুষ হিসেবে পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্টং,তেমনি পৃথিবীর প্রথম কোনো মানুষ হিসেবে কোলবালিশের সাথে বাসর করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে পারতাম আমি। কিন্তু তখন আমার বেঁচে থাকা হত না। তাই বাঁচার জন্য ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটা লেখালাম না। তবে এটাও বা কম কিসে? বাসর না করে বউয়ের সাথে পালিয়ে যাচ্ছি। এমনটা কি কখনো হয়েছে আগে? বিয়ের রাতে জামাই বউ বাসর না করে পালিয়ে গিয়েছে? ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এটাও হয়তো ইতিহাসের পাতায় রুপার অক্ষরে লেখা হতে পারে।
স্পৃহার কথামতো আমি তাঁর পেছনে পেছনে যাচ্ছি। বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে,একটা কাকপক্ষীও জেগে নেই। তবুও খুব সাবধানে বাড়ির সীমানাটা পাড় করলাম আমরা। প্রায় এক ঘন্টার মতো হাঁটলাম দুজনে। এই সময়টাতে আমাদের দুজনের মাঝে বিশেষ কোন কথা হয়নি। নিরাপদ একটা জায়গায় এসে স্পৃহা প্রথম যে কথাটা বলল,সেটা হলো।
“আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন এখন। আপনি আমার জন্য বিপদে পড়েছিলেন,আবার আমিই আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলাম। হিসাব বরাবার।”
স্পৃহার কথাটা কেনো জানি আমার ভালো লাগলো না। এভাবে কেউ কাউকে চলে যেতে বলতে পারে? আর তাছাড়া সে তো আমার বিয়ে করা বউ,হোক না সেটা পরিস্থিতির স্বীকার। তবুও তো আমরা দুজন এখন স্বামী স্ত্রী। আমার তাঁর ওপর খুব করে জোর খাটাতে ইচ্ছে করলো কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধার কারণে সেটা পারলাম না। আমি খুব নরম হয়ে সরল গলায় বললাম।
“এত রাতে আপনি এই জনমানবশূন্য স্থানে ভয় পাবেন না? আর বলা তো যায় না কখন কে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের অবস্থা তো জানেনই। যেই হারে ধর্ষন হচ্ছে। তার ওপর আবার আপনি অনেক সুন্দরী। আপনার ওপর থেকে নজর সরানো অনেক টাফ। তাই বলছিলাম আরেকবার ভেবে দেখেন। সত্যিই কি আমি চলে যাবো নাকি আপনার সাথে থেকে যাবো?”
আমার কথা শুনে স্পৃহা আগের স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও ভয় পেলো। তাই আমাকে বলল।
“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে সকাল হলেই আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। মনে থাকে যেনো।”
আমি তাঁর কথা শুনে হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। শুধু মাথা নাড়ালাম।
সারারাত স্পৃহার সাথে কাটালাম আমি। অনেক কথা বললাম তাঁর সাথে,আমার অতীতের বেদনাদায়ক দিনগুলোর কথা তাকে শোনালাম তবে সে এক মুহূর্তের জন্যও আমার জন্য মন খারাপ করলো না। বরং সে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ সারারাত ফোনের পর ফোন দিয়েও তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। আজ দুইদিন হলো তাঁর ফোন বন্ধ। সকালে যখন তাকে আমি বললাম,”তাহলে কি এখন আমি চলে যাব? যেহেতু এখন আর আমাকে আপনার প্রয়োজন নেই। আমি থেকেই বা কি করব?”
তখন সে রাগি কণ্ঠে বলল।
“চলে যাবেন মানে? আমি কি চলে যেতে বলেছি আপনাকে? আপনি আমার সাথে ততদিন থাকবেন যতদিন না আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে পাচ্ছি।”
তখন আমিও রাগী চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম।
“মানেটা কি? সবকিছু আপনার ইচ্ছেতেই হবে নাকি? আপনি নিজে বাঁচার জন্য আমাকে বিয়ে করলেন অথচ আপনি চাইলে আপনার বাবার পছন্দ করা ছেলেটাকে বিয়ে করতে পারতেন তাহলে আর আমাকে এত ঝামেলায় পড়তে হত না। এখন আবার বলছেন আপনার কথা শুনতে হবে। মগেরমুলুক নাকি?”
তখন স্পৃহা বলল।
“হ্যাঁ,আমার কথায় শুনতে হবে। কারণ আমি আপনার বিয়ে করা বউ। আর বউয়ের কথা জামাই শুনবে না তো কে শুনবে? বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করব,আপনাকে ডিভোর্স দিব তারপর আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যাবেন আমি কিছু বলব না। তবে যতদিন আপনি আমার বিয়ে করা স্বামী ততদিন আমার সাথে থেকে আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে হবে।”
এই সময়েও যে মেয়েটা মজা করবে আমি কখনো ভাবিনি। অবশ্য প্রথমাবার কথা বলেই বুঝেছিলাম মেয়েটা সিরিয়াস মুডে মজা করতে ভালোবাসে। তাই হয়তো এমন করছে। আমিও মজা করে বললাম।
“ওলে ওলে আমার সোনা বউটারে। এতই যদি জামাই জামাই বলেন তাহলে নিজে বাসর না করে কোলবালিশ এগিয়ে দিয়েছিলেন কেন?”
তখন স্পৃহা হেসে বলল।
“আমার বয়ফ্রেন্ড আছে তাই। বয়ফ্রেন্ড থাকতে জামাইয়ের সাথে বাসর করাটা কেমন দেখায় না? খুব খারাপ দেখায় এটা। তাই তো আপনাকে কোলবালিশ এগিয়ে দিয়েছিলাম। আপনি করেই দেখতে পারতেন। বিয়ে করার আগ পর্যন্ত তো ছেলেরা কোলবালিশের সাথেই বাসর করে। বউ পেয়ে নিজের প্রথম বউ কোলবালিশকে একমাত্র ছেলেরাই ভুলে যেতে পারে। আপনিও তেমন,একজন স্বার্থপর জামাই,যে বউ পেয়ে কোলবালিশকে ভুলে যায়।”
স্পৃহা প্রথম এভাবে হাসলো আমার সামনে। তাঁর হাসিটা জানান দিয়ে যাচ্ছে এর থেকে সুন্দর হাসি কারো হতে পারে না। আমি তাঁর হাসিতে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। তবে হেসে হেসে যে মেয়েটা এতো মজা করে কথা বলতে পারে আমার জানা ছিল না। আমিও মজার ছলে বললাম।
“আর জামাই থাকতে বুঝি বয়ফ্রেন্ডের কাছে চলে যাওয়াটা খুব ভালো দেখায়? আপনি আমাকে বলেন তো জামাই আগে না বয়ফ্রেন্ড আগে?”
তখন স্পৃহা বলল।
“অবশ্যই বয়ফ্রেন্ড আগে। সেজন্যই তো জামাই রেখে বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছি।”
তখন আমি বললাম।
“এটা আপনার ভুল ধারণা। জামাইকে বেশি ভালোবাসা উচিত,বয়ফ্রেন্ড তো আর আপন কেউ না। যেকোন সময় খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতে পারে। কিন্তু জামাই কখনো চাইলেও খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতে পারবে না।”
তখন সে বলল।
“ওইভাবে আগে না।”
আমি বললাম।
“তাহলে কিভাবে?”
তখন সে বলল।
“ডিম থেকে যেমন মুরগি হয় ঠিক তেমনি বয়ফ্রেন্ড থেকে জামাই হয়। তাই জামাইয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড। এই সিম্পল জিনিসটা বুঝতে পারেন না আবার নিজেকে জামাই দাবি করেন।”
আমি মেয়েটার কথা শুনে স্যামসাং ফোনের মতো হ্যাং হয়ে গেলাম। কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন সকাল আটটা বাঁজে।
অনেকটা সময় পর দুজনের নীরবতা ভেঙে স্পৃহা বলল।
“ওর ফোন তো এখনো অফ। কি করি বলেন তো? অনেক ক্ষুধাও লাগছে।”
ওর কথা শুনে মনে হলো আমারও অনেক ক্ষুধা লাগছে। সেই যে রাতে বাসায় খেয়েছিলাম। তাও তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারিনি। তারপর বিয়ে বাড়িতেও খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ওইরকম বিয়েতে বর কি পেট ভরে খেতে পারে? পারে না। আমিও পারিনি। তাই আমি দুজনের ক্ষুধা নিবারণের জন্য বললাম।
“চলেন সামনে কোথাও খেয়ে নেই। আমারও প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”
ফুটপাতের একটা হোটেলে আমরা দুজন হালকা নাস্তা করলাম। কারণ হোটেল গুলোতে এখনও ভাত হয়ে সারেনি। নাস্তা করতে করতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। হোটেলে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বাহিরে বের হওয়ার পর বুঝলাম ঝাপসা গরম চালিয়েছে। এই ঝাপসা গরমে বেশি সময় রোদের মধ্যে থাকলে ডিম সিদ্ধ হতে হবে৷ কিন্তু এছাড়া কিছু করারও নেই। কারণ স্পৃহা এখনো তাঁর বয়ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমিও কাউকে ফোন দেইনি। কারণ আমার কথা সবাই জেনে গিয়েছিল। এখন যদি আবার একটা মেয়েকে আমার সাথে দেখে তাহলে আমাকে খারাপ না ভাবার কোনো কারণ থাকবে না। তাই কাউকে ফোন করে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করতে চাইনি।
দশটার দিকে স্পৃহা আর সহ্য করতে পারল না। মনে হলো ঢলতে ঢলতে মাটিতে পড়ে যাবে। বেশি সুন্দরী মেয়েদের এটাই সমস্যা। তারা রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। স্পৃহা শুধু আমাকে বলল।
“আমি আর দশমিনিট এখানে থাকলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। প্লিজ বিশ্রামের জন্য কিছু একটা করুন।”
আমি কি করব কিছুই বুঝে আসছিল না। হঠাৎ করেই সামনে একটা আবাসিক হোটেল চোখে পড়ল। আমি স্পৃহাকে নিয়ে হোটেলে ২৪ ঘন্টার জন্য একটা রুম নিলাম। হোটেলের ম্যানেজার আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল।
“কোনো কিছু লাগলে বলবেন স্যার। মেয়েটা জোস স্যার।”
আমার ইচ্ছে করল ম্যানেজারকে কষে দুইটা চড় দিতে। কিন্তু পারলাম না কারণ এখানে যারা আসে তারা মেয়ে নিয়েই আসে। কেউ বা নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আসে,কেউ বা টাকা দিয়ে মেয়ে ভাড়া করে নিয়ে আসে। তাই ম্যানেজারকে কিছু বলতে পারলাম না। স্পৃহা আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে,ম্যানেজারকে তো মনে হয় পারলে মেরেই ফেলবে। আমি রুমে নিয়ে তাকে বুঝালাম।
“হোটেল যেমনই হোক না কেন আমরা সেফ থাকলেই তো হলো৷ আর আপনার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই সামনে যেটা পড়েছে সেটাতেই ঢুকে পড়েছি।”
আমার কথাগুলো পজিটিভ ভাবেই নিলো স্পৃহা। সে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলো আর আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম একটু বিশ্রামের আশায়। কারণ দুইরাত ধরে এক সেকেন্ডও ঘুমানোর সুযোগ হয়নি। চোখে প্রচন্ড ঘুম,তাই চোখ বুজে ঘুমের ঘরে তলিয়ে গেলাম। ঠিক তখনই ফোনটা ভো ভো শব্দ করে বেজে উঠল। চেয়ে দেখলাম মিলি ফোন করেছে। না চাইতেও ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে মিলি বলল।
“তোমার কি হয়েছে বল তো? এতবার ফোন দেওয়ার পরেও তুমি ফোন ধরো না। তোমার সাথে আমি দেখা করতে চাই। আমি তোমাকে এখন অনেক মিস করি। মনে হয় তোমাকে আমার এখন প্রয়োজন। একবার দেখা করে সব কিছু আগের মতো করতে চাই আমি।”
আমি মিলিকে কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই আমার চোখ আটকে গেলো আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে কোনো অপ্সরী ভুল করে জমিনে নেমে এসেছে,এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্পৃহা সুন্দর জানতাম তবে এতোটা সুন্দর হবে ভাবতে পারিনি। বিয়ের সাজে মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগ হয়নি কখনো। কিন্তু আজ যখন বিয়ের সমস্ত সাজ ধুয়ে মুছে নতুন ভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তখন আমি বুঝতে পারলাম তাঁর সৌন্দর্যের গভীরতা। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন। ভেজা চুলে মেয়েটাকে অনেক বেশি হট মনে হচ্ছে।
মিলি ওইদিক থেকে সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কানে মিলির আওয়াজ খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। আমার চোখ গুরুত্ব দিচ্ছে স্পৃহার হট দৃশ্যটাকে।
মিলি যখন বারবার বলছিল।
“কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন? আমি কি বলেছি শুনতে পাওনি?”
তখন আমার কি হলো জানি না,নিজের অজান্তেই মিলিকে বলে ফেললাম।
“আমি বিয়ে করেছি,আমার বউ আছে। এখন রাখি,বাই।”
আমার কথা শুনে মনে হলো স্পৃহা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আবার মনে হলো ধুর! আমিই তাঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি,আবার মনে হলো,না সেই আমার দিকে আসছে। আমি তাঁর দিকে যাচ্ছি নাকি সে আমার দিকে আসছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
চলবে………..