#নীল চিরকুট
#লেখনীতে-নৌশিন আহমেদ রোদেলা
২৮.
ঘড়িতে কয়টা বাজে সেদিকে খেয়াল নেই নম্রতার। কফি হাতে,ঘরময় পায়চারী করে আবোল তাবোল কথার ঝুড়ি খুলেছে সে। নীরা বিছানায় বসে ঘুমে ঢুলছে। নম্রতা উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘ও যে হঠাৎ এমন কিছু বলবে বা বলতে পারে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। হুট করেই বলে ফেলল, আপনি হয়ত একটু বেশিই সুন্দর,তাই না ? আমি জাস্ট বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম। ওই সময় নাদিম আর অন্তু না ফিরলে আমার যে কি হতো! ভাবতে পারছিস ?’
নীরা হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ভাবতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না।’
নম্রতা বিছানায় এসে বসল। অস্থির হয়ে বলল,
‘তাহলে আমার কি অবস্থা হয়েছিল একবার ভাব ? একদম আনএক্সপেক্টেট কিছু!’
নীরা হাসছে। আরফান নামক ব্যক্তিটাকে তার বেশ লাগছে। নীরা বালিশে ঠেস দিয়ে আয়েশ করে বসল। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘আগে আগে দেখো হতা হ্যা কিয়া!’
কথাটা বলে চোখ টিপল নীরা। নম্রতা হাসতেই আবারও বলল,
‘আমরা হয়ত লোকটিকে ঠিক চিনতে পারিনি নমু। লোকটা সবার সামনে যেমনটা শো করে আসলে তেমনটা নয়। ভিন্ন রকম।’
নম্রতা উত্তর দিল না। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গালে হাত দিয়ে আরফানকে ভাবতে লাগল। ভিন্ন রকম? সত্যিই লোকটি একটু অন্যরকম।মাঝে মাঝে গম্ভীর তো মাঝে মাঝে ভীষণ চঞ্চল।চোখ ভর্তি ছেলেমানুষি আর কৌতূহল।
বর্ষার শেষ আর শরৎের শুরু। কাল রাতে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় সকালটা ঝকঝকে, পরিষ্কার। গাছের পাতায় ল্যাপ্টে থাকা জল আর মিষ্টি সোনালী রোদে ভরা চারপাশ। নিশ্চুপ সকালে অচেনা পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দক্ষিণের জানালাটা খোলা। বৃষ্টির জলে ভিজে গিয়েছে ধবধবে সাদা পর্দা। বিশাল আম গাছের পাতার ফাঁক গেলে এক মুঠো রোদ এসে দুষ্টুমি জুড়েছে আরফানের বোজে রাখা চোখে আর গলায়। সকালের নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে নির্জন ঘর, বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত যুবক। হঠাৎ চুড়ির টুনটান আর বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধে জেগে উঠল আরফানের মস্তিষ্ক। ঘুমটা ছুটে গিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাল। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করে ডাকল,
‘ শ্যামলতা?’
প্রায় সাথে সাথেই মুখের ওপর এসে পড়ল এক মুঠো ভেজা বেলীফুলের পাঁপড়ি। আরফান তৎক্ষনাৎ চোখ বোজল। পুরু ভ্রু জোড়া খানিক কুঁচকাল। এতোক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আরফান এবার ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রমনী। পরনে তার সাদা ধবধবে শাড়ি। হাত ভর্তি শুভ্র কাঁচের চুড়ি। চঞ্চল চোখদুটোতে মায়া মেশানো কাজল। সারা শরীরে তাজা বেলীফুলের অলংকার। স্নিগ্ধ মুখটি সকালের নরম আলোয় ভেজা বেলী ফুলের মতোই কোমল, সুন্দর। আরফান ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়েই উঠে বসল। সামনে দাঁড়ানো যুবতী আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কেমন দেখাচ্ছে আমায়?’
আরফান হেসে বলল,
‘ বেলীফুলের থেকেও সুন্দর। কিন্তু হঠাৎ এতো সাজগোজ?’
মেয়েটি হাসল। তার হাসিতে প্রগাঢ় চঞ্চলতার ছাপ।
‘ শরৎে আকাশ ভর্তি সাদা মেঘের পদচারণ। তুমি কি জানো? শরৎের প্রেমিকা হলো মেঘ। তাই আমি মেঘ সেজে শরৎকে প্রেম নিবেদন করছি। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাকে মেঘের মতো লাগছে না?’
কথাটা বলে চরকির মতো ঘুরে নিজেকে প্রদশর্ন করার সুযোগ করে দিল সে। আরফান হেসে ফেলল। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চার-পাঁচ মাস যাবৎ ছাঁদের ঘরটিকেই আপন করে নিয়েছে আরফান। বিশাল ছাঁদের এক কোণায় ছোট্ট তার ঘর। সামনে এক টুকরো ছিমছাম, সুন্দর বারান্দা। বারান্দার দরজায় দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সারিবদ্ধ বেলীফুলের গাছ। আগে একটি ছিল। এখন অসংখ্য। সবই আরফানের লাগানো। আরফান বুক ভরে শ্বাস নিল। বেলীফুলের সুগন্ধটা নাকে যেতেই চোখে-মুখে খেলে গেল নিদারুণ চঞ্চলতা। আজ অনেকদিন পর বেলীফুলের সুবাস পাচ্ছে সে। তার চারপাশটা সুবাসে সুবাসে ভরে যাচ্ছে। আরফান চোখ ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি প্রসন্ন হাসি নিয়ে দোলনায় দোল খাচ্ছে। শাড়ির আঁচল ল্যাপ্টে আছে মাটিতে। তাকে দেখে সত্যিই মেঘের মতো লাগছে। আকাশ থেকে নেমে আসা এক টুকরো শুভ্র, সুন্দর মেঘ। আরফান বেতের সোফায় বসতে বসতে বলল,
‘ বর্ষার ফুল দিয়ে শরৎের মেঘ সাজাটা কি ঠিক হলো? এটা অন্যায় হয়ে গেল না? তোমার উচিত ছিল শরৎের কোনো ফুল দিয়ে মেঘ সাজা। বর্ষার ফুল দিয়ে মেঘ সাজাটা উচিত কাজ হয়নি। শরৎ রাগ করতে পারে।’
মেয়েটি সরু চোখে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বর্ষার ফুল শরৎ কালে ফুটলে আমার কী দোষ? বর্ষার ফুলেরা যদি আমায় রাণী হিসেবে ঘোষণা করে তাতেই বা আমার কী দোষ?’
আরফান হাসল। বেলীফুলের গাছগুলোতে থোকা থোকা ফুলের বাহার। আরফানের বুকের গহীনে বিনা অনুমতিতেই বেজে উঠল একটা নাম, ‘শ্যামলতা।’
‘ তুমি কি বিয়ে করবে না?’
‘ তুমি সবসময়ই একই প্রশ্ন কেন করো?’
হাসিমুখে প্রশ্ন করল আরফান। এই মেয়েটিকে সে পৃথিবী সমান ভালোবাসে। কিছুতেই রাগ করতে পারে না। মেয়েটি কৃত্রিম মন খারাপ নিয়ে বলল,
‘ তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিও যে বিয়ে করতে পারছি না। বুড়ি বয়সে বিয়ে করলে বুড়ো বুড়ো বর জুটবে। আমি বুড়ো বর বিয়ে করতে রাজি নই।’
‘ তাহলে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে। আমার বিয়ে নিয়ে কেন পড়েছ?’
মেয়েটি সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ কি বলছ? তুমি জানো না? মা আর আমি কঠিন একটা প্রতিজ্ঞা করেছি। তুমি আগে বিয়ে না করলে মা আমায় বিয়ে দিবে না আর আমিও বিয়ে করব না। দেখলে না? বড় ভাইয়ার সাথে কেমন ইন্সিডেন্ট ঘটে গেল। সব কি আমার দোষ ছিল ভাইয়া?’
নিদ্রার শেষ বাক্যটা বড্ড বিষণ্ন শোনাল আরফানের কানে। নিদ্রার সাথে কখনোই অতটা সখ্যতা ছিল না আরফানের। ছোট থেকেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আরফান বোনের সাথে খুব একটা সহজ হয়ে উঠতে পারেনি। নিদ্রাও ধারে কাছে আসত না। নিদ্রার সকল বায়না, দুষ্টুমি, পাগলামো ছিল আরফানের বড় ভাই নেহলকে কেন্দ্র করে। নেহালও ছিল আমোদপ্রিয়, চঞ্চল। ছোট বোনটাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। কিন্তু হঠাৎ-ই সব পাল্টে গেল। ভাইয়ার আকস্মিক মৃত্যু। তার এক বছর পর বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে কিভাবে যেন নিদ্রার সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো আরফানের। তবুও কোথাও একটা বিস্তর ফারাক। আরফান চেষ্টা করেও নেহালের মতো অতোটা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না। বোনটা যে তার বড্ড ভালোবাসার কাঙাল। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকাল। চোখের কোণে জল জমেছে তার। সকালের রোদে চিকচিক করছে সেই অশ্রু। নিদ্রা নিস্তব্ধ। আরফান ধীর পায়ে নিদ্রার পাশে দোলনায় বসল। ডানহাতটা কোলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
‘ তোমার কোনো দোষ ছিল না, নিদু। ইট’স অল আবাউট ডিস্টেনি।’
নিদ্রা অসহায় চোখে তাকাল। আরফানের বুকে আলতো মাথা রেখে বলল,
‘ ইট’স আ ডিস্টেনি?’
আরফান হালকা হাতে বোনকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ ইয়াপ। ইট’স আ ডিস্টেনি।’
কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধ কাটার পর হঠাৎই কথা বলল আরফান,
‘ তোমাকে আমার অপিনিয়নটা জানানো হয়নি নিদু।’
নিদ্রা কপাল কুঁচকে বলল,
‘ অপিনিয়ন? অপিনিয়ন অফ হোয়াট?’
আরফান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ এবাউট দেট গার্ল!’
নিদ্রা চোখ বড় বড় করে তাকাল। আরফান রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
‘ মেয়েটি আসলেই মারাত্মক সুন্দরী।’
নিদ্রা এবার মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল তোমার?’
‘ হ্যাঁ। হয়েছিল।’
‘ কিভাবে?’
‘ হসপিটালে। তার বন্ধু আমার পেশেন্ট ছিল।’
‘ তুমি তাকে বকোনি?’
আরফান হেসে মাথা নাড়ল। নিদ্রা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তোমার রাগটা কি মোটামুটি থেকে শূন্যে নেমে গিয়েছে?’
আরফান হেসে বলল,
‘ মনে হচ্ছে।’
‘ তুমি কি তাকে বিয়ে করছ?’
মেয়েটির চোখে বিস্ময়। আরফান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ বিয়ে করছি কি-না জানি না। তবে সম্ভবনা আছে। আমি তার একটা সিক্রেট জেনে গিয়েছি। সেই সিক্রেটটা পুরোপুরি এক্সপোজ করার আপেক্ষায় আছি। আমার ধারণা সে আমার সাথে গেইম খেলার চেষ্টা করছে।’
নিদ্রা লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ তারমানে তুমি বিয়ে করছ! আমি এক্ষুনি মাকে জানাচ্ছি যে নিষ্প্রভ ভাইয়া বিয়ে করছে। মেয়ে টেয়ে ঠিকঠাক। এখন শুধু বাসর সাজানো বাকি।’
আরফান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
‘ বিয়ে করছি কখন বললাম?’
‘ এইমাত্রই বললে। আচ্ছা মেয়েটির নাম কি? মাকে তো ডিটেইলস জানাতে হবে, তাই না? আচ্ছা? সে-কি সবসময়ই জিনিসপত্র ফেলাফেলি করে? নাকি দেখে দেখে ল্যাপটপ জাতীয় জিনিসগুলোই ফেলে? টাইম মেইন্টেইন করে ফেলে? নাকি যখন তখন ফেলে? আচ্ছা! তুমি উত্তরগুলোর লিস্ট বানাতে থাকো। আমি আগে মাকে ইনফর্ম করে আসি। শী শুড নো দ্যা গ্রেট নিউজ।’
কথাটা বলেই চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল নিদ্রা। ঘটনার আকস্মিকতায় আরফান হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎই ডেকে উঠে বলল,
‘ বাট আই ডোন্ট ইভেন নো শী ইজ এনগেজড অর নট! নিদু? নিদু? দাঁড়াও।’
নিদ্রার দেখা পাওয়া গেল না। সিঁড়িতে বেজে উঠা পায়ের শব্দগুলো মিলিয়ে গেল দূরে। আরফান ছোট্ট শ্বাস টেনে দোলনায় গা এলাল। ঠোঁটের কোণে অযথায় ফুটে উঠল হাসি। চোখদুটো বোজার সাথে সাথেই ভেসে উঠল আকর্ষণীয় সেই পা। নেশা ধরানো সেই তিল। সেইসাথে নম্রতার বিস্মিত, আশ্চর্য দুটো চোখ।
দুই দিন হলো ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। গঁদ বাধা পড়াশোনা থেকে খনিকের মুক্তি। ঘাসের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে বন্ধুরা। অন্তুর ভাঙা হাতও এখন ঠিকঠাক। সেইসাথে ঠিকঠাক তার মাথাও। গত একমাস যাবৎ নীরার সাথে কোনোরূপ ঝামেলা সে করেনি। একদম স্বাভাবিক থেকেছে। শান্তভাবে পরীক্ষাগুলোও দিয়েছে। কয়েক মাস আগে এডমিশন হওয়ায় নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীতে ভরে গিয়েছে ক্যাম্পাস। সব ফ্রেশারস্। প্রতিবারের মতোই মেয়েগুলো মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী। নাদিম, অন্তু, রঞ্জন নতুন মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করছে। ছোঁয়া গভীর মনোযোগে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। নম্রতার মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। গোটা এক মাসে আরফান একবারের জন্যও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। একবারের জন্যও না। মানুষটা সত্যি সত্যিই বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেল না তো আবার? নম্রতার রাগ লাগছে। আরফান যদি সত্যিই বিয়ে করে থাকে তাহলে তাকে একদম দেখে নিবে নম্রতা।পত্র দিবে তাকে আর বিয়ে অন্য কাউকে? এত সোজা? এমন হলে গলায় ছুঁড়ি ঝুলিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করবে। দরকার হলে সতীন নিয়ে সংসার করবে। নয়তো আরফানকে খুন করে জেলে গিয়ে বসে থাকবে। শান্তি ! নাদিম গিটার কোলে নিয়ে বসে ছিল। পাশ দিয়ে দুটো মেয়েকে যেতে দেখতেই ভদ্র ছেলের মতো কাছে আসতে বলল। মেয়েগুলো প্রত্যুত্তর না করে সামনে এসে দাঁড়াল। দুই জনের চোখ-মুখই রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে, ভয়ে এখনই জ্ঞান হারাবে। নাদিম বিরস কন্ঠে বলল,
‘ নাম কি? কোন ডিপার্টমেন্ট?’
মেয়েদুটো ভয়ে ভয়ে নাম বলল। তাদের গলা কাঁপছে। চোখদুটো কাঁদো কাঁদো। আজকালকার ফ্রেশারদের এমন ন্যাকা ন্যাকা ভাব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নাদিমের। নাদিম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ পানি আছে? ঠান্ডা পানি খাওয়াও তো।’
দুই জনের মাঝে লম্বা মেয়েটি যন্ত্রের মতো করে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল। বোতলটা নিতে গিয়ে নাদিম খেয়াল করল, মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপছে। এক ঢোক পানি গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে ছোঁয়ার হাতে দিল সে। ছোঁয়া বোতলটা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করল। চশমাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে গন্ধ শুকল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ এটা কি মিনারেল ওয়াটার? অথবা ফোটানো।’
‘ জি না আপু্। ভার্সিটি থেকেই নিয়েছিলাম।’
ছোঁয়ার মুখভঙ্গি দেখার মতো হলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বোতলটা নাদিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ সরি! আমি মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খাই না। কতশত ব্যাকটেরিয়া আছে। ছিঃ।’
নাদিম বোতল দিয়েই ছোঁয়ার মাথায় থাপ্পড় লাগাল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ বালের মিনারেল ওয়াটার মারাইতে আসছিস। আমি এইডা বুঝি না তোর মতোন গবেট ইংরেজরে এখনও এই দেশে রাখছেটা ক্যান? আই ওয়ান্ট টু গিভ ইউ আ লাত্থি। বিশ্বাস কর দোস্ত, তোর মতো গবেটরে বেশি হইলে ড্রেনের পানি খাওয়ানো যায়। এর থেকে শুদ্ধতম কিছু তোর লাইগা বাংলাদেশে নাই।’
ছোঁয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাল। নাদিম ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বাকি পানিটুকু শেষ করে বোতলটা ফিরিয়ে দিল। বেশ আয়েশ করে বসে বলল,
‘ আমাগো ডিপার্টমেন্টেই তো ভর্তি হইছ। চিনে আমাগো?’
মেয়েদুটো অসহায় মুখে মাথা নাড়ল। যার অর্থ চিনে না। নাদিম আগলা কন্ঠে বলল,
‘ মামা! চিনে না তো। এই দুঃখে ছাঁদ থাইকা লাফ দিয়া মইরা যাইতে মন চাচ্ছে।’
আতঙ্কে মেয়েদুটোর গলা শুকিয়ে এসেছে। তাদের সচেতন মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে র্যাগিং-এর মতো বিশ্রী প্রথাটার মধ্যে তারা ফেঁসে গিয়েছে। নম্রতা রয়ে সয়ে বলল,
‘ কষ্ট পাইস না দোস্ত। না চিনলে এখন চিনবে। সমস্যা কই? কি, সমস্যা আছে?’
মেয়েদুটো দ্রুত মাথা নাড়ে, সমস্যা নেই। নম্রতা ঠেস দেওয়া কন্ঠে বলল,
‘ এই তিনটা ভাইয়ের মধ্যে কার উপর ক্রাশ খাইছ? নাকি ক্রাশ খাও নাই?’
মেয়েদুটো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। নম্রতা আবারও ধমকে উঠতেই একজন রঞ্জনকে ইশারা করে বলল,
‘ এই ভাইয়াটাকে ভালো লাগে।’
নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ এই মেয়ে? এতো সাহস কোথায় পাও? সিনিয়রদের আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছ। যাওয়ার সময় সালামও দাওনি। কাহিনী কি? সিনিয়র মনে হয় না?’
‘ সরি আপু।’
নম্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ রঞ্জনকে ভালো লাগছে! মাই গড। তুমি আমার বরের ওপর কিভাবে ক্রাশ খেতে পারো? তোমার এতো সাহস কোথাকে?’
রঞ্জন হেসে ফেলল। নাদিম হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ বহুত বড় অন্যায় করে ফেলছ। আমার বান্ধবী বিশাল কষ্ট পাইছে। জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছে। এই জ্বালাপোড়া কমাতে পানি লাগবে। তোমার কাজ হলো, ভার্সিটির শেষ মাথায় যে চাপকল আছে ওখান থেকে বোতল ভরে পানি আনা। সময় মাত্র পনেরো মিনিট। এক মিনিট এপাশ-ওপাশ হলে খবর আছে। আর হ্যাঁ… চোরের ওপর বাটপারি করার চেষ্টা করবে না। বাটপারিতে আমরা হেডমাস্টারি করে এসেছি। টাইম স্টার্টস নাও…’
মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে হন্তদন্ত পায়ে ছুঁটে গেল। এতো বড় ভার্সিটি এড়িয়ায় কোথায় খুঁজবে সেই চাপকল? প্রথমত কিছু চিনে না তারওপর মাত্র পনেরো মিনিট! ছোঁয়া চশমা ঠিক করতে করতে দ্বিতীয় মেয়েটিকে বলল,
‘ তুমিও রঞ্জনের ওপর ক্রাশড? কেন? অন্তুকে দেখে ক্রাশ খেলে না কেন? অন্তু দেখতে বিশ্রী? তুমি ওকে অপমান করার চেষ্টা করছ?’
মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ না আপু। অন্তু ভাইয়াও খুব কিউট।’
‘ এই! তুমি সিনিয়র ভাইকে কিউট বললা? এতো সাহস কই পাও?’
মেয়েটি যেন অকূল পাথারে পড়ল। দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইল। নম্রতাদের কঠিন কথার ঘোরপ্যাঁচে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাল । দশ মিনিটের মাথায় মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দিল। নীরা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘ এবারের ফার্স্ট ইয়ারগুলো ভয়ানক বিচ্ছু। সামনে দিয়ে চলে যায় তবু সালাম দেয় না। আর কিছু বললেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লেগে যায়। আমরা যে পরিমাণ র্যাগ খেয়েছি তার টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্টও ওদের দেওয়া হয় না। ন্যাকাবাজ একেকটা।’
বন্ধুদের মধ্যে এই নিয়ে চলতে লাগল আলোচনা। নম্রতার হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল। উফ! আরফান তার খোঁজ কেন নিচ্ছে না? নম্রতার কি উচিত তার খোঁজ নেওয়া?
#চলবে….
[ রি-চেইক করিনি। ভুল-ভ্রান্তির জন্য দুঃখিত]