#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৩.
‘ না। আপাতত বহিষ্কার করা হচ্ছে না। তবে আপনার এই ভয়াবহ অপরাধের জন্য আপনাকে ভয়ানক এক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তুমিময় শাস্তি। এই শাস্তিতে আপনি টাপনি নিষিদ্ধ নগরীর শব্দ। পত্রমিতাকে কেউ কখনো “আপনি” বলে সম্বোধন করেছে শুনেছেন কখনো? আচ্ছা? আপনাকে কি এখন বন্ধু বলে সম্বোধন করা যায়? অনেকটা আগের যুগের পত্রমিতার মতো?
ছোটবেলায় দাদির কাছে পত্রমিতাকে ঘিরে অজস্র গল্প শুনেছি। আমার দাদাভাই আর দাদির সম্পর্কটা হয়েছিল মূলত চিঠি-পত্রকে কেন্দ্র করে। দাদি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে তখন “পত্রমিতালী” বলে একটা সংখ্যা ছিল। একদিন দাদির সই দুষ্টুমি করে সেই পত্রমিতালীতে দাদির নাম ঠিকানা দিয়ে দিল। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী কোনো চিঠিপত্র এলো না। সেখান থেকে চিঠি না এলেও চিঠি এলো অন্য একটা ঠিকানা থেকে। দাদুর ভাষ্যমতে সেটা ছিল দাদাভাই কতৃক ভুল ঠিকানায় চিঠি। ভুল চিঠিতে কিন্তু কোনো রোমান্টিসিজম ছিল না। চিঠিটা ছিল দাদাভাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারা যাওয়ার দুঃসংবাদ বহন করা দুঃখী দুঃখী চিঠি। আমার দাদি ছিল অল্পবয়স্কা আবেগী মেয়ে। দাদাভাইয়ের দুঃখে সে এমনই ব্যথিত হলো যে, দাদাভাইয়ের ঠিকানায় আবেগমাখা সান্ত্বনাপত্র পাঠিয়ে দিল। তারপরই শুরু হলো চিঠিচালান ভালোবাসা। প্রায় একবছর পর, দাদাভাই ঢাকা থেকে রাজশাহী দাদুর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। সেই বিয়েতে ওকালতি করার জন্য নাকি ঘটককে বিস্তর টাকা খাইয়েছিলেন দাদাভাই। আপনি ভাবতে পারছেন? সেই এতো এতো বছর আগে চুপি চুপি প্রেম করে বিয়ে করে ফেললেন তাঁরা। কেউ সেই প্রেমের খবর জানল না। বুঝল না। ব্যাপারটা মজার না? আমি রং-নাম্বারে প্রেমের গল্প শুনেছি কিন্তু এভাবে চিঠি প্রেমের গল্প একদম নতুন। আচ্ছা? তাদের প্রেমটাকে কী নাম দেওয়া যায়, বলুন তো? রং-নাম্বারের সাথে মিলিয়ে রং-লেটার?
বিঃদ্রঃ আপনি কিন্তু এবারও ইতিতে কিছু লেখেন নি। এবার আমি আপনাকে কী বলে সম্বোধন করি বলুন তো?
ইতি
শ্যামলতা ‘
চিঠিটা লিখে বার কয়েক চোখ বুলাল নম্রতা। তারপর কম্পিত হৃদয়ে চিঠিটা রেখে দিল নির্দিষ্ট বইয়ের মলাটের নিচে। বাকিটা সময় সেই অপরিচিত ‘সে’ এর থেকে পাওয়া দুই লাইনের চিঠিটা হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইলো। নোট বুক আর এসাইনমেন্টের পাতাগুলো ফ্যানের কৃত্রিম বাতাসে চঞ্চল হয়ে উঠল। নম্রতার খুশির জোয়ার যেন তাদের মাঝে প্রাণ দিল। বাতাসের ঝাপটায় উলোটপালোট হতে লাগল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আনমনা নম্রতার কাছে বইয়ের পাতার উড়োউড়োর শব্দটাকে হঠাৎ-ই ভীষণ মাদকীয় বলে বোধ হতে লাগল। সেই সাথে মাথায় উঁকি দিয়ে গেল অদ্ভুত এক প্রশ্ন, ‘ আচ্ছা? পত্রমিতার ‘সে’ নামক লোকটা যদি টাক পড়া বৃদ্ধ কোন লোক হয়, তবে? বা রাস্তার কোনো ছাইপাঁশ বেয়াদব ছেলে?’ মস্তিষ্কের করা যুক্তিসংগত প্রশ্নটা মনের কাছে খুব একটা পাত্তা পেলো না। সেই অপরিচিত মানুষটি যেমনই হোক সে যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ তা বেশ বুঝতে পারছে নম্রতা। লাইনের ভাঁজে ভাঁজেই ফুটে উঠছে লোকটির প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ববোধ। এটা কি শুধুই নম্রতার ভ্রান্ত ধারণা? হলে হোক। এই ভ্রান্ত ধারণা মেনে নিতেই যেহেতু ভালো লাগছে তাহলে এই ভ্রান্ত ধারণাতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষের ছোট্ট জীবনটাতে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকলে ক্ষতি নেই। ভ্রান্ত ধারণাকে বুকে আগলে ধরে খানিকটা খুশি আর খানিকটা স্বপ্ন দেখাতেও ক্ষতি নেই।
পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এবার দু’সপ্তাহের মাথাতেও হাতে পেলো না নম্রতা। প্রতিদিন কলেজ শেষে গ্রন্থগারের পরিচিত বইটিতে ডুব দিয়ে ব্যর্থ হয়েও খুব একটা মন খারাপ হলো না নম্রতার। বরং তার উচ্ছল প্রাণে জোয়ার এলো। ফুলে ফেঁপে উঠলো হাসি-তামাশাময় জীবন। অবসরে চিঠির জবাবে অপরিচিত ব্যক্তিটি কী কী লিখতে পারে সেই ভাবনায় আকন্ঠ ডুবে রইলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চমৎকার এক রবীন্দ্র সংগীতও গেয়ে ফেলল নম্রতা। বিস্ময়কর ভাবে পুরষ্কার হিসেবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দূরবীন’ বইটাও হাতে পেয়ে গেল। আহ! সেদিন নম্রতার কি আনন্দ। অল্পতে খুশি হয়ে যাওয়া নম্রতা সেদিন বান্ধবীদের পেছনে বিস্তর টাকা উড়াল। এক মাসের হাত খরচ আর জমানো টাকাগুলো শেষ করে মনের সুখে গান ধরল,
‘ তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ক্ষণেক–তরে।
আজি হাতে আমার যা–কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।
না চাহিলে তোমার মুখপানে
হৃদয় আমার বিরাম নাহি জানে,
কাজের মাঝে ঘুরে বেড়াই যত
ফিরি কূলহারা সাগরে॥’
এই গানটা সেদিন ওই টাইম-টেবিলহীন অপরিচিত ব্যক্তিটিকে ভেবে গেয়েছিল নম্রতা। নীরার ভাষায়, সেই গানের মতো আবেগময় গান নাকি পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন গাইতে পারে নাই। কথাটা শুনে প্রচুর হেসেছিল নম্রতা। তার দামফাটা, প্রাণখোলা হাসির মাঝেও সেই লোকটির ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। পত্রপ্রণয়ের তৃতীয় চিঠিটা এলো ঠিক ষোল দিনের মাথায়। এবারও সম্বোধনহীন গুটি গুটি অক্ষরে লেখা চিঠি। কিন্তু এবার আর সাদা নয় গাঢ় নীল রঙা পাতার মাঝ বরাবর দুই থেকে তিন লাইনের ছোট্ট এক চিঠি। নম্রতা ভেবে পায় না এই লোক এতো ছোট চিঠি লিখে কিভাবে? এর মাথায় কি এতো এতো কথা কিলবিল করে না? এই লোকটা কি স্বল্পভাষী? উহু, নম্রতা তো তাকে কথা বলতে দেখেনি। শুধু লিখতে দেখেছে। তাই লোকটিকে স্বল্পভাষী বলা যায় না। লেখার সাথে মিলিয়ে স্বল্পলেখ্য বলা যায়। নম্রতা আবারও চিঠির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গালের সাথে চেপে ধরে সুখী সুখী দৃষ্টিতে তাকাল। খোলা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল চিঠিতে। দুই-তিন লাইনের চিঠিটাই আনমনা হয়ে পড়তে লাগল নম্রতা।
‘ “রং-লেটার লাভ স্টোরি! বাহ! ইন্টারেস্টিং তো। কিছু কিছু সম্পর্ক সম্বোধনহীন হলে মন্দ হয় না শ্যামলতা। আপনার-আমার সম্পর্কটা না-হয় সম্বোধনহীনই হোক। আর হ্যাঁ, আপনার দেওয়া শাস্তিটা আমি মাথা পেতে নিলাম। কোনো একদিন প্রয়োজন হলে সে শাস্তির সত্যিকার প্রতিফলন ঘটাব। তুমিময় শাস্তির আগে চিঠিগুলো একবার আপনিময় হোক।’
এটুকু পড়েই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল নম্রতা। ছোট্ট একটু লেখাতে এতো আকর্ষণ কী করে ঢেলে দেয় এই লোক? লোকটির কাছে কি চিঠি-মাদক ধরনের কিছু আছে? নম্রতা প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ে। সেই পত্রপ্রণয়ের স্বল্পলেখ্য মানুষটি যে মনে করে সাদার বদলে নীল কাগজে চিঠি লিখেছে তাতেই নম্রতার খুশি যেন আর ধরে না। তারমানে, লোকটিও সময় করে তার মতোই চিঠিগুলোর কথা ভাবছে? ইশ! বেঁচে থাকা এতো আনন্দের কেন? অপেক্ষাগুলো এতো মিষ্টি কেন? আনন্দিত নম্রতা এবার খুশিমনে চিঠি লেখায় মন দিল। নীল কাগজের মসৃণ জমিনে কিশোরী আবেগের ঘটটা যেন উল্টে দিল। এক-দু শব্দ করে লিখে ফেলল দীর্ঘ এক চিঠি,
‘ সম্বোধনহীন চিঠি! বাহ রে! সম্বোধনহীন চিঠি লিখলে কিভাবে বুঝবো আপনার আর আমার সম্পর্কটা ঠিক কেমন? আমরা কি বন্ধু নাকি জীবনপথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া দু’জন আগুন্তকঃ মাত্র?
আচ্ছা? আপনি কখনো জ্যোৎস্না আলোয় স্নান করেছেন? আমি ছেলেবেলায় একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম খুবই অদ্ভুত এক ছেলে জ্যোৎস্না রাতে ছাঁদের পাটাতনে লম্বালম্বি শুয়ে জ্যোৎস্না বিলাশ করতো। তার সারা শরীরময় জ্যোৎস্নার মিষ্টি আলো ঝলমল করতো। একদম সিনেমার জ্যোৎস্নার মতো নীল দেখাতো তার গোটা শরীর। মাঝরাতের ঠান্ডা, শান্ত ঝিরিঝিরে বাতাসে কেঁপে উঠতো ছেলেটির উসকোখুসকো চুল। আমারও খুব ইচ্ছে জ্যোৎস্না স্নান করার। কিন্তু আম্মুর জন্য হচ্ছে না। মেয়েদের তো একা একা ছাঁদে থাকা বারণ তাই। আচ্ছা? আপনারও কি রাতে ছাঁদে উঠা বারন? যদি বারণ না হয় তাহলে একদিন গভীর রাতে জ্যোৎস্না স্নান করবেন। তারপর সেই পূঙ্খানুপুঙ্খ অনুভূতিগুলো আমায় জানাবেন। কি, জানাবেন তো? আমিও অবশ্য জ্যোৎস্না স্নান করব। কিন্তু সে তো অনেক দেরী। জ্যোৎস্না বিলাস সবসময় একা একা করতে হয়। তবে পাশে যদি প্রিয়তম কেউ থাকতে চায় তাহলে অবশ্য দু’জন থাকার নিয়ম আছে। কথায় আছে না? এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। কিন্তু দু’য়ের অধিক থাকলে কিছুতেই জ্যোৎস্না বিলাস হয় না। সেটা ইংরেজি কম্পোজিশন ‘দি মুনলিট নাইট’ হয়ে যায়। আমি তো ছাঁদে একা যেতে ভয় পাই তাই বরের জন্য অপেক্ষা করছি। বিয়ের পর বরের সাথে জ্যোৎস্না স্নান করব। সুন্দর টলমলে জ্যোৎস্না থাকবে সেদিন। বিশাল আকাশটিতে থালার মতো হলদেটে এক চাঁদ থাকবে। আমার গাঁয়ে থাকবে সাদা পাতলা এক শাড়ি। হাত ভরা লাল চুড়ি আর চোখ ভরা মায়াবী ঘন কাজল। ছাঁদের একপাশে একটি বেলীফুলের গাছ লাগাব সেখানে দু-একটা ঝড়া বেলীফুল ঝলমল করে ওঠবে। আমি খোলা লম্বা চুলগুলো ছাঁদের পাটাতনে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশ দেখব। ঝিরিঝিরি বাতাসে আমার চুলগুলো উড়বে। বাতাসটা ভরে যাবে বেলীফুলের অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণে। আমার পাশে শুয়ে থাকা প্রিয়তম হাতে হাত রেখে আবেগভরা কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলবে, ”শুনছো জ্যোৎস্না রাণী? আমি তোমাকে মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো ভালোবাসি।” আহা! স্বপ্নটা সুন্দর না?
বিঃদ্রঃ আপনি কি ভূতে ভয় পান? ভয় বাতিক থাকলে আমায় জানাতে পারেন। আমি দারুণ সব সূরা জানি। ওগুলো শুনলে ভূত দৌঁড়ে পালাবে।
ইতি
শ্যামলতা ‘
চিঠিটা লিখে জোরে শ্বাস টানল নম্রতা। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিঠির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, এমন সুপ্ত স্বপ্নের কথাগুলো কি এভাবে লিখে ফেলাটা ঠিক হলো? লোকটা আমায় কী ভাববে? পরমুহূর্তেই অস্বস্তিটা উবে গেল নম্রতার। মনে পড়ে গেল চির চিরন্তন বাক্য, একদম অপরিচিত মানুষ ছাড়া মনের সুপ্ত কথা প্রকাশ করে আরাম নেই। অপরিচিত মানুষ থেকে অনুভূতি নিয়ে কাটাছেঁড়ার আঘাত পাওয়ার ভয় নেই। তারা শুধু শুনে, ভাবে তারপর ভুলে যায়। তার পত্রমিতার ‘সে’ ও-তো তার অপরিচিত কেউই। ভীষণ অপরিচিত ‘সে’। তার কাছে অনুভূতি প্রকাশে ভয় নেই। একটুও না।
# চলবে….
[ বেশি ছোট হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছি। ]