#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৩১.
ঘর্মাক্ত দুপুরে গাধার মতো খেটে-খুটে মাত্রই বাসায় ফিরেছেন আনিসুল সাহেব। তেতে উঠা রোদে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মতিঝিলের অফিস থেকে ধানমন্ডি আসতে সময় লাগে সতেরো মিনিট। অথচ, অানিসুল সাহেবের লেগেছে এক ঘন্টা বিশ মিনিট। এই অসহ্য গরমে লোকাল বাস মানেই বিশ্রী ব্যাপার। সতেরো মিনিটের পথ অতিক্রম করতে ঘন্টাখানেক জ্যামে ফেঁসে থাকা তার থেকেও বিশ্রী ব্যাপার। চারপাশে ঘামের গন্ধ, ধুলাবালি, দমবন্ধ গরম বাতাস আর অযথা চেঁচামেচির মাঝে ঘন্টাময় বসে থাকলে কোনো ভদ্রলোকেরই মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। আনিসুল সাহেবেরও নেই। তবে তার মেজাজ খারাপের পুরো দোষটা জ্যামের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। যার ছেলে হুটহাট উধাও হয়ে যায়, তার মেজাজ খারাপ হওয়ার জন্য জ্যামের অপেক্ষা রাখে না। আনিসুল সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। স্ত্রী জাহানারা নিঃশব্দে খাবার বেড়ে দিতেই গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি,
‘ কাল রাতে কোথায় ছিলে?’
অন্তু ভাতে হাত দিয়েছে মাত্র। বাবার প্রশ্নে বিচলিত না হয়ে মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল। আনিসুল সাহেব আবারও একই প্রশ্ন করলেন। আগের বারের থেকেও ঠান্ডা শোনাল তার কন্ঠ। অন্তু ভাতের দলাটা গিলে নিয়ে নম্র কন্ঠে বলল,
‘ এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম আব্বা।’
আনিসুল সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। ধীরে ধীরে তপ্ত হয়ে উঠল কন্ঠস্বর,
‘ কেন? ঢাকা শহরে তোমার নিজস্ব বাসায় নিজস্ব রুম থাকা সত্ত্বেও বন্ধুর বাসায় থাকতে হলো কেন? আমি তোমার উত্তরের পেছনে কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না।’
অন্তু উত্তর না দিয়ে ভাত মাখাতে মনোযোগ দিল। আনিসুল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘ তুমি রাতে ফিরছ না। এই সংবাদটা বাসায় জানানো উচিত ছিল বলে কি তোমার মনে হচ্ছে না?’
‘ জি। মনে হচ্ছে।’
‘ তাহলে জানাওনি কেন?’
অন্তু উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে হুট করেই অদ্ভুত এক প্রস্তাব দিয়ে বসল,
‘ আমি বিয়ে করতে চাই আব্বা।’
আনিসুল সাহেব হতভম্ব চোখে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। শীতল কন্ঠে শুধালেন,
‘ কি বললে?’
অন্তু নির্বিকার কন্ঠে জবাব দিল,
‘ আমি বিয়ে করতে চাই।’
আনিসুল সাহেব খাবার খাওয়ায় মনোযোগী হলেন। কয়েক লোকমা খাবার খেয়ে খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘ তুমি কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছ? রাতের সময়টা তার সাথেই কাটিয়েছ বা কিছু?’
‘ জি না।’
আনিসুল সাহেব ঠান্ডা চোখে তাকালেন,
‘ তাহলে হঠাৎ বিয়ে করতে চাইছ কেন?’
‘ আমার প্রয়োজন।’
এবার যেন বিস্ফোরণ ঘটল। টেবিলে থাকা কাঁচের জগটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন আনিসুল সাহেব। জগটা তীব্র ঝনঝন শব্দ তুলে ইহলোক ত্যাগ করল। অন্তুর দশম শ্রেণী পড়ুয়া ভাই টেলিভিশন বন্ধ করে ভীত চোখে চেয়ে রইল বাবা আর ভাইয়ের দিকে। অন্তুর মা আঁতকে উঠে বললেন,
‘ আহ! অযথা জিনিসপত্র ভাঙছ কেন বল তো? ছেলেটাও তো মাত্র ফিরল। খাওয়া শেষ করেও তো কথা বলা যায় নাকি?’
আনিসুল সাহেব গর্জে উঠে বললেন,
‘ চুপ। একটা কথা বলবা তো থাপ্পড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব মহিলা। আমার টাকায় কেনা জিনিস আমি ভাঙব তাতে তোমার সমস্যা কই? যেখানে সমস্যা হওয়ার কথা সেখানে তো তোমায় দেখা যায় না। একমাত্র তোর জন্য ছেলেগুলো এতোটা বেয়ারা হয়েছে। সবার মতো যদি বউ পেটাতে পারতাম। পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলতে পারতাম তাহলে ছেলেও থাকত টাইট। তোকে পিটিয়েই ছেলে ঠিক করতে হবে আমায়। সারাদিন বাসায় বসে করিস কি তুই? ছেলে সামলাতে পারিস না?’
অন্তু শীতল অথচ কড়া কন্ঠে বলল,
‘ আম্মাকে তুই-তোকারি করবেন না আব্বা। যা বলার আমাকে বলুন। আম্মা? ঘরে যাও।’
আনিসুল সাহেবের রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। গর্জন করে বললেন,
‘ তোকে বলব! কয় দিনের পোলা হইছিস তুই? বিয়ে করবি! প্রয়োজন দেখাস? এই তুই রোজগার করিস? নিজেই তো আমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস। বউরে খাওয়াবি কি? নিজের রক্ত পানি করে তোদের শখ-আহ্লাদ পূরণ করছি আর তোরা ভার্সিটির নামে মেয়েবাজী করে বেড়াস? দেবদাস হইতে চাস? ওই হারামজাদা, তোর বাপের কি জমিদারি আছে যে দেবদাস হবি তুই? তোর বাপের কেরানির চাকরীতে দেবদাসগিরিও ফুটব না হারামীর বাচ্চা।’
‘ অযথা গালাগালি করবেন না আব্বা। সামান্য বিয়ে করা নিয়ে এতো হট্টগোল করার কিছু নেই।’
‘ এটা সামান্য! এই কু** বাচ্চা। তুই আমারে শিখাবি কোনটা সামান্য আর কোনটা জগন্য? সামান্য কেরানীর চাকরি করে পরিবারটাকে এই জায়গায় টেনে এনেছি আমি। নিজের শখ আহ্লাদ ভুলে তোদের আহ্লাদ পূরণ করেছি। ভালো স্কুল, কলেজে পড়িয়েছি। যখন যা চেয়েছিস সব দিয়েছি। লোন নিয়ে বাইক কিনে দিয়েছি। তার বিনিময়ে চেয়েছি, ছেলেগুলো ভালো করে পড়াশোনা করুক। প্রতিষ্ঠিত হোক। সমাজে একটু মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াই। আর তোরা? বিয়ে করবি? বিয়ে করে ফুটানি দিয়ে ঘুরবি? বেয়াদব। বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কি তুই শুয়** বাচ্চা?’
‘ সেটা আমার ব্যাপার আব্বা। আমার বউয়ের দায়িত্ব আমার। আপনার দায়িত্ব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া। নিয়ে যাবেন ব্যস।’
‘ তোর দায়িত্ব? জীবনে এক টাকা রোজগার করছিস? টাকা কামাইতে কত কষ্ট বুঝিস? পৃথিবীটা এতোই সোজা? সিনেমা পাইছিস? আমার বাড়িতে থেকে এসব সিনেমা চলবে না। এতোদূর পড়াশোনা করানোর পর তুই বাসের কন্ট্রাক্টারগিরি করে ভাত খেতে চাস? তোর চাকরীর ন্যূনতম যোগ্যতা আছে?’
অন্তু উত্তর দিল না। আনিসুল হক নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
‘ আজকের পর বিয়ে-টিয়ের কোনো কথা যেন আমার বাড়িতে না উঠে। আর ওই নীরা মেয়েটার আশেপাশেও যেন তোমায় না দেখি।’
অন্তু চমকে তাকাল। বাবার তো নীরার ব্যাপারটা জানার কথা নয়। অন্তু বলেনি, তাহলে? প্রশ্নটা করতে গিয়েও চুপ করে রইল অন্তু। আনিসুল হক খানিক চুপ থেকে বললেন,
‘ এসব ফালতু বন্ধু বান্ধবের কোনো প্রয়োজন নেই। এসব নষ্ট ছেলেপুলের সাথে এতো মাখামাখি কিসের তোমার? সব বাউণ্ডুলে বন্ধু জুটিয়েছ তুমি। সব কয়টা বেয়াদব। সেদিন হসপিটালের সামনে তোমার এক বন্ধুকে দেখলাম। গিটার নিয়ে ঘুরে যে ছেলেটা। হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে সিগারেট ফেলার প্রয়োজনটুকু বোধ করল না। সিভিলাইজেশ্যন বলে তো একটা কথা আছে নাকি?’
অন্তু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ আপনি মেইন পয়েন্ট থেকে সরে যাচ্ছেন আব্বা। আলোচনাটা আমাকে নিয়ে হচ্ছিল। আমার বন্ধুদের সিভিলাইজেশ্যন নিয়ে নয়।’
ক্ষুব্ধ আনিসুল সাহেব ভাতের প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। হুট করেই চড় বসালেন তার জোয়ান ছেলের গালে। রাগে টলমল কন্ঠে বললেন,
‘ আজকাল মুখে মুখে কথা বলাও শিখে গিয়েছ তুমি। ওইসব বেয়াদবদের সাথে থেকে থেকেই বুঝি এই অধঃপতন?’
ছেলেকে চড় মারতে দেখেই আতঁকে উঠলেন জাহানারা। দৌঁড়ে স্বামীর কাছে গেলেন। ডান বাহুটা টেনে ধরে বললেন,
‘ কি করছ! এতোবড় জোয়ান ছেলের গায়ে কেউ হাত তুলে? মাথাটা শান্ত করো। ওর…’
জাহানার কথার মাঝপথেই গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করল অন্তু,
‘ বিয়েটা আমি করছি আব্বা।’
কথাটা কানে পৌঁছানোর সাথে সাথেই জাহানারার গালে দানবীয় এক চড় বসালেন আনিসুল সাহেব। আকস্মিক চড়ে টেবিলের ওপর ছিঁটকে পড়লেন জাহানারা। হতভম্ব চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। চোখদুটো টলমল করছে তার। পরিস্থিতিটা কেমন অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্ন ঠেকছে। ক্ষুব্ধ আনিসুল সাহেব কিছু বলার আগেই আরও একবার বিস্ফোরণ ঘটল ঘরে। অন্তু সামনে থাকা চেয়ারটা মাথায় তুলে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। চেয়ারের আঘাতে ভেঙে টুকরো হলো বসার ঘরে থাকা একুশ ইঞ্চির টেলিভিশন সেট। অয়ন লাফিয়ে সরে দাঁড়াল। ভয়ে কেমন কুঁকড়ে গিয়েছে সে। ওয়ারড্রবের উপর থাকা ফুলদানিটাও তুমুল শব্দ তুলে ভাঙল। ভাঙল এক দুটো কাঁচের গ্লাস। নিস্তব্ধ ঘরটিতে মুহূর্তেই বয়ে গেল সরব এক ধ্বংসযজ্ঞ। অন্তু লাল চোখে বাবার দিকে তাকাল। প্রচন্ড ক্রোধে কাঁপছে তার শরীর।
‘ আম্মার গায়ে হাত তোলার সাহস করবেন না আব্বা। সমস্যা আমার সাথে আম্মার সাথে না।’
‘ তুই আমাকে ধমকি দিচ্ছিস? এতোবড় সাহস? বের হ আমার বাড়ি থেকে। এই মুহূর্তে বের হবি। তোর মতো নালায়েক, বেয়াদব ছেলে আমার প্রয়োজন নেই।’
‘ আপনার বাড়িতে থাকার ন্যূনতম ইচ্ছে আমার নেই। বিয়ের প্রস্তাব যদি নিয়ে যেতে পারেন তো বাড়িতে ফিরব নয়তো এই বাড়ির ছায়াও মাড়াব না আর। আম্মা? তোমার বরকে বলে দিও, বিয়েটা আমি এই মাসের মধ্যেই করতে চাই। আর তা না হলে, ছেলের কথা ভুলে যাও। আর এটাও বলে দিও, তোমার দুই ছেলের একটাও এখন বাচ্চা নাই। আম্মার গায়ে হাত উঠলে সেই হাত ভেঙে গুড়ো করতে দ্বিতীয়বার সে ভাববে না।’
কথাটা বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না অন্তু। সামনে থাকা ছোট্ট টোলটা লাথি দিয়ে প্রচন্ড শব্দ তুলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আনিসুল সাহেব হতভম্ব চোখে ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস। ছেলের এমন রূপ দেখে বাবা হিসেবে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে তার। এই দীর্ঘ জীবনে সংসারের পেছনে দেওয়া শত শত বলিদান চোখের সামনে ভাসছে তার। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্ত পানি করে কাদের জন্য করেছেন এসব? কাদের জন্য করেছেন এতো ত্যাগ? এতো পরিশ্রম? আনিসুল সাহেবের চোখ ফেঁটে জল গড়াতে চায়। কিন্তু অনেক বছরের শক্তপোক্ত বেড়িবাঁধ পেরোনোর সাহস তাদের হয় না। জল গড়ায় না। চোখ দুটো রক্তিম থেকে রক্তিম হয়ে উঠে ক্ষণে ক্ষণে। বড় ভাইয়ের ধ্বংসলীলা দেখে ভীত স্বন্ত্রস্ত হয়ে বাবার দিকে চেয়ে আছে অয়ন। বাবা নিশ্চয় ভাইয়ের রাগ মেটাতে তাকেই বেদারম মারবে এখন? মাকেও কি মারবে? অয়নের পিকনিকে যাওয়াটাও বুঝি ক্যান্সেল হবে। এতোকিছুর পর বাবার কাছে টাকা চাওয়ার সাহস কি অয়নের হবে? সাহস দেখিয়ে বাবাকে বললেই কি বাবা দিবে? অয়ন জানে, দিবে না। কখনোই দিবে না। অয়নের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের প্রতি তার প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে। রাগ হচ্ছে বাবার প্রতিও। বাবা কেন মারল মাকে?
প্রচন্ড গরম। গাছ-গাছালিতে ঝকঝকে, উত্তপ্ত রোদ। রোদের তাপে নুইয়ে পড়েছে গাছের কচি পাতা। তেতে উঠেছে ঘাস, পিচ ঢালা রাস্তাঘাট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানিক মামার চায়ের স্টল। পাশাপাশি দুটো কাঠের বেঞ্চ রেখে বিরস মুখে চা বানাচ্ছেন তিনি। গরমের দুপুরে চায়ের খদ্দর কম। নাদিম দুই বেঞ্চের একটিতে বসে সিগারেট টানছে। কালচে ঠোঁট জোড়ায় জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরে মোহনীয় এক সুর তুলেছে গিটারে। এমন সময় কোথা থেকে ছুঁটে এলো ছোঁয়া। নাদিমের পাশে ধপ করে বসে পড়ে রুমালে মুখ মুছল। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করার চেষ্টা করে বলল,
‘ উফ! এতো রোদ। শরীর জ্বলছে।’
নাদিমের গিটারে ছন্দপতন হলো। চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তা তুই তোর মাখনের অঙ্গ নিয়া রোইদে বাড়াইছিস কেন? ফ্রিজে ঢুইকা বসে থাকতে পারলি না? শরীর জ্বলছে! বা… খারাপ কথা আইসা গেছিল মুখে। দূরে গিয়া বস, হারামি।’
ছোঁয়া মুখ ফুলিয়ে তাকাল। ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটার বের করে গলা বেজাল। তারপর কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
‘ রঞ্জন কই রে? ক্লাসও তো করেনি আজ।’
‘ রঞ্জন জাহান্নামে গেছে। ডিপার্টমেন্টের ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে তুইও জাহান্নামে চলে যা বইন। দয়া কর। তোর এই ইস্টাইল মার্কা বাংলা শুনলে মেজাজ খারাপ হইয়া যায় আমার। বালের ইস্টাইল।’
ছোঁয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মেজাজ খারাপে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। নাদিমের এইসব থার্ডক্লাস কথাবার্তা শুনলে গা জ্বালা করে তার। একটা মানুষের মুখের ভাষা এতো অশ্লীল হয় কি করে? ছোঁয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
‘ নমু আর নীরুও ভার্সিটি আসেনি আজ। ফাজিলগুলো আমাকে একবার বললেই পারত। এসব তাদের প্রি-প্লেনড। ওরা আসবে না জানলে মরে গেলেও আসতাম না আমি। আর না তোর মতো ফাজিলের সাথে মুখ নাড়তে হতো।’
‘ নাড়স কেন মুখ? আমি কইছি মুখ নাড়তে? তোর কি দুনিয়াতে আর কোনো কাম নাই বাপ? সবসময় আমার গায়ের লগে ঢলাঢলি করস ক্যান? সরে বস।’
ছোঁয়া এক লাফে সরে বসল। চোখ-মুখ কুঞ্চকে ফেলল বিরক্তিতে,
‘ ছিঃ কথার কি ছিঁড়ি! মাম্মাম ঠিকই বলে, তুই একটা থার্ড গ্রেড ছেলে। আই শুড এবোয়েড ইউ।’
ছোঁয়ার কথায় দাঁত বের করে হাসল নাদিম। লম্বা হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার মাথায় চাটি মারল। সিগারেটে একটা সুখ টান দিয়ে বলল,
‘ ওহে ইংরেজের বাচ্চা বলদা ! প্লিজ, প্লিজ এবোয়েড মি। তোর মতো বলদ আমায় এবোয়েড করলে জানে বাঁচি। তু…’
নাদিমের কথা শেষ না হতেই অন্তুর আগমন ঘটল। এসেই কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়া লাথি দিয়ে উল্টে ফেলল কাঠের বেঞ্চি। ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। নাদিম শান্ত চোখে চেয়ে সিগারেটে শেষ টান দিল। অন্তু রাগে ফুঁসছে। প্রচন্ড রাগে উল্টে পড়া বেঞ্চিতেই ক্রমাগত লাথি দিচ্ছে। নাদিম শান্ত ভঙ্গিতে সিগারেটটা ফেলে পায়ে মাড়িয়ে আগুন নেভাল। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ এই যে লায়ক শাকিব খান? কাহিনী কিতা মামা? এসেই এ্যাকশন মুভি শুরু কইরা দিছস ক্যারে?’
অন্তুর রাগ কমছে না। বেঞ্চে আরও দুটো লাথি দিয়ে নিজের চুল খামচে ধরল সে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বের করে দুই হাতে মাথা চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। অন্তু ছোঁয়ার পাশে বসতেই সরে গিয়ে নাদিমের গা ঘেঁষে বসল ছোঁয়া। নাদিমের শার্ট খামচে ধরে ফিসফিস করে বলল,
‘ দোস্ত? অন্তুর সাথে কি প্যারানরমাল কিছু ঘটছে নাকি? ভূত-প্রেত টাইপ কিছু? আমার ভয় লাগছে।’
নাদিম রাগে কটমট করে বলল,
‘ আল্লাহ! ছোঁয়াইয়া রে! চড় থাপড়া না খাইতে চাইলে ছাঁড় আমারে। গরমে মইরা যাইতাছি। তারওপর গায়ে আইসা পড়তাছিস। সর সর….’
ছোঁয়া ভয়ে ভয়ে সরে বসল। নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,
‘ হইছেটা কি? বাম মাছের মতো লাফাইতেছিস ক্যান?’
অন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ এরা চাইতাছে আমি মরে যাই। আমি মরলে এদের শান্তি। শালার সব কয়টাকে খুন করতে পারলে শান্তি পাইতাম। ঝঝড়া করে দিল কলিজা।’
নাদিম হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তুর দিকে চেয়ে রইল। ছোঁয়ার চোখে মৃদুমন্দ ভয়।
ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই। রবীন্দ্র সরোবরে লেকের পাশে বসে আছে আরফান-নম্রতা। দু’জনেই নিশ্চুপ। এই নিশ্চুপ অনুভূতিগুলোই কত প্রবল, কত তীব্র। নিঃশ্বাসের শব্দগুলো যেন একেকটা বার্তা। অপ্রকাশিত কিছু অভিমান। বিকালের তেরছা আলো এসে পড়ছে লেকের জলে। চিকচিক করছে টলটলে পানি। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফান।
‘ গত আড়াই ঘন্টা থেকে নিশ্চুপ বসে আছি আমরা।’
নম্রতা তাকাল। গরম আর ঘামে কাজলের রেখা খানিক ল্যাপ্টে গিয়েছে চোখে। ঘর্মাক্ত, তেলতেলে মুখটা বড্ড স্নিগ্ধ লাগছে। আরফান অভিমানী চোখদুটোতে নিষ্পলক চেয়ে থেকে ঢোক গিলল। নম্রতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটতেই চোখদুটো গিয়ে আটকাল পাতলা ঠোঁটজোড়াতে।
‘ আপনি সবসময় টাইম টু টাইম কাজ করেন? এক মিনিট এপাশ-ওপাশ নয় কাট টু কাট?’
আরফান নম্রতার ঠোঁট থেকে চোখ সরিয়ে চোখের দিকে তাকাল।
‘ আমি অযথা সময় নষ্ট করতে পারি না। ছোটবেলার অভ্যাস।’
‘ হুটহাট হারিয়ে যাওয়াও হয়ত কিছু মানুষের ছোটবেলার অভ্যাস।’
আরফান ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ আপনি কথায় কথায় এতো ফোঁড়ন কাটেন কেন বলুন তো?’
‘ সত্য বললে মানুষ ফোঁড়নই ভাবে।’
কথাটি বলে মুখ ঘুরাল নম্রতা। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘ আমাদের কী আর কোনো কথা নেই?’
‘ আপনার পুরো নাম কি? আরফান-নিষ্প্রভ ব্যাপারটা কী? ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?’
আরফান হাসল। নম্রতার রক্তিম মুখটির দিকে চেয়ে বলল,
‘ ছদ্মবেশ কোথায়? আরফান-নিষ্প্রভ দুটোই আমার নাম।’
‘ তবে নিশাদ ভাইয়া জানে না কেন এই নাম? উনি তো আপনার ভালো বন্ধু, না?’
‘ নিশাদ আমার কলেজের বন্ধু। তাছাড়া, স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটিতে কাউকেই জানানো হয়নি এই নাম। নিষ্প্রভ নামটা আমার ব্যক্তিগত। এই নামে ডাকার অধিকার শুধুই কিছু ব্যক্তিগত মানুষদের।’
‘ মানুষ আবার ব্যক্তিগত হয় নাকি?’
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করল নম্রতা। আরফানের হাস্যোজ্জল উত্তর,
‘ আপনার ‘সে’ যদি ব্যক্তিগত হতে পারে তাহলে মানুষ ব্যক্তিগত কেন হবে না? আপনি কোনোভাবে আপনার ‘সে’ কে পশুশ্রেণীর অন্তভূর্ক্ত করে ফেলেননি তো?’
আরফানের কথায় হেসে ফেলল নম্রতা। আরফানও হাসল। লেকের জলে দৃষ্টি রেখে হঠাৎই প্রশ্ন করল সে,
‘ আপনি নিষাদকে ওভাবে খুঁজছিলেন কেন? আমি তো ভেবেছিলাম ওর সাথে আপনার বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে।’
‘ সেটা আমি বলব না। পারলে নিজে খুঁজে বের করুন নয়তো কৌতূহল দমন করুন।’
আরফান হেসে বলল,
‘ আপনার বিষয়ে কৌতূহল দিনকে দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। এই অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল দমন করাও যাচ্ছে না। এতো এতো কৌতূহল মাথায় নিয়ে আজ রাত থেকে আমার ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
নম্রতা সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
‘ তার আগে বলুন আপনার প্রিয় মানুষটি কে? কার জন্য অতো উতলা হয়ে উঠতেন আপনি? পাঁচটা বাজতেই কার কাছে ছুটে যেতেন? বিয়ে টিয়ে করে ফেলেননি তো?’
আরফানের গম্ভীর উত্তর,
‘ বিয়ে করে ফেললে কি করবেন?’
নম্রতা জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের পর হঠাৎই অদ্ভুত এক কাজ করে বসল নম্রতা। আরফানের পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরে নিজের দিকে টেনে নিল। শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ খুন করে ফেলব। প্রেম করবেন একজনের সাথে আর বিয়ে অন্যজনকে? এতো সহজ?’
নম্রতার হঠাৎ আক্রমনে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল আরফান। চোখ ঘুরিয়ে একবার নম্রতার হাতের দিকে তাকাল। তারপর চোখদুটো নিবদ্ধ করল নম্রতার ক্ষ্যাপাটে মুখে। নম্রতার টানা টানা অভিমানী চোখ। ছোট্ট, সুন্দর মুখটা এতোটা কাছে পেয়ে বুকের ভেতরে অবাধ্য, তরল এক চাওয়া উঁকি দিয়ে গেল। খুবই সন্তপর্ণে চোখ নামিয়ে নম্রতার ঠোঁটের দিকে তাকাল সে। মৃদু কন্ঠে উত্তর দিল,
‘ তাহলে আপনি এতো নাচানাচি করে বিয়ের শপিং করলেন যে? একজনকে প্রেমে ডুবিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করার এতো তাড়া?’
আরফানের কথায়, চাহনীতে কি ছিল জানা নেই। তবে, হঠাৎই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল নম্রতা। আরফানের কলার ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল সে। ঠোঁটে ঝুলতে লাগল অপ্রতিরোধ্য লাজুক হাসি। আরফানও হাসল নিঃশব্দে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেলীফুলের মালা বের করে বলল,
‘ পাঁচটা থেকে সাতটা সময়টুকু শ্যামলতা আর আমার একান্ত কিছু সময়। ওই সময়টুকুতে, এমনই কোনো একটা বেঞ্চে বেলীফুলের মালা হাতে বসে থাকতাম আমি। শ্যামলতা তখন খুব আয়োজন করে আমার কল্পনায় আসত। পাশে বসত। পরনে থাকত সাদা-লাল শাড়ি। খোলা চুল। চোখে কাজল। শ্যামলতা নিরন্তর গল্প করত। হাসত। অভিমান করত। আমি তাকে ফুল দিতেই সে খুশিতে ঝুমঝুম করে ফুল নিয়ে চুলে বাঁধত। কখনও শহরের অলিতে গলিতে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে আমার দস্যি শ্যামলতাটাকে খুঁজে বেড়াতাম। কখনও বা গ্রন্থাগারের ধূলিমাখা বইগুলোতে চেয়ে থাকতাম নির্নিমেষ। আবার কখনও শ্যামলতার বেলীফুলের রাজ্যে আকন্ঠ ডুবে থাকতাম। উল্টেপাল্টে দেখতাম তার ছেলেমানুষী প্রেমপত্র।’
এটুকু বলে থামল আরফান। নম্রতার দিকে ফিরে তাকিয়ে চঞ্চল কন্ঠে বলল,
‘ আপনি কি জানেন? আমি শ্যামলতাকে বিয়ে করে ফেলেছি, আমার কল্পনায়। কল্পনায় সে আমার স্ত্রী।বড় অবাধ্য স্ত্রী। সেদিন আপনি জড়িয়ে ধরার পর থেকে বউ হারিয়ে বিপত্নীক হয়ে গিয়েছি আমি। বউ কল্পনায় হানা দিচ্ছে না। আমার পাশে বসছে না। তার জায়গায় সদর্পে বসে আছেন আপনি। আপনিও বড় অবাধ্য। আর এই বেলীফুলের মালাটাও বড় অবাধ্য। অবাধ্য রমণীটির চুল ছাড়া অন্যকারো চুলে বাঁধা পড়তে তার খুব বেশিই আপত্তি।’
নম্রতা উঠে দাঁড়াল। আরফানের হাতে চিঠির খামটা ধরিয়ে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ বেলীফুলের মালাকে বলে দিবেন, এই অবাধ্য রমণী তাকে গ্রহণ করতে পারছে না। অবাধ্য রমণীর রাজ্যে তীব্র অবরোধ চলছে। যদি কখনও অবরোধ ভেঙে জোয়ার আসে। অভিমান ভেঙেচুড়ে লজ্জা আসে। সেদিন ভেবে দেখা যাবে। ততদিন অপেক্ষা চলুক। বেলীফুলের আজ তীব্র অপেক্ষার দিন।’
কথাটা বলে ফেরার পথে পা বাড়াল নম্রতা। দুয়েক পা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে হাত আঁকড়ে ধরল কেউ। নম্রতা ফিরে তাকানোর আগেই ঘাড়ের কাছে পেল গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ। নম্রতার শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল। নিঃশ্বাস হলো ঘন। কেউ একজন খুব যত্ন করে মালা জড়াল তার চুলে। হাতটা ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ অবাধ্য বেলীফুলের অত ধৈর্য্য নেই অবাধ্য সুন্দরী। অত অপেক্ষা তার সইবে না।’
নম্রতা এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। এই লোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে তার নিশ্চিত মৃত্যু! অনুভূতিময় ভয়ানক মৃত্যু!
#চলবে..
[ রাতের বেলা লিখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। তাই গল্প দিতে দিতে এতো দেরী। যারা রাতে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের জন্য দুঃখিত।]