ইলমা বেহরোজ
গ্রীষ্মের দুপুরে আকাশে সূর্য তার সমস্ত তেজ নিয়ে জ্বলজ্বল করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনালি আভা। সেই সোনামাখা রোদ্দুর জগৎকে এক স্বর্ণময় আবরণে মুড়ে ফেলেছে। গাছপালার পাতাগুলো নিশ্চল, বাতাসও থমকে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের মাটির রাস্তা থেকে উঠছে তপ্ত বাষ্প। এমন দুপুরে, যখন সবাই ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, রাইহা বাগান থেকে ধীরে ধীরে হাঁটছে নাভেদের ঘরের দিকে। তার কপালে জমে উঠেছে ঘামের বিন্দু, গায়ের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে রোদের তাপে। কিন্তু তার মনের মধ্যে যে অস্থিরতা ঘুরপাক খাচ্ছে, তার কাছে এই গ্রীষ্মের দাবদাহ তুচ্ছ। বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই একটু স্বস্তি পেল সে। ছায়ার স্পর্শে তার শরীর জুড়িয়ে গেল। দরজার কাছে পৌঁছতেই দেখা হয়ে যায় বেরিয়ে আসা নাভেদের সঙ্গে। তাকে দেখেই নাভেদ হাসল। সেই হাসিতে নেই কোনো কৃত্রিমতা, শুধুই একটি সরল আন্তরিকতা।
“শুনলাম সুফিয়ান ভূঁইয়া তোমাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন,” নাভেদ বলল, তার কণ্ঠে আন্তরিক খুশি, ” শুনে মনটা ভরে গেল আনন্দে।”
রাইহার চোখে মুখে অস্বস্তির ভাব। সে কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি মনে মনে খারাপ বোধ করছ না? মানে… আমি তোমার নির্ধারিত জায়গায় না গিয়ে…”
নাভেদ বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “আমার খারাপ লাগার কি আছে এতে? বরং আমি তো খুশিই।”
রাইহা এবার একটু জোর দিয়েই বলল, “কিন্তু তুমি যেখানে যেতে বলেছিলে, সেখানে না গিয়ে…”
নাভেদ হেসে উঠল। এবারও তার হাসিতে নেই কোনো কৃত্রিমতা বা অভিমান। বরং সেখানে একটা গভীর বোঝাপড়ার ছাপ, “রাইহা, আমি কি এতটাই স্বার্থপর যে নিজের পছন্দের জায়গায় না যাওয়ায় তোমার ওপর রাগ করব? তোমাকে নতুন জায়গায় পাঠানোর সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল বাধ্য হয়ে। বড় বেগম তোমাকে এখানে থাকতে দিতে চাইছিলেন না, তাই আমাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।”
সে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “তাছাড়া, আমি নিজেও তো সেখানে থাকতে পারতাম না। তোমাকে একাই থাকতে হতো। এখানে তুমি অনেক ভালো থাকবে, তা আমি জানি।”
রাইহা হাসল, “ঠিক তাই। এখানে হয়তো কেউই আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু এই বাড়ি, এই খোলামেলা পরিবেশ, এই গ্রামীণ জীবন… কিছুদিন এখানে কাটিয়ে মনে হচ্ছে আমি এই প্রথম সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছি।”
“আমি বুঝতে পারছি রাই,” নাভেদ বলল, তার কণ্ঠে গভীর সহানুভূতি, “তোমার জীবনটা কখনোই সহজ ছিল না, তাই না? তুমি সারাজীবন তোমার বাবা-মায়ের অহংকারের প্রতীক হিসেবে বেড়ে উঠেছ। কেউ কখনো তোমাকে একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখেনি। সবাই তোমাকে দেখেছে একটা পুরস্কার হিসেবে। যেন তুমি একটা জিতে আনা ট্রফি, যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে, প্রতিযোগিতা করতে পারে কে তোমাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে।”
রাইহা অবাক বিস্ময়ে নাভেদের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটার কি কোনো নেতিবাচক অনুভূতি নেই? শুধুই কি হাসি-খুশি আর বিনয়? সবকিছুই সে বুঝে? নাভেদের প্রতি তার প্রথম যে আকর্ষণ জেগেছিল, সেই অনুভূতি একটি ম্লান আলোর মতো ক্রমশ নিভে আসছে। নাভেদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি আচরণ সুন্দর। একটি নিখুঁতভাবে আঁকা চিত্রের মতো। মানুষের স্বভাবেই থাকে কিছু ত্রুটি, কিছু দুর্বলতা। সেই দুর্বলতাগুলোই তো একজন মানুষকে আরেকজনের কাছে প্রিয় করে তোলে, তাদের মধ্যে একটা আন্তরিক বন্ধন তৈরি করে। একজন মানুষ কি সত্যিই এতটা নিখুঁত হতে পারে? নাভেদকে দেখলে, তার সাথে কথা বললে বা তার আচরণ লক্ষ্য করলে রাইহার মনে এক ধরনের মোহ জাগে। তবে এই মোহ উপরি-চামড়ার মতো, যা তার হৃদয়ের অতল গভীরে পৌঁছায় না। একটি সুন্দর ছবি দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো, চোখ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু প্রাণ স্পর্শ করে না। তারা শুধুই বন্ধু। একজন আদর্শ বন্ধু হিসেবে নাভেদ অতুলনীয়, কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে? সে নিজেও জানে না। হয়তো এই কারণেই সে নাভেদের সঙ্গে চলে যেতে পারেনি। তার মনের কোণে শুধু স্বাধীনতার প্রতি ও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রতি অব্যক্ত আকর্ষণ।
নাভেদের থেকে এই বাড়ি, এই নতুন জীবনের স্বাধীনতা অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। এখানে সে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ পাচ্ছে। জীবনে শুধু নিখুঁততা নয়, প্রয়োজন আছে বৈচিত্র্যের, রহস্যের, এমনকি কিছুটা অনিশ্চয়তারও। এই সবকিছু মিলেই তো গড়ে ওঠে জীবনের পূর্ণতা। আর সেই পূর্ণতার স্বাদ সে পাচ্ছে এই নতুন জীবনে।
“দুঃখিত রাইহা, আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তুমি বুঝতেই পারছ, গম নিতে…”
তার কথার মাঝেই রাইহা দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিল। নাভেদের চোখে চোখ রেখে সে বলল, “নিশ্চয়ই, আমি বুঝতে পারছি তোমার অনেক দায়িত্ব।”
নাভেদ কৃতজ্ঞতার সাথে হাসল। “ধন্যবাদ বোঝার জন্য। আমরা পরে আবার কথা বলব, কেমন?” বলতে বলতে সে তার জামার পকেটে হাত দিয়ে কী যেন খুঁজল। রাইহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, “তুমি যাও, তোমার কাজ সেরে এসো।”
নাভেদ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে। জমিদার বাড়ির বিশাল লোহার গেইটের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়ায়। গ্রীষ্মের দাবদাহে তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। কপালে জমে থাকা ঘামের বিন্দুগুলো রুমাল দিয়ে মুছতেই তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো জমিদার বাড়ির ছাদের দিকে। সেখানে প্রখর রৌদ্রের মাঝে, একটি নারীমূর্তি দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকেও সেই নারীমূর্তিকে চিনতে নাভেদের অসুবিধা হলো না। জুলফাকে দেখার পর তার মনের সকল চিন্তা মুহূর্তেই উবে গেল। আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না তার কাছে। অধীর আগ্রহে সে পা বাড়াল জমিদার বাড়ির দিকে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রথমে নিজের ঘরে গেল, তারপর ধীরে ধীরে এগোল ছাদের দিকে। সন্তর্পণে ছাদের দরজা খুলল নাভেদ। বাইরে তখনও সেই প্রখর রৌদ্র। আর সেই রৌদ্রের মাঝে, একটি নারীমূর্তি। নাভেদ আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তার দিকে।
পায়ের শব্দ কানে আসতেই জুলফা পিছন ফিরে তাকাল। তার চোখে বিস্ময়ের ছায়া। দুপুরের খরতাপে সূর্যের আলো পুড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশ। জুলফার চোখ সংকুচিত করে রাখা। মাথার ঘোমটা একটু নেমে এসে কপালের উপর ছায়া ফেলেছে। হঠাৎ নাভেদকে দেখে তার বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল করে উঠল। মনে হলো যেন বুকের মধ্যে ঝড় উঠেছে।
জুলফা অবাক হয়ে বলল, “আপনি? এখানে?”
নাভেদ মৃদু হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ, আপনাকেই খুঁজছিলাম। কেমন আছেন?”
“ভালো,” জুলফা নিচু স্বরে উত্তর দিল। তারপর একটু থেমে, নিজের মনকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো,” নাভেদের কণ্ঠে একটা অব্যক্ত বেদনা। তার চোখে বিষণ্ণতা। সে ধীরে ধীরে বলল, “আগামীকাল চলে যাচ্ছি।”
জুলফা এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে নাভেদের চলে যাওয়ার কথাই ভাবছিল। সে কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “জানি।”
নাভেদ একটু ইতস্তত করে বলল, “যদি অনুমতি দেন, যাওয়ার আগে আপনাকে কিছু দিতে চাই।”
জুলফার চোখ চকচক করে ওঠে। পেটের ভেতর হাজার প্রজাপতি পাখা মেলে উড়তে শুরু করে। তার কণ্ঠে ফুটে উঠল অবাক কৌতূহল, “আমাকে?”
নাভেদ পকেট থেকে একটি ছোট্ট মখমলের বাক্স বের করে সেটি জুলফার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “এটা আপনার জন্য। একজোড়া কানের দুল।” তারপর একটু থেমে, যেন নিজের মনেই বলল, “আমার সামর্থ্য একজন সাধারণ কর্মচারীর মতোই। তবু আশা করি, এটা পেয়ে আপনি…”
জুলফা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে বাক্সটি নিয়ে নিল। তার চোখে আবেগের জল টলমল করছে। সে দ্রুত বলল, “আমি খুব খুশি হয়েছি।”
নাভেদ মৃদু হেসে বলল, “দেখতে পাচ্ছি।”
জুলফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখতে পাচ্ছেন?”
“আপনার খুশি,” নাভেদ নরম স্বরে জবাব দিল, “আপনার চোখের জল।”
জুলফা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল। তার গাল টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে। নাভেদ একটু হেসে বলল, “আপনাকে আমার সারাজীবন মনে থাকবে। যেমন করে আকাশে থাকে তারা, সমুদ্রে থাকে ঢেউ, আর বসন্তে থাকে ফুলের সুবাস।”
জুলফা সাহস সঞ্চয় করে নাভেদের গভীর চোখের দিকে তাকাল। তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে, যেন একটি অশান্ত পাখি খাঁচার মধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে, তবুও সে কষ্টে স্বর বের করে বলল, “আমারও মনে থাকবে।”
নাভেদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে, কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন এমনভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “সবচেয়ে মনে থাকবে সেদিন রাতের ঘোড়া দৌড়ের স্মৃতি।” তারপর ঈষৎ কৌতুক মিশ্রিত হাসি ফুটিয়ে বলল, “কিন্তু বলুন তো, হঠাৎ করে জ্ঞান হারালেন কেন? খুব ভয় পেয়েছিলেন?”
জুলফার মুখজুড়ে লজ্জায় গোলাপি আভা ধারণ করে। সে দৃষ্টি নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “তা নয়। সত্য বলতে, আমার অন্তরে চিরদিনই একটি গোপন বাসনা ছিল ঘোড়ার পিঠে চড়ে মুক্ত বাতাসে ছুটে বেড়ানোর। কিন্তু সেদিন, শারীরিক দুর্বলতার কারণে…”
নাভেদ জুলফার কণ্ঠস্বরের কোমলতা ও ভঙ্গুরতা অনুভব করে। এই নাজুক মুহূর্তটিকে আরও গভীর করে তুলতে সে সাহস করে একটু এগিয়ে গিয়ে, কিন্তু যথেষ্ট সম্মান বজায় রেখে বলল, “আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, তবে আমি আপনার সেই অপূর্ণ ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করতে পারি।”
জুলফা বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকাল।
নাভেদ, জুলফার প্রতিক্রিয়া দেখে উৎসাহিত হয়ে, আরও বিস্তারিতভাবে বলতে লাগল, “এই গ্রামের শেষ সীমায় একটি বিশাল হাওর আছে, যা প্রায় সতেরো মাইল বিস্তৃত। সেই হাওরের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রায় দুইশো ফুট নিচে ছুটে চলা পুষ্পনদীকে। এর প্রবল স্রোতের শক্তি এতটাই প্রচণ্ড যে, অভিজ্ঞ সাঁতারুরাও এর সামনে অসহায়। বড় বড় নৌকাগুলোও এর তীব্রতায় টালমাটাল অবস্থায় পড়ে যায়। আপনি কি কখনো এই অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেছেন?”
“না।” জুলফার কণ্ঠে উত্তেজনা।
নাভেদ জুলফার চোখে প্রকৃতিকে জানার তৃষ্ণা দেখতে পায়। সে আশকারা পেয়ে আবেগভরে বলল, “আগামীকাল সেখানে যাচ্ছি। আপনি যদি আমার সঙ্গী হন, তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।”
জুলফার চোখে মুহূর্তের জন্য একটা চমক খেলে যায়। সেইসাথে বুকের ভেতর শুরু হয় ঝড়ের তাণ্ডব। একদিকে সামাজিক বাধা, অন্যদিকে হৃদয়ের টান। তার চোখ নিচু হয়ে এল বটে, কিন্তু সেই নিচু চোখেও ছিল একটি গোপন সম্মতি।
জুলফার সম্মতি বুঝতে পেরে নাভেদের ঠোঁটেও দেখা গেল হাসির রেখা। চোখে ফুটিয়ে তুলল আবেগময় দৃষ্টি, যা জুলফার হৃদয়ে স্পন্দন জাগাল। নাভেদ মৃদু স্বরে বলল, “কাল ভোরে যখন সূর্যের প্রথম আলো বনে এসে পড়বে, আমি সেখানে থাকব। আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আপনি যদি আসেন, সেই মুহূর্তটি হয়ে উঠবে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল। আর যদি না আসেন, তবুও আমার স্মৃতিতে থেকে যাবে আপনার এই মুখখানি,”
তারপর একটু থেমে, আরও নরম স্বরে বলল, “আপনার মনের শান্তিই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। নিজের যত্ন নেবেন। আপনার প্রতিটি মুহূর্ত যেন সুখে ভরে থাকে।”
কথা শেষ করেই নাভেদ নিচে নেমে গেল।
অনেক দিন ধরে অন্তরে জমা হয়ে থাকা চাপা অভিমানগুলো আজ একটু একটু করে গলে যাচ্ছে ললিতার মনের কোণ থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে বাগানের দিকে, যেখানে রাইহা ছুটোছুটি করছে খামারের দুটো বাচ্চার সঙ্গে। তার নীল চোখে শিশুসুলভ আনন্দের ঝিলিক, যা দেখলে যে কারও মন ভরে যাবে। ললিতার মনে পড়ছে গত দিনগুলোর কথা, যখন সে ভেবেছিল এই তরুণীই জাওয়াদকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। প্রতিটি দিন যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল, যেখানে সে লড়াই করেছে একজন অজানা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। জাওয়াদের প্রতিটি বিরক্তিকর আচরণ, প্রতিটি উদাসীন দৃষ্টি তাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল সেই ধারণায়, রাইহাই তার ছেলেকে পরিবর্তন করেছে। তাদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে! কিন্তু আজ সত্যের মুখোমুখি হয়ে ললিতা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। জাওয়াদ আর রাইহা তো মাত্র কয়েকদিন আগে পরিচিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অনুরোধে জাওয়াদ তার বোনকে আশ্রয় দিয়েছে, এই-ই হচ্ছে আসল সত্য। এখন যখন সে রাইহাকে নতুন চোখে দেখছে, তখন দেখতে পাচ্ছে একজন আধুনিক, স্বাধীনচেতা তরুণীকে, যার সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক নয়, আত্মিকও। তার হাসি সকাল বেলার সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল, আর তার চঞ্চলতা এমনই প্রাণবন্ত যে তা যে কারও মন জয় করে নিতে সক্ষম। এমন একজন রূপবতী মেয়েকেই তো সব মা তার পুত্রবধূ হিসেবে কামনা করে। শুধু মেয়েটার মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির অভাব। তবুও ললিতার হৃদয়ে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। সে বুঝতে পারছে, কখনও কখনও আমরা যাকে শত্রু ভাবি, সে হয়তো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার হতে পারে। ললিতার মনে হঠাৎ একটা খেয়াল জাগল। রাইহাকে নিজের কয়েকটা শাড়ি উপহার দেবে সে, আর শেখাবে কীভাবে শাড়ি পরতে হয়। এই ভেবে উচ্ছ্বসিত মনে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল সিঁড়ির দিকে। ছাদ থেকে ধীর পদক্ষেপে নেমে আসছে তাদের অতিথি নাভেদ পাটোয়ারী। অতিথিদের তো খাসমহলের ছাদে যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে কেন নাভেদ সেখানে গিয়েছিল? তার বিস্ময় আরও গভীর হলো যখন দেখল, নাভেদের পর জুলফাও সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। জুলফার মুখে এক রহস্যময় হাসি, যেন কোনো গোপন আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে তার ঠোঁটের কোণে। চোখেও একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ