ইলমা বেহরোজ
পর্ব ২৪
বারান্দার পূব কোণে সুফিয়ান ভুইয়া তার পুরনো কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। পাশের চেয়ারে স্ত্রী ললিতা। সামনে বিস্তীর্ণ আম বাগান। গাছের মাথায় মাথায় পাখিদের কলতান। বাতাসে পাকা আমের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে।
সুফিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখে-মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “নাভেদ আজ চলে গেল। সকাল থেকে মনটা কেমন খচখচ করছে।”
ললিতা স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। মানুষটার চোখে-মুখে যে বিষণ্নতা, তা সেও অনুভব করছে। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “কেন? এত মন খারাপ কেন?”
সুফিয়ান চেয়ার থেকে সোজা হয়ে বসলেন, “এই নয় দিনে ছেলেটা যে কী উপকার করে গেল! শব্দর শহরে চলে যাওয়ার পর থেকে হিসাবপত্র নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তখনই দেবদূতের মতো এসে হাজির হলো ও।”
“ছোট ভাই তো যাওয়ার আগেই বলেছিল, হিসাবপত্র দেখার জন্য বিশ্বস্ত লোক খুঁজে নিতে।”
“খোঁজার দরকারই হয়নি।” সুফিয়ানের চোখে উজ্জ্বলতা, “নাভেদ নিজে থেকেই এগিয়ে আসে। প্রথম দিনেই ধরে ফেলে গমের সাপ্লায়ারদের কারসাজি। দেখো কাণ্ড! প্রতি বস্তায় দুই কেজি করে কম ওজন। হিসাব করে দেখাল প্রতি মাসে কত হাজার টাকা ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটা সাপ্লায়ারের একটা খতিয়ান বানিয়েও ফেলল।”
পাশের টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলে নিয়ে একচুমুক খেলেন। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন, “শব্দরের সঙ্গে যদি নাভেদের মতো একজন হিসাবরক্ষক থাকত! ওর ব্যবসায়িক প্রতিভা আর নাভেদের হিসাবের দক্ষতা এই দুটো মিললে আমাদের ব্যবসা আজ আকাশচুম্বী হতো। শব্দর অসাধারণ মেধাবী, ও বড় বড় ডিল করতে পারে, নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে পারে। নাভেদের মতো একজন যদি পেছন থেকে হিসাবপত্র সামলাত…”
ললিতা নীরবে শুনে যাচ্ছিল। স্বামীর কথার মাঝে বাধা দিল না।
সুফিয়ানের চোখে তখন উৎসাহের দীপ্তি, “তুমি দেখোনি, ছেলেটা কীভাবে কাজ করত? ভোর পাঁচটায় উঠে মজুরদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের সমস্যা শোনা। পুরনো খাতাপত্র ঘেঁটে বের করে আনল কত টাকা বাকি পড়ে আছে। শহর থেকে নতুন রেজিস্টার কিনে এনে হিসাবের একটা আধুনিক পদ্ধতিও চালু করেছে। শুধু কি তাই? প্রতিটা আম গাছের হিসাব নিয়ে এল। কত ফলন হবে, কোন বাগানে কী সমস্যা, সব কিছু খতিয়ে দেখেছে।”
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুফিয়ান, “আমাদের জাওয়াদ যদি ওরকম হতো! মাত্র নয় দিনে নাভেদ আমার মন জয় করে নিয়েছে! মাঠের ফসলের হিসাব থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রির হিসাব, সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে গেছে। শব্দরের অভাব টের পেতে দেয়নি। আশিক পাটোয়ারী কী ভাগ্যবান দেখো, নিজের সন্তান না হয়েও এমন একটা রত্ন পেয়ে গেছেন। আমার লোকজন মাসের পর মাস যা করতে পারে না…”
ললিতা স্বামীর কথার মাঝে বাধা দিলেন। আশার সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “ছোট ভাই ফিরে এলে একবার কথা বলবে ওর সঙ্গে?”
“কী বলব!” সুফিয়ান মাথা নাড়লেন। চোখে-মুখে হতাশা, “নাভেদের তো নিজের পথ আছে। নিজের বাবার ব্যবসা আছে।” তিনি থামলেন, আবার বললেন, “শব্দর যদি নাভেদের মতো একজন সঙ্গী পেত, কত দূর যেতে পারত ও। শুধু জ্ঞান নয়, কী সততা ছেলেটার মধ্যে। টাকা-পয়সার হিসাবে এক পয়সারও গরমিল রাখেনি। নিজের ব্যবসার মতো প্রতিটা কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে।”
বৈশাখী সূর্য তখন মাথার ওপর। গরম বাড়ছে। আম গাছের পাতায় পাতায় রোদের নাচন। সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। মনে মনে ভাবলেন, তার ছেলে জাওয়াদ যেন একদিন নাভেদের মতো হয়ে ওঠে। তারপর শব্দরের সঙ্গে মিলে ব্যবসার হাল ধরবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি সত্যি হবে? জাওয়াদের মধ্যে তো সেই আগ্রহ নেই। এই ভাবনা শুধুই আকাশকুসুম!
নাভেদ ঘোড়ার লাগাম আলতো করে ধরে নিয়ে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে। দুপুরের খরতপ্ত রোদ দুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সিল্কের পকেট রুমালটি বের করে নাভেদ জুলফার দিকে বাড়িয়ে দিল, তার চোখে একটু দ্বিধা, একটু অনুনয়।
“আপনার কপালে ঘাম জমেছে। মুছে ফেলুন।”
জুলফার ঠোঁটের কোণে একটু চতুর হাসি। শাড়ির আঁচলটা তুলে নিজের কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, “রুমালটা আপনারই থাক। আপনারও তো দরকার।”
নাভেদ রুমালটি দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মোছার ছলে একবার চোখ তুলল। দুজনের দৃষ্টি মিলল সেই মুহূর্তে। জুলফার বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকায়।
“আজ হঠাৎ করে আম্মার কথা মনে পড়ছে।”
“আপনার আম্মার?” জুলফার কণ্ঠে বিস্ময়।
“হুম। আপনাকে দেখলেই মাঝে মাঝে আম্মার কথা মনে পড়ে যায়। আপনার চোখের দৃষ্টি, মুখের হাসি সব একই ছাঁচে গড়া।”
জুলফা মাথা নিচু করে হাঁটছে। তার মুখের আদলে একটা মৃদু হাসি লুকিয়ে, যা চোখের কোণে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে।
“আম্মা খুব ভালো রান্না করতেন,” নাভেদ বলল, “বিশেষ করে বিরিয়ানি। আপনার হাতের বিরিয়ানির গন্ধও ঠিক তেমনি।”
“আপনি কী করে জানলেন আমি বিরিয়ানি রাঁধতে পারি?”
“গত শুক্রবার ঘরে যে বিরিয়ানি এসেছিল, সেটা যে আপনার হাতের রান্না এটা আমি জানি।”
জুলফা অবাক হয়ে তাকাল, “কে বলল আপনাকে?”
“কেউ বলেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মায়ের মতো একই যত্ন, একই ভালোবাসা ছিল সেই রান্নায়।”
জুলফার হৃদয়ে একটা মিষ্টি শিহরণ খেলে যায়। সে শঙ্খিনীকে দিয়ে বিরিয়ানি পাঠিয়েছিল! নাভেদ কীভাবে এত সহজে বুঝে গেল? দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল। ঘোড়াটা মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ছে।
“আপনার আম্মার মতো দেখতে হওয়াটা ভালো না খারাপ?” জুলফা শেষে সাহস করে জিজ্ঞেস করে। তার কণ্ঠে একটু কম্পন।
নাভেদ থমকে দাঁড়ায়। জুলফার দিকে ফিরে তাকিয়ে, তার গভীর চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলল, “আম্মা ছিলেন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।”
দুজনেই আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর এগিয়ে তারা ঘোড়ায় চড়ে বসে। দুপুরের সূর্যের উত্তাপ মাথায় নিয়ে ঘোড়া ছুটে চলে নিবিড় বনের দিকে।
বনের শেষ প্রান্তে এসে ঘোড়াটি থামে। দূরে জমিদার বাড়ির দালান-কোঠা দেখা যাচ্ছে। জুলফার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“এখান থেকে ফিরে যেতে হবে,” জুলফা আস্তে করে বলল।
নাভেদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “কিছু জিনিস বলা হয় না বলেই হয়তো বেশি সুন্দর থাকে।”
জুলফার চোখ ছলছল করছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল, “কিছু কিছু ভালোবাসা শুধু মনেই রেখে দিতে হয়। তাই না?”
“হ্যাঁ,” নাভেদের কণ্ঠ ভারী, “কখনো কখনো নীরবতাই সবচেয়ে বড় কথা হয়ে ওঠে।”
জুলফা ঘোড়া থেকে নামতে গিয়ে পা হড়কে গেলে নাভেদ দ্রুত তাকে ধরে ফেলল। মুহূর্তের জন্য দুজনের চোখাচোখি হয়। জুলফা তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায়।
“মাফ করবেন,” নাভেদ পেছনে সরে যায়।
জুলফা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বলল, “আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এত দূর…”
“কষ্ট?” নাভেদ মৃদু হেসে বলল, “আম্মা বলতেন, যার জন্য করা যায়, তার জন্য কোনো কিছুই কষ্ট নয়।”
আবারও থমথমে নীরবতা নেমে আসে। দূরের আকাশে সূর্য ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে।
হঠাৎ করেই জুলফা বলে উঠল, “জীবন এমন কেন? যাকে অন্তর দিয়ে চাই, তাকে কখনোই পাই না। আর যাকে পেয়ে যাই, তার প্রতি মনে কোনো টান থাকে না।”
নাভেদ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “আর যাকে পেতে চাই, সে অন্যের হয়ে যায়।”
বুক থমকে গেল জুলফার। সে চমকে তাকাল নাভেদের দিকে, “কী বললেন আপনি?”
“না, কিছু না। শুধু ভাবছিলাম, জীবনে কত কিছুই যে অধরা থেকে যায়। ঠিক যেমন…” নাভেদ আঙুল তুলে দেখাল, “যেমন আকাশের ওই শেষ সোনালি আভাটুকু।”
জুলফা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু সূর্য তো রোজই ডোবে, আবার ওঠে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু প্রতিদিনের সূর্যাস্ত কি একই রকম হয়? আজকের এই মুহূর্তটা, এই আলো-আঁধার, এই বাতাস… এসব কি আর কখনো ঠিক একইভাবে ফিরে আসবে?”
জুলফার চোখ ছলছল করে উঠল। একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গালে। “কেন এমন করে কথা বলেন? কেন…”
“কেন কী?” নাভেদ আরও কাছে সরে এল।
জুলফার বুক ধড়ফড় করছে। সে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “কেন এভাবে মনটাকে এত ব্যথা দেন?”
“আমার কথায় আপনার মনে ব্যথা লাগে?”
জুলফা চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, “যার কথায় ব্যথা লাগে, তার কাছে কি তা বলা যায়?”
“তবে কার কাছে বলবেন?”
“হয়তো কারও কাছেই না। হয়তো এই নির্জন বনের গাছপালার কাছে।”
জুলফা দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। সে বুঝতে পারছে যে তার হৃদয়ের দরজা খুলে যাচ্ছে নাভেদের কাছে। দ্রুত নিজেকে সংযত করে বলল, “অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমাকে এখন যেতে হবে।”
নাভেদ ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, “সামনে দেখা হলে চিনতে পারব তো?”
“আপনি তো বললেন, আমি আপনার আম্মার মতো। তাহলে চিনতে অসুবিধা হবে কেন?” জুলফা চেষ্টা করল হালকা হতে।
“সত্যি। প্রিয় মানুষদের চিনতে কখনো ভুল হয় না।”
এ কথায় জুলফার বুক কেঁপে ওঠে। সে কি নাভেদের প্রিয়? নাকি শুধুই মায়ের মতো বলে এমন করে বলল? তার মনে প্রশ্নের ঝড়। সে জমিদার বাড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যার শেষ আলোয় দালানটা রক্তিম আভায় জ্বলজ্বল করছে।
“আল্লাহ হাফেজ,” জুলফা প্রায় ফিসফিস করে বলল।
“আল্লাহ হাফেজ,” নাভেদ জবাব দিল। তারপর যোগ করল, “জানেন, আম্মা বলতেন, বিদায় বলার সময় কখনো ‘বিদায়’ বলা উচিত নয়।”
“কেন?”
“কারণ যারা সত্যি আপনার, তারা কখনো বিদায় নেয় না। তারা শুধু একটু দূরে সরে যায়।”
জুলফা আর দাঁড়াতে পারল না। তার বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে সামনের পথ। সে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল জমিদার বাড়ির দিকে। কানে বাজতে লাগল নাভেদের শেষ কথাগুলো।
নাভেদ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ দুটি স্থির, নিষ্পলক। জুলফার ছায়ামূর্তি যতক্ষণ না মিলিয়ে গেল সন্ধ্যার আঁধারে, ততক্ষণ। তারপর… কোনো যাদুকরের ছড়ির স্পর্শে, এক মুহূর্তে বদলে গেল তার সমগ্র অস্তিত্ব। সেই নরম, কোমল মুখমণ্ডল থেকে খসে পড়ল ভদ্রতার মুখোশ। চোখের করুণ দৃষ্টি মুছে গিয়ে ফুটে উঠলহিংস্র দীপ্তি। ঠোঁটের কোণে জমে উঠল বিদ্রূপের হাসি।
“কী বোকা এই মেয়ে!” সে বনের নিস্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে হেসে উঠল। তার কণ্ঠে ঝরে পড়ছে তীব্র বিদ্রূপ, “নিজের বিয়ে না দেখেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নিয়েছে যে তার বিয়ে হয়ে গেছে!”
না, সে কখনোই এই সন্দেহের বীজ জুলফার মনে অঙ্কুরিত হতে দেবে না। তাই তো নদীর পাড়ে যখন জুলফা বিয়ের কথা তুলেছিল, তখন সে কৌশলে কথাটা এড়িয়ে গেছে। কথা বাড়লে হয়তো জুলফার মনে সন্দেহ জাগতে পারত।
তবে একটা চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যদি জুলফা সত্যিই শব্দর ভূঁইয়ার বৈধ স্ত্রী না হয়, তাহলে তার পুরো পরিকল্পনাটাই তো ভেস্তে যাবে। জুলফাকে দিয়ে আর কোনো লাভই হবে না তার। শব্দর ভূঁইয়ার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার যে স্বপ্ন সে মনে পুষে এসেছে, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
নাভেদ চিন্তায় পড়ে যায়। যদি শব্দর ভূঁইয়া জেনেশুনেই এই খেলা খেলে থাকে? যদি সে জুলফাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকারই না করে? তাহলে তো জুলফাকে দিয়ে তার কোনো উপকারই হবে না। না, আর সময় নষ্ট করা যাবে না। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো সেই রহস্যময় বিয়ের রাতের সত্য উদ্ঘাটন করা।
কে এই প্রতারণার পেছনে কে? শব্দর ভূঁইয়া? নাকি জুলফার বেদে পরিবার, যারা হয়তো কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই খেলায় মেতেছে?
চলবে…