ইলমা বেহরোজ
সকাল থেকেই জাওয়াদের মন অস্থির। বারান্দার চেয়ারে বসে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কখনো উঠে পায়চারি করছে, কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের পথের দিকে তাকিয়ে থাকছে। মনির কবে আসবে, কী খবর নিয়ে আসবে এই চিন্তায় ধুকপুক করছে বুক।
সন্ধ্যার আবছা আলোয় অবশেষে মনিরকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখে জাওয়াদ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। মনিরের মুখে বিষাদের ছায়া। তার চোখেমুখে এমন একটা ভয়ার্ত ভাব যে জাওয়াদের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল।
মনির বিনীত ভঙ্গিতে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।
জাওয়াদ বলল, “কি খবর এসেছিস?”
মনির কিছুক্ষণ নীরব থেকে, মাথা নিচু করে থাকল।
“হুজুর…” মনিরের গলা ভারী, “কিছু সত্য এমন হয় যা না জানাই ভালো। মানুষের জীবনে কিছু অন্ধকার থাকে যা আলোয় এনে দেখার সাহস…”
জাওয়াদ ধৈর্য হারিয়ে বলল, “আসল কথা বল।”
“হুজুর, আপনি তো জানেন গুলনূরের জীবনের কাহিনী। জন্মের আগেই বাবাকে হারানো, পাঁচ বছরে মায়ের মৃত্যু। মামা-মামির বাড়িতে আশ্রয় পেলেও সেখানে পেয়েছে শুধু অবহেলা আর লাঞ্ছনা। দাসীর চেয়েও অধম জীবন…”
“এসব তো জানি,” জাওয়াদ অধীর হয়ে বলল, “নতুন কি জেনেছিস, সেটা বল।”
মনির চোখ বন্ধ করল। তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ। নিজেকে প্রস্তুত করছে একটা ভয়ংকর সত্য উচ্চারণ করার জন্য।
“হুজুর…” মনিরের গলা কাঁপছে, “ষোল বছর বয়সে… একদিন বিকেলে…” সে থেমে গেল।
জাওয়াদের মুখ শুকিয়ে গেল। চোখে আতঙ্ক।
“বল,”
“গুলনূর সন্ধ্যাবেলা, পুকুরঘাটে কাপড় কাচতে গিয়েছিল..হঠাৎ করে…” মনিরের কথা আটকে গেল গলায়।
মনির থেমে থেমে বলতে লাগল, “হুজুর, গ্রামের মোড়ল কামাল সাহেবের ছেলে…সেই শয়তান… মাতাল অবস্থায় এসে জোর করে তুলে নিয়ে যায় গুলনূরকে।” মনিরের চোখ সজল হয়ে উঠল।
জাওয়াদ পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। তার মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাতের আঙুলগুলো অজান্তেই মুঠো হয়ে উঠল।
মনির আবার বলতে শুরু করল, “গুলনূর চিৎকার করেছিল, প্রতিরোধ করেছিল… কিন্তু কে শুনবে? মোড়লের ছেলের বিরুদ্ধে কার সাহস? সেই রাতে শুধু ওর সতীত্বই নয় হুজুর, ওর কণ্ঠস্বরও কেড়ে নিয়েছিল ওই পাষণ্ড। প্রতিরোধ করতে গিয়ে মাথায় এমন আঘাত পেয়েছিল যে…” মনির কথা শেষ করতে পারল না। চোখ দুটি আবার ভিজে উঠল।
জাওয়াদের চোখের সামনে ভেসে উঠল গুলনূরের নীরব মুখ। যে মুখে কখনো হাসি ফোটে না, শুধু একটা গভীর বেদনার ছায়া লেগে থাকে। আজ সেই বেদনার উৎস জেনে তার বুকের ভেতরটাও যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
“কেউ প্রতিবাদ করেনি? পুলিশে খবর দেয়নি?”
মনির মাথা নেড়ে বলল, “সমাজের চোখে মেয়েদের সম্মান শুধু বিয়ের যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হয় হুজুর। মামা-মামি ভেবেছিলেন এই ঘটনা চেপে গেলে হয়তো একদিন গুলনূরের জীবনে সুখ ফিরে আসবে। কিন্তু কোথায় কার মুখে যে কথাটা বেরিয়ে গেল… গ্রামের মানুষ তো আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারে না।”
“আর ওই…ওই হারামজাদা এখন কোথায়?” জাওয়াদের গলায় প্রতিহিংসার আগুন।
“আল্লাহর বিচার কখন কীভাবে হয়, কেউ বলতে পারে না হুজুর। যে মদ খেয়ে গুলনূরের জীবনটাকে অন্ধকারে ঢেকে দিল, সেই মদই ওর কাল হয়েছে। নেশার ঘোরে একদিন রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে থাকতে মরে গেছে।”
জাওয়াদ চুপ করে রইল। বাইরে তখন সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাড়ির দাসীরা একে একে জ্বালিয়ে দিচ্ছে কেরোসিনের প্রদীপগুলো।
জুলফা সুরঙ্গের মুখ থেকে বেরিয়েই থমকে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়িয়ে ললিতা।
শঙ্খিনী সারাদিন ধরে কত কৌশলই না করেছে জুলফাকে বাঁচাতে। কখনো বলেছে জুলফা জ্বরে ভুগছে, কখনো বলেছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নানা অজুহাত দিয়ে ঢেকেছে জুলফার অনুপস্থিতি। কিন্তু ললিতার তীক্ষ্ণ নজর এড়াতে পারেনি।
“কোথায় ছিলে সারাদিন?” ললিতার কণ্ঠস্বরে বরফের মতো ঠাণ্ডা কাঠিন্য।
ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল জুলফার সমস্ত শরীর। মনে হলো পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতের কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল।
“কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে? কোনো ব্যবসায়ী নাকি?”
জুলফার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে দুরু দুরু করে উঠল। ব্যবসায়ী বলতে কি নাভেদকে বোঝাচ্ছে? কী করে জানল? কে দেখল তাকে? নাকি এটা শুধুই একটা অনুমান? হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল মাথার ভেতর।
“এতো সাজগোজ! এতো আয়োজন, কার জন্য?” ললিতার কথায় ঝরে পড়ল তীব্র বিদ্রূপ।
ঠিক তখনই জুলফার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠল সকালের সেই দৃশ্য। সুরঙ্গের অন্ধকারে ললিতার গোপন সাক্ষাৎ। কালো পোশাকে ঢাকা এক রহস্যময় মানুষের সঙ্গে ফিসফিসানি। তান্ত্রিকের সঙ্গে গুপ্ত পরামর্শ।
চোখ-মুখের ভয়ার্ত ভাব মুহূর্তেই পালটে গেল। এবার সে-ই আক্রমণের ভঙ্গিতে। চোখের দৃষ্টি শক্ত করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “সকালে সুরঙ্গের ভেতর কার সাথে কথা বলছিলেন, ভাবি?”
ললিতার মুখের রং পাণ্ডুর হয়ে গেল। চোখদুটো বিস্ফারিত হলো মুহূর্তের জন্য। কালো পোশাকের সেই মানুষটির কথা মনে পড়তেই তার শরীর হিম হয়ে গেল। নিজের গোপন রহস্য ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল ললিতা।
নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কী বলছ তুমি? কী দেখেছ?”
জুলফার ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে একটি বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে আত্মবিশ্বাসের আলো। সেই আলোয় ললিতার অহংকারী মুখোশ ক্রমশ গলে যেতে লাগল।
“অনেক কিছু দেখেছি ভাবি! শুধু দেখিনি, শুনেছিও। তান্ত্রিকের সঙ্গে…”
ললিতা এক পা এগিয়ে এল। তার চোখে এখন জ্বলন্ত আগুন। হাতের আঙুলগুলো অজান্তেই মুঠো হয়ে গেল, যেন কারও গলা টিপে ধরার জন্য প্রস্তুত, “সাবধান জুলফা! তোমার জিভটা—”
“আমার জিভ?” জুলফা এবার স্পষ্ট হেসে উঠল। তার হাসিতে বিদ্রূপ, “আপনার মতই আমারও অনেক রহস্য আছে ভাবি। আপনি যদি আমার কথা কারও কাছে বলেন, আমিও বলব। তখন দেখা যাবে কার অবস্থা কেমন হয়।”
দুজনের চোখে চোখ পড়ল। সেই দৃষ্টি মিলনে ছিল না কোনো ভয়, শুধু ছিল এক নীরব যুদ্ধের ঘোষণা। দুজনেই জানে, তাদের প্রত্যেকের কাছে এমন গোপন তথ্য আছে যা প্রকাশ হলে দুজনের জীবনই ওলট-পালট হয়ে যাবে।
ললিতার মনে হলো, এই মুহূর্তে সে একটি ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেও তো কম নয়। তার চোখেও জ্বলছে সেই একই প্রতিশোধের আগুন।
“তুমি ভেবেছ তুমি জিতে গেছ?”
জুলফা মাথা নাড়ল। তার ঠোঁটের কোণে খেলা করতে লাগল হাসি।
“না ভাবি,” সে বলল, তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। “আমি শুধু বুঝিয়ে দিতে চাইছি যে আমরা এখন সমান সমান। আপনি আমার রহস্য জানেন, আমি আপনার রহস্য জানি। এখন থেকে আমরা দুজনেই দুজনের কাছে বন্দী।”
জুলফার কথাগুলো তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বিঁধল ললিতার বুকে। এই কঠোর সত্যটা এড়ানোর উপায় নেই। এখন থেকে তারা দুজনেই একে অপরের কাছে বন্দী। একজন আরেকজনের সর্বনাশ করতে পারে, এই বোধটা দুজনকেই গ্রাস করে ফেলল।
জুলফা তার কালো ঘন চুলগুলো কাঁধে এনে নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত বুলোতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি, এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “যাই গোসলে যাই, একটু চুলের যত্ন করি।”
ললিতা দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। তার চোখের সামনে দিয়ে জুলফা বেরিয়ে গেল দুলতে দুলতে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাজছিল জয়ের সুর। সেই শব্দ যেন ললিতার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল – টং… টং… টং… প্রতিটি শব্দ তার পরাজয়ের ঘণ্টাধ্বনি।
রাতের আকাশে একে একে জ্বলে উঠছে নক্ষত্রের দীপমালা। কালো মখমলের মতো আকাশের গায়ে যেন কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে রূপোর কুচি। জাওয়াদ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এই পৃথিবীর বুকে কত না অবিচার, কত না নীরব আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। কিন্তু সময় তার নিজের ছন্দে বয়ে চলে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা সব কিছুকে পিছনে ফেলে।
সন্ধ্যা থেকে তার বুকের ভেতরটা টনটন করছে। কী করুণ নিয়তি গুলনূরের! জীবনে একটুও ভালোবাসা পায়নি মেয়েটা। সে নিজে একটা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে দিনের পর দিন ছটফট করছে। সেখানে গুলনূর? তার তো জীবনটাই শুরু হয়েছিল অন্ধকারের হাত ধরে। জন্ম থেকেই শুধু কষ্ট, যন্ত্রণা, অত্যাচার… তারপর সেই ভয়াবহ রাতে… জাওয়াদের বুক শিউরে উঠল। একজন নারীর সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?
কী করে বেঁচে আছে গুলনূর এত স্মৃতি নিয়ে? প্রতিটা রাত যখন আসে, তখন কি সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো ফিরে আসে? নাকি এতদিনে স্মৃতির দংশন কিছুটা কমে এসেছে? না, গুলনূরের চোখে যে বেদনার ছায়া, তা বলে দেয়, সময় কখনও কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে না। শুধু মানুষ শিখে যায় যন্ত্রণার সঙ্গে বাঁচতে।
জাওয়াদের হাত দুটো অসহায়ভাবে মুঠো হয়ে এল। কী করে সে সাহায্য করবে গুলনূরকে? কীভাবে মুছে দেবে তার জীবন থেকে এই কালো অধ্যায়? তার বড্ড ইচ্ছে করছে গুলনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, যেমন করে মা সান্ত্বনা দেন তার কষ্টে কাতর সন্তানকে।
চলবে…