সন্ধ্যার আলো-আঁধারি মুহূর্তে, জমিদার বাড়ির প্রাচীন অট্টালিকা এক রহস্যময় সৌন্দর্যে মোড়া। আকাশের বুকে লাল-কমলা রঙের আঁচড়। বাগানের ফুলগুলো ধীরে ধীরে পাপড়ি মুড়ে নিচ্ছে, দিনের শেষে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে। তাদের মিষ্টি সুবাস হাওয়ায় ভেসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, মন মাতানো এক অনুভূতি জাগিয়ে।
এই মনোরম পরিবেশের মাঝে, বাড়ির উপরের ঘরে, জানালার পাশে একা বসে আছে জুলফা। তার চোখে জমে থাকা অশ্রু তার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়েছে। মনের ভেতর চলছে এক তুমুল ঝড়। বাইরে পাখিরা দিনের শেষে নীড়ে ফেরার পালা। তাদের কলতান দিনের সমাপ্তির সুর বাজাচ্ছে। কিন্তু জুলফার অন্তরে সেই সুরের কোনো প্রতিধ্বনি নেই। তার মনে কোনো শান্তি নেই, বরং আছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। সে যেন এক অদৃশ্য পিঞ্জরে বন্দি, যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই।
প্রতিটি মুহূর্তে জুলফার মন কেঁদে উঠছে। সে মনে মনে কাতর প্রার্থনা করে, “হে আল্লাহ, কেন আমাকে এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করলে? কোন পথে হাঁটব আমি?”
বাইরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার নীলাভ আঁধার নেমে আসছে। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু করুণ গুঞ্জন। জুলফার মনও সেই সুরের মতো বিষণ্ণ ও অস্থির। নিচের অতিথি ঘরে রয়েছে নাভেদ – তার যৌবনের স্বপ্নপুরুষ। সেই বাবরি চুল, সেই মোহনীয় হাসি সব কিছু কত স্পষ্ট তার স্মৃতিপটে। সে নিচে নামতে ভয় পাচ্ছে, পাছে নাভেদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে পড়ে। নাভেদের সান্নিধ্যে গেলে তার সমস্ত সংযম ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
“না, আমি নিচে যাব না,” জুলফা দৃঢ়কণ্ঠে নিজেকে বলল। “রান্নাঘরেও পা বাড়াব না। এই ঘরেই থাকব, যতদিন না উনি বিদায় নেন।”
দিনের পর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। জুলফার অদ্ভুত আচরণে বাড়ির সবাই বিব্রত, বিশেষ করে ললিতা। তিন দিন ধরে জুলফা নিজের ঘর আর বারান্দার গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ।
তৃতীয় দিনের সকালে, সূর্যের আলো যখন বাড়ির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন হঠাৎ ললিতার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে এল। তার গলায় ক্ষোভ আর বিরক্তি স্পষ্ট, “আরে ও জমিদার বউ! এত বড় একটা বাড়ির কর্ত্রী হয়ে এভাবে ঘরকোণে লুকিয়ে থাকা কি সাজে? নামো, নামো শিগগির! রান্নাঘরে এসো। চোখ কানা নাকি? দেখছ না বাড়িতে অতিথি এসেছেন?”
জুলফা নিস্তব্ধ। যেন ললিতার কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে গেল, তার কানে পৌঁছল না। ললিতাও সহজে হার মানার পাত্রী নয়। সে আরও জোর গলায় বলতে থাকে, “বাহ্! দেখো তো কেমন নখরা করছে! মনে হচ্ছে কোন রাজকুমারী এসে বসে আছে! শোনো মেয়ে, তোমার বাবা যে দিনমজুর ছিল, সেটা কি ভুলে গেছ নাকি? জমিদার বাড়ির বউ হয়েছ বলে কি মাথায় অহংকার ঢুকে গেছে? তোমার দায়িত্ব-কর্তব্য সব ভুলে বসে আছ?”
জুলফার নীরবতা ললিতাকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। সে আরও তীব্র স্বরে বলতে থাকে, “ওগো মহারানী! কানে কি শুনতে পাচ্ছ না? নাকি মূল্যবান কানে সোনার দুল পরে কান বন্ধ করে রেখেছ? এই বিশাল সংসারের সব কাজকর্ম কি আমরা একাই সামলাব? আর তুমি শুধু সাজগোজ করে বসে থাকবে?”
জুলফার নিরুত্তর ভাব দেখে ললিতার মেজাজ চরমে ওঠে। সে ক্ষোভে ফেটে পড়ে, “যাও, যাও! বসেই থাকো তোমার সোনার পিঁজরায়। দেখি কতক্ষণ এভাবে চালাতে পারো। মনে রেখো, তোমার এই অবাধ্য আচরণের শাস্তি তুমি পাবেই। ভুলো না, এই বাড়িতে তোমার আসল পরিচয় কী আর আমরা কারা।”
ললিতার কটু কথাগুলো জুলফার হৃদয়ে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বিঁধছে। সে নিজের অনুভূতিকে প্রাণপণে দমন করে, নীরবে সহ্য করে যায় সমস্ত অপমান। সন্ধ্যা নামার পর, শব্দর উদ্বিগ্ন হয়ে জুলফার ঘরে এল। তার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। ধীরে ধীরে জুলফার কাছে এসে বসল।
“কী হয়েছে আমার রানীর?” শব্দর কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
“তিনদিন ধরে নিজের ঘরে বন্দি হয়ে আছো। কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”
জুলফা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। তারপর কিঞ্চিৎ নাটকীয় সুরে, অত্যন্ত সাবধানে বলতে শুরু করল, “আপনাকে একটা কথা বলিনি। আমি যখন যাত্রাপালায় নাচ করতাম, তখন নাভেদ পাটোয়ারী যে… এই লোককে দেখেছি। তিনি আমাকে চিনতে পারবেন কি না জানি না, কিন্তু যদি চিনে ফেলেন, তাহলে আপনার ভাইজান জেনে যাবেন আমার পরিচয়। এই ভয়ে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। আপনার সম্মান রক্ষার্থে আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছি।”
শব্দরের কপালে চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠল। সে ধীরে ধীরে বলল, “কিন্তু নাভেদ পাটোয়ারী দুই-তিন সপ্তাহ থাকবে। এতদিন কীভাবে নিজেকে বন্দি করে রাখবে?”
জুলফা তখন শব্দরের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে, চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি পারব। যখন মনে হবে আর পারছি না, তখন গোপন সুরঙ্গ বেয়ে বাগানে নয়তো বনে চলে যাব। আর ছাদ তো আছেই। সেখানে দাঁড়িয়ে মুক্ত আকাশের নীচে নিঃশ্বাস নেব।”
শব্দর এখনও চিন্তিত, “কিন্তু এটা তোমার জন্য খুবই কষ্টকর হবে, জুলফা।”
জুলফা তখন শব্দরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, তার চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনার জন্য এই কষ্ট আমার কাছে কিছুই নয়। আপনার মর্যাদা রক্ষা করাই আমার প্রথম কর্তব্য। আমি জানি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে আমি যে কোনো কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত।”
শব্দর জুলফার কথায় গভীরভাবে প্রভাবিত হলো। জুলফা দিন দিন যেন আরও বেশি করে আদর্শ স্ত্রীর রূপ ধারণ করছে। এ জীবনে তার আর কী প্রয়োজন? এমন একনিষ্ঠ, ত্যাগী স্ত্রী পেয়ে সে ধন্য।
শব্দর আবেগে অভিভূত হয়ে জুলফার কোমল হাতটি নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়। তার চোখে গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। সে মৃদু স্বরে বলল, “তুমি যা ভালো বোঝ, তাই করো। আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকব, তোমার ছায়ার মতো।”
জুলফা মৃদু হেসে শব্দরকে আশ্বস্ত করে। সে হাসিতে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা, কিন্তু তার অন্তরের গহনে যে ঝঞ্ঝা বইছিল, তা শব্দর টের পেল না। হাসির আড়ালে লুকিয়ে রইল এক গভীর বেদনা, যা সে কখনোই প্রকাশ করতে পারবে না। জুলফার মনের ভেতর একটা কথা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে – যদি সে নিচে যায়, যদি নাভেদের সামনে পড়ে, তাহলে সব ভেঙেচুরে যাবে। নাভেদকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত সংযম ভেঙে পড়বে, সে ভুলে যাবে নিজের সংসার, ভুলে যাবে স্বামীকে। তার এই আদর্শ স্ত্রীর ভূমিকা, এই ত্যাগের মুখোশ – সবই শুধু নাভেদের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখার একটা প্রয়াস মাত্র।
সূর্যের সোনালি আলোয় ঝলমল করছে জমিদার বাড়ির বিশাল ছাদ। ছাদের কোণায় একটি ছোট চাতাল, যেখানে বসে আছে জুলফা। তার পাশে দুই দাসী, একজন খাস দাসী শঙ্খিনী। জুলফার কোমল পায়ে লাল আলতা পরানোর কাজ চলছে। আঙুলে আঙুলে ছড়িয়ে পড়ছে গাঢ় লাল রঙের আলতা।
ছাদ থেকে চোখ মেলে তাকালে দূরে দেখা যায় সবুজ বন। বাঁ দিকে জমিদার বাড়ির সুসজ্জিত বাগান, যেখানে রঙবেরঙের ফুল ফুটে আছে। দক্ষিণ দিকে গ্রামের বাড়িঘর, মাঠ-ঘাট সব নজরে পড়ে। এক নজরে পুরো গ্রামটাকে দেখা যায় এখান থেকে।
হঠাৎ জুলফার চোখ পড়ল নীচের দিকে। একজন অচেনা লোক ঘোড়া নিয়ে জমিদার বাড়ির ভেতরে ঢুকল। তার দিকে এগিয়ে গেল নাভেদ। বাবরি চুল, পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা নাভেদের দিকে জুলফার চোখ আটকে গেল। দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেল সে।
নাভেদ আগন্তুকের সঙ্গে করমর্দন করে কথা বলতে বলতে দুজনে ঘোড়াটাকে নিয়ে হেঁটে আস্তাবল ঢুকে পড়ল।
উৎসুক হৃদয়ে জুলফা তার দাসীকে জিজ্ঞাসা করল, “লোকটা কে? কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে?”
দাসী উত্তর দিল, “নতুন অতিথি। নাভেদ বাবুর কর্মচারী।”
কিছুক্ষণ পর, আস্তাবলের দরজা খুলে গেল। জুলফার চোখ সেদিকে নিবদ্ধ হয়। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যায় মুহূর্তের জন্য। নাভেদ বেরিয়ে এল, তার শক্ত হাতে ধরা ঘোড়ার লাগাম। সূর্যের আলোয় তার বাবরি চুল চিকচিক করছে। একটি সুদৃশ্য লাফে সে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। জুলফার চোখে ধরা পড়ে নাভেদের দৃঢ় ভঙ্গি, তার সবল দেহের প্রতিটি পেশী ঘোড়ার সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। হঠাৎ নাভেদ ঘোড়ার পাশে হালকা চাবুক মারল। ঘোড়াটি সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করল। ধূলি উড়িয়ে, মাটি কাঁপিয়ে সেই শক্তিশালী প্রাণী ছুটে চলল। নাভেদের দেহ ঘোড়ার ছন্দের সাথে দোল খাচ্ছে। জমিদার বাড়ির বড় ফটক পার হয়ে নাভেদ আর তার ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু জুলফার চোখে তখনও ভেসে উঠছিল সেই দৃশ্য – বাতাসে উড়ন্ত চুল, ঘোড়ার পিঠে সোজা হয়ে বসা নাভেদের দেহ, তার চোখে দৃঢ় সংকল্প।
অতীত।
সকালের মিষ্টি রোদ্দুরে হাওরের কুয়াশা কেটে যেতেই জুলফার দল তানপুরা বাজারের পথে পা বাড়ায়। বাজারে পৌঁছে তারা নিপুণ হাতে সাজাল তাদের রঙিন পসরা। ঝকঝকে কাঁচের চুড়ি যেন রঙধনুর সাত রঙ ছড়িয়ে দিল চারদিকে। নানান রকমের পুঁতির মালা দুলছে হাওয়ায়। কানের দুল আর নাকফুল এমন সুন্দর করে সাজানো যে, দেখলেই মন ভরে যায়।
বৈশাখি তার মধুর কণ্ঠে খদ্দের ডাকছে:
“আইসেন গো বইনেরা, দেইখেন আমাগো লাল-নীল চুড়ি! কি সুন্দর মানায় আপনেগো হাতে!”
“ও ভাইসাব, আইসেন! দেখেন এই সোনার মতন ঝলমলে হার! আপনের বউরে দিলে খুশি হইব!”
“আরে মাইয়া লো, তোমার কানে এই দুলডা বসাইলে পরী লাগব! আইসো, দাম কম কইরা দিমু!”
জুলফা আর মান্নান খদ্দেরদের সাথে দর-কষাকষি করছিল। হঠাৎ একটা গুঞ্জন উঠল বাতাসে। কেউ একজন উচ্চস্বরে বলে উঠল, “শোনো শোনো! বাজারের মাঠে নাকি ঘোড়দৌড় হচ্ছে!”
এই কথা শুনে জুলফার চোখে জ্বলে উঠে কৌতূহলের আগুন। ঘোড়দৌড়! সে তো কখনো চোখে দেখেনি এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য। উত্তেজনায় মাকে বলল, “মা গো, আমি একটু ঘোড়দৌড় দেখে আসি।” মা মুখের দিকে তাকানোর আগেই রঙিন ঘাগড়া পরনে, ব্লাউজের ওপর ওড়না উড়িয়ে জুলফা ছুটল বাতাসের বেগে। তার মনে অনেক প্রশ্ন – কেমন দেখতে ঘোড়াগুলো? কত জোরে ছোটে? কে জিতবে?
আকাশে রোদের ঝিলিক আর মাঠের সবুজ ঘাসের মিলনে একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। জুলফা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেই আনন্দঘন পরিবেশের দিকে। মাঠের চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা রেখা এঁকে দিয়েছে। ভিড়ের মাঝে নিজের জায়গা করে নেয় জুলফা।
চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ করেই জুলফার চোখ আটকে গেল একজনের ওপর। সেই যে প্রথম দেখায় মন কেড়ে নিয়েছিল, তারপর হারিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরে, নাম না জানা সেই পুরুষ! নাভেদের চেহারা দেখে জুলফার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। সাদা রঙের ঘোড়সওয়ারের পোশাকে তাকে একজন রাজপুত্রের মতো লাগছিল। তার মাথায় হেলমেট থাকলেও নিচে থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো বাবরি চুল। সেই চুল বাতাসে উড়ছে, কালো মেঘের টুকরোর মতো। নাভেদের চোখে দৃঢ় প্রত্যয়, ঠোঁটে মৃদু হাসি। তার ঘোড়াটিও অপরূপ। গাঢ় বাদামী রঙের সেই প্রাণীটির দীর্ঘ কেশর বাতাসে উড়ছে এমনভাবে, যেন সে নিজেই একটা প্রাকৃতিক বিস্ময়।
চারদিকে উত্তেজনা আর উৎসাহের ঢেউ। লোকজনের কথাবার্তা, হাসি, চিৎকার সব মিলে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত কোলাহল। কিন্তু জুলফার কানে সব অস্পষ্ট হয়ে গেল। তার চোখ, মন, হৃদয় সব জুড়ে শুধু নাভেদের উপস্থিতি।
মাঠের এক কোণে অন্যান্য প্রতিযোগীরা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে অভ্যাস করছিল, কেউ বা ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
ঘোড়দৌড়ের শুরুর বাঁশি বেজে উঠতেই প্রতিযোগীরা শুরুর লাইনে সারিবদ্ধ হয়। নাভেদের ঘোড়া উদ্দাম হয়ে উঠেছে, সে দৃঢ় হাতে লাগাম ধরে আছে। জুলফার বুক দুরু দুরু করছে। তার চোখ শুধু নাভেদের ওপর নিবদ্ধ।
বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো ছুটে চলল। ধূলো উড়িয়ে, মাটি কাঁপিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। জুলফার মনে হলো, নাভেদের ঘোড়া বাতাসকেও পিছনে ফেলে দিচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসও দ্রুত হয়ে উঠেছে।
নাভেদ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। জুলফার হৃদয়ও নাভেদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, কেন এই অপরিচিত মানুষটির জন্য তার এত আবেগ?
ঘোড়দৌড়ের শেষ পর্যায়ে নাভেদ আরও জোরে ছুটতে শুরু করে। জুলফার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল, “হ্যাঁ! হ্যাঁ!” সে নিজেও বুঝতে পারল না কখন সে হাততালি দিতে শুরু করেছে। চারপাশের মানুষজন তার দিকে তাকাচ্ছে, অথচ তার কোনো হুঁশ নেই।
সূর্যাস্তের রঙিন আভায় রাঙা হয়ে উঠেছে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার পর অবশেষে শেষ হলো প্রতিযোগিতা। ধুলোর মেঘ কেটে যেতেই দেখা গেল, একজন অশ্বারোহী বিজয়ীর মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে।
জুলফার হৃদয় তখনও দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। সে একজন দর্শকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, যে বিজয়ী হলো তার নাম কী?”
লোকটি হাসিমুখে উত্তর দিল, “ওই যে দেখছেন, নাভেদ পাটোয়ারী। বাইরের লোক। শুনলাম বাণিজ্যের কাজে এখানে এসেছেন।”
জুলফার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। সে আরও জানতে চাইল, “বাণিজ্য? কী ধরনের বাণিজ্য?”
লোকটি বলল, “আমার যতদূর জানা, উনি এখানকার আড়তদারদের সঙ্গে চুক্তি করতে এসেছেন। ফসল সংগ্রহ আর পরিবহনের ব্যবস্থা করবেন। শুনেছি, উনার ব্যবসা নাকি দিন দিন বাড়ছে।”
জুলফার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল, “নাভেদ।”
সে নাভেদের দিকে তাকায়। তার সুগঠিত দেহ, উজ্জ্বল চোখ, আর বিজয়ীর হাসি যেন জীবন্ত শিল্পকর্ম। তার কালো ঘনকুঞ্চিত চুল হাওয়ায় উড়ছে, যা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। জুলফা টের পায়, তার দেহের প্রতিটি কোষে এক তীব্র অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। এ এক অব্যক্ত বাসনা, যা তাকে নাভেদের দিকে টেনে নিতে চাইছে।
নাভেদ শুধু ঘোড়দৌড়ের বিজয়ীই নয়, সে একজন সফল ব্যবসায়ীও বটে। তাছাড়া তার বেহালা বাজানোর হাতও অসাধারণ। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে জুলফা দেখতে পায়, চারপাশের প্রায় সব তরুণীর চোখেই নাভেদের প্রতি একই আকর্ষণ। তাদের চাহনিতে ফুটে উঠেছে অব্যক্ত বাসনা, নাভেদকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই দৃশ্য দেখে জুলফার বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। নিজের দিকে তাকায় জুলফা। সে তো একজন সাধারণ বেদে মেয়ে। তার সরল জীবন, অনাড়ম্বর পোশাক, আর সহজ-সরল কথাবার্তা – এসব নিয়ে সে কীভাবে এই উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? নাভেদের মতো একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তার নেই।
কিন্তু প্রেম তো কোনো সীমানা মানে না। সামাজিক মর্যাদা, অর্থ-বিত্ত – এসব তো প্রেমের কাছে তুচ্ছ। তার চোখে জল এসে গেল। সে বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে সে গভীর, অকৃত্রিম প্রেমে পড়ে গেছে। এ প্রেম হয়তো অসম্ভব, কখনোই পূর্ণতা পাবে না। কিন্তু তার কাছে এই অনুভূতিই সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে মূল্যবান। ভালোবাসতে তো দোষ নেই। এই ভালোবাসা যদি একতরফাও হয়, তবুও এটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। জুলফার ঠোঁটে হাসি ফুটে।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ