শব্দর গম ক্ষেতগুলি একে একে নাভেদকে দেখিয়ে বলল, “দেখুন, এখানে আমরা প্রকৃতির সাথে মিলে চাষ করি। আমাদের চাষীরা সবসময় মাটি ভালো রাখতে আর ভালো ফসল ফলাতে চেষ্টা করে।”
নাভেদ আগ্রহের সঙ্গে ক্ষেতগুলির দিকে চেয়ে বলল, “আপনার চাষীদের এই সাফল্য নিশ্চয়ই তাদের গর্বিত করেছে। তারা খুব সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর ফসল ফলিয়েছে।”
শব্দর একটু গর্ব ভরে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের চাষীরা খুব পরিশ্রমী আর দক্ষ। তাদের একাগ্রতা আর আন্তরিকতা আমাকে সবসময় উৎসাহিত করে।” তারপর সে অবাক হয়ে বলল, “আপনি শুনছেন না, এই বসন্তের আওয়াজ কীভাবে মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে?”
নাভেদ কান চেপে ধরে মুগ্ধভাবে শুনতে শুরু করল, “হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। গানের মতো লাগছে।”
শব্দর বলল, “এই মাঠগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে প্রকৃতিকে সম্মান দেখানো হয়। এটাই আমাদের চাষের মূল কথা।”
নাভেদ সন্তুষ্টভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আপনাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি খুবই প্রশংসার যোগ্য। আপনাদের এই উদার মনোভাবই ফসলের ভালো স্বাদ আর মান বজায় রাখছে।”
দুজন ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটছে সামনের দিকে, হঠাৎ নাভেদ একটু ভঙ্গুর ও উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, আমার উপস্থিতি কি আপনার পরিবারের কারো কাছে অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছে?”
শব্দর সুমধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “এরকম ভাবার কারণ কি? কেউ কিছু বলেছে?”
নাভেদ সাবলীলভাবে উত্তর দিল, “দাসীদের কথাবার্তা শুনেছি।”
শব্দর বিস্ময়ভরা ও প্রশংসাপূর্ণ কণ্ঠে বলল, “ওহো, আপনি দাসীদের কথা শুনেছেন! তা বলুন তো, কি শুনলেন?”
এক অজানা সংকোচে ভরা কণ্ঠে নাভেদ বলল, “দাসীরা বলছিল, আমার উপস্থিতির কারণে আপনার স্ত্রী নিচ তলায় আসতে পারছেন না। আমি খুবই দুঃখিত যদি আমার উপস্থিতি আপনাদের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে থাকে।”
শব্দরের মুখে একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে ছিল আশ্বাসের ছোঁয়া। সে নাভেদের দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এটা আপনার সাথে মোটেও সম্পর্কিত নয়। আসলে, আমার স্ত্রী কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। তাই তিনি বাইরে আসতে পারছেন না। আর দাসীরা তো জানেনই, তিলকে তাল বানিয়ে বলে।”
নাভেদের মুখের উদ্বেগ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। সে একটি গভীর, স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাস ফেলল। তার কণ্ঠে এখন অনুতাপের সুর, “সত্যি বলতে কি, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, হয়তো কোনোভাবে আমি আপনাদের কারো জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি।”
শব্দর তখন একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আপনি এমন ভাববেন না। এরকম কিছুই নয়।” তারপর সে যেন কিছু মনে করল। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি কি আমার স্ত্রী জুলফাকে দেখেননি?”
এই প্রশ্নে নাভেদ একটু অবাক হয়ে যায়। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ। শব্দর তখন বুঝতে পারে যে তার প্রশ্নটা হয়তো একটু অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে একটা ফাঁকা হাসি হেসে বলল, “মানে, আপনার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা হয়নি নিশ্চয়ই? হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তো তিনি নিচে আসতে পারেননি।”
নাভেদ এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তার মনে হলো, কোনো অজানা কারণে একটি সত্য লুকিয়ে রাখা উচিত। সে মাথা নেড়ে বলল, “না, আসলে আমি খেয়াল করিনি। সবার সঙ্গে কথা হলেও উনার সঙ্গে কোনো কথাবার্তাই হয়নি।”
শব্দর একটু স্বস্তি পেল। সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “তারপর বলুন, আপনার থাকার ব্যবস্থায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? যদি কোনো সমস্যা থাকে, নিঃসঙ্কোচে জানাবেন।”
নাভেদের ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “এখানে আমি সত্যিই একটা সুন্দর সময় কাটাচ্ছি। তবে…”
শব্দর তৎক্ষণাৎ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তবে?”
নাভেদ একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে, নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনো গোপন ইচ্ছাকে প্রকাশ করছে, এমন ভাবে বলল, “আমি কি রাতে বেহালা বাজাতে পারি? আসলে, বেহালা না বাজালে আমার ঘুম আসে না।”
শব্দরের চোখে-মুখে তখন আনন্দের ঝলক। সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “নিশ্চয়ই! বেহালার সুর আমার ভাইজানের খুবই প্রিয়। তিনি ভীষণ খুশি হবেন আপনার বেহালা শুনে।”
এই কথা শুনে নাভেদের মুখে ফুটে উঠে এক গভীর, আবেগপূর্ণ হাসি।
মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ বেজে উঠল বেহালার সুর। অতিথি ভবনের একটি ঘর থেকে জানালা দিয়ে ভেসে আসা সেই মধুর সুরে চমকে উঠলেন সুফিয়ান ভূঁইয়া। তিনি ধীরে ধীরে উঠে বসলেন বিছানায়।
কান পেতে শুনতে লাগলেন সেই অপূর্ব সঙ্গীত। শব্দরের থেকে শুনেছেন, নাভেদ নাকি বেহালা বাজানোর অনুমতি চেয়েছিল। সুফিয়ান মুগ্ধ হয়ে ভাবছেন, ছেলেটির কী অসাধারণ দক্ষতা! সুরে কী গভীর অনুভূতি! তিনি উঠে দাঁড়ালেন জানালার পাশে। অনুভব করেন, এই সুরের মাঝে লুকিয়ে আছে এক গভীর বেদনা, এক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা। তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেললেন সেই সুরের মায়াজালে। মনে হলো যেন তিনিও নাভেদের সাথে বেহালার তারে তারে ছুঁয়ে যাচ্ছেন জীবনের নানা স্মৃতি, নানা অনুভূতি।
গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে নাভেদের বেহালার সুরেলা আলাপ ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। জমিদারবাড়ির অতিথি ভবনে কেবল নাভেদই নয়, তার পাশে বসে রয়েছে তার বিশ্বস্ত সহচর সেলিম, যে পুরোপুরি মগ্ন হয়ে নাভেদের বেহালা বাজনা শুনছে।
এমন সময় আংশিক ঘুমে আচ্ছন্ন জুলফা হঠাৎ এক অপরিচিত শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে, “এ কীসের আওয়াজ?” মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে সে অনুভব করে, বেহালার মোহময় সুর তার হৃদয়ের অতল গভীরে প্রবেশ করছে। নিঃসন্দেহে এই মনোরম সুর নাভেদের হাতের স্পর্শে জন্ম নিয়েছে। জুলফা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিশুতি রাতের গাঢ় অন্ধকার, আর পাশে শব্দর বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই নিশীথে জমিদারবাড়ির মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল, সমগ্র অট্টালিকাটি ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে। শুধু নাভেদের বেহালার সুর সেই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে, বয়ে আনছে এক অনন্য অনুভূতি। জুলফা মুগ্ধ হয়ে বেহালার সুর অনুসরণ করে ধীরে ধীরে নিচতলার অতিথি ভবনের দিকে যেতে থাকে। ভবনটি খাসমহলের লাগোয়া হলেও প্রধান দরজা দুটি। তার শাড়ির আঁচল মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। তার চুল বিশৃঙ্খল, চোখে তখনও ঘুমের ঘোর। সে কোন এক অজানা আকর্ষণে টানা পড়েছে বেহালার সুরের উৎসের দিকে।
দরজার কাছে এসে জুলফা জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। তার চোখে ধরা পড়ে, নাভেদ চোখ বুজে সম্পূর্ণ তন্ময়তায় বেহালার তারে সুর তুলছে। মধ্যরাতের মৃদু আলোয় আলোকিত অতিথি ঘরটির এক কোণে একটি সুসজ্জিত পালঙ্কে নাভেদ বসে আছে। তার চোখ বন্ধ, দেহ স্থির, কেবল তার আঙ্গুলগুলির চঞ্চল নৃত্যেই বেহালা থেকে বের হচ্ছে অপূর্ব সুরের মালা। নাভেদ বেহালার সুরের শেষ কণা তুলে জানালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তৎক্ষণাৎ তার নজর আকৃষ্ট হয় দুটি উজ্জ্বল চোখের প্রতি। পরমুহূর্তেই সে লক্ষ্য করে, একজন দীর্ঘকেশী তরুণী দ্রুত গতিতে সরে পড়ছে। চুড়ি ও নূপুরের মৃদু ঝংকার তার কানে প্রবেশ করে। তৎপরতার সাথে নাভেদ দরজা খুলে বাইরে বের হয় কিন্তু সেই তরুণীর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পায় না। তার মনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে, কে ছিল এই অজানা তরুণী? জমিদার-গৃহিণীর মতো পটলচেরা চোখগুলো, কোনোভাবেই কি সে হতে পারে? নাভেদের মন সন্দেহ ও কৌতূহলে দোলায়মান হতে থাকে।
নাভেদের বেহালার সুর মধ্যরাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চুরমার করে দিত প্রতি রাতেই। তার সুরের মায়াজালে আটকে পড়ত সবাই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হতো জুলফা। তাই দ্বিতীয় রাতেও একই ঘটনা ঘটল। জুলফা চুম্বকের টানে আকৃষ্ট হয়ে চলে এসেছিল সেই দরজার সামনে। তৃতীয় রাতে তো সে আর নিজেকে সামলাতেই পারেনি। তার চোখে নেমে এসেছিল অনুভূতি ও মুগ্ধতার অশ্রুর বন্যা।
নাভেদ টের পেয়েছিল কেউ একজন তার সুর শুনতে আসে। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারেনি, এই রহস্যময়ী শ্রোতা কে? জমিদারের বউ, নাকি অন্য কেউ?
চতুর্থ রাতে নাভেদ মনস্থির করে ফেলল। সে জানতে চায় কে এই গোপন শ্রোতা। তাই সে একটি চতুর পরিকল্পনা করে। সেদিন রাতে নাভেদ আবার বেহালা বাজাতে শুরু করল। কিন্তু এবার সে দরজার কাছাকাছি বসেছিল। তার কানে এল পায়ের শব্দ। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। নাভেদ বুঝতে পারে, তার অজানা শ্রোতা এসে গেছে।
হঠাৎ করেই নাভেদ থামিয়ে দেয় বেহালা বাজানো। সে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একটানে খুলে ফেলল দরজা। চমকে উঠল জুলফা। সে পালাতে চাইল। কিন্তু নাভেদ তার চেয়েও দ্রুত। সে বলে উঠল, “পালাবেন না।”
জুলফা থমকে দাঁড়ায়। ভয়ে কাঁপছিল তার সারা শরীর। ধীরে ধীরে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নাভেদের দিকে।
চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জুলফার মুখমণ্ডল। তখনই নাভেদের মনে পড়ে যায় এমনি আরেক লুকোচুরি রাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে ফুটে উঠল বিস্ময়। জুলফার চোখে ভয় আর লজ্জা।
নাভেদ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল জুলফার দিকে। জুলফা পিছিয়ে যেতে চাইলে কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রাখল সেখানেই।
নাভেদ মৃদু স্বরে বলল, “আপনি কি…?”
||
ঘোড়দৌড়ের পর থেকে জুলফার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। নাভেদের প্রতি তার আকর্ষণ ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। প্রতিদিন, যখনই সুযোগ পেত, সে নাভেদকে দূর থেকে অনুসরণ করত। নাভেদের প্রতিটি পদক্ষেপ, তার কথা বলার ভঙ্গি, বেহালা বাজানোর ছন্দ সবই জুলফার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল। একদিন সকালে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে জুলফার চোখে পড়ে নাভেদের এক অপূর্ব দৃশ্য। সে দেখল, নাভেদ কী যত্ন আর মমতায় তার ঘোড়ার পরিচর্যা করছে। প্রথমে সে সাবধানে ঘোড়ার পা পরীক্ষা করল, তারপর খুর পরিষ্কার করতে লাগল। এরপর ঘোড়ার লেজ আঁচড়াতে শুরু করল, যেন কোনো শিশুকে আদর করছে। জুলফা অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখে। নাভেদের প্রতিটি স্পর্শে ফুটে উঠছিল অগাধ ভালোবাসা। কিছুক্ষণ পর, নাভেদ ঘোড়াটিকে নিয়ে নদীর ধারে চলে গেল। জুলফাও দূর থেকে অনুসরণ করল তাদের। নদীর পাড়ে একটি নির্জন জায়গায় বসে নাভেদ তার প্রিয় বেহালা বাজাতে শুরু করে। ঘোড়াটি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে সেই সুর শুনছিল। হঠাৎ কোনো কারণে ঘোড়াটি অস্থির হয়ে উঠলে নাভেদ তৎক্ষণাৎ বেহালা নামিয়ে রেখে ঘোড়ার কাছে যায়। সে ধীরে ধীরে ঘোড়ার কানের কাছে কিছু বলে। জুলফা অবাক হয়ে দেখে, কীভাবে ঘোড়াটি আবার শান্ত হয়ে গেল। নাভেদ তার নিজের খাবার ঘোড়ার সঙ্গে ভাগ করে খায়। যেন দুই প্রিয় বন্ধু একসঙ্গে দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছে। সন্ধ্যায় আবার সেই অপূর্ব দৃশ্য – নাভেদ ঘোড়াকে বেহালার সুর শোনাচ্ছে।
দিনের পর দিন এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে জুলফার হৃদয়ে নাভেদের প্রতি ভালোবাসা আরও গভীর হতে থাকে। নাভেদের হৃদয় কত কোমল, কত ভালোবাসায় ভরা। শুধু মানুষের প্রতি নয়, একটি পশুর প্রতিও তার এত যত্ন, এত ভালোবাসা, এটা জুলফাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ধীরে ধীরে সে নিজেও সেই ঘোড়াটির প্রতি একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতে লাগল। নাভেদের ভালোবাসার প্রতিটি স্পর্শ সেই ঘোড়াটিকেও তার কাছে এক অসাধারণ সত্তায় পরিণত করেছে। জুলফার ধারণা, এই ঘোড়াটি শুধু একটি প্রাণী নয়, নাভেদের হৃদয়ের একটি অংশ। প্রতিদিন এইভাবে নাভেদকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, তার প্রতিটি কাজ লক্ষ্য করা – এটাই হয়ে উঠল জুলফার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নাভেদের জগতে। নাভেদের মতো এমন সংবেদনশীল, ভালোবাসায় ভরা মানুষ সে আর কখনও দেখেনি।
একদিন রাতের অন্ধকারে জুলফা চুপিসারে বাজারের প্রান্তে যায় যেখানে নাভেদের ঘোড়া বাঁধা ছিল। সে নিজের বোরকার নিচে থেকে একটি ছোট বস্তা বের করে, যাতে কিছু শস্য ও একটি ছোট পাত্রে পানি ছিল। জুলফা সাবধানে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে যায়, তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে ঘোড়ার মুখের কাছে শস্য এগিয়ে দেয়। ঘোড়াটি প্রথমে সন্দেহের সাথে তাকায়, তারপর আস্তে আস্তে খেতে শুরু করে। জুলফা মৃদু হাসে, তার চোখে একটু আনন্দের ঝিলিক। পানির পাত্রটি এগিয়ে দেওয়ার সময় সে ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তার মনে হয়, এই স্পর্শের মাধ্যমে সে নাভেদকেও যেন ছুঁয়ে ফেলল।
আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে জুলফা বলে উঠল, “ওগো সুন্দর ঘোড়া, তোমার মালিক নাভেদ কেমন আছেন? আমি সারাক্ষণ তার কথা ভাবি। তার সুখ আর শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি।”
ঘোড়াটিকে খাওয়ানো শেষ করে জুলফা তার মুখে এক মধুর হাসি ফুটিয়ে তুলল। সে আবার বলল, “আশা করি, এই খাবারটা তোমার পছন্দ হয়েছে। তোমার মালিক নাভেদকে বলো, আমি তাকে খুব পছন্দ করি। তার প্রতি আমার…”
কথাটা শেষ করতে পারল না জুলফা। তার চোখে জল এসে গেল। সে ঘোড়ার গায়ে আবার হাত বুলিয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরে যায়।
পরদিন সকালে, সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন পৃথিবীকে আলোকিত করছে, তখন নাভেদ তার প্রিয় ঘোড়ার কাছে এল। দূর থেকেই সে লক্ষ্য করে ঘোড়াটি অন্যদিনের চেয়ে বেশ প্রফুল্ল ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কাছে গিয়ে সে দেখে ঘোড়ার পাশে একটি খালি পাত্র পড়ে আছে, আর মাটিতে ছড়িয়ে আছে কিছু শস্যের অবশিষ্টাংশ। কেউ রাতের অন্ধকারে এসে তার ঘোড়াকে খাইয়ে গেছে। কে এই ব্যক্তি? কেন সে এই দয়ার কাজ করছে?
নাভেদের হৃদয়ে একটা অদ্ভুত আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার ভাব জেগে ওঠে। সে আশেপাশে খুঁজতে থাকে দয়াবান মানুষটিকে, কিন্তু কাউকেই পেল না। তার কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে এ সম্পর্কে, তারাও কিছু জানে না।
পর পাঁচ দিন একই ঘটনা ঘটল। প্রতি সকালে নাভেদ দেখে তার ঘোড়া খেয়েদেয়ে আরও শক্তিশালী ও সজীব হয়ে উঠছে। এই অজানা ব্যক্তির প্রতি তার কৌতূহল ও কৃতজ্ঞতা বাড়তে লাগল।
পঞ্চম দিন, নাভেদ একটি চিঠি লিখে রাখল ঘোড়ার পাশে:
” প্রিয় দয়ালু আত্মা,
আপনার পরিচয় অজানা, কিন্তু আপনার করুণা ও ভালোবাসা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। প্রতি রাতে আপনি যে নীরবে এসে আমার প্রিয় ঘোড়াটিকে খাওয়ান, তা আমার হৃদয়কে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
আপনি কে? কেন এই নিঃস্বার্থ সেবা করছেন? আপনার উদারতা ও করুণা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি আপনাকে চোখে দেখার জন্য, আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
দয়া করে সামনে আসুন। আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। আপনার মত মহৎ মানুষের সান্নিধ্য পেলে আমার জীবন ধন্য হবে।
অপেক্ষায় রইলাম,
নাভেদ পাটোয়ারী। “
পরদিন সকালে, নাভেদ আশা নিয়ে ছুটে এল ঘোড়ার কাছে। কিন্তু তার চিঠি যেখানে ছিল, সেখানেই অনাদৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো উত্তর নেই। তবে ঘোড়াটিকে যে খাওয়ানো হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই রহস্যময় ব্যক্তি যেন একটি স্বপ্নের মত। তাকে ধরা যায় না, অথচ তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। নাভেদের মনের কৌতূহল আরো গভীর হয়, সেইসাথে বাড়ে এই অজানা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার আকাঙ্ক্ষা।
পরদিন। রাতের নিঃশব্দতা চাদরের মতো ঢেকে ফেলেছে সারা পরিবেশ। অন্ধকারের গভীরতায় মিশে গিয়েছে জুলফার কালো বোরকা আর নিকাব। তার পা দুটি নিজের থেকেই চলছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে সেই ঘোড়ার কাছে। হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত, কানে বাজছে নিজের রক্তের শব্দ। মনের কোণে জানে, এ পথ বিপদসঙ্কুল। তবুও নাভেদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে বারবার টেনে আনে এখানে।
তানপুরার কাজ শেষ হয়েছে কবেই, শুধু নাভেদের সান্নিধ্যের আশায় সে এখনও এখানে। ঘোড়াটিকে স্পর্শ করলেই মনে হয় যেন নাভেদকেই ছুঁয়ে ফেলেছে, আর খাওয়ানোর সময় কল্পনা করে, সে যেন নাভেদকেই খাওয়াচ্ছে। এই মধুর অনুভূতি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারে না জুলফা।
সতর্ক পদক্ষেপে সে এগিয়ে যায় ঘোড়ার দিকে। চোখ দুটি সজাগ, কান খাড়া। নিশ্চিত হয়ে নেয়, আশেপাশে কেউ নেই। তারপর ধীরে ধীরে বস্তা থেকে বের করে খাবার, ঘোড়ার সামনে রাখতে যায়।
হঠাৎ-ই অন্ধকার চিরে ভেসে আসে একটি গম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কে তুমি?”
চমকে ওঠে জুলফা। হাত থেকে পড়ে যায় শস্যের বস্তা। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে নাভেদ। জুলফার শরীরে শুরু হয় অনিয়ন্ত্রিত কম্পন। পালাতে চেষ্টা করলে নাভেদ ধরে ফেলে তার হাত, “ভয় পেও না,” বলে নাভেদ, তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত কোমলতা, “আমি শুধু তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আর জানতে চাই, কেন তুমি এটা করছ?”
জুলফা নীরব, তার শরীর কাঁপছে ভয়ে। নিকাবের ফাঁক দিয়ে শুধু দেখা যায় তার বড় বড় দুটি চোখ, যা অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ