#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব ১৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পৃথার এক হাত শক্ত করে ধরে আরুশকে আদেশের সুরে বলল,
-“বাইরে যা তুই।”
তুর্যের আদেশ আসতে দেরী কিন্তু আরুশের বেরিয়ে যেতে দেরী হলো না। আরুশ যেন টুপ করে লাফিয়ে গাড়ির বাইরে পড়লো। সাথে সাথে গাড়ির দরজা লক করে দিল তুর্য। পৃথার হাত ছেড়ে দিয়ে গা এলিয়ে দিল সিটের সাথে। পৃথার ভয় আরও বাড়লো। আগে তো তাও একজন সুস্থ মানুষ আরুশ তাদের সাথে ছিল আর এখন সে একা একটা অর্ধ পাগল, ব্রিটিশ পুরুষের সাথে গাড়ির ভিতরে। এ লোক যদি তাকে কিছু করেও ফেলে সে অবলা একজন মেয়ে মানুষ হয়ে কিছুই করতে পারবে না। যদি মে’রে টে’রে ফেলে দেয়? ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো পৃথার। না না এই পরিস্থিতিতে কোনো ভাবেই তাকে দমে গেলে চলবে না। যে করেই হোক নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। এখান থেকে বেরুতে হবে অতি দ্রুত। পৃথা দুই হাত উঁচিয়ে গাড়ির জানালায় আঘাত করতে শুরু করলো। চেঁচিয়ে বলল,
-“কেউ আছেন? দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে। এই খারাপ লোকটা আমাকে তুলে নিয়েছে।”
তুর্য নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
-“তুমি ভয় পেলে, চিৎকার করলে অথচ তুমি জানলেই না পৃথিবীতে এই মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা আমার নিকটই তুমি নিরাপদ বেশি। স্বামী আমি তোমার।”
পৃথার নিজের চিৎকার চেঁচামেচিতে তুর্যের বলা নিচু কন্ঠের একটা শব্দও তার কর্ণে পৌঁছালো না। ছেলেটা শেষ এক পলক তাকালো ব্যস্ত পৃথার পানে অতঃপর চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো আগের মতোই। পৃথা কতক্ষন চিৎকার চেঁচামেচি করলো। অতঃপর ক্লান্ত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তুর্য চোখ মেলে তাকালো পৃথার পানে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
-“দম শেষ।”
পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আপনি অমাকে এখানে তুলে কেন এনেছেন? বদ লোক একটা।”
তুর্য নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে বসে গাড়ির পিছনের দিক থেকে এক বোতল পানি বের করে আনলো। পৃথার পানে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“পানিটা খেয়ে নাও। ইসসস হাঁপিয়ে গেছো একদম।”
পৃথা পানির বোতলটা হাতে নিল না। বরং তেতে ওঠা কন্ঠে বলল,
-“খাব আমি আমি আপনার পানি। নামিয়ে দিন আপনি আমাকে।”
তুর্যের মেজাজটা সেই সকাল থেকেই চটে আছে। বউ তার, যার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে। খুঁজতে খুঁজতে ছুটে এসেছে সেই সূদূর ঢাকা থেকে রাজশাহীতে। তবুও বউকে নিজের করে পয়নি। সেই বউ কিনা তার চোখের সম্মুখে তাকেই উপেক্ষা করেই অন্য পুরুষের পাশ ঘেঁষে রাস্তায় হাঁটে। আর যত অভিনয় তার সম্মুখে। তুর্য তবুও নিজেকে যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সে কখনওই চায় না এই বাচ্চা বউটার উপরে তার ক্রোধের লেশমাত্র পড়ুক। তুর্য জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,
-“মুরগির বাচ্চা মুরগির বাচ্চার মতো থাকো। এভাবে বাচ্চাওয়ালা মুরগির মতো ফোঁস ফোঁস না করে পানিটা গলায় ঢলো। চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ঘেমে গেছো।”
-“আমাকে নিয়ে আপনাকে এত ভাবতে হবে না। আমাকে নামিয়ে দিল এক্ষুনি।”
পৃথার কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর। দাঁতে দাঁত চাপলো তুর্য। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল,
-“নামিয়ে দেব অবশ্যই তবে তোমার বাসা পর্যন্ত গিয়ে।”
-“আমি আপনার সাথে যাব না ব্রিটিশ,বদ লোক।”
তুর্য এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভিতর থেকে ক্রোধ যেন উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে ছেলেটার। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুর্যের। তার লম্বাটে পরিপুষ্ট হাতটা বাড়িয়ে হুট করে সে চেপে ধরলো পৃথার সুডৌল নরম কোমড় খানা। সেখানে বেশ শক্তপোক্তভাবে চেপে ধরে মেয়েটাকে নিয়ে এলো নিজের নিকট। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“তা আমার সাথে যাবে কেন? যাবে তো ঐ কলেজের অল্প বয়স্ক কচি কোনো স্যারের সাথে।”
তুর্যের কন্ঠ নিঃসৃত কোনো কথা তেমনভাবে পৌঁছালো না পৃথার কর্ণে। মেয়েটা বরং নাজেহাল হয়ে উঠেছে তুর্যের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে। এই প্রথম পৃথার অঙ্গে কোনো পুরুষের ছোঁয়া তাও এতটা গভীরভাবে, শরীরের গভীরতম এক স্থানে। মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে কেমন। তীব্র অস্বস্তিবোধে নাজুক হয়ে পড়েছে ছোট মেয়েটার কিশোরী হৃদয়। ভিতরে ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। কম্পিত কন্ঠে বলল,
-“আমাকে ছেড়ে কথা বলুন।”
তুর্য ছাড়লো না। বরং টেনে মেয়েটাকে আরও নিকটে নিল। পৃথার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-“ছাড়বো না। কি করবে তুমি?”
তুর্যের প্রতিটি নিঃশ্বাসের বায়ু আছড়ে পড়ছে পৃথার চোখ মুখ জুড়ে। পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল মেয়েটা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তুর্যের এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পৃথার কেমন খারাপ লাগছে না। পৃথা শুনেছে পুরুষ মানুষের অযাচিত স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ বা কু নজর নাকি নারীরা বুঝতে পারে। পৃথা হয়তো এর আগে এমন স্পর্শের কখনও সম্মুখীন হয়নি তবে কোনো পুরুষের নজর দেখেই বুঝে নিতে পারতো কোনটা ভালো নজর এবং কোনটা খারাপ নজর। তবে আজ কেন এ স্পর্শের মানে সে বুঝতে পারছে না? এই অপরিচিত স্পর্শ খারাপ লাগছে না পৃথার নিকট আবার ভালোও লাগছে না। কেমন দোটানার মন মজেছে। লজ্জা, ভয়, সংকোচ, সংশয়ে হৃদয় অবদ্ধ হয়েছে। তবুও কেন যেন পৃথা জোর গলায় কিছু বলতে পারছে না। এটাই বোধহয় পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন। লোকমুখে শোনা যায়,” বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলে দুই নর নারীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা এক অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি করে সাথে সাথেই।” কথাটা বোধহয় বহুলাংশে সত্যি। তাই না জেনে, না বুঝেও তুর্যের স্পর্শকে খারাপের খাতায় ফেলতে পারছে না মেয়েটা। পৃথা চোখ বন্ধ রেখেই শীতল কন্ঠে বলল,
-“চিৎকার করবো আমি।”
তুর্য বাঁকা হাসলো। পৃথার মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝলো সে। ক্ষীন কন্ঠে ছেলেটা বলল,
-“প্রথমত তুমি হাজার চিৎকার করলেও তোমার কন্ঠে উচ্চারিত একটা শব্দও গাড়ির বাইরে যাবে না। দ্বিতীয়ত তুর্য চৌধুরীর হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর সাধ্য কারো এই মুহূর্তে নেই মুরগির বাচ্চা।”
“তুর্য চৌধুরী” নামটাই কম্পন ধরালো পৃথার কায়া জুড়ে। এর আগে বহুবার এই লোকের সাথে পৃথার দেখা হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে তবে নামটা জানা হয়নি। বারবার ব্রিটিশ লোক বলেই সম্বোধন করেছে তাকে। কিন্তু এই নামটা কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথাও শুনেছে হয়তো। কিন্তু কোথায় শুনেছে পৃথা মনে করতে ব্যর্থ হলো। যেথায় শুনেছে শুনুক তো। এখন এই লোকটার থেকে নিজেকে মুক্ত করাই মেয়েটার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কিন্তু সে লেগেছে এর নামের রহস্য খুঁজতে। তুর্য চৌধুরী নামটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল পৃথা। মুহুর্তেই আবার আগের রূপে ফিরে গেল সে। কটমট করে বলল,
-“ছাড়ুন আমাকে অ’স’ভ্য পুরুষ মানুষ।”
তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,
-“ছাড়লেই ঐ চ্যাংড়া স্যারের কাছে যাবে নাকি? সেই পাঁয়তারা করছো?”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। তখন থেকেই
নাহিদ স্যারকে নিয়ে এই লোক অপমানের পর অপমান করে যাচ্ছে। কেন? নাহিদ স্যারের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? নেই তো। শুধুমাত্র আজ সকালে একসাথে একটু কলেজে এসেছে তাই এই লোক এত কথা বানিয়ে ফেললো? পৃথা ফুঁসে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আমি যার কাছে খুশি যাব আপনার কি? আপনি কোন অধিকারে আমাকে এসব কথা বলছেন?”
তুর্য রেগে গেল। খাবলে ধরলো মেয়েটার নরম কোমড়ের ভাঁজ। ক্রোধে হিসহিসিয়ে বলল,
-“কোন অধিকারে বলেছি তা তোমার রা’জা’কা’র বাপকে জিজ্ঞেস করো। সে খুব ভালোভাবে চিনে আমাকে। আর আমার অধিকারটাও তার জানা সম্পূর্ন ভাবে।”
পৃথা তেতে গেল। উঁচু কন্ঠে বলল,
-“একদম আমার বাবাকে উল্টা পাল্টা কথা বলবেন না। আমার বাবা মোটেই রা’জা’কা’র না বরং আপনি ব্রিটিশ।”
তুর্য মুখ বাঁকালো। নির্লিপ্ত হয়ে বলল,
-“তোমার বাপটা রা’জা’কা’র। ভাই দুটো আ’লব’দর আল শা’মস। তোমার গুষ্টি শুদ্ধো সব বেই’মানে’র দল শুধুমাত্র তুমি ছাড়া।”
-“মুখ সামলে কথা বলুন।”
তুর্য আলতো হাসলো। পৃথার পানে আরেকটু ঝুঁকে বলল,
-“মুখ সামালাবো না আমি। কি করবে? মুখে চু’মু খাবে! তেমন ইচ্ছে থাকলে দ্রুত কাজটা সেড়ে ফেল। শুভ কাজে দেরী করতে নেই জানো না তুমি?”
পৃথা হতবম্ব হয়ে গেল। সবকিছু যেন মাথার উপর থেকে চলে গেল। এতক্ষন না হয় চেপে ধরেছে ক্রোধের বশে আর এখন চু’মু খাওয়ার কথাও বলছে? আগে তো ভেবেছিল এ লোক শুধুমাত্র ব্রিটিশ, তারপরে আবিষ্কার করলো এ ব্রিটিশের পাশাপাশি আধপাগল এখন অ’স’ভ্য”ও বটে। ছিঃ ছিঃ চরিত্রের কি শ্রী। পৃথার হতবাকতার মাঝেই তাকে ছেড়ে দিল তুর্য। ঠিকঠাক হয়ে বসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আরুশকে মেসেজ করলো,
-“গাড়িতে আয়।”
আরুশ প্রায় সাথে সাথেই গাড়িতে এলো। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলো দ্রুততার সাথে। এরপরে সময় কেটে গেল খুব দ্রুত। এমনিও কলেজ থেকে পৃথার বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। তার উপর মেয়েটা চুপচাপ বসে রয়েছে গাড়ির সিটে। আরুশ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের বিল্ডিং এর সম্মুখে এসে থামালো গাড়িটা। তুর্যের আদেশেই পৃথাদের বাসার সম্মুখে আর নিল না। পরে দেখা যাবে ঐ রাজা’কা’রের দল তাদের একসাথে দেখে কোনো গন্ডগোল লাগিয়ে দিবে।
গাড়ি থামার বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও পৃথাকে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে ভ্রু কুঁচকালো তুর্য। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো,
-“নামবে নাকি তোমার বাসা পর্যন্ত যাব? পরে তোমার রাজা’কার বাপ, আল’বদর আর আল শা’মস ভাই আমার সাথে দেখে ফেললে কিন্তু আমার কোনো দোষ নেই।”
পৃথা ফুঁসে উঠে তাকালো তুর্যের পানে। তবে বলল না কিছুই। এখন এই লোকের সাথে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে দেরী করার ইচ্ছা নেই কোনো। এমনিই এই আধপাগলের পাল্লায় পড়ে অনেকটা সময় দেরী হয়েছে মেয়েটার। পৃথা ফোঁস ফোঁস করতে করতে গাড়ি ছেড়ে বাইরে নেমে দাঁড়ালো। তীব্র ক্রোধ নিয়ে ঠাস করে লাগালো দরজাটা অতঃপর হনহন করে হাঁটা দিল সম্মুখ পানে। তুর্য হেসে ফেললো বউয়ের রাগ দেখে। বিরবিরিয়ে বলল,
-“মুরগির বাচ্চার মতো বউটা আমার।”
আরুশ সম্মুখে বসে লুকিং গ্লাসে দেখলো তুর্যের হাসি মুখটা। কেমন যেন তুর্যের কার্যকলাপে সায় দিতে পারছে না সে। বউকে যেহেতু হাতে পেয়েছে তাদের বিয়ের কথা বলে দিলেই তো পারে। এত অভিনয় করে সময় নষ্ট করার কি দরকার? তবে এই কথাগুলো তুর্যের সম্মুখে বলার সাহস পায় না ছেলেটা। আবার না বলেও থাকতে পারছে না। অধৈর্য্য লাগছে তার। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের ভিতরে সাহস সঞ্চয় করলো আরুশ। অতঃপর তুর্যকে শুধালো,
-“স্যার আপনি ম্যামকে এখনও বলে দিচ্ছেন না কেন সে আপনার বউ। আপনাদের বিয়ে হয়েছিল।”
থামলো আরুশ। আমতা আমতা করে আবার বলল,
-“একবার সত্যিটা বলে দিলেই তো হয়। সব ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। এসব লুকোচুরি খেলার মানে কি স্যার?”
চলবে…..