#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সাথে সাথে পৃথা চেঁচিয়ে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“সাবধান বিছানায় আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবেন না। সাত বছর আমাকে ছেড়ে ছিলেন না? এখন আরও সাত বছর আমাকে ছেড়ে থাকার প্রস্তুতি নিন।”
তুর্য যেন আকাশ থেকে মাত্রই টুপ করে পড়লো ধরনীর বুকে। বিস্মিত নয়নে তাকালো তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটার দিকে। এসব কি বলছে পৃথা? বিছানায় আসতে পারবে না! আরও সাত বছর বউ ছেড়ে দূরে থাকতে হবে? তুর্যের মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। পরক্ষনেই সে নিজের হাত উঁচিয়ে হাতের কড়গুলো এক এক করে গুনতে শুরু করলো। এখন যদি তুর্যের বয়স সাতাশ বছর হয় তবে সাত বছর পর কত হবে? এক এক করে গুনলো। আটাশ, ঊনত্রিশ, ত্রিশ, একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ, চৌত্রিশ। তুর্যের চোখ গুলো বড় বড় হলো। সাত বছর পর তার বয়স চৌত্রিশ হবে! তুর্য তাকালো বউয়ের পানে। চোখ বড় বড় রেখেই শুধালো,
-“তুমি কি আমাকে আমার বাচ্চাদের থেকে আব্বা ডাক শোনানোর বদলে দাদা ডাক শোনানোর পরিকল্পনা করছো বউ?”
পৃথা ভরকালো। এ পুরুষ এসব কি বলছে? এখনও অব্দি বিয়েটাই ঠিকভাবে মানা হলো না। এর মধ্যে বাচ্চা কাচ্চা কোথা থেকে এলো? বেলাজ , বেশরম পুরুষ কোথাকার। কতদূর অব্দি চিন্তা করে ফেলেছে ভাবতেই শিউরে উঠলো মেয়েটা। পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আপনি বিছানা থেকে উঠুন তাড়াতাড়ি। এখানে আমি একা ঘুমাবো।”
তুর্য বিছানা ছেড়ে উঠলো না। বরং সরু দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,
-“তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো?”
পৃথা নিজের ডান হাত উঁচালো। এক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো সোফার পানে। অতঃপর পরিস্কার কন্ঠে বলল,
-“সোফায়।”
তুর্য ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে না বুঝালো তৎক্ষণাৎ। জোরালো কন্ঠে বলল,
-“এত যু’দ্ধ বিগ্রহ করে করে বউ এনেছি আলাদা ঘুমানোর জন্য নাকি? আশ্চর্য!”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“হ্যা আলাদা ঘুমানোর জন্যই এনেছেন। সাত বছর তো খুব ছেড়ে থেকেছিলেন আমাকে। এখন আরও সাত বছর দূরে থাকবেন।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো পৃথার পানে। অতঃপর হুট করেই একটু একটু এগিয়ে গেল মেয়েটার নিকট। মৃদু কন্ঠে বলল,
-“এখনই তো প্রাপ্তবয়স্ক নয় তুমি। তারপর যদি আবার ফিরতাম ঐ সাতবছরের মধ্যে, সামলাতে পারতে তো আমাকে?”
পৃথার ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো। মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড সময় নিল তুর্যের কথার মানেটা বুঝতে। তবে সম্পূর্ণভাবে পৃথার মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই কান গরম হয়ে উঠলো। বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো সে তুর্যের পানে। ছিঃ কি নির্লজ্জ কথা বার্তা। সামলাতে পারতো মানে কি? পৃথা জ্বলে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“অসভ্য, বেশরম বিছানা থেকে উঠুন আপনি। আমি আপনার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো না, কিছুতেই না। বিয়ের আসরে না হয় ক্রোধের বশে আমাকে ত্যাগ করেছিলেন আমিও তার জন্য আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু এর পরবর্তী সাত বছর কি হয়েছিল? কেন একটাবারও আমার খোঁজ খবর নেননি। এর জন্য আমি আপনাকে মাফ করবো না।”
তুর্য অস্থির হলো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
-“তোমার সাথে আমার জোর করে বিয়ে দেওয়া এবং আমার ক্রোধে বিয়ের আসর ত্যাগ কোনোটাই তোমার অজানা নয়। বিয়ের আসর ত্যাগের এক মাসের মাথাতেই আমি দেশ ছেড়েছিলাম পাড়ি জমিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। কিন্তু সেখানে গিয়েও আমি শান্তি পাইনি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার অবাধ্য পিছুটান আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। বারবার মনে হয়েছে আমি ভুল করেছি। যতই জোর করে বিয়ে হোক না কেন বিয়েটা তো হয়েছে। আবার তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্য ভেবে বার বার পিছিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভোলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তোমাকে ভুলতে আমি অন্য মেয়েদের সান্নিধ্যে পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু….”
এই টুকু বলেই থামতে হলো তুর্যকে। পৃথা জ্বলে উঠলো। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
-“আমাকে ভোলার জন্য আপনি অন্য মেয়েদের সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন? লু’চ্চা ব্যাডা। এতক্ষন তো আপনাকে যাও মাফ করতাম। এখন তো মাফ করার প্রশ্নই ওঠে না। দূর হন আপনি আমার চোখের সম্মুখ থেকে, আমার বিছানা থেকে।”
তুর্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পৃথার কথায়। সে বেশ ভালোই বুঝলো আবেগের বশে ভুল স্থানে ভুল কথার বলে ফেলেছে। এখন কি হবে? বউ যে তার রেগে গেছে ভীষনভাবে। আগে তো শুধুমাত্র বিছানা ছাড়ার কথা বলেছিল। এখন তো চোখের সামনে থেকেও দূর হতে বলছে। তুর্য ব্যস্ত হলো। পৃথাকে ঠান্ডা করতে বলল,
-“কোনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যাইনি তো আমি। শুধুমাত্র যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।”
পৃথা ঠান্ডা হলো না। বরং দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“চেষ্টা তো করেছেন।”
থামলো পৃথা। তুর্যের পানে আঙ্গুল তুলে বলল,
-“এই! এই আপনি এখনও বিছানায় কি করছেন? আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। বিছানা ছাড়ুন দ্রুত।”
তুর্য নিজের জালে নিজেই ফেঁ’সে’ছে। বেচারার এখন ইচ্ছে করছে নিজের চুলগুলো নিজে টেনে টেনে ছিঁড়তে। কে বলেছিল আবেগের বশে তাকে অন্য মেয়েদের কথা বলতে। ঐটা ছাড়া তো বাকি সব বলতে পারতো তাহলেই হতো। তুর্য ঢোক গিললো। করুন কন্ঠে বলল,
-“তোমাকে ছাড়া আমি কোনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যাইনি বউ। ওটা শুধুমাত্র একটু খানি চেষ্টা করেছিলাম। যে চেষ্টায় আমি কখনওই সফল হইনি।”
পৃথা মানলো না তুর্যের কথা। চেঁচিয়ে উঠলো সে। হুমকি দিয়ে বলল,
-“আপনার কোনো কথা আর আমি শুনতে চাইছি না। আপনি বিছানা থেকে উঠবেন নাকি আমি নিজে রুম থেকে বেরিয়ে যাব?”
কথাটা বলেই পৃথা রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। পা বাড়ালো দরজার দিকে। তুর্য ভরকালো। তড়িঘড়ি করে সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত হয়ে বলল,
-“আমি উঠছি তো বিছানা ছেড়ে। সোফায় যাচ্ছি আমি তবুও তুমি বাইরে যেও না।”
পৃথা থমকে দাঁড়ালো। তুর্যের পানে একবার ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানায় বসলো আবার। তুর্য স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো এবারের মতো। যাক বউ তো তবুও বাইরে যায়নি রুমেই আছে। বাইরে গেলেই আবার আরেক ঝামেলা বাঁধতো। এমনিই তাদের আলাদা করার জন্য ঘষেটি বেগমের বংশধর তাহমিনা বেগম ওত পেতে রয়েছেন। তার উপর যদি শুনতেন পৃথাও তার সাথে থাকতে চায় না তাহলে তো হয়েছেই। সাত বছরে আর সত্যি সত্যি বউয়ের মুখ দেখা লাগতো না। বাচ্চা কাচ্চা তো বহুদূরের ব্যাপার। এখন তবুও এক রুমে আছে দু’জন। আসবে যাবে দেখা হবে দুজন দুজনের সাথে। আর পৃথার রাগ! ওটাও খুব দ্রুতই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবে তুর্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তুর্য তাকালো বউয়ের পানে। মেয়েটা ইতমধ্যে শুয়েও পড়েছে। হতাশ হলো তুর্য। কি নিষ্ঠুর বউ তার। তাকে সোফায় ঘুমাতে দিয়ে বিছানা দখল করে কি আরামে শুয়ে পড়েছে। এর মনে কি একটুও দয়া মায়া নেই?
তুর্য অসহায় ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো সোফার পানে। কোনো রকমে আঁটসাঁট বেঁধে শুয়ে পড়লো সোফায়। কিন্তু বউ থাকতেও এভাবে কি একা শোয়া যায়? মন যে মানতে চায় না। তুর্যের মনের মধ্যেও আনচান আনচান শুরু করছে। মুরগির বাচ্চার মতো বউটার সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করছে ভীষন। ক্রমেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছে মন মস্তিষ্ক। তবুও ছেলেটা নিজেকে দমিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা চালালো। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে। এখন তার একটু ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলেও ঘুম আর ধরা দিল না তুর্যের চোখে। শরীর ক্লান্ত, চোখেও ঘুম আছে কিন্তু হৃদয়ের অস্থিরতা ঘুমাতে দিচ্ছে না। বউয়ের সান্নিধ্য না পেলে এই অস্থিরতা কাটবে বলেও মনে হয় না। তুর্য সোফা থেকে মাথা উঁচিয়ে তাকালো বিছানার পানে। মৃদু কন্ঠে ডাকলো,
-“বউ! ও বউ!”
পৃথা কোনো সাড়া দিল না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুর্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। আগের তুলনায় গলা উঁচিয়ে কন্ঠে সুর তুলে ডাকলো,
-“বউ গোওওও, ওওওও বউ।”
কেবলই চোখ দুটো লেগে এসেছিল পৃথার। এর মধ্যেই আবার এর এমন স্বরে ডাকাডাকি। প্রথমবার গান শুনে কোনো সাড়া শব্দ না দিলেও। এবার আর চুপ থাকতে পারলো না মেয়েটা। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে। এমন ছাগলের মতো সুর তুলেছেন কেন?”
পৃথা অপমান করলেও সে অপমান বিন্দু পরিমাণ গায়ে লাগলো না তুর্যের। বউয়ের অপমান গায়ে লাগালে বাচ্চা কাচ্চা আর পয়দা হওয়ার সুযোগ পাবে না। তুর্য ভেংচি কাটলো। ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল,
-“এই টুকু ছোট সোফায় আমার এত বড় শরীরটা আটাচ্ছে না বউ।”
থামলো তুর্য পরপর নিজের পয়ের দিকে ইশারা করে বলল,
-“পা দুটো বাইরে পড়ে আছে দেখো।”
পৃথা বিছানায় উঠে বসলো। কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো তুর্যের পানে। ভারী কন্ঠে বলল,
-“তো আমি কি করবো?”
গলা খাঁকারি দিল তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমাকে একটু বিছানায় নাও না।”
-“না”
পৃথার কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর। তবে হাল ছাড়লো না তুর্য। মলিন কন্ঠে বলল,
-“সারাটা রাত কতটা পথ জার্নি করে এসেছি। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে ভীষন। এখন যদি একটু ঠিকভাবে ঘুমাতেও না পারি। যাক কি আর করার বউ যখন বিছানায় স্থান দিবে না বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হবে।”
পৃথা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। মায়া হলো মেয়েটার। যত যাই হোক না কেন এটা তুর্যের রুম। সেখানে তুর্য ঠিকভাবে ঘুমাতে পারবে না আর পৃথা আরামে ঘুমাবে। বিষয়টা মোটেই ভালো দেখায় না। যদিও পৃথার বেশ ইতস্তত লাগছে এভাবে এক বিছানায় তুর্যের সাথে ঘুমাতে। কিন্তু উপায় তো নেই। এখন বাইরে গিয়ে আলাদা থাকার কথাও বলা যাচ্ছে না। নতুন বউ সে। লাজ লজ্জারও তো একটা ব্যাপার আছে। চাইলেই কি শ্বশুর শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলা যায়,
-“আমি আলাদা ঘুমাবো।”
তারাও বা কি ভাববে। তাছাড়া তুর্য তার স্বামী। যতই মান অভিমান থাকুক না কেন সারাজীবন তো আর আলাদা থাকতে পারবে না। এক সাথে একদিন না একদিন থাকতেই হবে তা এখন হোক আর তখন। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো পৃথা অতঃপর বলল,
-“বিছানায় আসুন।”
তুর্যের ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। যাক তার পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে। বউ তাকে বিছানায় ডেকেছে এর থেকে শান্তি আর আছে নাকি? তুর্য আনন্দে গদগদ হয়ে বিছানায় গেল। সাথে সাথেই পৃথা একটা কোলবালিশ ফেলে দিল বিছানার মধ্য বরাবর। তুর্যের পানে তাকিয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-“আপনি এই কোলবালিশের ওপাশে ঘুমাবেন আর আমি এপাশে। ভুলেও এই কোলবালিশ সরিয়ে এপাশে আসার চেষ্টা করবেন না। মনে করবেন এটা ভারত চীনের বর্ডার।”
তুর্যের মুখ খানা চুপসে গেল। কত আশা নিয়ে সে বিছানায় এসেছিল আর শেষে কি হলো। তাদের মধ্য বরাবর আগাছা হয়ে উদয় হলো এই কোলবালিশের। তুর্য হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। অসহায় কন্ঠে বলল,
-“এর নাম ভারত চীন বর্ডার না রেখে ভারত বাংলাদেশ বর্ডার রাখা যায় না বউ? ভারত বাংলাদেশ বর্ডার হলে মাঝে মধ্যে তাও দুই চার পয়সা ঘুস দিয়েও বর্ডার পেরুনোর সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভারত চীন বর্ডারে নো চান্স। সোজা গু’লি করে খুলি উড়িয়ে দিবে।”
চলবে…..
( আমার দ্বিতীয় ইবুক “কৃষ্ণময়ীর সুদর্শন” পড়েছেন তো। না পড়লে এখনই পড়ে নিন বইটই অ্যাপ থেকে মাত্র ৪০ টাকার বিনিময়ে। আরও একটিবার পড়ে নিন জায়ান আর পূর্বাশার ভালোবাসাময় রোমান্টিক গল্প। গল্পটা বইটি কিভাবে কিনবেন কমেন্ট বক্সে দেওয়া হলো। )