#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
[ প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
আলতোভাবে পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে তোমার। ওঠো তাড়াতাড়ি।”
পৃথা উঠলো না। একটু নড়েচড়ে উঠে পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। টেবিল থেকে প্লেট হাতে নিয়া ভাত মাখাতে মাখতে ডাকলো পৃথাকে। কিঞ্চিৎ শক্ত কন্ঠে বলল,
-“তুমি উঠবে নাকি আমি জোর করে উঠিয়ে বসিয়ে দেব?”
পৃথা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালো আবার। ঘুমের ঘোরেই উঠে বসালো বিছানায়। চোখ বন্ধ রেখে বলল,
-“সমস্যা কি এত ডাকছেন কেন? বলছি তো আমি খাবো না। আপনি খান, খেয়ে ঘুমান।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই আবার মেয়েটা শুয়ে পড়তে নিল বিছানায়। তুর্য এক হাত বাড়িয়ে আঁটকে দিল পৃথাকে। শাসনের সুরে বলল,
-“না খেয়ে একদম শুবে না তুমি।”
পৃথাও আর বলল না কিছু। এতক্ষনে এটুকু সে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে যে সে না খেলে তুর্য ঘুমাতে দিবে না। তার থেকে বরং খেয়ে ঘুমানোই ভালো। ঝামেলা থাকবে না কোনো। তুর্য ততক্ষণে ভাত মেখে হাতে লোকমা নিয়ে ধরলো পৃথার মুখের সম্মুখে। মেয়েটাও কোনো দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল কয়েক লোকমা। অতঃপর ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
-“ব্যস আর খাবো না। এখন আমাকে ঘুমাতে দিন।”
তুর্যও খাওয়া নিয়ে আর জোরাজুরি করলো না। অল্প খেলেও খেয়েছে তো। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে সে আবার ডাকলো পৃথাকে। বলল,
-“পানি খেয়ে ঘুমাও বউ।”
পৃথা অর্ধশোয়া হয়ে বসলো। স্বামীর হাত থেকেই একটু পানি পান করে আবারও শুয়ে পড়লো। তুর্য হাসলো ওষ্ঠ প্রসারিত করে। বউটা তার ভীষন ঘুম কাতুরে। এতক্ষন যদি তাকে নিয়ে কেউ এভাবে টানাটানি করতো ঘুম সেই প্রথম দিকেই উবে যেত। তুর্য আবারও হাসলো, হাত বাড়িয়ে মুছিয়ে দিল পৃথার মুখ অতঃপর নিজেও খেতে শুরু করলো ঐ প্লেট থেকেই।
ক্ষানিক সময় নিয়ে নিজের খাওয়া শেষ করলো তুর্য। খাবার প্লেট গুলো গুছিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো বিছানায় পৃথার পাশেই। আজ তাদের মধ্যে কোলবালিশ নেই কোনো। থাকবে কোথা থেকে? সে কোলবালিশ তো তুর্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই সকলের অগোচরে বাইরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন যেন কেন তার মনে হচ্ছে কোলবালিশটা থাকলেই ভালো হতো। তুর্য ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ভিতরে ভিতরে তার পুরুষালী সত্ত্বা নড়েচড়ে উঠছে একটু একটু করে। একজন বিবাহিত পুরুষ মানুষ বউকে নিয়ে এক বিছানায় খুব কাছাকাছি শুয়ে আছে এমন পরিস্থিতিতেও কি তার পুরুষালী অনুভূতিগুলো হানা দিবে না? অবশ্যই দিবে। তুর্যেরও দিয়েছে। যদিও একটা সামান্য কোলবালিশ কখনও তার পুরুষালি সত্ত্বাকে বেঁধে রাখতে পারতো না কিন্তু মনকে তো বুঝ দিতে পারতো এটা বলে যে বউ তাদের মধ্যে প্রাচীর তুলে দিয়েছে, এই প্রাচীরের ওপাশে যাওয়া তার বারন। তুর্যের ভাবনা চিন্তার মধ্যেই পৃথা ঘুমের ঘোরে এগিয়ে এলো তার পানে। নিজের এক হাত দ্বারা জড়িয়ে ধরলো তুর্যের বেকাবু শরীর খানা। শিউরে উঠলো ছেলেটা, সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল মুহুর্তেই। এমনিই এতক্ষন নিজের ভিতরকার পুরুষালী সত্ত্বার অনুভূতিতে অসহায় ছিল সে এর মধ্যে আবার বউয়ের স্পর্শ। পৃথার শরীরটা একদম লেগে আছে তুর্যের শরীরের সাথে। মেয়েটার প্রতিটি ভারী নিঃশ্বাস জাগিয়ে তুলছে তুর্যের শরীরের লোমকূপগুলো। কি একটা অবস্থা! তুর্যের দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। ঝাপটে ধরতে ইচ্ছে করছে পৃথার নরম দেহটা। মেয়েটার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে নিজের স্পর্শ এঁকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুর্য যেন একটু বেশিই বেকাবু হয়ে পড়লো আজ। নিজেকে আর সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু করার যে কিছুই নেই। তাকে নিজেকে সংযত রাখতে হবে। এই মুহূর্তে অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গিয়ে পৃথার সাথে জোর জবরদস্তি করলে তাদের সম্পর্কের অবনতি বই উন্নতি হবে না। মেয়েটার মনে তুর্য সম্পর্কে বাজে ধারনা সৃষ্টি হবে। আজকে এক রাতের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে হয়তো পরে দেখা যাবে কখনও তাকে মেনেই নিতে পারলো না পৃথা। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। নিজের শরীর থেকে পৃথার হাতটা সরিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে নেমে পড়লো বিছানা থেকে। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা চালালো। কিন্তু পৃথাকে ছেড়ে এখানেও ভালো লাগছে না। মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে। এত বছর এত অপেক্ষার পর পৃথাকে কাছে পেয়েও দূরে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কি এক যন্ত্রনার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে তুর্য। না পারছে সইতে আর না পারছে মুখ ফুটে বলতে। তুর্য বারান্দায়ও থাকতে পারলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই আবারও বিছানায় চলে এলো। শুয়ে পড়লো পৃথার পাশে মেয়েটার পানে মুখ ফিরিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
-“এত কেন পোড়াচ্ছো আমাকে বউ? ঐ সাত বছরের জন্য? যে সাতটা বছরে তোমার কোনো অনুভূতিই ছিল না, ঐ সাত বছর তো তোমার কোনো কষ্টও হয়নি কারন তুমি জানতেই না আমাদের বিয়ের কথা। জেনেছো মাত্র কয়েকদিন আগে। সেই কয়েকদিন আগে জেনেই দীর্ঘ সাত বছরের জন্য অভিমান করে বসলে অথচ আমি তো পুরো সাতটা বছরই তোমার জন্য ছটফটিয়ে কাটিয়েছি, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি, তোমাকে পাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি। কিন্তু শেষ অব্দি কেউ আমাকে বুঝলো না এমনকি তুমিও বুঝলে না। আমাকে তোমরা কেন বুঝলে না বউ?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না কোনো। আসবে কিভাবে? পৃথা তো ঘুমাচ্ছে, গভীর ঘুমে নিমজ্জিত সে। তুর্যের বলা কোনো কথাই তো কর্ণে পৌঁছায়নি তার। আচ্ছা মেয়েটা যদি এই মধ্য রাতে তুর্যের এই কাতর কন্ঠের বাক্যগুলো শুনতো তারপরেও কি অভিমান নিয়ে বসে থাকতে পারতো? হয়তো পারতো আবার হয়তো পারতো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। একটু এগিয়ে পৃথাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। হৃদয়ে স্থান পাওয়া অনুভূতিদের সাথে হাজারটা যু’দ্ধে লড়াই করতে করতেই দুই চোখ বন্ধ করলো ছেলেটা।
৩৩.
সকালের আলো ফুটেছে চারদিকে। সূর্যটা ধীরে ধীরে নিজের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘেরা শহরটাও ধীরে ধীরে তার ব্যস্তময় পরিচিত রূপে ফিরে এসেছে। চারদিকের কোলাহল ধ্বনিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল পৃথার। একটু নড়েচড়ে উঠতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো কারো শক্তপোক্ত পুরুষালী বাহুবন্ধনে। পিটপিট করে চোখ খুললো পৃথা। চোখের সম্মুখে দেখতে পেল তুর্যের ঘুমন্ত মুখশ্রী। ছেলেটা কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে তাকে। মুহুর্তেই দু চোখ থেকে পুরোপুরিভাবে ঘুম উধাও হয়ে গেল মেয়েটার। ছিটকে দূরে সরে গেল পৃথা। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“আপনি আমার এত কাছে কেন? আর কোন সাহসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন ব্রিটিশ অ’স’ভ্য পুরুষ?”
পৃথার আকস্মিক ধাক্কায় হকচকিয়ে উঠলো তুর্য। হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো সে। কিন্তু পরক্ষনেই সকাল সকাল নিজের বউয়ের মুখ থেকে এমন ঝাঁঝালো বাক্য কর্ণে পৌঁছাতে বিরক্ত হলো। সারারাত কতটা যন্ত্রনায় সে কাটিয়েছে তবুও কোনো প্রকার জোর করেনি বউকে উল্টো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথচ সকাল সকাল কিনা সেই বউ একটু জড়িয়ে ধরার জন্য চোটপাট দেখাচ্ছে। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকালো তুর্য অতঃপর বলল,
-“আমি জড়িয়ে ধরি নি বরং তুমি জড়িয়ে ধরেছো। তাকিয়ে দেখো আমি আমার স্থানেই আছি, উল্টো তুমি তোমার স্থান থেকে সরে এসেছো।”
সেই গাড়ির মতো যুক্তি। পৃথার এবার সন্দেহ হলো। বারবারই কি সে নিজের স্থান ছেড়ে তুর্যের নিকটে যায়? পৃথা সন্দিহান সুরে প্রশ্ন করলো,
-“প্রতিবার আমিই আমার নিজের স্থান থেকে সরে আপনার কাছে যাই নাকি এর মধ্যে অন্য কোনো কারন আছে?”
তুর্য অপ্রস্তুত হলো পৃথার কথায়। মেয়েটা কোনোভাবে ধরে ফেললো না তো তার কারসাজি? এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,
-“এর মধ্যে আবার অন্য কি কারন থাকবে?”
থামলো তুর্য। বিছানা থেকে চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। তাড়াহুড়ো করে বলল,
-“আমার পেটে চাপ দিয়েছে ভীষণ। ওয়াশ রুমে যেতে হবে।”
কথাটা বলেই এক প্রকাশ দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকলো তুর্য। পৃথার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। ধারালো দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইলো তুর্যের চলে যাওয়ার পানে।
৩৪.
পৃথা ফ্রেশ হয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়েছে অনেক আগেই। ইতমধ্যে সকলের সাথে খাবার টেবিলেও বসে পড়েছে সে। তুর্যও কিছু সময়ের মধ্যেই একদম স্যূট বুট পড়ে বেড়িয়ে এলো কক্ষ থেকে। গলা বাড়িয়ে বলল,
-“আমি বাইরে যাচ্ছি, কাজ আছে অনেক।”
তহমিনা বেগম সাথে সাথেই কপালে ভাঁজ ফেললেন। তিনিও গলা বাড়িয়ে বললেন,
-“খেয়ে তারপর যেদিকে খুশি যা।”
তুর্য হন্তদন্ত হয়ে খাবার টেবিলের কাছে এলো। পৃথার প্লেট থেকে একটা শুকনো পাউরুটি তুলে মুখে পুড়লো। চিবুতে চিবুতে বলল,
-“এখন আসছি।”
তাহমিনা বেগম আর কিছু বলবেন তার আগেই তুর্য পা বাড়ালো সম্মুখ পানে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার কি মনে করে তাড়াহুড়ো করে ফিরে এলো খাবার টেবিলের নিকট। একবার সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে একটু ঝুঁকে গেল পৃথার পানে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
-“ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে বউ, নিজের যত্ন নিবে। আমার আজ ফিরতে একটু দেরী হবে।”
কথাটা শেষ করে পরপরই আবার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল তুর্য। পৃথা অবাক চোখে চেয়ে রইলো স্বামীর চলে যাওয়ার পানে। তুর্যের একটু আগের বলা কথাগুলো কেমন যেন এক রাশ ভালো লাগার সৃষ্টি করলো তার হৃদয়ে। তাদের বৈবাহিক জীবনে একসাথে থাকা কেবল মাত্র দুই দিন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি এখনও, সে ভালো কোনো ব্যবহারও করেনি তুর্যের সাথে অথচ ছেলেটা তার কতটা যত্ন নিচ্ছে। গতকাল রাতে তুলে খাইয়ে দেওয়া এখন আবার এতটা আদুরে ভঙ্গিতে তার থেকে বিদায় নেওয়া। একটা মানুষকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দিলে তার থেকে অবহেলা পেয়েও তার যত্ন নেওয়া যায় ভাবছে পৃথা।
চলবে…..