অচেনা পর্ব ৩
শিবলী ভাইয়ের লিপস্ক্রাব কেনার বিষয়টা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। যদিও আমি স্বাভাবিকই থাকলাম। তবুও আমার ফাঁটা ঠোঁটজোড়া এতদিনে যেহেতু দেখতে পেয়েছে তাই প্রেম হতে আর বাকি নেই। আমার পক্ষে অবশ্য উনাকে আর হ্যাঁ বলা সম্ভব না। যেহেতু সামনে আমার বিয়ে তাই না বলে দিতেই হবে। উনি হয়তো ভগ্নহৃদয়ে আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিষয়টা চিন্তা করেই শান্তি লাগছে।
আমার ছোট চাচীর ঘরে ধুম ধারাক্কা নাচ হচ্ছে। কালকের মধ্যে নাচ তুলে ফেলা হবে। পরশু নাকি ড্রেস রিহার্সাল আছে। স্টেজে উঠে নাচানাচি হবে। উঠানেই দুইটা টেবিল জোড়া লাগিয়ে স্টেজ করা হবে। আমি ছোট চাচীর ঘরে উঁকি দিলাম। ঘর থেকে গরমে আগুনের ভাপ বের হচ্ছে বলে মনে হলো। ছোট চাচীর ঘরে মেজ চাচীর দুই মেয়ে রুনি টুনি কোমরে ওড়না বেধে এদিক ওদিক লাফিয়ে কিছু একটা করছে। ওদের ছোট ভাই রুনন যে ক্লাস ফাইভে পড়ে সে একটা সানগ্লাস পরে কিছু একটা ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। তার পাশেই ছোট চাচীর পাঁচ বছরের ছেলে শ্রাবণ মনের আনন্দে খুবই লাফাচ্ছে। এই নাচটা একটু ভালো হচ্ছে। এক কোণায় আমার মামাতো বোন রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। সে খুবই সংকোচের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট চাচী দেখি তাকে বোঝাচ্ছে,
“তুমি হাতটাকে এইযে নমস্কারের মতো করবা। করে লাফ দিয়ে স্টেজের একদিক থেকে আরেকদিকে যাবা। বুঝেছো?”
“যদি পড়ে যাই?”
“আরে পড়বা কেন? দুইটা টেবিল তো জোড়া লাগানো থাকবে।”
রুমকি ভয়ে ভয়ে লাফ দিলো। লাফ তেমন জোড়ালো হলো না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। এই ঘরের ছাদটা টিনের। তাই গরম খুব বেশি।
আমি আর বসে না থেকে আমার মায়ের পাশে গেলাম।
আমার মা বারোমাসী রোগী। আজকে কোমর ব্যথা তো কালকে পিঠ ব্যথা। আজকে কি হয়েছে জানি না। দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন উনি। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখছেন। আবার উহ আহ করে চোখ বন্ধ করে ফেলছেন।
আমার মায়ের অসুস্থতায় অবশ্য বাড়ির কাজে তেমন অসুবিধা হয় না। দুই চাচী সব সামলে নেন। তবে যেদিন একটা তরকারি কম হয় বা ডালে লবন বেশি হয় সেদিন দুই চাচী মুখটা গম্ভীর করে বলে,
“বুবুর আজকে শরীরটা ভালো ছিলো না। সারাদিন কি যে টানাটানিতে গেলো দিনটা।”
সবাই বেশ আহা উহু করে বিষয়টা শেষ হয়ে যায়। আরেকটা সময়ে মায়ের অসুস্থতা বেশ কার্যকরী। আমাদের যখন কোন বিশেষ দাওয়াত থাকে যেমন ফুপুর বাসায় কারো বিয়ে কিংবা মেজচাচীর বাসায় কারো জন্মদিন তখন আমরা মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে যাই না। আসল কারণ বড়লোক আত্মীয়র বাসায় গেলে উপহার, মিষ্টি এসব নেওয়ার ঝামেলা থাকে। এই ঝামেলা থেকে বাঁচা আমাদের জন্য খুবই জরুরী।
মা খুব আস্তে করে উঠে বললো,
“হ্যাঁ রে রাবেয়া! তোর বরের কোন ছবি পেলি? ছেলে কি দেশে এসেছে? কিছুই তো জানি না।”
“না মা। পাত্রের ছবি বা পাত্র কাউকেই পাওয়া যায়নি। পাত্র দেশে এসে পৌছাবে বৃহস্পতিবার। অতএব দেখাদেখি সব বিয়ের পর।”
মা অস্ফুট স্বরে কি বলতে বলতে জানি আবার শুয়ে পড়লো।
বিকালবেলা আমার নানা ফোন করে আমার বাবার সাথে লম্বা সময় কথা বললো। ফোনের এপাশ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভদ্রতাসূচক হাসি ধরে রাখার কিন্তু কেন জানি তার মুখটা ধীরে ধীরে ঝুলে যাচ্ছে। ফোন রেখে বাবা মেজচাচার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিরাট বিপদ। বজলুর বিয়ে পরের সপ্তাহে।”
এখানে বাবা কেন বিপদে পড়লো বুঝলাম না। তবে আমার একটু শান্তি লাগছে। বজলুকে লিস্টে রাখতে ভালো লাগছিলো না। কিন্তু আমার আবার তিনজনের থেকে ছোট লিস্ট রাখা পছন্দ না। যাক বজলু বাদ পড়লো। এই ছেলেটাকে আমার অসহ্য লাগে।
বাবা আর মেজচাচা অন্যঘরে চলে গেলো। “বিরাট বিপদ” নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে। বড় ভাইয়া ভাত খেতে খেতে বললো,
“তুই বুঝলি কি হলো?”
“কিছুই বুঝলাম না। ঘটনা কি?”
“নানা এক লাখ টাকা আর একটা সোনার ব্রেসলেট দেওয়ার কথা ছিলো। সেই এক লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে জামাইয়ের জন্য কাপড় কেনা হবে। বাকি পঞ্চাশ হাজার তোর হাতে দেওয়া হবে। এখন বজলুর বিয়ে হলে সেই আশার গুড়ে বালি। নানা তো বজলুকে সবচেয়ে ভালোবাসে।”
এই কথাটা ঠিক যে নানা বজলুকে সবচেয়ে ভালোবাসে। কিন্তু টাকাটা খুবই দরকার। সোনার ব্রেসলেটটা পাওয়া যাবে কিনা কে জানে! নানী তো সেই কবেই দিয়েছে। নানী মারা যাবার পর আনবো আনবো করে আর নিয়ে আসা হয়নি। এখন তো কি একটা বিপদ হলো।
ভাইয়া খাওয়া শেষ করে বারান্দায় রাখা বালতি থেকে পানি নিয়ে হাত ধুতে লাগলো। আমি পাশে সাবান আর গামছা নিয়ে দাঁড়ালাম। হাত ধুতে ধুতে ভাইয়া বললো,
“রাবেয়া তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি খুব ভালো ব্যবস্থা করছি। তুই নিশ্চিন্তে আমিনুল না ফাহিমুল তার কথা ভাবতে থাক।”
“তুমি টাকা দিবা?”
ভাইয়া গামছা বাদ দিয়ে আমার ওড়নায় হাত মুখ মুছে বললো,
“না। আমি দিলে বড়জোর বিশ হাজার। কিন্তু আমি কয়েক লাখ টাকার ব্যবস্থা করছি। তুই শুধু দেখ।”
এরমধ্যে মেজচাচী এসে ভাইয়ার হাতে টাকা ধরিয়ে দিলো। দিয়ে বললো,
“শিবলীকে লিপস্ক্রাবের টাকাটা দিয়ে দিস তো। কালকে কবিতা শুনছিলাম তো। তাই টাকার কথা ভুলে গিয়েছি।”
বলেই মেজচাচী হন্তদন্ত হয়ে ছোট চাচীর ঘরে চলে গেলো। নাচানাচির অবস্থা মনে হয় তুঙ্গে।
পড়ন্ত দুপুর এখন। সূর্য হেলে পড়েছে একদিকে। এই সময়টা আমাদের স্যাতস্যাতে বাড়িটা দেখতে এত ভালো লাগে। কেমন কোমল একটা রোদ। আমি হাতে সাবান আর গামছা নিয়ে বারান্দাতেই বসে থাকলাম।
স্পর্শকে দেখতে পেলাম। সে ছোট গেট খুলে ঢুকে বড় গেইটা খুললো। সে বড় গেইট টা কেন খুলছে কে জানে! বোঝার জন্য আমি মেজচাচাকে ডাক দিলাম। ডেকে এনে আমি বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলাম। একটা মাইক্রোবাস ঢুকেছে যেখান থেকে আমার ফুপু আর ফুপা নামছে। উনারা আমেরিকায় থাকে। আমি লাফিয়ে সিড়ি থেকে নামার আগেই কোথা থেকে জানি মেজচাচী এসে “বড় বুবু” বলে চিৎকার করে লাফিয়ে ফুপুকে জড়িয়ে ধরলো। আমার বুকের মধ্যে খুশিতে ছলাৎ ছলাৎ করছে। ফুপু থাকলে আমাদের এমনিতেই আনন্দ হয়। বাসার সবাই একে একে বেড়িয়ে আসছে। কে কিভাবে খুশি প্রকাশ করবে ভেবে পাচ্ছে না। শুধু ছোট চাচী কি জানি বলার জন্য উশখুশ করছে।
এদিকে রুনন ফুপার হাত ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে একই কথা বলে যাচ্ছে,
“আমার হেলিকপ্টার! আমার হেলিকপ্টার!!”
পাঁচ বছরের শ্রাবণ শুধু কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে বড় ভাইয়ার কোলে উঠে নাচের স্টেপ দিয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া আস্তে করে মুখটা আমার কানের কাছে এনে বললো,
“সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম? টাকা নিয়ে আর চিন্তা করিস না।”
ভাইয়া আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ছোট চাচী ভাইয়াকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে চলে গেলো। একটু পর ভাইয়া আর চাচী দুইজন মিলে আমার মামাতো বোন রুমকিকে রক্তাক্ত অবস্থায় কোলে কেমন অদ্ভুতভাবে বসিয়ে বের করে আনলো ঘর থেকে। এরপর সোজা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে কোথায় জানি চলে গেলো। পুরো দৃশ্যটি সিনেমার মূল ঘটনার পাশের দৃশ্য বলে মনে হলো। সবাই কিছুক্ষণ তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হৈ হৈ করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেলো।
বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম আর স্পর্শ উঠানে দুইটা সুটকেস আর একটা কার্টন নিয়ে ইতস্তত চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
(চলবে)