অচেনা পর্ব ৪
ফারাহ তুবা
স্পর্শকে আমি বাসায় সুটকেসগুলো ঢুকিয়ে দিতে বললাম। এছাড়া আর উপায় নেই। ঠেলেঠুলে সবগুলো লাগেজ বারান্দায় ঢুকিয়ে হাঁপাতে লাগলো। একইসাথে চারিদিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগলো। নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসার পর অবাক হয়ে বললো,
“আপনাদের বাসার একি অবস্থা! বাইরে থেকে দেখে ভাবতাম আলোর সমস্যা মনে হয়। গ্রীলগুলো দেখে মনে করেছি অনেকদিন রঙ করা হয়নি। কিন্তু আপনাদের বাসার অবস্থা তো খুবই খারাপ। দেয়ালে সবুজ কালো এসব কি! হলুদ না সাদা রঙের দেয়াল তা তো বোঝাই যাচ্ছে না। আর ওদিকে কি সর্বনাশ!”
এই পর্যন্ত বলে আমাদের বারান্দার সাথে লাগা রান্নাঘরের দরজার ভেঙে যাওয়া অংশ ধরে দেখতে লাগলো। ওখানে সামান্য রড বের হয়ে আছে। আমাদের বাসাতে অনেক অংশেই এরকম আছে। তাই আমাদের এসবে অবাক লাগে না। একবার মেজচাচীর ঘরে ছাদের কিছু সিমেন্ট খসে পড়েছিলো পায়ের উপর। চাচী ঘুমের ঘোরে আচমকা উঠাতে ব্যথা পেয়েছিলো। সেই চিৎকারে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এছাড়া আর তেমন কোন অসুবিধা আমরা এসবে বোধ করিনি। তবে স্পর্শ একটা করে সুটকেস ভেতরে নিয়ে যায় আর অবাক হয়। তার বিস্ময়ের সীমা থাকলো না যখন আমাদের কালো মোজাইকের মেঝে সামান্য উঠে আসলো সুটকেস টানাটানিতে। সে যাবার সময় বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আঙ্কেল! আমি যে আপনাদের বাগানের কোণায় ভাড়া থাকি সেটা নাকি সার্ভেন্ট রুম। ওখানে মেঝেতে দামী টাইলস আর বাথরুমের একেকটা হোল্ডার তো অনেক দামী মনে হয়। আপনাদের বাসার এই অবস্থা কেনো?”
এই বলে আমাদের বারান্দার সোফা নাড়িয়ে বললো,
“এই সোফাতো মনে হচ্ছে বসলেই ভেঙে যাবে।”
বসার আর প্রয়োজন পড়লো না। একটু নড়ানোতেই এক পা খুলে গেলো। আসলে এই পাটা অনেকদিন ধরে ভাঙা। আমরা বাড়ির মানুষরা কায়দা করে বসতে পারি। স্পর্শ তো আর এসব জানে না। সে অপ্রস্তুত হয়ে প্রশ্নের উত্তর না নিয়েই চলে গেলো। বাবাও খুব স্বাভাবিকভাবে ভেতরে চলে গেলো। আমরা এই প্রশ্নের সাথে অভ্যস্ত। আমি গিয়ে আবার মোজাইকের টুকরাটা জায়গামতো বসিয়ে দিলাম। সোফার পায়াটা ঠিক করে দিলাম।
সন্ধ্যা নাগাদ রুমকিকে নিয়ে ভাইয়া আর ছোট চাচী চলে আসলো। আসার পর ঘটনা জানা গেলো। ঘটনা হলো নাচানাচিতে লাফানোর সময় রুমকির পায়ে আলনার ভাঙা অংশ ঢুকে গিয়েছে। সে ব্যথা সামান্য পেয়েছিলো। কিন্তু চাচী কি করতে গিয়ে জানি কাটা গভীর হয়ে গিয়েছে। নড়াচড়াতে রক্ত ছড়িয়ে গিয়ে হয়েছে বিপদ!
আমি কিছুতেই ভেবে পেলাম না ওর মুখে আর মাথায় রক্ত লাগলো কিভাবে! কিন্তু কেন জানি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে না। রুমকি ছোট চাচীর বিস্কুটের টিন নিয়ে বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। আজকেই মনে হয় শেষ করে দিবে। চাচী এই টিন তিন মাসে শেষ করে। কিন্তু আজকে রুমকিকে কেউ কিছু বলতেও পারছে না।
আমি ছাদে চলে গেলাম। ছাদে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম যে স্পর্শের উপস্থিতি আমার মনে কোন দোলা দিয়েছে কিনা! আসলে দেয়নি। কিন্তু কেন?! আমি কি অস্বাভাবিক! হয়তো আমার প্রেম করার ক্ষমতা নেই। শিবলী ভাইয়ের কথা ভাবলে আগে মনের মধ্যে কেমন করতো। সময়ের সাথে সাথে সেটাও চলে গিয়েছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বাইশ বছর বয়স আমার। ডিগ্রী পর্যন্ত সব গার্লস দিয়েই পার করেছি। তাই বলে একটা কোন ছেলে আমার জন্য পাগল হবে না। আমার পিছে ঘোরাঘুরি করবে না? এ কেমন কথা!
রাত প্রায় আটটা বাজে। সবার খাওয়া মনে হয় এতক্ষণে শেষ। আমাকে আজকে কেউ ডাকছে না। ইদানিং আমার রূপচর্চা ছাড়া কোন বিষয়ে তেমন জোরাজুরি করা হয় না। তাছাড়া ছোট চাচা আমাকে দূরে দূরে থাকতে বলেছে। আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হবে। এরমধ্যে আমার নাকি থাকার প্রয়োজন নেই।
আমার মনের মধ্যে কেমন জানি গভীর প্রেমভাব উদয় হচ্ছে। আগে থেকেই ইচ্ছা হতো যে আমাকে কেউ পাগলের মতো ভালবাসুক। কিন্তু কেন জানি আমার মধ্যেও এই অনুভূতিটা উঁকি ঝুকি মারছে। স্পর্শ বা শিবলী ভাইয়ের জন্য না। কার জন্য কে জানে!
আমি নিচে নেমে আসলাম। এখনই মুখ ঘষাঘষি না শুরু করলে মেজচাচী অস্থির হয়ে যাবে। নিচে বেশ উৎসবের আমেজ চলছে। পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো হচ্ছে। বাটি এদিক সেদিক ঘুরছে। বিয়ে নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু পুরো আলোচনা হচ্ছে ফুপুর সারপ্রাইজ ভিজিট নিয়ে। ফুপু খুব উত্তেজিত স্বরে বলছে,
“আরে তোমরা তো বলে দিয়েছো যে কোন অনুষ্ঠান করছো না। আমিও তাই আর কাজ থেকে ছুটি নেইনি। এভাবে কি আর আসা যায়…..”
এরপর লম্বা করে ভাইয়ার জোরাজুরির গল্প শুনলাম। ভাইয়া নাকি বলেছে ফুপুরা আসলে এটাই আমার উপহার হবে। তারপর কিভাবে কাউকে না জানিয়ে স্পর্শকে ভাইয়া এয়ারপোর্টে পাঠালো আর কিভাবে ফুপুরা আসলো এই গল্প করতে করতে ফুপু নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলো।
আমার এই আসরে বসা হলো না। মেজচাচী টেনে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলো। আবারও সবুজ কি জানি মাখিয়ে দিলো। আজকে সবুজের মাঝে কমলা রঙের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। চাচী আনন্দিত হয়ে বললো,
“পাশে যে বিল্ডিং ওখানে আমার এক বান্ধবী থাকে। ওর কাছ থেকে দুই চামচ অন্য আরেকটা স্ক্রাব এনেছি। দেখি কি হয়!”
মেজচাচী অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আমার মুখে স্ক্রাব মাখাচ্ছে। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। মেজচাচীর খুব সাজগোজের জিনিসের শখ। বেচারি প্রায়ই একটা ড্রেসিং টেবিলের জন্য টাকা জমায়। কিন্তু সংসারের টানাটানিতে সবই খরচ হয়ে যায়। এই যে আমার জন্য দুই তিনটা জিনিস কিনেছে এসবে মেজচাচীর প্রায় তিন হাজার টাকা চলে গিয়েছে। মেজচাচী এই টাকা বাজারের খরচ থেকে কতদিনে বাঁচিয়েছেন কে জানে!
“মেজচাচী শুনো। আমার কার সাথে বিয়ে হচ্ছে?”
“ভালো মানুষের সাথে।”
আমি হেসে ফেললাম। মেজচাচী রেগে বললো,
“তুই হাসছিস কেন? মুখে এইসব দিয়ে একদম হাসবি না। ভাঁজ পরে যাবে মুখে।”
“তোমাকে কে বললো যে সে ভালো মানুষ?”
চাচী আমার গলায় স্ক্রাব মাখাতে মাখাতে বললো,
“আমিনুলের মাকে দেখে বুঝলাম। দেখলি না কি সুন্দর করে কথা বলে। ছেলে বিদেশে থাকে অথচ কোন দেনাপাওনা নাই। অহংকার নাই।”
আমি চুপ করে থাকলাম। আর বিয়ের বাকি পাঁচ দিন। আমার দুই চাচীর যত শখ দুই দিন পর থেকে এটা সেটা অনুষ্ঠান শুরু করে দিবে। এখন যেহেতু ফুপু আছে তাই হয়তো কিছুটা খরচও করা হবে। এত আয়োজন যার জন্য সেই মানুষটাকেই দেখলাম না। আশেপাশে কিনা শিবলী ভাই, স্পর্শ এদের নিয়ে ঘুরছি। বজলু তো এখন লিস্ট থেকে বাদ হয়ে গিয়েছে। এখন কি আমিনুলকে লিস্টে রাখবো! রাখা যায়। হয়তো সে চারদিন পর দেশে এসে প্রেমের প্রস্তাব দিবে। আমায় ছবি দেখে হয়তো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। “হয়তো” র উপর দিয়ে কি বিয়ে করা ঠিক হচ্ছে!
সব রূপচর্চা শেষ করে আমি বারান্দার ঠান্ডা বাতাসে বসে থাকলাম। ঘরের সব কথা বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফুপু আগে থেকেই আমার গয়না বানিয়ে রেখেছিলো। তাই এটা নিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত। আহামরি কিছু না। চার আনা করে আট আনার কানের ঝুমকা বানানো হয়েছে। ফুপুর এক ভরির চেইন আর দুইটা কানের দুল গতবার এনেছিলো। সেগুলো দিয়ে টেনেটুনে একটা মালা বানানো আছে। এটুকুই আমার সম্বল। আমার নানা এখন ব্রেসলেটটা দিবে কিনা এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমার মায়ের ইচ্ছা গিয়ে ঝগড়া করে নিয়ে আসা। ফুপু আর ছোট চাচা ভদ্রভাবে আলোচনা করে নিয়ে আসতে চায়। ভাইয়া একবার চুরির প্রস্তাব দিলো। ভাগ্যিস ভাইয়ার কথাটা কেউ শুনতে পায়নি এত কথার মাঝে। রাত বেড়েই চললো। নানাভাবে টাকা জোড়া লাগিয়ে কিভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা যায় তার নানা ধরনের বুদ্ধি বের হচ্ছে। আমার ফুপু আসায় টাকার সমস্যা তেমন কমেনি। তবে বাড়িতে উৎসবের আমেজটা বেড়ে গিয়েছে। রুমকি পা ছেচড়ে ছেচড়ে আমার পাশে এসে বসলো। সে একটা বিদেশী চকলেট খেতে খেতে বললো,
“আপা, আমার নাচ তো বন্ধ। শোন তোর বিয়ের পর তুই তোর চাচীর হিন্দি সিনেমা দেখা বন্ধ করিস। কি কি সব যে করাচ্ছে বাচ্চাদের দিয়ে। উনি আর মেজচাচীও অবশ্য নাচবে। মা বলছে যে উনারও শখ আছে। হলুদ শুধু মেয়েরা মেয়েরা হলে মা নাচবে।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “মামী নাচবে? এই শরীর নিয়ে?”
রুমকি হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”
হঠাৎ রুমকির আচরণ কেমন বদলে গেলো। সে খুব অস্থির হয়ে বললো,
“আপা, বাইরে থেকে কি আমাদের দেখা যাচ্ছে? চুলটা কি ঠিক আছে? কি যে ছাতার মাথা পায়ে ঢুকলো। সন্ধ্যায় চুলটাও আচড়ানো হয়নি। আমি যাই মুখটা ধুয়ে আসি।”
অস্থির হয়ে রুমকি পা টেনে ছেচড়ে ভেতরে চলে গেলো। কিছুই বুঝলাম না আমি। বাইরে দোলনায় বসে স্পর্শ কিছু একটা আবৃত্তি করছে। আজকে খুব আস্তে আস্তে করছে তাই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ভরাট গলাটা শুনতে ভালো লাগছে।
শুনতে শুনতে মনে হলো আমিনুলের গলার স্বরটা কেমন। আজকালকার যুগে কেউ না দেখে কথা বলে বিয়ে করে! এসব তো আর আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। বাড়ির সবাই আমাকে বেহায়া ভাববে। মনের মধ্যে অবশ্য বেহায়াপনাই ঘুরে আমার। বাইরে যত ভালোমানুষি।
সেইরাতে বার বার ঘুরেফিরে আমিনুলের কথা মনে হতে লাগলো। ঘুমের মধ্যে কেমন একটা মিষ্টি বাতাসের মতো আমেজও কাজ করলো।
(চলবে)