অচেনা পর্ব ৫
আমি যদি সারাদিন ধরি সেইক্ষেত্রে হাতে আর চারদিন আছে। ফুপু বিরাট লিস্ট করে সবার হাতে কাজের দায়িত্ব ধরিয়ে দিয়েছেন। টাকা পয়সার ভাগ বন্টনও হয়েছে। এখন আমার বিয়েতে মেহেদী, হলুদ, সংগীত সব কিছুই হচ্ছে। মেজচাচীর দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে যার আইফোন 13 প্রো ম্যাক্স আছে। সে এসে এমনভাবে ছবি তুলবে যে মনে হবে খুবই আধুনিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। শুধু অনুষ্ঠানে মানুষজন তেমন বাড়ানো হয়নি। ফুপু ফুপাসহ আমরা বাড়ির চৌদ্দ জন মানুষ। আমার নানা বাড়ি থেকে শুধু একজন মামার পরিবার মানে রুমকির মা-বাবা আসবে যারা ঢাকায় থাকে। নানার বয়স হয়ে গিয়েছে আর উনি আবার বজলুর বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত তাই আসতে পারছেন না। আমরা খুব দু:খী দু:খী চেহারা করে এই আলোচনা করছি। কিন্তু আমি জানি মনে মনে সবাই বেজায় খুশি। একজন মানুষ কমলেও আমাদের লাভ। মেজচাচী আর ছোটচাচীর বাসা থেকে শুধু মুরব্বিদের বলা হয়েছে। ব্যাস শেষ। পরিবারের বাইরে আমার দুই বান্ধবী আসার কথা আছে কিন্তু আমি এখনো তাদের বলিনি। এদিকে স্পর্শ আর শিবলী ভাই মনে হচ্ছে আসবেই। ওরা অবশ্য বাড়িরই লোক হিসাবে ধরা যায়। সব মিলিয়ে পঁচিশ জনের সামান্য এদিক ওদিক হচ্ছে। মেজচাচী আবার কথায় কথায় দাওয়াতের হিসাবে ড্রাইভারদের ধরে। সে দুইজন ড্রাইভার ধরে রেখেছে। নিজেদের বাসার মধ্যেই কে গাড়িতে করে আসবে এটা শুধু চাচীই জানে!
বাড়ির সবার তোড়জোড় দেখতে ভালো লাগছে। আমার বাবা আর মেজ চাচা তাদের ব্যবসার কাজ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। উনাদের আহামরি কোন ব্যবসা নেই। একটা স্টেশনারি আইটেমের দোকান আছে। উনারা সারাদিনই বলেন,
“দোকানের পজিশন খুবই খারাপ। বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে।”
বেচা বিক্রি খুবই কম একথা খুবই সত্য। আজব ব্যাপার যে আশেপাশের চারটা দোকানের খুবই ভালো বিক্রি হয়। এই দোকানের কি অসুবিধা কে জানে! তবে আমার বাবা ও মেজ চাচাকে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত বলে কখনোই মনে হয়নি। দিনে দুই বেলা দুই ভাই যায় আবার নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরে আসে। রাতে তিন ভাই একসাথে বসে আমাদের বিশ বছর আগে কেনা বাইশ ইঞ্চি চারকোনা সাইজের টিভিতে নাটক দেখতে পারে। এটাতেই উনারা আনন্দিত। আপাতত এক সপ্তাহ একটা ছেলেকে বসিয়ে দিয়ে উনারা বিয়ের কাজকর্ম করবে বলে ঠিক করেছে।
আমি সকালে শুয়ে শুয়ে আশেপাশের আওয়াজ শুনছি। আর মাত্র কয়েকদিন। এরপর জীবন কেমন হবে কে জানে!
লুবনার ডাকে উঠে বসলাম। আমার দুই বান্ধবী লুবনা আর চামেলি এসেছে। খুব সহজভাবে আচার খেতে খেতে লুবনা পা তুলে বিছানায় বসলো। তারপর বললো,
“শোন! স্পর্শ যে ছেলেটা আছে না? ও কে? দেখলাম বাড়িতে বাজার টানাটানি করছে। বললাম একটানে রিকশা নিয়ে গিয়ে আলপনার রঙ কিনে আনতে। সে এনেছে দুইটা রঙ। সাদা আর লাল। কালো মোজাইকে লাল রঙ বসবে? সাথে হলুদ লাগবে না? বল তো বুদ্ধিটা কি!”
আমি উঠে বসে বললাম,
“তোদের খবর দিয়েছে কে?”
চামেলি চকাস চকাস করে আঙ্গুল চেটে বললো,
“তোর মেজচাচী ফোন করে আসতে বললো। বাসা থেকে আমার বড়বোনের বিয়ের আলপনার রঙ তুলি আনতে বললো। বাসায় শুধু নীল রঙটা ছিলো। ওটাই এনেছি। ব্রাশ অবশ্য সবগুলোই এনেছি।”
আমার এতটুকুই কথা হলো ওদের সাথে। এরপর ওরা কাজে নেমে পড়লো। বারান্দার জিনিসপত্র সরিয়ে ঝেড়েমুছে আলপনা করতে নামলো। খুবই কাঁচা হাতে কিছু ডিজাইন করা হলো। মূলত গোল্লা আর টান টান দিয়ে শেষ। একটা কলকা ধরনের কিছু আঁকার চেষ্টা করলো স্পর্শ আর চামেলি মিলে। পরে সেটা বড় আকারের গোল নীল রঙের বল হয়ে থেকে গেলো। ভাগ্যক্রমে কালো মেঝেতে সেভাবে দেখা গেলো না।
আলপনার এক ফাঁকে লুবনা এসে আমাকে ফিসফিস করে বললো,
“তুই আমার ফোনটা নে। তোর তো স্মার্ট ফোন নাই। আমার ফোন নিয়ে তুই ওইসব ভিডিও দেখ। ওই যে বিয়ের পর যেসব করে না।”
“যাহ! তুই কি বলিস।”
লুবনা রাগী চেহারা করে বললো,
“আরে শিখে রাখ। বিয়ের আগে এসব দেখতে হয়। তুই বাসর রাত লিখে সার্চ দে। ইউটিউবে ঢুক।”
বলে লুবনা চলে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। সবার মধ্যে বসে এসব দেখতে ইচ্ছা করছে না। এরমধ্যে রুমকি খুব রেগে আমার পাশে এসে বসলো। তার পায়ের অবস্থা আরেকটু খারাপ হয়েছে। মনে হচ্ছে না বিয়ে পর্যন্ত থাকতে পারবে। হালকা জ্বরও আছে মনে হচ্ছে। রুমকি ফোলা ফোলা মুখে আমার পাশে বসে বললো,
“আপা, তোর দুই বান্ধবীকে কেন ডেকেছিস? চামেলি আপুকে দেখ। স্পর্শকে ছাড়ছেই না।”
“তাতে তোর কি!”
“জানি না আপা। আমার এসব ভালো লাগছে না।” রুমকির গলা ধরে আসছে। আমি কিছুই বুঝলাম না।
বিকাল নাগাদ লুবনা খুবই অস্থির হয়ে গেলো। আমাদের নিয়ে সে ছাদে চলে গেলো। আমাকে শিখতেই হবে ছেলেমেয়ের সম্পর্কের বিস্তারিত। আমার চিন্তা করেই কেমন গা ঘিন ঘিন করছে। তবুও আমরা ইউটিউবে “বাসর রাত” সার্চ দিলাম। একটা বাংলা সিনেমা আসলো উপরে। নিচে কয়েকটা বাংলা সিনেমার সিন আর কিছু বউ সেজে মডেলিং-এর ছবি আসলো। চামেলি বুদ্ধি করে সার্চের টপিকটা বদলালো। এবার লেখা হলো “মেয়েদের গায়ে হাতাপিতা”। এবারের ভিডিওর উপরের ছবি দেখে আমরা বুঝলাম আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি। আমাদের তিনজনের কান মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। বুক ধুকপুক করছে। কিন্তু ভিডিও অন করে আমরা হতাশ হলাম। মোটামুটি সবগুলোই বিজ্ঞাপন। দুএকটা বাজে ভিডিও। কিন্তু আকার ইঙ্গিতেই সব শেষ। আমার একটু আরাম লাগলো। আসল ভিডিও বের হলে লুবনা আর চামেলি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। হঠাৎ করে কে জানি চামেলিকে ডাকলো।
স্পর্শ দেখি খুব স্বাভাবিকভাবে হাত ভর্তি জিনিস নিয়ে চামেলিকে দেখাতে এসেছে।
“চামেলি দেখো তো। এই ঝালর টাইপের কাগজগুলো স্টেজে লাগাবা নাকি পাতলা কাগজগুলো?”
চামেলি খুব আহ্লাদী গলায় বললো,
“আপনি কিনে নিয়ে চলে এসেছেন? আমি তো এমনিই বলছিলাম আর হলুদ তো পরশুদিন।”
“পরশুদিন আমি আসলে একটু ব্যস্ত। অফিস ডে তো। আজকেও অফিস ছিলো। কিন্তু ছুটি নিয়েছি।”
চামেলি খুব অভিমানের স্বরে বললো,
“না এসব শুনবো না ভাইয়া। পরশু আপনি একটা পাঞ্জাবি পরে অবশ্যই আসবেন। চলেন তো নিচে গিয়ে স্টেজ নিয়ে একটু আলোচনা করি।”
ওরা চলে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার লিস্ট থেকে স্পর্শকেও বাদ দিতে হবে। বাকি থাকলো শুধু শিবলী ভাই। আর অবশ্য কয়েকদিন। এরপর শুধু আমিনুল নামের একজন থাকবে লিস্টে।
রাতে বাসায় ছোট খাটো একটা নাটক হয়ে গেলো। আমার বড় মামা, মামী আর নানা আসলো। নানা মূলত এসেছিলেন ব্রেসলেটটা দিতে। মুখে তো আর এসব কেউ বলে না। তাই বললো দোয়া দিতে এসেছে। সবাই খুব আদর আপ্যায়ন করে বসালো। উনাদের রাতের খাবার খেতে দেওয়া হলো। আমাদের অবস্থার এই মূহুর্তে বিশেষ অবনতি ঘটায় আমরা একবেলা ভাত, ডাল, সবজি আর আরেক বেলা ভাত, ডাল, ভর্তা খাচ্ছি। ঈদের আগে বা বাসায় কেউ অসুস্থ হলেই আমাদের মেন্যু এরকম হয়ে যায়। এতে কারো তেমন আপত্তি হয় না। তবে আজকে খেতে বসে বড় মামী ফোঁস করে উঠলো। উনি প্রতিবারের মতো বললো,
“আপার বাসায় আসলে শুধু ভাত আর ভর্তা দিয়ে খেতে হয়। আমি তো আর ননদ না যে আমাকে পাঁচ পদ রেঁধে খাওয়াবে।”
বড় মামী প্রায় বারো তেরো বছর আগে একবার আমাদের বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলো। সেই দাওয়াতে উনি পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংস, খাসির রেজালা, টিকিয়া করেছিলেন। আমাদের বাড়ির সবাই পরম তৃপ্তি সহকারে সেই খাবার খেয়েছে এবং ভুলেও গিয়েছে। কিন্তু বড় মামী যখনই আমাদের বাসায় আসেন সেই কথা স্বরণ করাতে ভুলেন না। আগে আমরা উত্তেজিত হতাম। ধীরে ধীরে মামীর পাত্তাটা কমে গিয়েছে। তবে আসল নাটক শুরু হলো খাওয়ার পর। নানা যখন ব্রেসলেটটা দিতে যাবে তখন মামী শুরু করলো কান্না। প্রথমে চোখে হাত দিয়ে, এরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তারপর হঠাৎ সশব্দে। সবাই বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। রুমকি এসে মামীকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“মা, কাঁদছো কেন?”
আমার মামা দেখি খুব গম্ভীর হয়ে বললো,
“তোর মা কাঁদে দু:খে।মানুষের কত ধরনের দু:খ থাকে জীবনে। এই ব্রেসলেট পরা হাতের সেবা করলো কে আর পাচ্ছে এখন কে! সেই দু:খে কাঁদছে।”
পরিস্থিতি বেশ থমথমে হয়ে গেলো। নানা কি করবে ভেবে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। আমার মা এবার উত্তেজিত হয়ে বললো,
“এইটা তো সেই কবেই মা রাবেয়াকে দিয়ে গিয়েছে। রুমকিকেও তো কানের কি জানি দিয়েছে।”
মামীর কান্না আরও বেড়ে গেলো। মামা যে পূর্ন সমর্থন আছে এ ব্যাপারে তা আর বুঝতে বাকি নেই। এখন নানা আর ফেরাতেও পারছে না। দিতেও পারছে না। বড় ভাইয়া এই প্রথম পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে আসলো। সে এসে মামার থেকেও ভারি কিন্তু থমথমে গলায় বললো,
“আপনার কথা ঠিক। কে যত্ন করে আর কে ভোগ করে! আমার মা ছোট থেকে আদাবরের বাড়িতে থাকলো। বড় হলো। বাড়িকে যত্নে আগলে রাখলো আর থাকে এখন কে! যাই হোক বাদ দেই এইসব। আমরা নাহয় রাবেয়ার বিয়েটা ওই বাড়ি থেকেই দেই। তাছাড়া ভাগ নেওয়ারও একটা বিষয় আছে।”
এবার মামার চেহারাটা কোমল হয়ে গেলো। নানাও মনে হচ্ছে একটু প্রাণ ফিরে পেলো। উনি বললো,
“এসব আলোচনা পরে হবে। রাবেয়াকে দোয়াটা করে যাই। এখন আবার বজলুর সামনেই বিয়ে। আর তো আসার সময় হবে না।”
বড় মামী কান্না থামিয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। উনার পরিকল্পনায় এই অংশটা ছিলো না। তাই কি করবে না বুঝে রুমকিকে জোর করে নিয়ে গেলো। রুমকি কিছুতেই যাবে না। কিন্তু আমরা কেউ তেমন জোর না করায় তাকে চলে যেতে হলো। যাবার সময় বড় মামা বাবার হাত ধরে বললো,
“দুলাভাই, কিছু মনে করেন না। মেয়ে মানুষের শখ তাই ওকে সায় দিচ্ছিলাম। আপনিও তো আপাকে কত বেলীফুলের মালা কিনে দিতেন। মনে আছে?”
এটুকু কথাতেই বাবা দেখলাম খুশি হয়ে গেলো। আমার মা লজ্জায় মুখ ঢাকলো। দুই চাচী মিলে মাকে খোঁচাখুঁচি করতে লাগলো। বাসার পরিবেশটা আবার সহজ হয়ে গেলো।
(চলবে)