ওহে প্রিয়.
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩২
________________
সারারাত তালুকদার বাড়ির কেউ দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। হ্যাভেনের চাচা হামিদ তালুকদারও মাঝরাতে নিজ ফ্ল্যাট থেকে বাড়িতে ছুটে এসেছেন। পরিবারের সঙ্গে খুব একটা সময় কাটায় না মানুষ টা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিজনেস আর সিগারেট বিহীন অন্যকিছুতে মন দিতে পারেনি৷ ছেলে দু’টোকে নিয়েও তেমন মাথা ঘামায়না৷ মাথার ওপর বড় ভাই, মায়ের মতোন ভাবির ছায়া থাকতে ছেলে দু’টোকে নিয়ে তাঁর কোন চিন্তা নেই। হুমায়ুন তালুকদারও ছোট ভাইয়ের প্রতি ভরসার কমতি রাখেনি। বাবার দেওয়া শেষ সম্বল পারিবারিক বিজনেসের পুরো দায়িত্বটাই ছোট ভাইকে দিয়েছেন। রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো নিয়েই তাঁর যতো ব্যস্ততা বিজনেসটা না হয় ছোট ভাই’ই সামলাক। হ্যারির পড়াশোনা শেষ বিধায় সেও বিজনেসে যোগ দিয়েছে। তবে হ্যাভেন বা হিরার এসবে বিন্দু ইন্টারেস্টও নেই। তবুও হ্যাভেন বিজনেসের খোঁজ নেয় কিন্তু হিরা এসবের ধারেকাছেও যায় না। আজ মাঝরাতে হামিদ যখন প্রিয় ভাতিজার আহত হওয়ার খবর শুনলো এক মিনিটও দেরি করেনি ফ্ল্যাট থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতে। ছুটে এসেছেন বাড়িতে।
বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা। হুমায়ুন তালুকদার হ্যাভেনের রুম থেকে সকলকে বের করে দিয়ে বেশ বকাঝকা করলেন। এও বললেন,সে ভুল করেছে। এতো তাড়াতাড়ি এতো বড় দায়িত্ব দেওয়া তাঁকে ঠিক হয়নি৷ রাজনীতি জিনিসটা সবার দ্বারা হয় না। যদি হতোই দু’দুবার এভাবে এট্যাক হতো না সে। দোষ সে শত্রু পক্ষ কে দেবেনা। দোষ সে দেবে ছেলেকেই। চারদিকে বিড়ালের অভাব নেই ফাঁকা মাঠে মাছ পিছ পিছ করে কেটে রাখলে তাঁরা তো ধেয়ে আসবেই। বাবাকে কি বলে স্বান্তনা দেবে বুঝে ওঠতে পারলোনা হ্যাভেন তবে এতো উত্তেজিত হওয়াতে বাবার ব্লাড প্রেশার বেড়ে না যায়। হুমায়ুন তালুকদার বসা ছেড়ে ওঠলেন এবং আদেশ করলেন তাঁর সঙ্গে নিচে যেতে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এসেছেন যা যা ঘটেছে সব জানাতে হবে তাঁকে । লোকটা মাস্ক পড়া থাকলেও আকৃতি বর্ণনা তো করাই যাবে।
রাত প্রায় তিনটা ছুঁই ছুঁই। হ্যাভেনের থেকে আহির নতুন নাম্বারটা কালেক্ট করে রুবিনা তালুকদার কে দিলো হ্যারি৷ আহির বাবার থেকেই আহির নতুন নাম্বারটা কালেক্ট করেছিলো হ্যাভেন। রুবিনা তালুকদার নিজ রুমে গিয়ে আহির নাম্বারে ডায়াল করলেন। তৃতীয় বারে রিসিভ হলো ফোনটি। আহি সালাম দিতেই রুবিনা তালুকদার সালাম ফিরিয়ে বললেন,
-‘ অনাগত সন্তান হারিয়ে তুমি আজ দিশেহারা মা। আর আমি দশমাস গর্ভে ধারণ করেছি ওকে। বছরের পর বছর এই বুকে আগলে মানুষ করেছি। আটাশটি বছর আমার কলিজাটাকে চোখের সামনে বেড়ে ওঠতে দেখছি। আমার একমাত্র সম্পদ আমার হ্যাভেন তাঁর কিছু হয়ে গেলে আমার পুরো সংসারটাই যে ভেঙে যাবে মা। আমার পুরো জীবনটাই তছনছ হয়ে যাবে। আমি বা তোমার শ্বশুড় মশাই কেউ বাঁচবে না। আমি আমার বুকের ধন কে হারাতে চাইনা। আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাই আমার সন্তান কে ‘।
শোয়া থেকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো আহি। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে কিছু বুঝতে পারছেনা সে। মাঝরাতে শ্বাশুড়ি মা এসব কি প্রলাপ করছেন? তাঁর ছেলের করা অন্যায় গুলো কি সে ভুলে গেলো? তাঁর ছেলে তাঁর কলিজা আর তাঁর মায়ের কলিজা কি সে না নাকি তাঁর অনাগত সন্তান এ পৃথিবীতে আসলে সে সন্তান তাঁর কলিজা হতো না। দুনিয়ার মানুষ গুলো এতো স্বার্থপর কেনো? চাপা এক শ্বাস ছেড়ে আহি বললো,
-‘ আপনি বিচলিত হবেন না মা। আপনার ছেলের কিছু হবেনা ইনশাআল্লাহ দ্রুত সে সুস্থ জীবনে ফিরে আসবে ‘।
-‘ কি করে ফিরে আসবে? আমার ছেলেটা যে শত্রুদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে ‘ বলেই ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো রুবিনা তালুকদার।
আহি আঁতকে ওঠলো কাঁপা স্বরে জিগ্যেস করলো,
-‘ কি বলছেন মা ওনি এখন কোথায়? কেমন আছেন ওনি’?
রুবিনা তালুকদারের সাথে কথা শেষ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো আহি। আজ যদি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না আসতো বা সে তাঁকে ওভাবে অপমান করে, ছোট করে বের করে না দিতো এমন বিপদের সম্মুখীন কখনোই হতোনা হ্যাভেন। কেনো সে এইটুকু মাথায় রাখলো না মানুষ টার চারদিকে সবসময় বিপদ ঘুরপাক খেতেই থাকে। একদিকে তীব্র ঘৃণা অপরদিকে তীব্র ভালোবাসা, মায়া,টান কোনদিকে যাবে সে? কোনদিকে মোড় নেবে তাঁর জীবন? তাঁর ভিতরে ধাও ধাও করে জ্বলে ওঠা আগুন টা কে নেভাবে? তাঁর সব ঘৃণাকে ভালোবাসায় পরিণত করতে কেই বা পারবে ঐ মানুষ টা ছাড়া? দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো আহি। তাঁর এ জীবনে কান্না ছাড়া আর কিছুই নেই বোধ হয়। দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা বিহীন জীবন এখন তাঁর কাছে স্বপ্ন সমতুল্য।
.
হাতে তিন’টা সেলাই পড়েছে হ্যাভেনের। প্রয়োজনীয় সকল মেডিসিন দেওয়া হয়েছে তাঁকে সেই সাথে সাইকোপ্যাথি সমস্যা দূরীকরণের মেডিসিন গুলোও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ সারারাত নির্ঘুম কেটেছে আহির। ভোরের দিকে হ্যারিকে কল করে হ্যাভেনের খবর নিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলো সে। বিছানার পাশে বসে ছোট বোনকে নামাজের জন্য ডেকে তুলে বিক্ষিপ্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো বিছানায়। দুঃশ্চিতায় একটুও ঘুমাতে পারলো না। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এবার এমন কিছু একটা করবে যাতে হ্যাভেনের দ্বিতীয় দফায় করা এই পাগলামি গুলো বন্ধ হয়৷ এবং রোজ রোজ হন্যে হয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে এসে এমন বিপদের সম্মুখীন না হয়।
সকাল দশটার দিকে এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় হ্যাভেনের। গত চারদিনই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে সে। যখন তাঁর দুচোখ জুরে ঘুম নেমে আসে তখন দিন দুনিয়ায় হুঁশ থাকেনা। অথচ যখন ঘুম ভাঙে তখন মাথায়,বুকে যন্ত্রণারা কিলবিল করে। সদ্যজাত শিশুর কান্নারা যেনো তাঁর ঘুম ছুটানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বুকের ভিতর অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হয়। আর এই ব্যাথা সৃষ্টি করতে বাঁধ্য করে আহির বিধ্বস্ত মুখশ্রী। একদিকে নবজাতকের গলা ফাটানো চিৎকার অপরদিকে আহির সেদিনের কাঠিন্য রূপের তীরের ন্যায় বুলি। যা তাঁর বুকের মধ্যেখানে গভীর এক ক্ষতর সৃষ্টি করেছে। অসহ্য এ দহন থেকে মুক্তি কি মিলবেনা তাঁর। পাপিষ্ঠদের প্রতি কোন করুণা কি জন্মায় না রক্তে মাংসে গড়া ঐ মানুষ গুলোর মনে? আজ চারদিন আহি এ ঘর, এ সংসার ত্যাগ করেছে। অথচ বুকের ভিতরের চিনচিনে ব্যাথাগুলো এমন একটা ভাব করছে না জানি কতোকাল তাঁর বুক মরুভূমিতে পরিণত করে রেখেছে, বাড়িটা করে গেছে নিস্তব্ধ রাতের শশ্মানঘাট। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে গভীর এক শ্বাস ত্যাগ করলো হ্যাভেন। বালিশের পাশে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে বেশকিছু সময় থম মেরে বসে রইলো। গত’দুবছরে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের ঘটনা স্মরণ হতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এলো। সময় থাকতে কেনো সে বুঝে ওঠতে পারলোনা সবটা? তাহলে আজ পরিস্থিতি এভাবে হাতের বাইরে চলে যেতোনা। আফসোসেঘেরা আরো একটি গভীর শ্বাস ছেড়ে ফোন চাপতে লাগলো। আহির ফেসবুক আইডি হিয়া ওপেন করে দিয়েছিলো। যার ফলে পাসওয়ার্ড সম্পর্কে অবগত সে। কি একটা ভেবে আহির আইডিটি লগইন করলো। বিষন্নভরা মুখটা নিমিষেই উজ্জ্বলতায় ভরে গেলো তাঁর।
একঘন্টা আগেই আহি তাঁর বান্ধবী মিনার সঙ্গে চ্যাটিং করেছে। তাঁদের কথোপকথনগুলোর কিছু অংশ দেখতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হ্যাভেনের। আহি যখন প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগে বান্ধবীর সঙ্গে খারাপ লাগা শেয়ার করে হ্যাভেনের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার কথা জানায় এবং এও বলে সে নিজের আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করতে পাচ্ছে না। তাঁর শুধু কান্না পাচ্ছে তখন মিনা বলে,
-‘ দোস্ত তুই কি ওনাকে ভালোবাসিস? যদি ভালো না বাসিস ওনার বিপদে এতো উতলা হচ্ছিস কেনো? কান্নাকাটিই বা করছিস কেনো ‘?
আহির উত্তরটি ছিলো এমন,
-‘ দেখ আমি তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। মানলাম ওনি আমার সাথে অন্যায় করেছে। আমি ওনাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। তাই বলে মানুষ টা মরে যাক সেটা তো চাইতে পারিনা। এতোগুলো দিন একসঙ্গে ছিলাম। একি ছাদের নিচে একি বিছানায় একে অপরের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। অস্বীকার করার জো নেই ওনার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসের শাক্ষী ছিলাম আমি। আমার প্রতিটি উত্তপ্ত শ্বাসের কারণ ছিলো ঐ মানুষ টি।
ভালো না বাসি একটা মায়া তো আছেই তাইনা৷ হয়তো কিছু তিক্ত অনুভূতির শিকার হয়ে সারাজীবন একসাথে কাটাতে চাচ্ছিনা তাই বলে তাঁর এতোবড় ক্ষতিও চাইছিনা। মানুষ টা উচিত শিক্ষা পাক এটা চাই তাই বলে প্রাণ হারাক কেউ তাঁর প্রাণ নিয়ে নিক এটা কখনোই চাইনারে দোস্ত ‘৷
মৃদু হাসলো হ্যাভেন বুকের ভিতরটায় আচমকাই কেমন হালকা হালকা অনুভব করছে সে।অপ্রত্যাশিত সুখ পেয়ে বুকে মৃদু কম্পন ধরেছে। শরীরের শিরা উপশিরা গুলো কেমন টগবগ করছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে বউটাকে শক্ত করে বুকের ভিতর জরিয়ে নিতে। ইচ্ছে করছে তাঁর চোখের সমস্ত অশ্রুকণাগুলো নিজ ওষ্ঠে শুষে নিতে। ইচ্ছে করছে তাঁর মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করতে “ভালোবাসায় ঘেরা আঁখিদ্বয়ে আর অশ্রু ঝড়তে দিবোনা প্রিয়। এই দৃষ্টিতে দুঃখের সমুদ্র আর নয় বরং ভালোবাসার সমুদ্র দেখতে চাই। এই তোমার মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর নয় বিষাদীয় যন্ত্রণা এবার সুখময় ভালোবাসার সমুদ্রে আছড়ে পড়তে চাই তোমায় নিয়ে। অনেক হয়েছে এই অশ্রুবর্ষণ এবার না হয় ভালোবাসার বর্ষণে ভিজিয়ে দেই তোমায় পুরোটাই। অনেক কাঁদিয়েছি তোমায় এবার না হয় তোমার ঠোঁটের এক চিলতে হাসির দায়িত্ব টাই আমি নিই”।
__________________
এরমধ্যে কেটে গেছে আরো চারদিন। আহির সঙ্গে
দেখা করতে যাওয়ার সুযোগ পায়নি হ্যাভেন। একদিকে শত্রুদের চিহ্নিত করতে চলছে পুলিশের তদন্ত।অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি তে এসেছে নানারকমের চাপ। দ্রুতই গরিব,দুঃখীদের খাদ্য বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। দুপুরে খাবার টেবিলে এই নিয়েই টুকটাক কথা হচ্ছিল বাবা ছেলের মাঝে। হ্যাভেনের গলা দিয়ে খাবার নামছিলো না৷ মুখ বন্ধ রেখে জোর পূর্বক খাবার চিবুচ্ছে আর গিলছে। বাম’পাশটায় মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে। আহি চলে যাওয়ার পর থেকে খাবার টেবিলে বসে অসংখ্য বার এ’পাশটায় চোখ বুলায় হ্যাভেন। খাওয়া শেষে বুকচিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। একটা মানুষের শূন্যতা এতোখানি পুড়াতে পারে জানা ছিলো না তাঁর। আজ বুঝি মানুষ টাকে এক পলক না দেখলে মরণই হবে তাঁর। তাঁর বাবার পাশে মা দাঁড়িয়ে আছে। যেমনটি গত দুবছর আহি দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁর পাশে। যখন মানুষ টার সর্বক্ষণ বিচরণ চলতো তাঁর আশেপাশে তাঁর ঘরে তখন নজরই দেওয়া হয়নি৷ অথচ আজ যখন মানুষ টা সব ছেড়ে,ছুড়ে বেরিয়ে গেছে তখন তাঁর মনের সর্বত্রই বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। তবে কি দূরত্বই বুঝিয়ে দেয় সম্পর্কের গভীরতা? হ্যাঁ সম্পর্ক যে সম্পর্কে অবহেলা, অসম্মান যতোই থাকুক ছিলোনা কোন লুকোচুরি খেলা। দু’জনই ছিলো দুজনের নিকট মেলে ধরা বইয়ের পাতার মতো। তবে আহি কি সেই পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছিলো কখনো? নাকি মোটা মলাটে আবদ্ধ পাতা গুলো অবদি পৌঁছাতেই পারেনি? দু’বছর একসঙ্গে থেকেও একে অপরের মন অবদি কেনো পৌঁছাতে পারেনি তাঁরা নাকি পেরেছে শুধুই তাঁদের অবচেতন মন? কেনো মনে হচ্ছে দুজনের দুজনকে অনেকটা সময় দেওয়া উচিত। একসঙ্গে বসে একে অপরের মনের ভাব আদান-প্রদান করা উচিত। কিন্তু সেই সুযোগ টা কি দেবে তাঁকে আহি? নাকি আবারো অপদস্ত করে তাড়িয়ে দেবে ঘর থেকে?
.
রাত এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট হ্যাভেনের গাড়ি এসে থামলো আহির বাড়ির গেটের সামনে।জানালার পাশে বসে দূর আকাশে উজ্জীবিত চাঁদটার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিলো আহি। বিষন্ন মনে বসে অসংখ্য তাঁরার ভীরে হাস্যজ্জ্বল চাঁদটাকে অতি সন্তর্পণে পরখ করে চলেছিলো। গাড়ির হর্ণ কানে বাজতেই বুকটা ধক করে ওঠলো তাঁর। চোখ বেয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।ত্বরিতগতিতে দু’হাতে দুগাল মুছেই দৌড়ে দরজা খুলে গেট অবদি গিয়েও ফিরে আসলো। বাবা,মায়ের রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ করতেই সাজি ওঠে দরজা খুলে মেয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
-‘ কিরে কি হয়েছে ঘুমাসনি ‘?
-‘ আম্মু ওনি এসেছেন গেট টা খুলে দাও। আমি অনার সঙ্গে বারান্দার রুমে শুয়ে পড়বো। ফ্রিজে খাবার রেডিই আছে শুধু গরম করে খাওয়িয়ে ওনাকে আমার রুমে শুয়ে পড়তে বলো আজ রাতে আর ফিরতে হবে না। সেদিনের পর থেকে ওনার বাড়ির লোক প্রচন্ড দুঃশ্চিতায় ভুগছে। বার বার ফোন করে বলেছে আমি যেনো কোনমতেই রাতে সে আসলে তাড়িয়ে না দেই। স্বামী হিসেবে মূল্যায়ন নয় একজন মানুষ হিসেবে এটুকু করতে চাই আম্মু’।
একটু চমকালেও তা প্রকাশ করলো না সাজি। তবে মেয়ে তাঁকে এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বোঝাচ্ছে কেনো বুঝে আসলোনা। আসলে এই বোঝানোটা কি তাঁকে ঘিরেই নাকি নিজেই নিজেকে জোর পূর্বক বোঝাচ্ছে? সারাদিন মেয়েটার ছটফটানি এবং সন্ধ্যায় নিজ হাতে রান্নাবান্না করে ফ্রিজে খাবার তুলে রাখার কারণ স্পষ্ট হয়ে গেলো তাঁর কাছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো এগারোটা বেজে আটান্ন মিনিট। আর দু’মিনিট বাদেই ১৫ই এপ্রিল পড়বে তাঁর মেয়ের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী।
গেট খুলে দিতেই লম্বা এক সালাম দিয়ে আশেপাশে তাকালো হ্যাভেন। এরপর ওকি ঝুঁকি দিতে শুরু করলো আহির ঘরের দিকে। সাজির হাতে কিছু প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভার তমালের দিকে তাকাতেই সে একটি শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো। শপিং ব্যাগটি নিয়ে সাজির পিছনে সেও ঢুকে পড়লো বাড়ির ভিতর। আহির রুমের পাশেই বাথরুম বাথরুমের ভিতরেই চাপকল। হ্যাভেন মুখের মাস্ক খুলে পকেটে রেখে হাত’পা মুখ ধুয়ে আহির ঘরে ঢুকে পড়লো। আহি অনাকে ওঠিয়ে খাবার রুমের সাইটে বারান্দা রুমে পাঠিয়ে হ্যাভেনের জন্য বিছানা রেডি করছিলো। হ্যাভেন রুমে ঢুকতেই তয়ালে এগিয়ে দিয়ে সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু তাঁর হাত আঁটকে ধরলো হ্যাভেন। বললো,
-‘ Happy second wedding anniversary Dear ‘।
চমকে ওঠলো আহি। ফিরে তাকালো হ্যাভেনের আধভেজা মুখটাতে। বুকের ভিতরটায় ঢিপঢিপ করছে। পুরো শরীর জুরে বয়ে যাচ্ছে শীতল শিহরণ। এই সেই পুরুষ যার শরীরের ঘ্রাণ মিশে আছে তাঁর সমস্ত সত্ত্বায়। এই সেই পুরুষ যার উন্মাদনায় প্রতিরাতে মত্ত হতে বাঁধ্য হতো সে। একে অপরের চোখে চোখ রাখতেই দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো আহি। তবে সম্পূর্ণ তাঁর থেকে চোখজোরা বিচ্ছিন্ন করতে পারলো না। চোখ আঁটকে গেলো হ্যাভেনের বুকের দিকটায়। শার্টের কয়েকটি বোতাম খোলা। সেখান থেকে ওকি দিচ্ছে তাঁর লোমশ ভর্তি বুকটা। যে বুকে একটুখানি ঠাঁই পেতে রাতের পর রাত বেহায়ার মতো জোরপূর্বক কাছে গিয়েছে,আবদার করেছে, বায়না ধরেছে। অথচ মানুষ টা তাঁকে মূল্যায়নই করেনি আর না মূল্যায়ন করেছে তাঁর অনুভূতিগুলোকে। তবে আজ কেনো ছুটে ছুটে আসে মানুষ টা মূহুর্তেই বিমর্ষ অনুভূতিরা আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো তাঁকে। এক ঢোক গিলে ছলছল করে ওঠা চোখ গুলো লুকানোর চেষ্টা করতে চোখ সড়িয়ে হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বললো,
-‘ হাত ছাড়ুন রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ুন। অসভ্যের মতো আমাকে ছুঁবেনও না তাকিয়েও থাকবেন না ‘।
হ্যাভেন কোন কথা শুনলো না বরং জোরপূর্বক কাছে টেনে একটু ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে আহির দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড সময় স্থির দৃষ্টিতে আহির ভিজে ওঠা ফোলা চোখদ্বয়, লাল টকটকে নাক এবং শুষ্ক ঠোঁট জোরা পর্যবেক্ষণ করে বললো,
-‘ পুড়ছি আমি ছাই হচ্ছো তুমি এ’কি মানা যায় সুন্দরী ‘?
-‘ আপনার পোড়ায় আমার ছাই হতে বয়েই গেছে। হাত ছাড়ুন আম্মু খাবার বেড়ে বসে আছে খেয়ে নিন গিয়ে ‘।
বাঁকা হাসলো হ্যাভেন চোখ বুজে তৃপ্তির এক শ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ রান্নাটা কি শ্বাশুড়ি মায়ের হাতের না তাঁর মেয়ের হাতের ‘।
-‘ আমিই রেঁধেছি হাত ছাড়ুন ‘। বলেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে রুম ত্যাগ করলো আহি। হ্যাভেন আহত দৃষ্টিতে তাঁর যাওয়ার পানে ক্ষণকাল তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেও বেড়িয়ে পাশের রুমে চলে গেলো।
চলবে…
.