ওহে প্রিয় .
জান্নাতুল_নাঈমা
পর্ব_৪৯
___________________
কিছু সময় আসে যখন নিজের ভিতর তৈরী হওয়া অদম্য ইচ্ছে,অনুভূতি গুলো চাইলেও পূরণ করা যায় না। তাই অদম্য সেই অনুভূতি’কে নিজের মন এবং মস্তিষ্কের তীব্র সহায়তায় দমন করতে হয়। কিন্তু হ্যাভেন বার বার হেরে যাচ্ছে আহির কাছে। হেরে যাচ্ছে নিজের কাছে। কিন্তু তাকে তো হারলে চলবে না। আজ যদি সে হেরে যায় তাহলে সবচেয়ে বড় হার আহিরই হবে।
নিজেকে স্ট্রং রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে হ্যাভেন। কিন্তু আহি যেনো আজ তাকে সবদিক থেকেই ঘায়েল করে ছাড়বে। আহির ঘন নিঃশ্বাসের তীব্র শব্দে কান ঝিনঝিন করছে তার। আহির উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের প্রতিটি শব্দ, কোমল ওষ্ঠজোড়ার ভেজা স্পর্শ হ্যাভেনের শরীরের প্রতিটি লোমকূপে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। উন্মাদের মতোন হ্যাভেনের সান্নিধ্য পাওয়ার প্রচেষ্টা করছে আহি। কিন্তু হ্যাভেন থেকে বিন্দু মাত্র সাড়া পেলো না৷ ফলশ্রুতিতে হ্যাভেনের বুকে মাথা রেখে একহাতে টিশার্ট সহ পিঠ খামচে ধরলো। অপরহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকে আঘাত করতে করতে ডুকরে ওঠলো। বললো,
-‘ আপনি কেন এমন করছেন হ্যাভেন? বার বার কেন আমার সাথে এমন হয়? যখন আমি আপনাকে চাইনি তখন আপনি আমার কাছে এসেছেন। যখন আমি চেয়েছি তখন আপনি আমায় দূরে সরিয়ে দিয়েছেন৷ এই খেলা আর কতো দিন চলবে বলবেন?’
এক ঢোক গিললো হ্যাভেন। প্রচন্ড রাগ হলো আহির প্রতি তার। অদ্ভুত একটা মেয়ে! কখনো পাথরের চেয়েও শক্ত কখনো বা তুলোর চেয়েও নম্র।ভিন্ন সময় ভিন্ন এই রূপ কেবল নারী দ্বারাই সম্ভব। তবে মানতে হবে তার বউ দারুণ ধৈর্যহীন একটা মেয়ে। তার সকল অধৈর্যতা আজ যেনো আহির ওপর ভর করেছে। তবে এমন উন্মাদের মতো আচরণ দেখে পৈশাচিক আনন্দও হচ্ছে বটে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সামলাবে কি করে?
আহির শরীরের সকল উষ্ণতায় হ্যাভেনের অবস্থা নাজেহাল প্রায়। কোনরকম আহিকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে ওঠে গিয়ে লাইট অন করলো। আলোতে আহির দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলো সে৷ পা থেকে মাথা অবদি অদ্ভুত ভাবে শিউরে ওঠলো তার। প্রচন্ড খারাপ লাগলো। সেই সাথে মায়াও কাজ করলো মেয়েটার জন্য। আর যাইহোক সে এইটুকুন জানে মানসিক ভাবে হোক আর শারীরিক ভাবে হোক মানুষ নিজের চাহিদাটুকু আদায় করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠলে পার্টনার থেকে যদি রেসপন্স না পায় যন্ত্রণাটা ঠিক কতোটা গভীর হয়। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো হ্যাভেন। দু’হাঁটু ভাঁজ করে তার ওপর মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল আহি। হ্যাভেনকে কাছে আসতে দেখে মাথা উঁচিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো। হ্যাভেন আহির কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে আহিকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আহির পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। কপালের ঘাম চোয়াল বেয়ে পড়ছে। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে৷ মুখশ্রী থেকে চোখ নিচে নামাতেই দেখলো গলা দিয়ে ঘাম ঝড়ে পড়ছে। বুক বরাবর ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। গলায় পরা স্বর্ণের চিকন চেইনটা ঘামের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। আহির শরীরের ঘামের গন্ধে শরীরে, মনে অন্যরকম মাদকতা কাজ করলো হ্যাভেনের। ধীরে ধীরে এতোটাই আসক্তি এসে গেলো যে চোখ বন্ধ করে লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো। আহির পুনঃপুন ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে হ্যাভেনের বিক্ষিপ্ত শ্বাস গুলোরও বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। আহিকে সম্পূর্ণ নিজের মাঝে আবদ্ধ করে ঘাড়ে ওষ্ঠ ছুঁইয়িয়ে দিলো। আহির দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হ্যাভেনের কাঁধে। এতে হ্যাভেন ব্যাথাহতো হয়ে আহিকে বিছানায় শুইয়িে দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে গিয়ে কপালে আলতো ভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। একে একে চোয়াল,চিবুক গলায় গভীর চুম্বন একে দিয়ে কানের কাছে ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়িয়ে দৃঢ় স্বরে বললো,
-‘ আ’ম সরি আহি। প্রাপ্তিটা যেখানে সীমাহীন তুচ্ছ এই আবদার সেখানে অতি নগণ্য। ‘
হ্যাভেনের কোন কথাই বুঝতে পারলো না আহি৷ কিন্তু হ্যাভেন যখন তার থেকে সরে যাচ্ছিলো তখন চমকে গিয়ে হ্যাভেনের কাঁধ খামচে ধরলো। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুতি ভরা কন্ঠে বললো,
-‘ আমি আপনার স্ত্রী আমি আপনার সঙ্গ চাইছি। আমি আপনাকে চাইছি হ্যাভেন আমি আপনার প্রথম স্ত্রী, প্রথম ভালোবাসা হতে পারিনি। আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও আপনার শেষ ভালোবাসা হতে চাই। আমি আপনার প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে পারিনি আমি আপনার দ্বিতীয় সন্তান’কে আমাদের সন্তান’কে পৃথিবীতে আনতে চাই। আমি আফসোস নিয়ে মরতে চাইনা হ্যাভেন। আমি কিছু হারাতে চাই না। আর না নিজের ভালোবাসা থেকে নিজের প্রিয়জন থেকে দূরে থাকতে চাই। আমি আপনাকে হারিয়ে প্রিয় করতে চাইনা হ্যাভেন। আমি আপনাকে আমার করে, আমি আপনার হয়ে আপনার চোখে চোখ রেখে বলতে চাই আপনি আমার প্রিয় হ্যাভেন। অপ্রিয় থেকেও অনেক বেশী প্রিয় আপনি আমার। আমি আপনাকে ঘৃণা করেছি। কিন্তু ভালোও বেসেছি। শুরুটা যাই হোক শেষটায় আমি শুধু আপনাকেই চাই আমার প্রিয় হিসেবে। আপনি আমায় ফিরিয়ে দেবেন না। আমি আর ফিরে যেতে চাইনা৷ আপনি আমায় দূরে সরাবেন না। প্লিজ হ্যাভেন, প্লিজ। ‘
কথাগুলো বলতে বলতেই মাথা ওঠিয়ে হ্যাভেনের কপালে কপাল ঠেকিয়ে ওষ্ঠে চুমু খেলো আহি। হ্যাভেনও গাঢ় করে একটি চুমু খেয়ে আহিকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে রুম থেকেও বেরিয়ে গেলো। আহি স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে রইলো। দু’চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়লো অগণিত অশ্রুধারা।
__________________
ফজরের আজানের ধ্বনি কানে বাজতেই ঘুম ভেঙে গেলো আহির৷ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে বিছানার মাঝ বরাবর বালিশ বিহীন ঘুমিয়ে ছিলো। তখনি রাতের কথা মনে পড়ে৷ বুক ফেটে কান্না আসতে চায়৷ রাতেও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কতো কাঁদবে সে? হ্যাভেন কেন তার সঙ্গে এমন করছে? এমনটা’তো করার কথা নয়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে অনেকটা সময় বসে রইলো সে। যখন মনে পড়লো হ্যাভেন ঘরে ফেরেনি। সারারাত বাইরে আছে কিন্তু কেন? বিছানা ছেড়ে বাথরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে কাবার্ড থেকে শাড়ি বের করে পরে নিলো। নিজেকে পরিপাটি করে নিয়ে দোতলা থেকেই নিচে চোখ বুলিয়ে হ্যারির রুমের দিকে পা বাড়ালো।
.
দরজায় বেশ কয়েকবার ঠকঠক করতেই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে দরজা খুললো হ্যারি। আহিকে দেখা মাত্রই মুখোভঙ্গি পাল্টে গেলো তার। দু’হাতে চোখ কচলে কোমড়ের ওপর ওঠে যাওয়া টিশার্ট নিচে নামাতে নামাতে বললো,
-‘ ভাবি মা আপনি ! এতো সকালে কিছু বলবেন এনিথিং সিরিয়াস। ‘
-‘ তোমার ভাইয়া কোথায় হ্যারি? ওনি ফোনও সঙ্গে নিয়ে যায় নি। কোথায় গেছেন ওনি? ‘
আশ্চর্য হয়ে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলো হ্যারি। যখন আহির চোখ,মুখের দিকে খেয়াল হলো তখন নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ভ্রুজোড়া কুঁচকে বললো,
-‘ আমার কাছে তো আসেনি। কখন বেরিয়েছে?’
মাথা নিচু করে আহি বললো,
-‘ মাঝরাতে।’
হ্যারি রুম থেকে বের হয়ে বললো,
-‘ আমি দেখছি চিন্তা করবেন না। ‘
.
পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজা শেষে হ্যারি বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে আহির ঘরে গিয়ে জানালো গাড়ি নিয়ে যায়নি, তমালকেও জানায়নি এবং দেহরক্ষী অবদি নেয়নি। সব শুনে আতংকিত হয়ে কেঁদে ফেললো আহি৷ থতমত খেয়ে হ্যারি বললো,
-‘ এ’মা আপনি কাঁদছেন কেন ভাবি মা! ডোন্ট ওয়ারি কিছু হবে না ভাই ফিরে আসবে। আমি রমাকে ফোন করে দিয়েছি একটু পর এসেই সকালের খাবার তৈরী করে দেবে আপনি খেয়ে নেবেন কেমন? আমার একটু ঘুম প্রয়োজন যাই গিয়ে ঘুমাই।’ হাই তুলতে তুলতে রুম ত্যাগ করলো হ্যারি।
আহি প্রচন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। ভাই নিখোঁজ আর হ্যারি এতো নিশ্চিন্ত? তাহলে কি হ্যারি জানে হ্যাভেন কোথায়?
.
সারাদিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো৷ তবুও ফিরলো না হ্যাভেন। রাতের খাবার হ্যারির সঙ্গেই খেয়েছে আহি। গলা দিয়ে খাবার না নামলেও খুব কষ্টে গিলেছে। হ্যারিকে নানাভাবে জিগ্যেসও করেছে হ্যাভেন কোথায়? হ্যারি টুঁ শব্দটিও করেনি। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে জানিয়েছে আগামীকাল বাড়ির সবাই ফিরছে। তা শুনে বুকের ভিতর মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে আহির৷ হ্যাভেনের সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে তাকে যে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু সে কোন মতেই যাবে না। যাবে না মানে যাবে না। মামার বাড়ির আবদার নাকি? যখন ইচ্ছে হবে কাছে টানতে চাইবে যখন ইচ্ছে হবে দূরে সরিয়ে দেবে? এ বাড়ি থেকে এক চুল পরিমাণও নড়বে না সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়ে চুপচাপ বেডরুমে ঘাপটি মেরে বসে রইলো আহি। কখনো পুরো রুম জুরে পায়চারি তো কখনো দু’হাতে চোখ মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কান্না করছে। আর ভেবে যাচ্ছে হ্যাভেন কোথায়? কেন এমন করছে? আর কতো কষ্ট দেবে তাকে মানুষ টা। একটুও কি দয়া হয় না তার? এতো পাষণ্ড মন কেনো হ্যাভেন তালুকদারের?
.
পরেরদিন রুবিনা তালুকদার সহ সকলেই বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা ছয়টায়। এবং এসেই আহির সঙ্গে টুকটাক কথা বলে আহির ব্যাগপত্র মেঝেতে রেখে হিরাকে বললো আগামীকাল ভোরেই আহিকে বাপের বাড়ি রেখে আসতে। আহি এতো বার করে হ্যাভেনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা তুললো তবুও কারো কোন ভাবান্তর হলো না৷ বাধ্য হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে হুমায়ুন তালুকদার’কে রিকোয়েস্ট করলো আহি যে অবদি হ্যাভেন না ফিরবে সে অবদি যেনো তাকে এ বাড়ি থাকতে দেওয়া হয়৷ আহির এহেন আচরণে রুবিনা তালুকদার সহ প্রত্যেকেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হুমায়ুন তালুকদার গম্ভীর ভঙ্গিতে শুধু ‘হুম ‘ বলেই ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেলেন। এদিকে বাড়ির প্রতিটি সদস্যই আহিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ এড়িয়ে চললো। এ নিয়ে আহিও কোন কথা বললো না। নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে গেলো৷ উদ্দেশ্য ছিলো বেড রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে মন খুলে কাঁদার কিন্তু ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি পাস করতে নিয়েও থেমে গেলো সে। সিগারেটের গন্ধ এবং অতি পরিচিত পারফিউমের কড়া ঘ্রাণে বক্ষঃস্পন্দন উগ্র হয়ে এলো তার। আত্মাটা ভীষণ ছটফট করতে শুরু করলো৷ সেই সাথে বক্ষঃস্থল চিনচিনে ব্যাথায় প্রহৃত হলো। এক হাতে বুকের বামপাশে চেপে ধরে এক ঢোক গিলে শুখনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে তরান্বিত হয়ে পা বাড়ালো ছাদের উদ্দেশ্যে। প্রবল উত্তেজনায় এলোমেলো ভাবে ছাদের দরজা অবদি পৌঁছালেও আরেক পা বাড়ানোর সময় শাড়ির আঁচলে পা লেগে উষ্ঠা খেয়ে ছাদের মেঝেতে ধপাশ করে পড়ে গেলো। দু’হাত এবং নাকের ডগা থেতলে গিয়ে ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠলো মেয়েটা।
চলবে…
আগামীকাল অন্তিম পর্ব আসছে সেই সাথে সারপ্রাইজ ও পাবে সকলেই।
.