#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ১৭
বাসায় ফিরেই নবনী বাবাকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হাশেম আলী মেয়ের এই আনন্দের কারণ বুঝতে পারলেন না।নবনী বাবাকে জড়িয়ে ধরেই বললো,”আমার চাকরিটা হয়ে গেছে বাবা।১ তারিখ থেকে জয়েনিং। আমার কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে বাবা এখনো। “
হাশেম আলীর চোখ ভিজে এলো। দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন তিনি।তারপর মেয়েকে বললেন,”এখানে হোটেল কোথায় আছে মা,আমি মিষ্টি কিনে আনমু।সবাইকে আমি মিষ্টি খাওয়ামু।আইজ যে আমার আনন্দের দিন।”
নবনী নিজে বাবাকে নিয়ে বের হলো মিষ্টি কিনতে।বাসায় ফিরলো ১০ কেজি মিষ্টি নিয়ে। রাবেয়া বেগম মাংস নামিয়ে ভিজিয়েছেন আজকে বিরিয়ানি করার জন্য।
মেয়েটা যে কি পরিমাণ পেরেশানিতে ছিলো তা তিনি বুঝেন।আজ সবাই মিলে না হয় একটু ভালো খাবার খাবে।
নবনী আজ বাবাকে সাথে করে নিয়ে গেলো সবার বাসায় মিষ্টি দিতে।অনেক দিন ধরে নবনীর মাথায় এই চিন্তা ঘুরছে।যাদের কাছে তাহেরা বেগম তার বাবাকে গ্রামের বাড়িতে কাজ করা লোক বলে পরিচয় দিয়েছেন তাদের সবার কাছে গিয়ে নবনী আজ বলবে উনি আমার বাবা।
সবার বাসায় গিয়ে নবনী মিষ্টি দিয়ে এলো। শুধু তামিমদের বাসা ছাড়া। সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা দিলো।সাব্বির দুইটা টিউশনি খুঁজে নিয়েছে।এক তারিখ থেকে শুরু করবে পড়ানো।
হাশেম আলী ছলছল চোখে নিজের সন্তানদের দিকে তাকান।কে বলে তিনি গরীব?
যার এরকম সোনার টুকরো সন্তান আছে সে কিভাবে গরীব হতে পারে? তিনি তো সবার চেয়ে ধনী।
রাবেয়া বেগম বললেন,”কাঁথাটা সেলাই করন শেষ রে মা।আরেকটা কাঁথার গাঁথুনি করে দিস আমারে।আমি সেলাই করমু।এইখানে তো করার মতন তেমন কোনো কাম নাই।কাঁথাটা সেলাই করলে তাও নিজের সময় কাটে।”
নবনী অবাক হলো। এতো তাড়াতাড়ি রাবেয়া বেগম কাঁথা সেলাই করে ফেলবে তা তার ধারণাতে ছিলো না।
দুপুরে খাবার পর ৩ বোন মিলে মায়ের সাথে বসে আরেকটা কাঁথার বেজ তৈরি করে দিলো।নবনী কাঁথায় ফুল একে দিলো।
নবনীর মনের একটা সুপ্ত ইচ্ছে একসময় চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের আলাদা একটা পরিচয় গড়ে তোলার।তা যদি হয় দেশীয় পণ্য দিয়ে তবে খারাপ কি?
————–
মেঘের যেনো কিছুতেই দেরি সহ্য হচ্ছে না আর।চাকরি কার হলো তা জানার জন্য মেঘ কৌতুহলে মরে যাচ্ছে যেনো।
বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,”জয়েন করলেই দেখবে কে পেয়েছে চাকরিটা। এখন নাম বললে কি তুমি তাকে চিনবে?”
মেঘ মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। শফিক আহমেদ হাসলেন।মেঘ গিয়ে কোম্পানির এইচ আর কে জিজ্ঞেস করলো কে হচ্ছে তার পিএ।
এইচ আর বললেন,”স্যার, নবনী নামের একজন। “
মেঘের অবিশ্বাস্য লাগলো নবনীর নাম শুনে।আবারও জিজ্ঞেস করলো তাই।
আবারও শুনলো নবনী
মেঘ আবারও জিজ্ঞেস করলো, আবারও নবনীর নাম শুনলো।
আনন্দে মেঘ এইচ আর কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর সোজা শিমলাকে কল দিলো।শিমলাকে জানাতেই শিমলা ভীষণ আনন্দিত হলো। মেঘ বললো, “কাল চলে আসিস নীড়কে নিয়ে,তোকে একটা স্পেশাল ট্রিট দিবো রে আপা।”
শিমলা বললো,”উহু,এভাবে আমি ট্রিট নিবো না।যেদিন নবনীকে জয় করতে পারবি সেদিন আমি ট্রিট নিবো। “
মেঘ আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।
এরপর বাবাকে কল দিলো। শফিক আহমেদ অফিসেই ছিলেন।ছেলের কল পেয়ে অবাক হলেন কিছুটা। রিসিভ করতেই মেঘ বললো, “হ্যালো, মেঘালয় স্পিকিং।জনাব শফিক আহমেদ,আপনার কাছে এই অধমের বিনীত আবেদন অতি শীঘ্রই আমার জননীর সাথে আলাপ করে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক।পাত্রী আমি পছন্দ করে রেখেছি।পাত্রী পছন্দ করা নিয়ে আপনাদের কোনো হয়রানির মুখোমুখি আমি করতে চাই না।তাই আপনাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে নিজেই ঠিক করে রেখেছি পাত্রী।অতি শীঘ্রই আমি বিয়ে করে সংসারী হতে চাই।
আপনার বাধ্যগত পুত্র,মেঘালয়। “
শফিক আহমেদ ছেলের কথা শুনে জোরে হেসে ফেললেন।তারপর পিওনকে ডেকে বললেন, “মিষ্টি নিয়ে এসে আমাকে একেবারে গুনে গুনে ৫ টা মিষ্টি দিবে।আর অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে।আজকে আমি কোনো নিয়ম মানবো না”
পিওন টাকা নিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মিষ্টি এলো।সবার ডেস্কে মিষ্টি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।শফিক আহমেদ নিজের বাড়িতে কল দিলেন।খোশমেজাজে স্ত্রীর সাথে আজ কথা বলা শুরু করলেন।শফিক সাহেবের স্ত্রী মাসুমা নখে নেইল পালিশ দিচ্ছেন,কাজের মেয়ে রুমা তার কানে ফোন ধরে রাখলো।
মাসুমা স্বামীকে ঝাড়ি মেরে বললো,”কল দেয়ার আর সময় পেলে না?নখে একটু নেইল পালিশ দিচ্ছি তার মধ্যে কল দিয়ে বিরক্ত করছো।বলি তোমার কি আর কোনো কাজ নেই সময় অসময়ে বাসায় কল দিয়ে রংঢং করা ছাড়া? “
শফিক আহমেদ ভাব নিয়ে বললো,”দূর ফাউল মহিলা,শুনো তুমি। তোমার সাথে মধুর সুরে কথা বলার জন্য আমি কল দিই নি।এবার থেকে তোমার সাথে কথা বলবো করলার রস মুখে দিয়ে। সব কথা তিতা বের হবে।”
মাসুমা বেগম ধমকে বললেন,”দূর হাঁদারাম, করলা আমার প্রিয় সবজি।বরং তোমার অপ্রিয়,ওটা তুমি পারবে না।একটা কথা যদি ঠিক মতো বলতে পারতে।”
শফিক আহমেদ দমে না গিয়ে পূর্ণ উদ্যমে বললেন,”চুপ,একদম চুপ।আমি তিতা খাওয়ার অভ্যাস করবো।দরকার হলে নিমের রস মুখে দিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো যাতে আমার কথা এতো বেশি তিতা হয় যে তুমি চিনির বস্তায় লুকিয়েও রক্ষা পাবে না।আর আসল কথা শোনো।আমার পরিবারে নতুন সদস্য আসছে,অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি দাদা হয়ে যাবো।তখন তুমি মাসুমা গেট আউট হয়ে যাবে।মেঘ অলরেডি পাত্রী পছন্দ করে ফেলেছে।আমাকে বলেছেও পাত্রীর সব ডিটেইলস। তবে আমাকে কড়াকড়িভাবে নিষেধ করেছে কোনো ভাবে যাতে তোমার কাছে এসব সিক্রেট ফাঁস না করি।আমার ছেলে তো,বুঝলে না।আমার কাছেই সব শেয়ার করে তাই।”
মাসুমা বেগম কল কেটে দিলেন।তারপর নেইল পালিশ ফেলে দিয়ে ছেলেকে কল দিলেন।নাকের জল,চোখের জল মিশিয়ে বললেন,”আমি তো এখন কেউ না।মা’কে এখন আর ভালো লাগে না।বাবা-ই এখন সব।বিয়ে পর্যন্ত চলে গেলি,বাপ বেটা পাত্রী দেখে ফেললি অথচ আমি জানলাম ও না?
এদেশের সরকার রোহিঙ্গাদের ও আরো বেশি দাম দেয়,তোরা বাপ ছেলে মেয়ে আমাকে সেই দাম ও দেস না।আমি আজই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাবো।আমার শেষ ঠিকানা তো ওদের সাথেই আমি বুঝে গেছি।”
মেঘ কিছুই বুঝতে পারলো না মায়ের এসব হাবিজাবি কথার মানে।
মায়ের কথা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছ তুমি এসব মা?আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।”
মাসুমা বেগম নাক পরিষ্কার করে বললেন,”এখন তো কিছুই বুঝবি না।বুঝতে হবে না।আমি আজই যাচ্ছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। শুনে রাখ,আমার এক কথা।তোর বাপে তোকে নিয়ে কোথায় গিয়ে নাকি পাত্রী দেখে আসছে,আজকে আমিও তোর জন্য পাত্রী দেখতে যাবো।আমাকে যদি বাসায় দেখতে চাস তবে আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।তোর বাপের কাছে আমি কিছুতেই হারতে পারবো না।না হলে আমি সত্যি রোহিঙ্গাদের সাথে গিয়ে থাকবো।”
মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলেন।তারপর কল দিলেন শিমলাকে।শিমলা কল ধরতেই শুনতে পেলো মামী কাঁদছে। শিমলা হাসি চেপে বললো, “হ্যাঁ মামী বলেন,মামা কি করেছে?”
মাসুমা গাড়িতে বসতে বসতে বললেন,”আমি বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি রে মা।তোর বাসায় আসছি।সোজা তো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।আগে এসে তোর সাথে বিষয়টি আলোচনা করবো।তুই বলবি আমার ভুল কোথায়।তোর মামা,মেঘ,মেঘলা কাউকে আমার আর দরকার নাই।এরা কেউ আমার আপন না রে মা।তোর মামা নাকি মেঘের বিয়ের তারিখ ফিক্সড করে ফেলেছে আমাকে না জানিয়ে।আমি কি ঘরে থাকা সোফা যে আমার সাথে একবার আলোচনা করতে পারলো না।তুই বল মা,তোর বিবেচনা কি বলে?”
শিমলা হাসি চেপে বললো,”মামার দোষ সব।”
মাসুমা বেগম ফিসফিস করে বললেন,”আমি সব বুঝতে পেরেছি বুঝলি,তোর মামা আসলে তার সেই প্রাক্তন প্রেমিকার খপ্পরে পড়েছে।চিনেছিস তো কোন মেয়ে?আরে ওই মেয়ে,যার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তোর মামা সারা রাত ভাঙা রেডিও বুকে ঝুলিয়ে বাগানে বসে গান শুনেছে।মশাদের গান শিখিয়েছে।
এজন্য এখন আর আমার সাথে কথা বলতে চায় না।আমাকে কি বলেছে জানিস তুই?শুনলে তুই স্ট্রোক করবি।এজন্য এখন ফোনে বলবো না।তোর বাসায় এসে বলবো।নয়তো আবার স্ট্রোক করে পড়ে থাকলে খালি বাসায় কে তোকে ডাক্তারের কাছে নিবে।”
শিমলা হাসতে হাসতে সোফায় গড়াগড়ি খেলো।শিমলা জানে মামীর স্বভাবের কথা।সবসময় মামার দোষ খুঁজবে মাসুমা বেগম। তার সব কথার শেষ কথা হয় শফিক আহমেদ এর প্রাক্তন প্রেমিকা।মামা যদি তিল বলেন,মামী সেটাকে তাল নয় তরমুজ বানিয়ে ফেলেন।
শফিক আহমেদ এর দুই ছেলে মেয়ে মেঘ আর মেঘলা আবার বাবার সাপোর্টার। তাই মাসুমা বেগম কিছু হলেই শিমলার কাছে ছুটে যান।
নবনী কল দিয়ে শিমলাকে জানালো তার চাকরি হবার কথা।শিমলা অনুরোধ করে বললো একবার তার বাসায় আসতে।
মাসুমা বেগম আসার ৫ মিনিট পর নবনী এলো।আজ আসার সময় নীড়ের জন্য এক বক্স চকলেট নিয়ে এলো।
ভেতরে প্রবেশ করতেই অচেনা এক মহিলাকে সোফায় শিমলার সাথে বসে থাকতে দেখে নবনী কিছুটা বিব্রত হলো। তারপর সালাম দিলো দুজনকে উদ্দেশ্য করে।
মাসুমা বেগম সব অভিযোগ ভুলে গিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর হঠাৎ করেই তার গলার সুর পাল্টে গেলো। মিষ্টি সুরে নবনীকে বললেন,”তোমার নাম কি মা?”
শিমলা বললো, “ওর নাম নবনী।”
মাসুমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,”তোকে জিজ্ঞেস করেছি?”
শিমলা চুপ হয়ে গেলো। নবনীকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,”কোথায় থাক তুমি মা?”
নবনী বললো তার বাসা কোথায়।
মাসুমা বেগম হেসে বললেন,”মাশাল্লাহ তুমি দেখতে যেমন সুন্দর তোমার গলার স্বর ও তেমন মিষ্টি। আমার ও একটা ছেলে একটা মেয়ে আছে মা।কি আর বলবো,নিজের ঘরের কথা কাউকে বলতে নেই।তবুও তোমাকে বলছি তুমি তো আপন মানুষ ,ওদের গলা তো নয়,ফাঁটা বাঁশ যেনো।কথা বললে আর মাইক ব্যবহার করা লাগে না।আমার মেয়ে দুদিন দেখলাম গানের রেওয়াজ করছে,ওমা তার পর থেকে বাসার আশেপাশের গাছে,বাগানের গাছেও কোনো পাখি বসে না।আমার ছেলে যখন বাথরুমে গিয়ে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে গান গায় বলে দাবি করে তখন আশেপাশের সকল বিল্ডিং এর মানুষ কানে তুলা দিয়ে রাখে।এরকম অবস্থা আমার বাসায়।”
নবনী না হেসে আর পারলো না। মাসুমা বেগম বললেন,”বিশ্বাস করবে না তো জানি।এই তো একটু পর শিমলার মা আসবে,সেই হবে সাক্ষী। “
শিমলা ইশারা করে নবনীকে বললো,”যা বলে শুনে যাও।উনি এরকমই। “
নবনীর মনে হলো,”উনি মানুষটা অসম্ভব ভালো। মনে কিছু নেই। “
মাসুমা বেগম মনে মনে ঠিক করলেন,”এই মেয়েকেই তিনি পুত্রবধূ বানাবেন।শফিক আহমেদের পছন্দ করা মেয়েকে কিছুতেই তিনি মেনে নিবে না।”
চলবে…..
রাজিয়া রহমান