#তৃতীয়_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)
যে প্রাক্তনকে আমি তুচ্ছ ভেবে ফেলে এসেছিলাম আজ তার সুনাম বর্তমান শ্বশুর শ্বাশুড়ির মুখে শুনতে হচ্ছে দিন রাত। এটা আমার জন্য কত বড় একটা মানসিক অশান্তি আর বলে বোঝানো যাবেনা। তবে তারাও কি করবে? তারা তো জানে না, যে যেই ডাক্তার তাদের ছেলের জীবন আমার স্বামীর জীবন রক্ষা করেছেন সে আমার প্রাক্তন স্বমী হন। নিজেকে একদম গুটিয়ে এই জায়গা থেকে সড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে বাবা মা আজকে রাতে থাকবেন সাহেলের সাথে হাসপাতালে আর আমি ও দিবা বাসায় যাবো, মেডিকেল কলেজের ক্লাস শেষ করে দিবা ও চলে এসেছে। আমি আর দিবা বাসায় চলে গেলাম্ম
বাসায় ফিরে গোসল করে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম সেই দিনটার কথা যখন প্রথম ঢাকায় আসি, খালা খালু আমাকে অনেক ভালোবাসতেন তাদের যখন বাচ্চা ছিলো না তখন থেকেই তারা আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন, এরপরে তাদের বাচ্চা হলেও আমার প্রতি সেই আদর কমে নি তাই যখন সে জানে যে আমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছি তখনই ঢাকায় সে আমার জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনে গিফট করেন যা ইরাদের বাসা থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে ছিলো, এরপর ঢাকা চলে এলাম সিলেট থেকে। আমি প্রথম ইরাদকে দেখেছিলাম ক্লাসে, সবচেয়ে সুদর্শন যুবক ছিলো আমাদের পুরো কলেজে ইরাদ। ওকে দেখে আমার চোখ আমি প্রথম থেকেই সড়াতে পারিনি একটা ভালোলাগা কাজ করেছিলো।
এবং প্রথম দিনেই তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়
আমি বুঝতে পারছিলাম তার ও আমাকে ভালো লেগেছে, আর লাগবেই না কেনো? আমি ছিলাম যেমন রূপবতী তেমনি স্মার্ট একজন মেয়ে। দিন পার হতে থাকে ইরাদের নতুন নতুন গুন বের হতে থাকে, সে খুব ভালো গান করতে পারতো, কবিতা আবৃত্তি করতে পারতো। ইরাদের সাথে আমার ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, এই বন্ধুত্ব কিভাবে যে প্রণয়ে পরিনত হয়ে যায় তা আমরা বুঝতেই পারিনি। যখন আমরা সেকেন্ড ইয়ারে উঠি তখন আমার মাথায় ভূত চাপে আমি বিয়ে করবো। ইরাদকে আমিই প্রেশার দেই বিয়ের জন্য। সে আমাকে মানা করেছিলো, বলেছিলো
– মেঘা ৩-৪টা বছর কষ্ট করে অপেক্ষা করো। আমি এর মাঝে কিছু একটা করেই ফেলবো ইনশাআল্লাহ। আপাতত পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশানি করি যা দিয়ে আমি তোমাকে মন মতো তেমন কিছুই দিতে পারি না, এই সময় তুমি আমার বাসায় কিভাবে এডজাস্ট করবে? আর তা ছাড়া মা বাবাও বিষয়টা কিভাবে নিবে?
– ইরাদ আমি তোমাকে তিনদিন সময় দিলাম।
তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করো আমি বিষ খাবো।
এই বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম, আমি খুব জেদি ইরাদ তা ভালোভাবেই জানতো। আমি টানা ৩ দিন ফোন অফ করে রাখলাম, আমি জানি আমাকে না দেখলে ইরাদ পাগল প্রায় হয়ে যায়। ও আমাকে এতই ভালোবাসতো যে আমি অসুস্থ হলে ও রোজা রাখতো আমার জন্য। আমার অন্যান্য বান্ধুবীদের বয়ফ্রেন্ডরা তাদের দামি গিফটস দিতো বলেছিলাম একদিন, তারপর সে মেডিকেল স্টুডেন্ট হওয়া স্বত্তেও ৩টা টিউশানি করাতো শুধু আমার জন্য। যাতে তাদের সাথে বসলে আমার বলতে না হয় আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে কিছু দেয় না, আমার কেয়ার করে না। অনেক বেশি কেয়ারিং ছিলো ইরাদ, আমি ওকে ভালোবাসতাম ঠিকি কিন্তু কেনো যেনো ওর থেকে আমাকে নিজের পারিবারিক অবস্থানের জন্য বেশি কিছু মনে হতো। আমি ঠিক কথায় বলে বুঝাতে পারবো না আমি কেমন অনুভব করতাম। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার ফোনে কল এলো,
দেখলাম মা ফোন করেছেন
– হ্যালো মা
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ, হেমা কেমন আছে?
– ভালো, জামাই কেমন আছে এখন?
– ভালো আছেন জ্ঞান আসলে জানাবো
– দিবা ফোন করেছিলো আজকে বললো অনেক ভালো একজন ডাক্তারের হাতে নাকি অপারেশন হয়েছে
– মা হিমাকে ফোনটা দাও
– ও ঘুমাচ্ছে উঠলে দিবো
– আচ্ছা মা রাখছি
ফোনটা কেটে দিলাম, সবার সাথে ইরাদকে নিয়ে আর কথা বলতে কোনো রকম ইচ্ছা করে না। মা কে জানাইনি যে ইরাদই সে যার হাতে সাহিলের অপারেশন হয়েছে। আমি শুধু চাচ্ছি সাহিল খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক এবং আমরা ফিরে যাই আমাদের বাড়িতে। ইরাদের ছায়া যেখানে আছে সেখানে থাকতে চাই না একদম, আমার কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসে।
.
রাতের বেলা ইরাদের দু’টো অপারেশন আছে আজকে রাতটা হাসপাতালেই হয়তো কাটাতে হবে। এদিকে ইরাদের বন্ধু আরিফ আজকেও ইরাদের চাচিকে ফোন দিয়ে বলেছে ইরাদের বিয়ের কথা। ওর জন্য সবাই মিলে জোরেশোরে পাত্রী খুঁজে চলছে, যদিও ইরাদ সাফ মানা করে দিয়েছে তারপরেও সবার একটা ইচ্ছা আছে ইরাদ যেনো আবার বিয়ে করে, আতো বছর তো নিজেই একা কাটিয়ে গেছে ও আর কত দিন এভাবে থাকবে? তাই ইরাদ ভেবে নিয়েছে রাতে বের হলে একদম কাজ শেষ করে ফিরবে এবং রাতে শুধু ঘুমাবে বাসায়, বাংলাদেশে বাকি যে কতদিন থাকবে ততদিন কাজ নিয়েই নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে হবে।
আজকে আরিফ ওকে জিজ্ঞেস করেছে একটা প্রশ্ন,
– ইরাদ তুই কেনো বিয়ে করতে চাস না? তুই কি এখনো মেঘা কে ভালোবাসিস?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ইরাদ দেয় নি, সে এখন আর মেঘাকে ভালোবাসে না। আসলেই ভালোবাসে না এইজন্যই সেদিন এতো বছর পরে মেঘাকে দেখেও তার মনে কোনো রকম অনুভুতি হয় নি বরং যখন এভাবে সবার সামনে তুমি সম্ভোধন করে মেঘা ইরাদকে বলেছিলো এতে ইরাদ বিরক্তবোধ করছিলো,
রাত ১১টা বাজে ইরাদ একটা অপারেশন শেষ করে লিফটে উঠে ঠিক তখনই দেখে
একটা মেয়ে বই দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে,
মেয়েটা আর কেউ নয় বরং রুহি
রুহি লিফটে দাঁড়িয়ে হাতে একটা বই নিয়ে পড়ছে। সে সময়ই ইরাদ এসেছে লিফটে
ইরাদ একটু অবাক হয়ে রুহির দিকে তাকায়,
আর এমন সময় লিফটটাও থেমে গেলো হয়তো কোনো সমস্যার কারণে
রুহি ইরাদকে দেখার সাথে সাথে রুহির হার্টবিট একদম দ্রুতগাতিতে চলতে থাকে। রুহি আর ইরাদ একা পুরো লিফটে রুহি প্রচুর নার্ভাস হয়ে গেছে, এতো কাছ থেকে ইরাদকে দেখে ওর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয় আর
রুহির এই হঠাৎ হঠাৎ ভয় পেয়ে যাওয়াটা ইরাদ বুঝেনা কেমন যেনো একটা অস্বাভাবিক আচরণ লাগে ইরাদের
– আ আ আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, এতো রাতে এখানে?
– পড়তে
– হুম?
– কালকে আইটেম আছে তাই পড়ছিলাম
– হসপিটালে?
– হ্যাঁ…… না….. মানে বাসায় বসে পড়তে পারিনি আগে কারণ ব্যাস্ত ছিলাম আমি আর আসলে……
রুহির এই অগোছালো কথা ইরাদ বুঝতে পারছিলো না।
এই মেয়েটাকে নিয়ে একটা পাকা ধারণা হয়ে গেছে ইরাদের, যে এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে অবশ্যই আর সে ফ্লুয়েন্ট কথা বলতে পারে না হয়তো।
লিফট কিছুক্ষণ পরে ঠিক হয়ে যায়, যখন রুহি বের হবে লিফট থেকে সে নিজের ওড়নায় পা দিয়ে ফেলে ভুলে,মানুষ নার্ভাস থাকলে যা হয় তাই হচ্ছে বারবার রুহির সাথে এদিক সেদিক শুধু পরে যাচ্ছে ভুলভাল বলছে। ইরাদকে দেখলে ওর এই অবস্থাই হয়।
পা পিছলে পড়ে গেলে একদম ধপ করে যে মাটিতে পরে যেতো কিন্তু ইরাদ তখনই ওর হাতটা ধরে ফেলে।
রুহি আরো ভয় পেয়ে যায়,
রুহিকে দাড় করিয়ে ইরাদ বলে
-মিস রুহি ইউ শুড বি কেয়ারফুল
– ও ওকে স্যার।
রুহি লিফট থেকে ফিরে কেবিনে চলে গেলো, মুখে মুচকি একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে ওর। ইরাদের চোখের চাহনি একদম কলিজায় লাগে, রুহির নামটা রুহির এতো ভালো লাগেনি কোনোদিন আজকে ইরাদের মুখে নিজের নামটা শুনে যে পরিমান ভালো লাগছে তা হয়তো ও বলে বুঝাতে পারবে না। ওর প্রতিটা সমস্যায়, ও আগে ইরাদের ছবি দেখতো, কারণ ওর কাছে ইরাদকে সুপারম্যান মনে হতো, যে মানুষটা অন্য একজন মানুষের জান বাচায় সে তো অবশ্যই সুপারম্যান, ইরাদকে দেখলে ও একটা মনোবল পেতো। ওর এতোই ভালো লাগতো ইরাদকে দেখতে আর এখন ইরাদ আসার পর থেকে,
স্পেশালি ওর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ওকে ইরাদ বাচাচ্ছে, কোনো কষ্ট পেতে দিচ্ছে না। এসব কিছুই ওর স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। প্রতিটি মানুষের জীবনে একজন রোল মডেল থাকে রুহির জীবনে সেই মানুষটা ইরাদ।
রাতে ১১ঃ৩০টার দিকে গেটে কে যেনো বেইল দিচ্ছে, মেঘা দরজা খুলে দেখে সাহিলের মা বাবা এসেছে।
– মা বাবা আপনারা?
– হ্যাঁ আমরা চলে এসেছি
– তাহলে সাহিলের সাথে কে আছে হসপিটালে?
– রুহি
– যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো মা রুহি থাকলে আর কোনো টেনশন হবে না।
– হ্যাঁ বউমা
পেছন থেকে দিবা এসে বলে,
– মা কালকে তো আমাদের বেশ হার্ড সাবজেক্ট এর আইটেম আছে, রুহি আজকে তোমাদের আসতে বললো কেনো?
মেঘা- রুহি কত শার্প স্টুডেন্ট এটা তো জানোই ওর নিশ্চিত পড়া শেষ তাই হয়তো বলেছে মা বাবাকে আসতে
– হতে পারে
এই বলে দিবা চা নিয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। আজ পড়তে হবে খুব ভালোভাবে
এদিকে রুহির উপস্তিতি সবসময়ই সবাইকে যে কোনো সমস্যার মাঝেও স্বস্তি দিতে পারে, কারণ ও এতোটাই গোছানো আর লক্ষ্যি একটা মেয়ে যে আশেপাশের সবাই ওর ওপরে আস্থা রেখে শান্তি অনুভব করে।
এদিকে ইরাদ ড্রাইভ করে বাসায় যাচ্ছে, আনমনে রুহির আচরণ গুলো মনে করে ওর হাসি পাচ্ছে, ওর ধারণা মেয়েটা কিছুটা অগোছালো ও কিন্তু সর্বপরি ওকে ভালোই লেগেছে, এসব কিছুর পরেও
কেনো যেনো মনে হচ্ছে সে কিছুটা ইনোসেন্ট ধরনের।
(চলবে….)