__হুমায়ূন আহমেদ
জামিলুর রহমান সাহেব দশটার আগেই অফিসে চলে আসেন। অফিসের কর্মচারীদের দশটার সময় আসার কথা–ওরা তা করে কি-না সেটাই তার দেখার উদ্দেশ্য। মালিক দশটার আগেই চলে আসেন, কর্মচারীদের এই বোধটা মাথায় থাকলে তারাও সকাল সকাল আসবে। ঘটনা সে রকম ঘটে না, সবাই সবার ইচ্ছামত হেলতে দুলতে এসে উপস্থিত হয়। কেউ সাড়ে দশটায় কেউ এগারোটায়। এসেই চায়ের অর্ডার। যেন অফিসে এসেছে চা খেতে। বারোটা বাজতেই অফিসের পিওন সামছু মিয়া বের হয়ে যায় সিঙ্গাড়া আনতে। রাস্তার মোড়ে বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টে সিঙ্গাড়া ভাজা হয়। সামছু মিয়া গরম সিঙ্গাড়া নিয়ে আসে। জামিলুর রহমান সাহেবের ধারণা ছিল সিঙ্গাড়া তারা নিজের টাকায় কিনে এনে খায়। কিছুদিন হল জেনেছেন ঘটনা তা না। খরচ যায় অফিস থেকে। ক্যাশিয়ার বিনয় বাবু সিঙ্গাড়ার দাম অফিস খরচে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
অফিসের হিসাবপত্র জমিলুর রহমান সাহেব খুব খুটিয়ে দেখেন না। হিসাবপত্র ঠিক থাকলেই হল। তিনি দেখেন ব্যাংকে জমা টাকার হিসাব। মাঝে মাঝে ক্যাশিয়ার বিনয় বাবু যখন বলেন, স্যার প্যাটি ক্যাশে টাকা নাই তখন চোখে চশমা দিয়ে প্যাটিক্যাশের বই এ চোখ বুলিয়ে যান। তাঁর প্রায়ই মনে হয়— মাসে মাসে ন হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে এমন একটা অফিস না হলেও তার চলত। হিসাব নিকাশ যা আছে নিজেই করতে পারতেন। যোগ এবং বিয়োগ অংক। যোগ বিয়োগ এমন কিছু জটিল অংক না। তার জন্যে মাইনে দিয়ে ক্যাশিয়ার পোষার দরকার কি? অফিস ম্যানেজার, ম্যানেজারের এসিসটেন্ট, সাইকেল পিওন, সাধারণ পিওন সবই বাহুল্য। লাভের গুড় এরাই চেটেপুটে খেয়ে ফেলছে। শুধু গুড় খেয়েই তৃপ্ত না। বেলা বারোটার সময় বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টের সিঙ্গাড়াও খাচ্ছে।
আজ অফিসে আসতে জমিলুর রহমান সাহেবের বেশ দেরী হল। পাগলায় ইটের ভাটা দেয়ার একটা পরিকল্পনা তার আছে। ঢাকা শহরে লোকজন পাগলের মত বাড়িঘর বানাচ্ছে। যত একতলা বাড়ি আছে সব ভেঙ্গে রাতারাতি সেখানে দিশতলা বারতলা এপার্টমেন্ট হাউস হচ্ছে। ইটের দাম বাড়ছে হু হু করে। ইটের ভাটিগুলি ইট সাপ্লাই দিয়ে কুল পাচ্ছে না। ব্যবসার এই লাইনটা ধরা দরকার। এসব ব্যাপারে কারো সঙ্গে যে পরামর্শ করবেন। তাঁর সে উপায় নেই। বুদ্ধিদাতা কাছের মানুষ তার কেউই নেই। ফাতেমার সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কে কোন কথা তার কখনোই হয়নি। ফাতেমা রাতে ঘুমুতে যাবার সময় স্বামীর সঙ্গে যে সব গল্প করেন। তার বেশীর ভাগই রোগ ব্যাধি সম্পর্কে। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে, হজম হচ্ছে না, চোখ ব্যথা হচ্ছে–রোদে তাকালে চোখ জ্বালা করে চশমা নিতে হবে, এইসব। জামিলুর রহমান শুনে যান, হঁহাঁ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গেই তার কথাবার্তা হয় না। এরা যখন ছোট ছিল তখন তিনি ছিলেন তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। একা মানুষের জন্যে এত বড় ব্যবসা দাঁড় করানো ভয়াবহ ব্যাপার। তিনি সেই ভয়াবহ কান্ডটা শান্তভাবে করেছেন। তা করতে গিয়ে সংসার থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। মিতু, টোকন, শোভন এদের সঙ্গে দিনের পর দিন দেখাই হয় নি। বাসায় যখন ফিরেছেন তখন গভীর রাত। বাচ্চারা সবাই ঘুমিয়ে। তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেছেন— বাচ্চারা স্কুলে। আজ তাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব অসীম। মিতু হয়ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, তিনি বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছেন, মিতু তাকে দেখবে কিন্তু কিছু বলবে না।
একবার এ রকম তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন। অপেক্ষা করছেন ম্যানেজারের জন্যে। ম্যানেজার এসে তাকে নিয়ে যাবে। তখন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, মিতু এক কাপ চা নিয়ে এসে বলল, বাবা তোমার চা।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চা চাইনিতো।
মিতু বলল, আমি বানিয়েছি, খাও।
তিনি চায়ে চুমুক দিলেন। তাঁর খুবই লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। যেন মিতুর এই হঠাৎ মমতা গ্রহণ করার যোগ্যতা তাঁর নেই। তিনি একটা অন্যায় করছেন। চায়ের জন্যে মেয়েকে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু বলা দরকার। কি ভাবে বলবেন তিনি ভেবে পেলেন না। বাইরের কাউকে থ্যাংক য়ু বলা যায়, নিজের মেয়েকে কি বলা যায়? চা খুব ভাল হয়েছে এই জাতীয় কথা বলা যায়। কথাগুলি গুছিয়ে বলার আগেই মিতু চলে গেল। কথাগুলি বলা হল না।
জামিলুর রহমান সাহেব বুঝতে পারছেন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার দূরত্ব কমানোর এখন সময় হয়ে এসেছে। বয়স হয়েছে, ঘুম কমে গেছে। বাড়িতে পা দিলেই ক্লান্তি লাগে। এই ক্লান্তি দূর করার জন্যে পরিবারের মানুষদের আশে পাশে দরকার। তা ছাড়া তিনি তার এক জীবনে কি করলেন না করলেন তাও তাদের জানা দরকার। কোন একদিন ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মারা যাবেন। এরা কেউ জানতেও পারবে না, তার কত টাকা কোথায় খাটছে, কি কি ব্যবসা আছে, কয়টা ব্যাংকে একাউন্ট আছে। তাদের সম্ভবত ধারণা তিনি কষ্টে সৃষ্টি কোনমতে একটা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসার লাভে তিনতলা একটা বাড়ি হয়েছে—তাও পুরোটা শেষ হয়নি—ছাদে রেলিং হয়নি, দালান রং করা হয় নি। ব্যবসায় আয় যা হচ্ছে তা দিয়ে অফিস খরচ চালাতেই তিনি হিমসিম খাচ্ছেন। হঠাৎ করে ট্রাক কিনে ঝামেলায় পড়েছেন—লসের উপর লস যাচ্ছে।
ফাতেমা একবার বলেছিলেন, গাড়ি না-কি খুব সস্তা হয়েছে। সবাই গাড়ি কিনছে। তুমি একটা গাড়ি কিনতে পার না? তিন লাখ টাকা দিলেই না-কি একটা রিকন্ডিশান্ড গাড়ি পাওয়া যায়। তিনি কিছু বলেননি। শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন। ফাতেমা এর পর আর গাড়ি প্রসঙ্গে কোন কথা বলেন নি।
কিছুদিন হল তাঁর গাড়ি কিনতে ইচ্ছে করছে। নিজের জন্যে না, বাড়ির জন্যে। হঠাৎ ঝকঝকে একটা নতুন গাড়ি দেখলে তাঁর ছেলেমেয়েদের মুখের ভাব কি হয় তা তার দেখার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা তিনি চাপা দিয়ে রেখেছেন— গাড়ি কেনার অর্থই হচ্ছে গাড়ির সঙ্গে যন্ত্রণা কেনা। ড্রাইভার রাখা। ড্রাইভারের বেতন। সেই বেতনে তার চলবে না, সে তেল চুরি করবে। নতুন চাকা বিক্রি করে পুরানো চাকা লাগিয়ে রাখবে। তার ছিড়ে রেখে বলবে গাড়ি নষ্ট গ্যারেজে নিতে হবে। সেই গ্যারেজের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা থাকবে। ফিফটি ফিফটি শেয়ার। হাজার টাকার কাজ করালে ড্রাইভার পেয়ে যাবে পাচিশ। কি দরকার?
ঢাকা শহর হচ্ছে রিকশার শহর। একেকটা শহরের সঙ্গে একেক জিনিস মানায়। ঢাকার সঙ্গে মানায় রিকশা। তিনি নিজে রিকশায় চলাফেরা করেন। তাঁর ভালই লাগে। গাড়িতে ছোটাছুটির দরকার কি? স্লো এন্ড স্টিডি উইনস দি রেস। দৌড় যখন শুরু হয় তখন খরগোস জেতে না, জেতে কচ্ছপ। তিনি জন্ম থেকেই কচ্ছপ।
ইটের ভাটির ব্যাপারে এক দালালের সঙ্গে কথা বলার জন্যে গোপীবাগ গিয়েছিলেন। দালাল শব্দটা শুনলেই মনে হয়— আজে বাজে টাইপ মানুষ, যার কাজই লোক ঠকানো। জামিলুর রহমান সাহেব খুব ভাল করে জানেন দালালদের ক্ষমতা কি পরিমাণ হতে পারে। ভাল একজন দালাল ধরা মানে ষোল আনা কাজের আট আনা কমপ্লিট। তিনি যে দালালের কাছে গিয়েছিলেন তার নাম মোখলেস। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। ধূর্ত চেহারা। দুই চোখে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই। শুরুতে সে কথাবার্তা শুরু করল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। জামিলুর রহমান সেই তাচ্ছিল্য গায়ে মাখলেন না।
ইটের ভাটি দিতে চান?
জ্বি।
কিয়লার না গ্যাসের?
গ্যাসের। কয়লা ব্যবহারতো নিষিদ্ধ।
কোন কিছুই নিষিদ্ধ না। বাংলাদেশে সবই সিদ্ধ। কোনটা বেশী সিদ্ধ। কোনটা অল্প সিদ্ধ।
ইটের ভাটির ব্যবসা আগে কখনো করেছেন?
নতুন নামবেন?
জ্বি।
মোখলেস অনেক সময় নিয়ে বিড়ি ধরাল। কোমরের লুংগীর খুঁট থেকে পানের বাটি বের করে জর্দা ভর্তি পান মুখে দিল। চোখ বন্ধ করে পান চিবুতে লাগল। জমিলুর রহমান সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এক সপ্তাহের নোটিশে দেড় কোটি টাকা ক্যাশ বাইর করতে পারবেন?
জামিলুর রহমান শীতল গলায় বললেন, পারব।
আমার খোঁজ আপনি কার কাছে পাইছেন?
কার কাছে খোঁজ পেয়েছি। এটা জানা কি আপনার দরকার?
না, দরকার নাই। আপনে পনেরো দিন পরে আবার আসেন। এই পনেরো দিনে আমি খোঁজ খবর করব।
জামিলুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন। মোখলেসও তাঁর সঙ্গে ঘর থেকে বের হল। জামিলুর রহমানকে রিকশা খুঁজতে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল, গাড়ি আনেন নাই?
আমার গাড়ি নাই। আমি রিকশায় চলাফেরা করি।
মোখলেস বলল, আমার প্রাইভেট বেবী আছে। আপনেরে দিয়া আসুক।
দরকার নেই। পেট্রোলের গন্ধ আমার সহ্য হয় না।
স্যার, আপনার ঠিকানা দিয়ে যান।
পনেরো দিন পর আমি নিজেই আসব। তখন ঠিকানা দেব।
জ্বি আচ্ছা।
মোখলেসের কাছ থেকে আসতে গিয়েই অফিসে তার দেরী হল। তিনি অফিসে পৌঁছলেন বারোটার দিকে। অফিসে পৌঁছেই মনে হল কোন একটা ঝামেলা হয়েছে সবার মুখ থমথমে। অফিসের পিওন দৌড়ে তার ঘর খুলে দিল। ফ্যান ছেড়ে দিল। পিরিচ দিয়ে ঢাকা ঠান্ডা এক গ্লাস পানি টেবিলে রাখল। অফিসে পা দিয়েই তিনি ঠান্ডা এক গ্রাস পানি খান।
পানির গ্লাস শেষ করে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জমিলুর রহমান বললেন–সামছু মিয়া, কি ব্যাপার?
ক্যাশিয়ার সোব আপনেরে বলব।
তুমি বললে কোন অসুবিধা আছে? ঘটনা কি আগে তুমি বল— তারপর ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে শুনব।
আমি কিছু জানি না। স্যার। ঘটনার সময় আমি বাইরে ছিলাম। ম্যানেজার সোব আমারে চিঠি পোস্ট করতে বলেছিলেন। আমি গিয়েছি। চিঠি পোস্ট করতে। তখন ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাটা কি?
ছোট সাব এসেছিল।
ছোট সাব মানে কে? শোভন?
জ্বি।
তারপর?
আপনে ক্যাশিয়ার সাবরে জিগান।
তোমাকে জিজ্ঞেস করছি তুমি বল—শোভন এসে টাকা চাইল?
জে।
টাকা নিয়ে চলে গেছে?
জে।
কত টাকা?
প্যাটি ক্যাশে যত ছিল সবই নিছে।
কত ছিল?
মনে হয় তিরিশ হাজার। আইজ একটা পেমেন্ট দেওনের কথা। চেক ক্যাশ করাইছে।
শোভন একা এসেছিল?
জ্বে না। টোকন ভাইয়াও ছেল। গাড়িতে বইস্যা ছেল। নামে নাই। নামছে খালি শোভন ভাইয়া।
শোভন টাকা চেয়েছে আর বিনয় বাবু আয়রণ সেইফ খুলে টাকা দিয়ে দিয়েছে?
উনি দিতে চান নাই। ম্যানেজার সাব উনারে দিতে বলছেন। ম্যানেজার সাব খুব ভয় পাইছেন।
ভয় পেয়েছে। কেন? শোভন পিস্তল বের করেছিল?
জ্বি।
আচ্ছা যাও।
ক্যাশিয়ার সাবরে আসতে বলি?
কাউকে আসতে বলতে হবে না। যখন ডাকব তখন আসবে।
স্যার, চা বানায়ে দিব?
না। দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও।
সামছু দরজা লাগিয়ে ভীত মুখে বের হয়ে গেল। জামিলুর রহমান চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলেন। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে—শরীর ঘামছে। হার্ট এ্যাটাকের প্রাথমিক পর্যায় নাতো? না, তা না। এরকম তার আগেও কয়েকবার হয়েছে। চুপচাপ বসে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। এখন তার করণীয় কি? পুলিশে খবর দেবেন? পুলিশকে বলবেন, আমার দুই ছেলে এসে ডাকাতি করেছে। আর্মড রোভারী। সঙ্গে পিস্তল ছিল। না, তা করা যাবে না। জামিলুর রহমান তার মন অন্যদিকে ফেরাবার চেষ্টা করছেন— পারছেন না। না পারলেও চেষ্টা করতে হবে। আজকের কাগজ পড়া হয় নি। কাগজ পড়া যেতে পারে। তিনি বেল টিপলেন। সামছু ঢুকল। তিনি বললেন, দেখি আজকের কাগজটা দেখি।
চা দিব স্যার?
দাও, চা দাও।
বুকের চিনচিন ব্যথাটা মনে হয় কমে আসছে। ব্যথা পুরোপুরি কমুক তখন বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে। তিনি সিঙ্গাড়ার গন্ধ পেলেন। বারোটা বেজে গেছে। অফিসে সিঙ্গাড়া চলে এসেছে। কি এমন জিনিস যে প্রতিদিন খেতে হয়? তিনি নিজে আজ একটা খেয়ে দেখবেন না-কি?
চলবে…
অপেক্ষা গল্পের লিংক all part