আমি পদ্মজা পর্ব ২৪
____________
বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্মজা।
তার পরনে শাড়ি রয়ে গেছে। আকাশের বুকে থালার মতো একখান চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। খুব সুন্দর দৃশ্য।
‘পদ্ম…’
পদ্মজা কেঁপে উঠে,পিছনে ফিরে তাকাল। মোর্শেদকে দেখতে পেয়ে গোপনে হাঁফ ছাড়ল । মোর্শেদ বললেন,’তোর মায়ে কী আর উঠে নাই?’
‘না,আব্বা।’
মোর্শেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু ভাবলেন। তারপর বলেন,’তুই হজাগ ক্যান? যা ঘরে গিয়া ঘুমা। আমি ঘাটে যাইতাছি।’
‘আচ্ছা,আব্বা।’
মোর্শেদের যাওয়ার পানে পদ্মজা তাকিয়ে রইল। সে কী যেন ভাবছে কিন্তু কী ভাবছে ধরতে পারছে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে উদাসীনতা কেটে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে সাবধানে হেঁটে সদর ঘরে ঢুকল। সদর ঘরে পাটি বিছিয়ে দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়রা ঘুমাচ্ছে। তাদের ডিঙিয়ে পদ্মজা হেমলতার ঘরে আসে। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন বেঘোরে। শুনেছিল,লিখন শাহ কে নিয়ে তার মা নিজ ঘরে এসেছিলেন। এরপর কী হলো কে জানে! সন্ধ্যার পর পূর্ণা গিয়ে জানাল,আম্মা ঘুমাচ্ছে। হেমলতা কখনো সন্ধ্যা সময় ঘুমান না। তাই পদ্মজা ঘোমটা টেনে হেমলতার ঘরে ছুটে আসে। হেমলতাকে এত শান্তিতে ঘুমাতে কখনো দেখেনি পদ্মজা। তাই আর ডাকেনি। কেউ ডাকতে আসলে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক না। এখন মধ্য রাত। পদ্মজা হেমলতার মুখের সামনে মাটিতে বসে।
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। গলা কাঁপছে তার। শ্বশুর বাড়ি কীভাবে থাকবে সে! মাকে ছাড়া দুইদিন থাকতে গিয়ে এতো বড় ঝড় বয়ে গেল। আর এখন সারাজীবনের জন্য মায়ের ছায়া ছেড়ে দিতে হবে। এই মুখটা না দেখলে তার দিন কাটে না। এই মানুষটার আদুরে,শাসন ছাড়া দিন সম্পূর্ণ হয় না। পদ্মজা বিছানায় মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে উঠল। অস্ফুট করে ডাকল,’আম্মা।’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা চোখ খুলেন। পদ্মজা খেয়াল করল না। সে কাঁদতে কাঁদতে চাপা স্বরে বলছে,’তোমাকে ছাড়া কেমনে থাকব আম্মা! বিয়ে করাটা কী খুব দরকার ছিল।’
‘ছিল।’
পদ্মজা চমকে উঠে মাথা তুলল। গলার স্বর আগের অবস্থানে রেখে বলল,’কেন আম্মা?’
‘সব জানতে নেই মা।’
পদ্মজা মাথা নত করে নাক টানে। হেমলতা বললেন,’বিয়ে হতেই হবে। বর বদল হলে সমস্যা নেই। তোর কী আর কাউকে পছন্দ?’
হেমলতার প্রশ্নে পদ্মজা বিব্রত হয়ে উঠল। হেমলতাও প্রশ্নটা করতে গিয়ে অস্বস্থি বোধ করেন। পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে জানাল, তার আলাদা করে কাউকে পছন্দ নেই। হেমলতা উঠে বসেন। চুল খোঁপা করতে করতে প্রশ্ন করেন,’রাত কী খুব হয়েছে? মানুষের সাড়া নেই।’
‘মাঝ রাত।’
‘আর তুই জেগে থেকে কাঁদছিস?’ হেমলতা বললেন। মৃদু ধমকের স্বরে।
পদ্মজা নিরুত্তর। হেমলতা জানালার বাইরে চেয়ে দেখলেন,চাঁদের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল। চাঁদের আলো গলে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। জ্যোৎস্না রাত। তিনি বিছানা থেকে নামতে নামতে পদ্মজাকে তাড়া দেন,’শাড়ি পাল্টে সালোয়ার-কামিজ পরে নে।’
‘কেন আম্মা?’
‘যা বলছি কর।’
পদ্মজা ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিল। উঠানে এসে দেখে,হেমলতার হাতে বৈঠা। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,’আম্মা,তুমি নৌকা চালাবা?’
‘পূর্ণারে নেব? নেওয়া উচিত। যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়। প্রান্ত,প্রেমা যেন টের না পায়।’
পদ্মজা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা তাড়া দেন,’যাবি তো।’
পদ্মজা হন্তদন্ত হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পূর্ণাকে নিয়ে ফিরল। পূর্ণা ঘুমে ঢুলছে। হেমলতা ঘাটে এসে দেখেন মোর্শেদ নৌকায় বসে বিড়ি ফুঁকছেন।
‘নৌকা ছাড়ো।’
মোর্শেদ দুই মেয়ে আর বউকে দেখে হকচকিয়ে গিয়েছেন। তার মধ্যে হেমলতা যেভাবে বললেন,নৌকা ছাড়ো, আরো ভড়কে গেলেন। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন,’ক্যান? কিতা অইছে?’
মোর্শেদের জবাব না দিয়ে পদ্মজা,পূর্ণাকে নিয়ে হেমলতা নৌকায় উঠে পড়েন। স্থির হয়ে বসেন। বৈঠা মোর্শেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেন,’জ্যোৎস্না রাতের নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি আমরা। তুমি এখন আমাদের মাঝি।’
হেমলতা থামেন। এরপর আঞ্চলিক ভাষায় বললেন,’লও মাঝি বৈঠা লও। ছাড়ো তোমার নৌকা। যত সিকি চাইবা তুমি ততই পাইবা।’
একসাথে চারটা দুঃখী মানুষ হেসে উঠে। মোর্শেদ বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা ছাড়েন। হুট করেই যেন অনুভব করছেন, যুবক কালের রক্ত শরীরে টগবগ করছে। এইতো তার সংসার, এইতো তার আনন্দ।
রাতের নির্মল বাতাস। মাদিনী নদীর স্বচ্ছ জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। কচুরিপানারা ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর মুগ্ধকর। পূর্ণার বুকের ভারটা খুব হালকা লাগছে। পদ্মজা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। রগে রগে শান্তি ঢুকে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে যেকোনো দুঃখী মানুষকে সুখী অনুভব করানোর মন্ত্র ঢেলে দিয়েছেন।
‘মোর্শেদ নাকি গো?’
হিন্দুপাড়া থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে ডাকল। মোর্শেদ এক হাত তুলে জবাব দিলেন,’হ দাদা আমি।’
‘রাইতের বেলা যাইতাছ কই?’
‘মেয়ে-বউ লইয়া জ্যোৎস্না পোহাইতে বাইর হইছি দাদা।’
‘তোমাদেরই দিন মিয়া।’
মোর্শেদ আর কিছু বললেন না। হাসলেন। ওপাশ থেকেও আর কারো কথা শোনা গেল না। নৌকা আটপাড়া ছেড়ে হাওড়ে ঢুকে পড়েছে। সাঁ,সাঁ করে বাতাস বইছে। গায়ের কাপড় উড়ছে। হেমলতা দুই মেয়ের মাঝে এসে বসেন। তিনি চাদর নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়েকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে চাদরে ঢেকে দেন। বাতাসে চাদর উড়ে আরো আওয়াজ তুলছে। চাঁদটা একদম মাথার উপর। তাদের সাথে সাথে ঘুরছে! মোর্শেদ মনের সুখে গান ধরেন-
লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আমি কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
পাকনা চুল আমার বলতেই পূর্ণা ফিক করে হেসে ফেলল। পদ্মজাকে ফিসফিসিয়ে বলল,’আব্বা বোধহয় এখনো জোয়ান থাকতে চায়।’
পদ্মজা হেসে চাপা স্বরে বলে,’চুপ থাক। আব্বা কী সুন্দর গায়।’
মোর্শেদ গেয়ে যাচ্ছেন-
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
হায়রে,ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
জানত যদি হাসন রাজা
হায়রে,বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
মোর্শেদ থামেন। তিন মা-মেয়ে একসাথে হাতের তালি দিল। হাতের তালিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল। এতো সুন্দর সময়! এতো সুন্দর রাত বার বার ফিরে আসুক। মোর্শেদ হা করে তাকিয়ে থাকেন সামনে থাকা তিনটা মানুষের দিকে। তাদের চোখেমুখে খুশি ঝিলিক মারছে। অথচ,তিনি জানেন একেকজন কতোটা দুঃখী। মোর্শেদ ঢোক গিলে লুকায়িত এক সত্যের কষ্ট লুকিয়ে যান। হেমলতা আর তিনি ছাড়া এই কলিজা ছেঁড়া কষ্ট কেউ জানে না। মোর্শেদ হেসে বললেন,
‘এই অভাগা মাঝিরে কী আপনারা আপনাদের মাঝে জায়গা দিবেন?’
মোর্শেদের কণ্ঠে শুদ্ধ ভাষায় মিষ্টি আবদার শুনে পদ্মজা পুলকিত হয়ে উঠল। ইশ! আজ সব কিছু কত সুন্দর! পূর্ণা বলে,’দেব। এক শর্তে, নৌকা চালানোর বিনিময়ে সিকি যদি না নেন।’
মোর্শেদ মেয়ের রসিকতা দেখে হা হা করে হাসেন। সেই হাসি বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কানে। তিনি বৈঠা রেখে এগিয়ে আসেন। হেমলতার সামনে বসেন। নৌকা নিজের মতো যেদিকে ইচ্ছে ছুটে চলছে। মোর্শেদ হেমলতাকে বলেন,’দুইডা ছেড়িরে খালি তুমি ধইরা রাখবা? ছাড়তো এইবার। আয়রে তোরা আমারে ধারে আইয়া ব।’
পদ্মজা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। হেমলতা যেতে বলেন। পদ্মজা মোর্শেদের ডান পাশে বসে,আর পূর্ণা বাম পাশে। মোর্শেদ পূর্ণাকে এক হাতে, পদ্মজাকে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠেন। অপরাধী স্বরে বলেন,’আমি বাপ হইয়া পারি নাই আমার ছেড়িদের বেইজ্জতির হাত থাইকা রক্ষা করতে। আমারে মাফ কইরা দিস তোরা।’
মোর্শেদ কখনো এতো আদর করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেননি। এই প্রথম ধরেছেন। আবার কাঁদছেন। পদ্মজার কোমল,নরম মন ব্যথিত হয়ে চোখ বেয়ে জল রূপে বেরিয়ে আসে। হেমলতা মোর্শেদের পায়ের কাছে বসেন। মোর্শেদের হাঁটুতে মাথা রেখে, দুই মেয়ের হাত চেপে ধরে রাখেন। কেটে যায় অনেক মুহূর্ত। নৌকা হাওড়ের পানির স্রোতে একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক যাচ্ছে। বাতাসে চার জনের চোখের জল শুকিয়ে ত্বকের সাথে মিশে গেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে পদ্মজা বলল,’জানো আম্মা, আজ আমি বুঝলাম, জীবনে সুখ বা দুঃখ কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখে মর্মাহত না হয়ে সুখের সময়টা তৈরি করে নিতে হয়। তাহলেই জীবনে সুখকর মুহূর্ত আসে। আবার সুখ সর্বক্ষণ সাথে থাকে না। দুনিয়ার লীলাখেলার শর্তে দুঃখ বার বার ফিরে আসে।’
হেমলতা পদ্মজার দিকে না তাকিয়ে,পদ্মজার ডান হাতে চুমু দেন। চাঁদটা অর্ধেক হয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি আকাশে মিলিয়ে যাবে।
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ
সম্পূর্ন গল্পের লিংক