ফুলসজ্জা সিজন ২ পর্ব ১২
লেখিকাঃ #অনামিকা_ইসলাম “অন্তরা”
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।
হেসে দেয় আবির, তুমি? ভড়কে যায় নীলিমা। তাড়াতাড়ি ফলের কার্টুনটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে।
আবির হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার কাছে চলে যায়। ‘কি ব্যাপার? অন্ধকারে বসে আছো যে?’ মুহূর্তেই বলে উঠে নীলিমা, আমি কিছু খাইনি। হা, হা করে অট্টোহাসিতে মেতে উঠে আবির। এ যেন সেই পুরনো প্রবাদ, ‘ঠাকুর ঘরে কে’রে, আমি তো কলা খাইনি’ কথাটার মতই। কথাটা বলে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। আবিরের হাসি শুনে টের পায় কত বড় বোকামীর পরিচয় দিয়েছে। বোকামীর জন্য আনমনে নীলিমা নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।
হাসি থামালো আবির। নীলিমার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরল। মৃদু হেসে প্রশ্ন করল- ‘খিদে পেয়েছে, খাবে। এজন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’
লাইট’টা জ্বালিয়ে ধীরে সুস্থে বসে খেলেই তো হতো। অত্যন্ত নীচু গলায় নীলিমার জবাব, না মানে আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তো তাই ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে লাইটটা জ্বালাইনি।
ওকে, ফাইন। হয়েছে তো। এবার তো কার্টুনটা সামনে আনো…..!!!
নীলিমা কার্টুন’টা সামনে এনে আপনমনে খাওয়া শুরু করছে, আবির চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে নীলিমার খাওয়া দেখছে। একটা সময় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে দাঁড়ায়। বসা থেকে উঠে নীলিমার একটা হাত ধরে আবির। ধীর পায়ে নীলিমা বিছানার দিকে এগুচ্ছে।
বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। তারপর লাইটটা অফ করে নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়ে নীলিমার পাশে। অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে আবির। মিনিট ত্রিশেক এভাবে শুয়ে থেকে ঘুরে শুয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে যায়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির দেখতে পায় নীলিমা কেমন ঢ্যাবঢ্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে। ‘ঘুমাওনি এখনো?’
মাথাটা আংশিক তুলে প্রশ্ন করে আবির।
‘উহু, ঘুম আসছে না উত্তর দেয় নীলিমা।’
মৃদু হেসে আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। স্পর্শ করে নীলিমার গাল, এলোমেলো চুলগুলো গুজে দেয় কানের পাশে। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে টেনে নেয় বুকে, ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে নীলিমা, ওর ভারী হয়ে গরম নিশ্বাসগুলো তার’ই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একহাতে আবির ওর পাশে রাখা চাদরটা নীলিমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে আবির নীলিমার কপালে আবারো ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে আবিরও।
নীলিমার গর্ভের সময়কাল ৭মাস____
হাত পা গুলো অসম্ভব রকমের ফুলে যায় ওর। পা’গুলো ফুলে তো তালগাছের মতই হয়ে গিয়েছিল। নড়াচড়া করতে খুব কষ্ট হতো বিধায় কিচেনে কোনো রকম রান্না বসিয়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময় রুমে এসে বসে থাকত। কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আবিরের কিনে আনা ফলমূল, দুধ কখনো বা মায়ের পাঠানো গম+ডাল+চাল+চিনি মিশ্রিত গুড়ো খেতো। নজর এড়ায় না শাশুড়ির। এ নিয়ে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দেয় নীলিমাকে। ওনার এক কথা, মা ওনিও হয়েছেন। এভাবে খাই, খাই করেননি কখনো। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থেকেছেন। নীলিমার ভাষ্যমতে, খাওয়া নিয়ে আমার শাশুড়ি আমাকে যতগুলো কথা শুনিয়েছেন ততগুলো কথা বোধ হয় আমি কালো হয়ে জন্ম নেওয়া’তেও শুনিনি।”
সেদিন নীলিমার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। এই সময় বাসার কাজের লোক তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে বাসার সকলকে বকে এক করে ফেলে আবির। চাল, ডাল, গম, চিনির যৌথ মিশ্রণে তৈরি পুষ্টিকর খাবার নীলিমাকে খাইয়ে দিয়ে, প্লেটে কিছু ফল ধুয়ে নীলিমাকে খেতে বলে, সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য দ্রুত কিচেনের দিকে পা বাড়ায় আবির। দ্রুত বাবা মায়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে নীলিমার জন্য ভাত বসিয়ে দেয়। নীলিমার আবার ভাত হলে কিচ্ছু লাগে না। বড্ড খেতে চায় মেয়েটা। কিন্তু খাবার সামনে নিলে একমুঠো ভাতের বেশী খেতে পারে না। যাও খায় সেটা আবিরের জুড়াজুড়িতে। ভাত বসিয়ে দিয়ে দ্রুত তরকারী কুটছিল আবির। পিছন থেকে কিচেনে ঢুকে ওর মা। **নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
আবির তরকারী কুটে চুলোয় তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে মা, ছেলের পাক্কা রাধুনীর মত রান্না করার দৃশ্য দেখে নিঃশব্দেই আবার কিচেন থেকে প্রস্থান করেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে উগ্র মেজাজ নিয়ে সোজা আবিরের রুমে ঢুকেন। নীলিমা তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে এক একটা করে আঙুর মুখে দিচ্ছিল। হঠাৎ’ই পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। আচমকা শাশুড়িকে থেকে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। হাত থেকে ফলটা পরে যায়। কাছে আসেন আবিরের মা। তাচ্ছিল্যের হাসি এসে বলেন, কালে কালে আরো কত কি দেখতে হবে! বউ নবাবজাদির মত পালংকে শুয়ে থাকবে আর জামাই গিয়ে রান্না করবে….!!!
হায়রে, একটা বাচ্চা পেটে ধরে মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। ভয়ে ঢোক গিলে নীলিমার জবাব, মা! শরীর’টা খুব দুর্বল দুর্বল লাগছিল তাই……
হাত উঁচু করে নীলিমার শাশুড়ি ওরফে আবিরের মা। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
” এ্যা, দুর্বল লাগে…!
সারাদিন শুয়ে বসে থেকে বলে দুর্বল লাগে। ওরে, পেটে আমিও বাচ্চা ধরেছিলাম। তোমার মত এত পায়ে পা তুলে শুয়ে থাকিনি। ৭মাসের বাচ্চা পেটে রেখেও রান্না করছি, কুয়া থেকে পানি তুলে আনছি, ঢেকিতে ধান বানছি। অথচ কোনো নিচু বংশ থেকে আসিনি আমি। নামকরা পুরনো ধনী ছিলেন আমার দাদা। তার’ই সন্তান আমার বাবা। মঠখোলাতে বিরাট বড় কাপড়ের দোকান ছিল ওনার। বছর শেষেও ঢুলি ভরা ধান, গম থাকত’ই। এত বড় খানদানি বংশের মেয়ে হয়েও শ্বশুর বাড়িতে দিন কাটিয়েছি খেয়ে না খেয়ে। আর ওনি খাবারের নিচে ডুবেই থাকেন সব সময়। কাজের বেলায় যত অজুহাত।”
অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনান আবিরের মা নীলিমাকে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে দ্রুত বের হয়ে যান রুম থেকে। খাটে মাথা রেখে দু’চোখের নোনাজল ছেড়ে দেয় নীলিমা। রুমে প্রবেশ করে আবির। আবিরের আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয় নীলিমা।
“কি ব্যাপার? এভাবে শুয়ে আছ কেন?”
বলেই কাছে আসে আবির। ফলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, কি হলো? এগুলো খাওনি যে? ভেঁজা গলায় নীলিমার জবাব- খেয়েছি, আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু পরে খাই? মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুলে আবির, ঠিক আছে। এখন একটু রেস্ট নাও। একটু পর ভাত খাইবা। তারপর ভরা পেটে ফলগুলো খেয়ে নিও। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নীলিমা। ‘আচ্ছা, আমি মা বাবাকে বলে আসি ব্রেকফাস্ট করে নিতে।’
চলে যাচ্ছিল আবির, ফিরে আসে।
‘ আচ্ছা! মাকে দেখলাম এদিকে থেকে যেতে।” মা কি রুমে আসছিল নাকি? মাথা নাড়ে নীলিমা, ‘জ্বি, আসছিলেন।’
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করেন আবির-
“মা, আজকেও তোমাকে প্রাচীনকালের কাহিনী বলে চড়া কথা শুনিয়েছে?”
হেসে দেই নীলিমা,
” কি যে বলো না! ওনি কেন কথা শুনাবেন? ওনি তো আসছিলেন বলতে এভাবে শুয়ে বসে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আমার ভালো হবে।”
মুখ থেকে চিন্তার ছাপ সরে যায় আবিরের। কারণ- ও জানে ওর নীলিমা কখনো ওকে মিথ্যে বলবে না, বলতে পারেই না। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে নীলিমার কপালে একটা আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় আবির।
আবির চলে যাওয়ার পর প্রত্যেক বারের পর আজও নীলিমা বলে উঠে,
” ক্ষমা করো আমায়। এ নিয়ে শতেক বার মিথ্যে কথা বললাম তোমায়। কিন্তু কি করব বলো? আমার যে এর ছাড়া কোনো তোমায় নেই। এসব কথার জের ধরে সংসারে ভাঙোক ধরোক এটা আমি কোনো কালেই চাইতে পারব না। হাজার হোক শাশুড়ি তো। শাশুড়ি তো মায়ের’ই সমান। মা সন্তানকে কতকিছুই তো বলতে পারে, সেগুলো মনে ধরলে চলবে কিভাবে? আর তাছাড়া ওনি বুড়ো হয়ে গেছেন। বয়স হয়েছে। এখন একটু আধটু এসব বলবে। এসব মনে নিয়ে বসে থাকলে যে হয় না। কারণ, আমরা মেয়েজাত…”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা। ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেয়, দুর অজানায়…..
ক্ষাণিক বাদে’ই মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে নীলিমার। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে একচুমুকে সবটুকু দুধ খেয়ে ফেলে।
“আর যায় হোক!
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”
কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..
“আর যায় হোক! **নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”
কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..
সারাটা ক্ষণ ক্লান্ত নীলিমাকে আবির আরো ক্লান্ত করে দিত এটা খাও, ওটা খাও করে। রান্না করার সময় হলে নীলিমা যখন ধীর পায়ে রান্না ঘরে যেত আবির তখন চেয়ার হাতে পিছনে এসে দাঁড়াত। নীলিমাকে জোর করে রান্নাঘরের এককোণে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই রান্নায় লেগে পরত। রান্নাটা আবির বেশ পারে কারণ ঢাকায় থেকে আবির যখন পড়াশুনা করত তখন বন্ধুরা মিলে রান্না করে খেত। তারপর আবিরের চাকরী হলো, এদিকে ওর বাবাও ফ্ল্যাট কিনল। নতুন বাসায়ও আবির নিজে নিজেই রান্না করে খেয়ে কলেজে যেত। যদিও ওর বাবা বলেছিল কাজের জন্য কোনো লোক রাখতে। অন্তত পক্ষে রান্নাটা যাতে করে দিতে পারে। কিন্তু আবির একটু অন্যরকম। উচ্চবংশে জন্ম নিয়েও খুব অনাড়ম্বর জীবন যাপন করত। সর্বোপরি, নিজের কাজ নিজে করে খেতে পছন্দ করত। আবির ছুটি নিয়ে বাসায় আসার পর নীলিমা হাতে গুনা কয়েকদিন রান্না করেছে। বাকিদিনগুলো বলতে গেলে বলতে হয় আবির’ই রান্না করেছে। মায়ের নজর এড়িয়ে আড়ালে লুকিয়ে আবির নীলিমাকে রান্নায় হেল্প করেছে। কখনো তরকারী কুটে দিয়েছে, কখনো বা মাছ কেটে দিয়েছে। কারো পায়ের শব্দ পেলে কিচেন থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকে যেত আবির আর নীলিমা রান্নায় দাঁড়িয়ে পরত।
দিন এভাবেই কাটছিল____
সেদিন নীলিমাকে দেখতে ওর বান্ধবী হিয়া এসেছিল। নীলিমার ছোট বোন লিমা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং করত ঢাকা, ফার্মগেইট। হিয়া আসার সময় লিমাকেও সাথে করে নিয়ে আসে। প্রিয়জনদের পেয়ে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা ভুলেই যায় ওরা অনেক দুর থেকে এসেছে। ওদের ফ্রেশ হওয়া দরকার, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। সব ভুলে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা এক বিরাট গল্প জোড়ে দেয় বান্ধবী এবং বোনের সাথে। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নীলিমার শাশুড়ি। দুর থেকে ইশারায় ডাক দেয় নীলিমাকে। শাশুড়ির ডাকে সাড়া দেয় নীলিমা। নীলিমার শাশুড়ি ফিসফিসিয়ে বলেন, গল্প যে জুড়ে দিয়েছ বাসায় রান্না করার মত কিছু আছে? নীলিমা নিচু স্বরে না-বোধক জবাব দেয়। অনেকটা রাগ দেখিয়ে বলেন-
কিছুই নাই, এদিকে বাসায় মেহমান এসেছে। কোথায় আবিরকে ফোন দিবা, তা না করে গল্প জুড়ে দিয়েছ? ওরা কতদুর থেকে এসেছ জানো? এবারো নীলিমা নিচু স্বরে বলে উঠে, দিচ্ছি কল মা। নীলিমা আবিরের নাম্বারটা ডায়াল করতেই ওর শাশুড়ি হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গিয়ে নিজের কানের কাছে ধরে। নীলিমা তো পুরা’ই থ। কানে ফোন রেখেই গম্ভীর মুখে শাশুড়ির প্রশ্ন-
“কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ওদেরকে শরবত দাও। আমি ফ্রিজে রেখে আসছি। আর নুডলস রান্না করছি দেখো। এগুলোও সামনে এনে দাও।”
দিচ্ছি বলে নীলিমা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়….
নীলিমার শাশুড়ি এমনিতে ওকে যত তিক্ত কথায় শুনাক না কেন, বাসায় মেহমান আসলে দৌঁড়াতে থাকে কি খাওয়াবে না খাওয়াবে। এটা একটা ওনার বিশেষ গুন।
আবির সওদা করে তাড়াতাড়ি’ই ফিরে আসে। আবির ফিরে আসলে ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত রান্না ঘরে চলে যায় নীলিমার শাশুড়ি। নীলিমা চুপসে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ির পিছনে আর ওর শাশুড়ি রান্না করছে। পিছনে ফিরে নীলিমার শাশুড়ি-
” কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ফ্রিজে দেখো ফল রাখা আছে, ভালোভাবে ধূয়ে ঐগুলো ওদের সামনে দাও।”
নীলিমা শাশুড়ির কথা মত ফ্রিজ থেকে ফল বের করে নিঃশব্দে রান্নাঘর ত্যাগ করে।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর নীলিমা ওর বান্ধবী হিয়া এবং বোন লিমাকে নিয়ে গেস্টরুমে যায়। ফিরে আসছিল নীলিমা, পিছন থেকে বলে উঠে লিমা-
” আমি দুনিয়াতে অনেক অনেক মানুষ দেখেছি কিন্তু আমার আপুর মত মানুষ দেখিনি।”
পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। গড়গড় করে বলতে থাকে লিমা-
” তুই কিরে আপু? একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মেয়ে হয়ে কি করে তুই তোর শাশুড়ির এত অত্যাচার সহ্য করছিস?”
রেগে যায় নীলিমা-
” খবরদার! আর একটাও কথা বলবি না।”
পাশ থেকে বলে উঠে হিয়া-
” কেন? বললে কি করবি? ও কি মিথ্যে কিছু বলছে নাকি?”
বান্ধবীর কথায় চেহারায় বিরক্তি ফুঁটে উঠে নীলিমার। মুখে বিরক্তি ভাব নিয়েই প্রশ্ন করে, চুপ করবি?
—– কেন চুপ করব? আর কত? আর কত ঐ মহিলার অত্যাচার সহ্য করবি? এমনভাবে মানসিক অত্যাচার চলতে থাকলে তুই তো পাগল হয়ে যাবি! আর তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কি করে এসব সহ্য করছিস? কেন প্রতিবাদ করছিস না? তুই বুঝতে পারছিস খাওয়ার অভাবে, শুধুভাবে খাওয়ার অভাবে তোর কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে? তুই বুঝতে পারছিস পরিবর্তিতে এটা বাচ্চার উপর কতবড় প্রভাব ফেলতে পারে?
হিয়া থামতে না থামতেই লিমা বলে উঠে-
” কাকে কি বুঝাচ্ছ আপু? ওনি তো তোমার আমার মত সাধারণ কোনো মানুষ না যে আমাদের কথা বুঝবেন! ওনি হচ্ছেন নায়িকা সাবানা। সেই মহৎ হৃদয়ের সাবানা যিনি শাশুড়ির অবর্নণীয় অত্যাচার সহ্য করেও কিচ্ছু বলবে না। ওনি মহান হিয়া আপু। তোমার কি মনে হয় এরকম মহান হৃদয়ের অধিকারী নায়িকা সাবানা আমাদের কথা শুনবে? শাশুড়ি যদি ওনাকে তিনবেলা ভাত নাও দেয় তবুও ওনি মুখ খুলবেন না।”
হিয়া লিমাকে থামিয়ে দিয়ে নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলেন-
” নীলিমা! আমার মনে হয় তোর শাশুড়ির ব্যাপারটা আবির স্যারকে খুলে বলা দরকার। এভাবে তো চলতে পারে না। আর কত? আর কত দিন অভুক্ত থাকবি? শুধু তো কথায় মারেন না ওনি, ভাতেও মারেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তো তোর বাচ্চার ক্ষতি হবে। তাই বলছি প্লিজ স্যারকে খুলে বল সবটা।”
কথাগুলো বলে নিশ্বাসও ফেলতে পারেনি হিয়া, তার আগেই পেছন থেকে বলে উঠে আবির,
“ওর বলতে হবে না, আমি সব জানি।”
চমকে উঠে পিছনে তাকায় হিয়া। আবিরকে এভাবে রুমে এগিয়ে আসতে দেখে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় হিয়াসহ লিমার। নীলিমারও অবস্থা যায় যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পেছনে না ঘুরলে ও বুঝতে পারে আবির সব শুনে নিয়েছে।
আমতা আমতা করে হিয়া যখন আবিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন থামিয়ে দেয় আবির। তোমরা ক্লান্ত। কথা না বাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো। আবির নীলিমার কাঁধে হাত রেখে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। “চলো……..”
নীলিমা ধীরগতিতে আবিরের সাথে হাঁটতে থাকে।
রাত্রি অনেক হয়েছিল, আর তাছাড়া নীলিমার শরীরটাও বেশী ভালো যাচ্ছে না আজকাল। তাই আবির মায়ের কথা তুলে নীলিমাকে উত্তেজিত করতে চায়নি। আর চায়নি বলেই বিছানা পরিষ্কার করে নীলিমাকে ধরে শুইয়ে দেয়। নীলিমা কথা বলতে চাইলে আবির থামিয়ে দেয়।
” চুপ! আমি আর এ সম্পর্কে কোনো কথা এখন শুনতে চাই না। যা শুনব, বাচ্চাটা ভালোভাবে হওয়ার পর। আর মায়ের সাথে শেষ বোঝাপড়াটা সেদিন’ই হবে।”
কথা বাড়ায়নি নীলিমা। চুপটি করে আবিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। বিছানায় উঠে বসে। আবিরও জেগে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বেলে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে। ঘুমে ঢুলুঢুলু নীলিমা বসে বসেই ঘুমুচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে খাবারের নানা আইটেম নীলিমার সামনে এনে রাখে। নীলিমা তখনো বসে বসে ঝিমুচ্ছে। বিভিন্ন খাবারের নাম বলে বলে প্রশ্ন করে আবির-
” খাবে?”
প্রত্যেকবার’ই মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক জবাব দেয় নীলিমা। প্রশ্ন করে-
” তাহলে….. কলা খাবে?”
” উম্মমমম কলা বলে মাথা নাড়ে নীলিমা।”
হেসে দেয় আবির।
ওরে কলা পাগলীটা আমার….!
তোমার কলা খাওয়ার খিদে পেয়েছে সেটা বলবা না? কলা খেতে নীলিমা ভালোবাসে। ফলের মধ্যে এই একটা ফল’ই বলা ছাড়া খায় নীলিমা। আবিরও তাই প্রত্যেকদিন রাত্রে মোড়ের দোকান থেকে কলা নিয়ে এসে টেবিলে’ই রেখে দেয়। মাঝরাত্রে অন্য খাবার খাওয়ার আগে কলাটা ওর চাই’ই চাই। **নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
কিন্তু আজতো নীলিমা ঘুমে ঢুলুঢুলু তাই আবির কলাগুলো দু’বালিশের ফাঁকে রেখে নীলিমাকে শুয়ে দেয়। নীলিমার কপালে আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দেয় আবির—
” তোমার চোখে ঘুম। কলাটা ঘুম থেকে উঠে খেও।”
বাধ্য বালিকার মতো চোখ বোজে নীলিমা।
লাইটটা নিভিয়ে পাশ বালিশে শুয়ে পরে আবির। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই আবির মাথার পাশেই কুটকুট শব্দ শুনতে পায়। অনেক খেয়াল করে শুনার পর আবির সিদ্ধান্তে এলো এটা ইঁদুরের শব্দ। নিশ্চয় কলার উপর হামলা। ওরে ইঁদুর আজ তোর একদিন কি আমার একদিন মনে মনে কথাটা বলেই আবির নিঃশব্দে লাইট জ্বেলে দেয়। রাগান্বিত মুখে হাসি ফুটে উঠে আবিরের। “এ যে বড় ইঁদুর….”
ঘুমন্ত চোখজোড়া মিটমিট করে নীলিমা শুয়ে শুয়েই কলা খাচ্ছে। চোখগুলো ঘুমের কারণে খুলতে পারছে না, তারপরও কলা খাচ্ছে…..
দেখতে দেখতে নীলিমার বাচ্চা প্রসবের দিন এগিয়ে আসে। আবির এখন একমুহূর্তের জন্যও নীলিমাকে চোখের আড়াল করে না। সবসময় নীলিমার পাশে পাশে থাকে। গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। সেদিন আবিরের বাবাকে বিশেষ একটা কারণে দেশের বাহিরে যেতে হচ্ছিল। আবিরের মা ছেলেকে বলেন, বাবাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসতে। আবির যেতে চাচ্ছিল না নীলিমাকে ছেড়ে।
নীলিমার গম্ভীর জবাব-
” সময় এখনো দেরী আছে। আজ মাত্র ৪তারিখ। ডাক্তার এ মাসের ১৭তারিখ আর ২৩তারিখের কথা বলেছে। আপনি প্লিজ বাবাকে দিয়ে আসেন। আমার জন্য টেনশন করবেন না। আর তাছাড়া গাড়ি তো আছে’ই। আপনি যাবেন আর আসবেন।”
নীলিমার জোড়াজুড়িতে আর মায়ের কথায় শেষমেষ আবির বাবাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে রাজি হয়। বাবাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে একমুহূর্তও দেরী করেনি আবির। বাসায় আসতেই নীলিমার চাপা আর্তনাদ শুনতে পায়। শব্দটা নিচ তলার’ই এক রুম থেকে আসছে। কিন্তু ও রুমে নীলিমা কেন আসল? আর ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওর কিছু হলো নাতো? ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে আবিরের। দৌঁড়ে দরজার কাছে যেতেই পাশ থেকে বাঁধা দেয় আবিরের মা। আবির ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে আবিরের মায়ের জবাব,
” তোর বউ অসুস্থ। ভিতরে যাওয়া যাবে না। ভিতরে দাই মহিলারা গেছেন মাত্র।”
চমকে গিয়ে প্রশ্ন করেন আবির-
” What?”
উত্তর দেয় আবিরের মা,
” ঘন্টা খানেক হলো বউ অসুস্থ হয়ে পরছে। তোর উত্তর পাড়ার জ্যাঠি তো দাইয়ের কাজ করেন। ওনাকে আনছি। ওনারা তিনজন কেবল ভিতরে গেছেন বউকে দেখতে। আল্লাহকে ডাক।”
অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আবির। একঘন্টা ধরে ও অসুস্থ, আর তুমি মাত্র মানুষ ডেকে এনেছ। তাও দাই। যাদের হাতে আমার ২ভাই মরেছে তুমি নার্স না ডেকে তাদের ডেকে এনেছ? তাদের হাতে আমার বউকে ছেড়ে দিয়েছ? তুমি পারো নি লোক ডেকে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে? একঘন্টা হয়ে গেল আমাকে কল কেন দাওনি….?
আবিরকে থামায় ওর মা।
” দ্যাখ, আবির। আমাদের বংশে কারো সিজার হয়নি। নীলিমারও হবে না। নীলিমার নরমাল ডেলিভারি হবে।”
উত্তেজিত হয়ে উঠে আবির,
” কারো হয়নি, কিন্তু নীলিমার হবে। ডাক্তার বলেছে ওর শরীরের যা কন্ডিশন ওর নরমাল ডেলিভারি হতে পারে না।”
” কিন্তু…..”
আবির একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ায়নি। মাকে সরিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। মহিলাদের সরিয়ে কোলে তুলে নেয় নীলিমাকে। গাড়ির পেছনে শুইয়ে দিয়ে আদিবা আপুকে ফোন করে আসতে বলে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। নীলিমাকে অটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আবিরের মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। চিন্তিত মনে বাইরে পায়চারি করছে। মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে হসপিটালে পৌঁছে যায় আদিবা ও তার স্বামী। তারাও চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। কিছুক্ষণ পর অটি থেকে বেরিয়ে আসে একজন নার্স।
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করে আবির, কি হলো সিস্টার? উত্তরে নার্স বলে,
” রোগীর রক্ত লাগবে। জরুরী ভিত্তিতে রোগীর রক্ত লাগবে।”
আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল আদিবা।
” আমি, আমি দিব রক্ত। আমার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ।”
আসুন, টেস্ট করে দেখি….
নার্স আদিবাকে চলে যায়। রক্ত দেয়া হলে আদিবা চলে আসে, কিন্তু নীলিমার কোনো খুঁজ নেই। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম সবার। খবর পেয়ে নীলিমার মা চলে আসছে, চলে আসছে বোন লিমা ও বান্ধবী হিয়া। চিন্তিত মুখে হিয়ার প্রশ্ন-
” এতক্ষণ ধরে ওরা কি করছে? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়।”
হিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ডাক্তার নুসরাত। মিষ্টি হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে-
” Double Congratulation, Mr. Abir.”
চমকে যায় আবির। Double Congratulation মানে?
হেসে দেয় ডাঃ নুসরাত। মুখে হাসির রেখা নিয়েই বলে উঠে, আপনি একসাথে দু’সন্তানের বাবা হয়ে গেলেন। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। খবরটা শুনার পর চারদিকে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবার মুখেই হাসি। শুধু হাসি নেয় আবিরের মুখে। চিন্তিত মুখেই আবারো প্রশ্ন করেন ডাঃ নুসরাতকে-
” আর নীলিমা? ও, ও কেমন আছে?”
” আল্লাহর রহমতে মা এবং সন্তান তিনজন’ই সুস্থ আছেন।”
.
চলবে____