ফুলসজ্জা সিজন ২ পর্ব ৪
লেখিকাঃ #অনামিকা_ইসলাম “অন্তরা”
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
যায় হোক!
পরদিনও আবির নীলিমাকে নিজ হাতে শাঁড়ি, চুড়ি পরিয়ে দিয়ে খোঁপায় বেলীর মালা গুজে দেয়। সকাল ১০টা নাগাদ আবির নীলিমাকে নিয়ে নীলিমাদের বাসায় পৌঁছে। কোনো রকম কুশল বিনিময় করেই আবিরকে আবারো রওয়ানা দিতে হয়। নীলিমাদের বাসা থেকে স্কুল খুব কাছেই। ৭মিনিটের পায়ে হাটা রাস্তা। গাঁড়ি নিয়ে যাওয়াতে দু’মিনিটও লাগেনি।
নীলিমার আসার পূর্বেই ওর বান্ধবীরা জমায়েত হয়ে গেছে স্কুলে। নীলিমাকে দেখে দুর থেকে একটা হাসি দেয় “তামান্না”। ও’ই প্রথম নীলিমা আসার খবরটা সবাইকে দেয়। খবর শুনে দৌঁড়ে আসে সবাই। এসেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় একটা মেয়ে। আসলে অনেকগুলো দিন পর বান্ধবীকে পেয়েছে তো তাই হয়তো চোখে জল এসে গেছে। ইতোমধ্যে গাড়ির চারিপাশে ভিড় জমে গেছে। স্কুলের সবচেয়ে সেরা ছাত্রী, সবার প্রাণের “নীলি” এসেছে, সেই সংবাদ শুনে ক্লাস সেভেন, এইটের বাচ্চারাও ছুটে আসে। কেউ কেউ তো দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে আর বলছে- নীলি আপা আইছে, আমাগো নীলি আপা আইছে….. মুহূর্তেই পুরো স্কুল কোলাহলে ছেয়ে যায়। ভিড় ঠেলে কাছে আসেন গ্রন্থাকারের শামীমা মেম। সালাম দিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে গল্প জুড়ে দেন ওনি। আজ অনেকগুলো দিন পর স্নেহের “নীলিমা”কে পেয়ে কথার বলার মাঝখানে চোখের জল ছেড়ে দেন ওনি। নীলিমাকে ওর সহপাঠী বন্ধুরা একরকম টেনে মঞ্চের কাছে নিয়ে যায়। নীলিমা বান্ধবীদের সাথে হাসি, আনন্দ, গল্পে মত্ত হয়ে যায়। অদূরে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আবির ওর ছোট্ট ডানাকাটা পরীটার প্রাণখোলা হাসি দেখছে।
কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষকের চোখ যায় মাঠের শেষ প্রান্তে পলাশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি ও তার পাশের ভদ্রলোকটির দিকে।
প্রশ্ন করেন ওনি-
” কে ওনি?”
ছেলে- মেয়েরা নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে প্রশ্নোত্তরে বলে, স্যার! ওনি আমার সাথে এসেছেন। প্রধান শিক্ষক এতক্ষণে বুঝতে পারেন আসল ঘটনা। দপ্তরীকে ডেকে কিছুটা ধমকের স্বরে বলেন, “স্কুলের অতিথিকে যদি এভাবে দাঁড়িয়েই থাকতে হয় তাহলে আপনারা কিসের জন্য?”
মাথা নিচু করে দপ্তরী হাফিজ উদ্দিন জনাব আবির সাহেবকে সসম্মানে অফিসে নিয়ে আসে। অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত করবে অত্র বিদ্যালয়ে গর্ব, বিদায়ী ছাত্রী “নীলিমা”। ইংরেজী স্যারের মাইকে ঘোষনা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা। যদিও সবসময় ও’ই শুরু করে কুরআন তেলওয়াত থেকে, তবে আজকে কেমন জানি লাগছে। ইতোমধ্যে মাইকে আরো একবার নীলিমাকে ডাকা হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে নীলিমা ও,প্রান্তে অতিথি আসনে বসে থাকা আবিরের দিকে তাকায়। আবির মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে নীলিমাকে তেলওয়াত করতে বলে। নীলিমা মঞ্চে উঠে তেলওয়াত শুরু করে। তেলওয়াত শেষ করে সোজা মাথা নিচু করে নিচে নেমে আসে সে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আবিরের আসনের দিকে তাকায় নীলিমা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবির তখনো নীলিমার দিকে তাকিয়ে। মানপত্র পাঠ শুরুর আগে শহীদদের স্মরণে এবার একটা দেশাত্মবোধ গান নিয়ে আসছেন আমাদের অত্র স্কুলের বিদায়ী ছাত্রী “নিলীমা”। নীলিমা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এমনিতে এখনো হার্টবিট দ্রুত উঠানামা করছে, এখন আবার গানও গাইতে হবে ওনার সামনে। না, না! পারব না। নীলিমা হাত দিয়ে স্যার’কে ওর নাম না বলার বিনীত অনুরোধ করে। স্যার আবারো ঘোষনা করেন, নীলিমাকে অনুরোধ করা হচ্ছে মঞ্চে আসার। বাধ্য নীলিমা মঞ্চে যায়। মাইক হাতে নিয়ে বামে আবিরের দিকে তাকায়। আবির হাসি দিয়ে মাথা নাড়ে। নীলিমা গায়-
” যে মাটির বুকে
ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা,
দেনা, তোরা দে….না…..
সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দেনা….”
সবাই করজোড়ে হাততালি দিয়ে নীলিমাকে অভিনন্দন জানায়। তারপর একে একে সকল কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। সবাইকে মিষ্টি বিতরণ শেষে আলাদা করে পরীক্ষার্থীদের হাতে সুন্দর করে মিষ্টি প্যাক করে দেয়া হয়। অফিস কক্ষে আবিরকেও যথাসাধ্য অতিথীর মর্যাদা দেয়া হয়। সবাইকে সালাম দিয়ে এডমিট কার্ড নিয়ে বিদায় হয় আবির ও নীলিমা।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা সন্নিকটে এসে যায়। আবির ওর কলেজ থেকে ৩দিনের ছুটি নিয়ে নীলিমাকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে পরীক্ষার যাবতীয় নিয়মকানুন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়ে আসে। আসার আগে নীলিমার হাতে একটা ফোন দিয়ে আসে, যাতে করে জানতে পারে নীলিমা কখন কি করছে, কিভাবে পড়ছে? রাত্রিতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে এবং শেষ রাত্রিতে কল দিয়ে ঘুম থেকে তুলে আবির নীলিমাকে পড়তে বসাতো।
পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট দেয়। আবিরের দেখাশুনা এবং নীলিমার মেধার জোড় ও আল্লাহর অশেষ রহমতে নীলিমা ভালো রেজাল্ট করে। পুরো বাংলাদেশ থেকে মেধাক্রমে নীলিমা প্রথম হয়।
নীলিমাকে আবির ওর কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। নীলিমাও এ নিয়ে আর কোনো বাকবিতণ্ডায় যায় নি। কারণ, ও শুনেছে আবিরের কলেজটা খুব নামকরা। অনেক বছরের সুনাম ও গৌরব রয়েছে কলেজটির। কলেজের প্রথম দিন’ই মিশুক নীলিমা ফ্রেন্ডস জুটিয়ে ফেলে। হিয়া নীলিমার বেস্ট ফ্রেন্ড সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। হিয়া ছাড়াও নীলিমার আছে আরো ৪,৫জন বান্ধবী। এরা একেকজন একেক গ্রুপের হলেও এদের সাথে নীলিমার রয়েছে আন্তরিকতা। নীলিমা সাইন্সের স্টুডেন্ট। তাই শুধুমাত্র বাংলা এবং ইংরেজী ক্লাসের সময় নীলিমা ওদের সাথে একত্রে বসতে পারত, আড্ডা দিতে পারত।
সেদিন ছিল বোধবার…..
আবিরের বাংলা ক্লাস। নীলিমা ও তার কমার্সের কিছু বন্ধুরা কর্ণারে দুটো বেঞ্চে বসে। সেদিন হিয়া আসেনি বিধায় নীলিমা ওদের সাথেই আড্ডা জুড়ে দেয়। আড্ডা দেয়ার একপর্যায়ে নীলিমাকে একটা বান্ধবী প্রশ্ন করে, কিরে! তোর না বাচ্চা হবে? তো পরীক্ষা করেছিস? নীলিমা শুকনো মুখে উত্তর দেয়, স্যারকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। রিপোর্ট নেগেটিভ আসল। নীলিমার বান্ধবীরা জেনে গিয়েছিল নীলিমা সহজ-সরল, বোকা-সোকা একটা মেয়ে। তাই ওরা ওকে নিয়ে একটা মজা করতে চাইল। আর এক্ষেত্রে নীলিমার বড় দুর্বলতা “বাচ্চা”। সেদিন নীলিমার হাতে ওরা একটা ঔষধ ধরিয়ে দেয়। বলে দেয়-
“নীলি তোর বাচ্চা হবে যদি তুই স্যারের অজান্তে এই ঔষধটা স্যারের জন্য তৈরিকৃত স্যুপ কিংবা অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দিতে পারিস।” বান্ধবীদের কথা শুনে নীলিমার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠল। লাফিয়ে উঠে বলল, সত্যি বলছিস তোরা? এটা খাইয়ে দিলেই হয়ে যাবে? ওরা হাসি আটকিয়ে বলল, হুম! হয়ে যাবে….. তুই গোপনে খাইয়ে দিস। আর হ্যাঁ, রাত্রে ঔষধ খাওয়ার পর স্যারের রিয়েকশনটা কিন্তু আমাদের বলতে হবে…! না বললে কিন্তু বাচ্চা হবে না বলে দিলাম… নীলিমা হেসে বলে, আরে! এ নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি রাতেই ফোন করে জানাবো।
স্কুল ছুটি শেষে আবিরের সাথে বাসায় চলে যায় নীলিমা। নীলিমার খুশি আর দেখে কে? বাসায় আসার পর থেকে একা একা শুয়ে হাসছে নীলিমা। আবির কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে না। সন্ধ্যায় নামাজের বিছানায় বসে হাসি, কুরআন তেলওয়াত করা থেকে উঠে হাসি, পরতে বসে হাসি, টিভি দেখতে বসে হাসি, রুমে আবিরের সামনে বসে রাতের খাবার খেতে গিয়ে ভাত মুখে নিয়ে হাসি। হাসতে হাসতে নীলিমার নাক দিয়ে ভাত বেরিয়ে আসে। ওমাগো, ঝাল লাগছে, পানি, পানি বলে চিৎকার করতে থাকে নীলিমা। পরীক্ষার খাতা দেখছিল আবির। বসা থেকে উঠে পানি আনার জন্য খাবার টেবিলে রাখা পানির জগটা আনার জন্য জগে হাত দিতেই থমকে যায় আবির। জগের ঠিক পাশেই আবির পাউডার জাতীয় কিছু দেখতে পায়। ঐটা হাতে নিয়েই আবির রুমে যায়। আবিরের হাতে বান্ধবীদের দেয়া ঔষধটা দেখে ভয়ে চুপসে যায় নীলিমা। আবিরের বলার আগেই বসা থেকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরে। ধমকের স্বরে প্রশ্ন করে আবির-
” কি এটা? কে দিয়েছে তোমাকে?”
নীলিমা কাঁপা গলায় জবাব দেয়,
স্যা স্যা স্যাস্যার….
আমার কোনো দোষ নেই। ওরা আমায় দিয়েছে।
**নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
ওরা কে? আর কি কারনে দিয়েছে? দ্বিগুন রেগে প্রশ্ন করে আবির। উত্তর দেয় নীলিমা- পপি, জোনাকি, ফাতেমা, ঝুমা… ওরা বলেছে আপনাকে এটা গোপনে স্যুপের সাথে খাইয়ে দিতে। তাহলে আপনি আমায় আদর করবেন। তবেই আমার বাচ্চা হবে।
রাগে কাঁপতে থাকে আবির। ভেবেছিল, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ম্যাচিওরিটি’টা চলে আসবে, বুঝতে শিখবে নীলিমা। কিন্তু তার আর হলো কই? কলেজে উঠেও একের পর এক যা ঘটিয়ে চলছে আবিরের তাতে তো মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। অন্যদিন মাথা ঠান্ডা করলেও আজ আবির পারেনি নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে। তাইতো ঔষধ বাইরে ফেলে দিয়ে এসে নীলিমাকে ঝাঁঝালো গলায় কড়া কথা শুনিয়ে দেয়, সেই সাথে বলে দেই ওদের সাথে যেন আর কখনো না দেখি তোমাকে। নিশ্চুপ নীলিমা ভয়ে ভয়ে মাথা ঝাঁকায়।
পরদিন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে নীলিমা ওর ফ্রেন্ডদের। কিন্তু বাংলা ক্লাসের সময় ওরা ঝেঁকে বসে নীলিমার পাশে। কিরে রাতটা কেমন কাটলো? কিংবা কি হয়েছিলরে রাত্রে? একেকজনের একেক প্রশ্ন আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি। নীলিমা উত্তরে কিছু বলার জন্য পিছনে ফিরতেই ক্লাসে আসে আবির। ক্লাসে ঢুকেই আবির নীলিমাকে পিছনে তাকানো অবস্থায় দেখতে পায়। রাগে ফুসতে থাকে আবির। এটা দেখে নীলিমার ভিতরটা কেঁপে উঠে। শুকিয়ে যায় গলা। আবির পড়া জিজ্ঞেস করলে সব গুলিয়ে ফেলে আবিরের লাল চোখ দেখে। বেঞ্চের উপর এক ঠ্যাংয়ে আবির নীলিমা ও তার পড়া না পারা বান্ধবীদের দাঁড় করিয়ে রাখে। প্রায় ১০মিনিট এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখছে, তবুও রাগ কমছিল না দেখে আবির সবগুলারে সামনে আনে। অতঃপর কান ধরে ১০০বার উঠাবসা করতে বসে। একবার কম হলে পরবর্তীতে দ্বিগুন শাস্তি এটা শুনে নীলিমা মনে মনে একদুই গুনতে থাকে আর উঠবস করতে থাকে।
ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্টসদের সামনে এভাবে কান ধরে উঠবস করা, ব্যাপারটা খুব লজ্জার। একশ বার কান ধরে উঠবস করেই নীলিমা ওর জায়গায় গিয়ে বসেছে যদিও অন্য মেয়েরা ২০বারের অধিক উঠবস করেনি। পাশেই ছেলেরা মিটমিট করে হাসছে আর ফিসফিস করে কথা বলছে, লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকা অবস্থা’ই নীলিমার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু নিচে বইয়ের মাঝে পরে। মাথা নিচু অবস্থায়’ই নীলিমা এক হাত দিয়ে ভেঁজা চোখ মুছে নেয়। সেদিন আর কোনো ক্লাস না করে নিঃশব্দে নীলিমা কলেজ ত্যাগ করে। যে ছেলেরা পাশ থেকে ফিসফাস আর হাসাহাসি করছিল, সেই ছেলেদেরও আবির মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে প্রত্যককে একেক ঠ্যাংয়ে ১০টি করে, ২০ ঘা বসিয়ে দেয়। কলেজ ছুটির পর ছেলেরা এ নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নালিশ করে যায়। প্রিন্সিপাল স্যার আবিরকে ওনার কক্ষে ডেকে নেক্সট টাইম যাতে এরকম নালিশ না আসে সে ব্যাপারে হুশিয়ার করে দেন। রাগে গজগজ করে আবির বাসায় চলে যায়। নীলিমাকে ইচ্ছে করেই আবির নেয়নি। কিন্তু আশ্চর্য হলো তখন, যখন বাসায় গিয়ে দেখল নীলিমা তার আগেই বাসায় পৌঁছে গেছে। কলেজ ড্রেস চেঞ্জ না করেই বিছানার এককোণে বালিশ বুকে জড়িয়ে চুপটি করে চোখ বোজে আছে নীলিমা। কিচ্ছু বলেনি আবির। না ধমক, না চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার কথা। নীলিমাও আবিরের আগমনের শব্দে চোখ টা যে বন্ধ করল, সেটা খুলল আবির সন্ধ্যার আগে বাহিরে চলে যাওয়ার পর।
আবির বাহিরে চলে গেলে উঠে বসে নীলিমা। চোখের পাশে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর রেখা মুছে, ড্রেসটা চেঞ্জ করে নেয়। মাগরিবের আজান দিলে নামাজ পড়ে পড়তে বসে। রাত্রি ৮টার দিকে রাতের খাবারের জন্য রান্না বসানো হয়। আবির ফিরে আসে বাসায়। আজ আর কোনো পাগলামি করেনি নীলিমা। আবির আসার পর একবার শুধু তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। আবিরও কোনো কথা না বলে সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টসদের পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসে পরে। রাত্রি ১০টার দিকে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে রুমে যায় নীলিমা। ধীর কন্ঠে আবিরকে জানায়- “টেবিলে খাবার দিয়ে আসছি,
খেয়ে আসেন।”
খাতাগুলো রেখে টেবিল থেকে একটা প্লেট নিয়ে সোফায় নীলিমার পাশে এসে বসে। ভাত মেখে নীলিমার মুখের দিকে এগিয়ে দিতেই, উঠে দাঁড়ায় নীলিমা।
” বিকেলে কলেজ থেকে ফেরার পথে হিয়াদের বাসা থেকে বিরিয়ানি খেয়ে আসছি। আমার দ্বারা আর আজকে খাওয়া সম্ভব না। আপনি খেয়ে নিন।”
কথাটা বলেই বিছানায় একপাশে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পরে নীলিমা। জবাবে কিছুই বলেনি আবির। শুধু সিক্ত নয়নে একবার নীলিমার দিকে তাকালো। তারপর প্লেটটা টেবিলে রেখে অন্যান্য খাবারগুলো ঢেকে রেখে কিচেনের লাইটটা অফ করে দেয়। চুপটি করে এসে বিছানায় শুয়ে পরে আবির। নীলিমার বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে চোখের জল ছেড়ে দেয়। মনে মনে বলতে থাকে, আমি ওকে এত বড় শাস্তি দিলাম? এ আমি কি করলাম? কিভাবে এটা করতে পারলাম? নিঃশব্দে গুমড়ে কেঁদে উঠে আবির। তারপর একটা সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। রাত্রে হাড় কাঁপানো জ্বর আসে নীলিমার। ছটফট নীলিমা কিছু না বলে নিঃশব্দে শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে।
সকাল হয়ে গেছে।
ফজর নামাজটাও পরেনি
আবার এখনো শুয়ে আছে। রাগ করলে মানুষ এমন করে? নামাজ ছেড়ে দেয়??? প্রশ্নটা করেই নীলিমার হাত ধরে টান দেয় আবির। চমকে যায়। নীলিমার শরীরটা এতটাই গরম ছিল যে আবির তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে আনে।
” হায় আল্লাহ! এত গরম কেন এর শরীর?”
কথাটা বলেই ঘুমন্ত নীলিমার কপালে হাত রাখে। আঁতকে উঠে আবির। পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে নীলিমার। এখন আমি কি করব? এত সকালে তো কোনো ফার্মেসীও খোলা পাব না। উপয়ান্তর না দেখে আবির ওর রুমাল ভিঁজিয়ে নীলিমার মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। নীলিমার শরীরের তাপমাত্রা এতটাই প্রকট ছিল যে ঐ তাপের প্রভাবে কপালে রুমাল দেয়া মাত্র’ই রুমাল গরম হয়ে যাচ্ছিল। ওমাগো, শরীরটা নাড়াতে পারছি না আমি, খুব ব্যাথা করছে, এসব বলে অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করতে থাকে নীলিমা।
” আজ শুধু মাত্র আমার অবিবেচকের মত কাজের জন্য ওর এই অবস্থা হলো, কথাটা বলেই চোখের পানি ছেড়ে দেয় আবির।”
সকাল ১০টায় ফার্মেসী থেকে ঔষধ আনিয়ে গরম ভাত তরকারী রান্না করে আবির নীলিমার পাশে এসে বসে। ধীর গলায় নীলিমাকে ডাকে।
” নীলিমা! শুনছো….
আর কত ঘুমোবে? সকাল হয়েছে। উঠে পরো এবার”
নীলিমা তড়িগড়ি করে উঠে বসে বিছানায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে দিনের ১০টা নাকি রাত্রের নয়টা বাজে? শুকনো মুখে আবিরের জবাব, দিনের ১০টা। সকালের নামাজটা দু’জনেই ঘুমের জন্য মিস দিয়েছি। যায় হোক, পরে কাযা করে নিও। চলো এখন…..
নীলিমা ওর ঘাড় থেকে আবিরের হাতটা ছাড়িয়ে দেয়।
” আপনি আমায় এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন যে? আমি কি যেতে পারি না নাকি?”
নরম স্বরে আবিরের জবাব, তোমার শরীরে জ্বর নীলিমা। পরে যেতে পারো। এখন কথা না বাড়িয়ে চলো তো…..
আবির পিছন থেকে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর নীলিমা আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। ওয়াশরুমে নিয়ে আবির নিজ হাতে নীলিমাকে ব্রাশ করিয়ে দিয়েছে, চোখে মুখে পানিরছিটা দিয়ে দিয়েছে। তারপর আবির ওর কাঁধে রাখা তোয়ালে দিয়ে ভেঁজা মুখটাও মুছে দিয়েছে। হন্যে হয়ে নীলিমা তখনো আবিরের চোখে মুখে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে নিজ হাতে আবির যখন নীলিমাকে খাইয়ে দিচ্ছিল, তখনো নীলিমা আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। ট্যাবলেটের পাতা থেকে আবির যখন ট্যাবলেট বের করছিল তখন সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে দেয় নীলিমা। মনে মনে চিৎকার দিয়ে নীলিমা ওর ভেতরের সত্তাকে জানান দেয়,
“নীলি! পেরেছিস তুই! তুই পেরেছিস….
**নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
যে চোখে একদিন তুই তোর জন্য ঘৃণা দেখতে পেয়েছিলি, আজ সেই চোখে’ই তোর জন্য ভালোবাসার অথৈ সাগর দেখতে পাচ্ছিস। তুই আসলেই পেরেছিস নীলি…..”
সেদিনের পর থেকে নীলিমা পাল্টে যায়, ঘোর পাল্টে যায়। আগের সেই বাচ্চা, বাচ্চা ভাবটি আর ওর মধ্যে নেই। আগের মতো আর পাগলীও করে না। করেনা কারনে অকারনে আবিরকে জ্বালাতন।
অতিবাহিত হয়ে গেল অনেকগুলো বছর। সেদিনের সেই ঘটনা, কলেজে কান ধরে উঠবস করানোর দিন আবির ওর নীলিকে হারিয়ে ফেলেছে, হারিয়ে ফেলেছে আগের সেই বাচ্চা নীলিকে। ওর নীলি এখন আর আগের মত হাসে না, বাচ্চাদের মত আসে না ছুটে ওর কাছে। কাজ থেকে টেনে নিয়ে বলে না, চলুন না! ডাক্তারের কাছে যায়। বাবুটার বয়স কত হয়েছে জেনে আসি। এখন আর কেউ চশমা চুরি করে নিজ চোখে দিয়ে রাখে না। সর্বোপরি, আবির এখন আর কাউকে ধমকাতে পারে না। পারবে কিভাবে? ওর নীলির দিন যে এখন মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে পড়াশুনা করে কাটে। মাসে কোনো একদিন মন চাইলে আসে, সাথে সাথে আবার চলেও যাও। যে একটু সময়ের জন্য আবির নীলিমাকে পায়, সে সময়টুকু আবিরের নীলিমাকে চিনতে চিনতেই চলে যায়। নীলিমা চলে গেলে মনকে প্রশ্ন করে আবির-
” এ আমার সেই নীলি তো? যে একসময় আমি ধমক না দিলে খেত না?!”
” এ আমার সেই নীলি তো! একটু ব্যস্ত থাকলেই যে বলত, হু! বুঝি তো আমার দিকে তাকাতে এখন আর ভালো লাগে না, তাই ব্যস্ততার বাহানায় দুরে থাকুন।”
নীলিমা যে সময়টা হোস্টেলে বান্ধবীদের আনন্দে দিন কাটাতো আর আবির সে সময়টা একাকী অন্ধকারে বসে চোখের জল ফেলে কাটিয়ে দিত।
কোর্স শেষে নীলিমা হোস্টেল ছেড়ে দেয়। বান্ধবীদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে। ২দিন পর’ই আবার ইন্টার্নির জন্য নীলিকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। সেখানকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে ইন্টার্নি শেষে তবেই ঢাকায় ফিরবে। ব্যস্ত নীলিমা বিরামহীন ভাবে যখন ওর জিনিসপত্র গুছাচ্ছে, আবির তখন চুপিসারে বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে নীলিমার ডায়েরীর পাতায় চোখ বুলায় যেখানে লিখা_____
” যে রাত্রি থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষের এক নবজীবনের সূচনা ঘটে, অভিনয়টা শুরু ঠিক তার পরদিন থেকে। একটা মেয়ে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় পরিজন সবাইকে ছেড়ে শূন্য হাতে শ্বশুর বাড়িতে পা রাখে। সবাইকে ছেড়ে চলে আসলেও তার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আঁকা থাকে অচেনা পুরুষটিকে ঘিরে, যাকে সে কখনো দেখেনি, চিনেনি, জানে নি। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। বাবাকে হারিয়ে একরকম বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পরে যখন বিয়ের পিড়িতে বসলাম, তখন চোখ ভর্তি স্বপ্ন ছিল সেই অদেখা রাজকুমারকে নিয়ে, এক মাস্টারমশাইকে নিয়ে। আমার আবিরকে নিয়ে। ৭দিনে একটু একটু করে যে স্বপ্ন আমি আমার বুকে লালন করেছিলাম, সেই লালিত স্বপ্ন নিমিষেই ভেঙে তছনছ হয়ে যায় ভয়ানক সেই ফুলশয্যার রাত্রিতে ওর কথার করাল গ্রাসে। ভালোবেসে বুকে টানার পরিবর্তে ও আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন। শারীরিক আঘাত নয়, সে ওর অপ্রিয় কিছু কথার তলোয়ার দ্বারা আমায় আঘাত করেছিল। আমার দিকে চাদর-বালিশ ছুঁড়ে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল আমার সঠিক স্থানটা। যে আমি কখনো অন্যায় কিছু সহ্য করিনি, সেই আমি চুপটি করে রুমের এককোণে শুয়ে পরলাম। চোখ থেকে পানি পরেছে কিন্তু ভেঙে পরিনি। পরদিন যখন ও আমার দিকে তাকিয়ে এক পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল, “অভিনয়টা তাহলে ভালো’ই পারো! আমিও এটাই চাই”….
তখন মনে মনে একটাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম_
” যে চোখে আজ আমার জন্য একরাশ ঘৃণা দেখছি, সেই চোখে একদিন আমার জন্য ভালোবাসার অথৈ সাগর দেখতে চায়।” সেদিন থেকেই শুরু হলো অভিনয়ের পালা।
হা, হা! কত বোকা’ই না ও…..
যে আমি অজপাড়া গায়ে বেড়ে উঠেছি, তাকেই কি না বাচ্চা হওয়ার কারন শিখাতে আসে। ওরে! তোদের মত শহুরে ছেলে মেয়েদের চেয়ে আমরা গ্রামের ছেলে মেয়েরা এদিক দিয়ে একধাপ এগিয়ে। যে বিষয়টা তোরা প্রযুক্তির কল্যানে জানতে পারিস, সে বিষয়টা আমরা দাদি, নানি, ভাবীদের থেকে তার অনেক আগেই শিক্ষা পায়। সর্বোপরি আমি একজন সাইন্সের স্টুডেন্ট। আর তাকেই কি না তুই……(……)…..???
নীলিমা সবকিছু গুছিয়ে আবিরের আলমারি শেষমেষ একবার গুছানোর জন্য কাপড়ে হাত দিয়েই ভেতর থেকে আবিরের একটা তালাবন্ধ ডায়েরী নিচে পরে যায়। ডায়েরী তুলে আগের জায়গায় রাখতে গিয়ে নীলিমার ওর নিজের ডায়েরীর কথা মনে হয়।
” কোথায় গেল? খাটেই তো ছিল।”
নীলিমা খাটে রাখা সমস্ত কাপড় এলোমেলো করে ফেলে, খুঁজতে থাকে ওর ডায়েরী। আবিরের সব কাপড় চোপড় এলোমেলো করে তার ভিতরেও খুঁজে নেয়। আলমারির কোনো বক্সে’ই নীলিমা ওর ডায়েরীটা খুঁজে না পেয়ে মাথায় হাত রেখে ফ্লোরে বসে পরে। পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখে আবির। ফিরে তাকায় নীলিমা। মলিন মুখে আবির হাতের ডায়েরীটা নীলিমার দিকে এগিয়ে দেয়। আবিরের চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। নীলিমা বুঝতে পারে আবির ওর ডায়েরী পড়ে নিয়েছে। আর এখন ওকে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু আমি তো আজকে কোনো প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রস্তুত না। মাথা নিচু করে বিছানায় বসে পরে নীলিমা। আবির নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীর গলায় প্রশ্ন করে-
” ডায়েরীর পাতার কথাগুলো সত্যি?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ-বোধক উত্তর জানায় নীলিমা। আবিরের ভেতরটা ভেঙে চূড়ে গুড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পরে যাবে। তারপরও নিজেকে শক্ত করে। নীলিমার দুটো হাত চেপে ধরে বলে-
” আমি জানি নীলিমা তুমি আমার সাথে মজা করছ। তুমি কোনো অভিনয় করতে পারো’ই না। আমার নীলিমা তো এমনি’ই বাচ্চা। ও আমার সাথে কোনো বাচ্চা বাচ্চা অভিনয় করতে পারেই না……”
হ্যাঁচকা টানে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নীলিমা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“আমার নীলিমা, তাই না?”
উত্তর দেয়, হ্যাঁ! আর আমি জানি তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি আমায় ভালোবাসো…..
হা, হা! ভালোবাসা?!!……
অট্টহাসিতে মেতে উঠে নীলিমা। হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করে, আয়নাকে নিজেকে দেখেছেন আজকাল? চুল অর্ধেক পেকে গেছে, পুরাই একটা বুড়ো বুড়ো লাগে। আর সেই বুড়োকে ভালোবাসবে ডাক্তার নীলিমাকে….?!!!
.
চলবে____
।
#কোনো গল্পের পর্ব খুজে না পেলে সর্বশেষ পোস্ট কমেন্ট করে জানাবেন।
।
।
।
#আপনাদের উৎসাহ পেলে পরবর্তী পার্ট দিবো। আসা করি সবাই লাইক কমেন্ট করে সাথেই থাকবেন।