#পিশাচ দেবী
২য় পর্ব
.
গতদিন সন্ধ্যার পর আকলার ঘরে না ফেরাটা অনেকের নজরে পড়েছিল। সকালে তাই গোষ্ঠীর একজন-দুজন করে মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে এলো। আকলা তাদের সবাইকে সেই ভয়ঙ্কর রাতের বর্ণনা শুনালো। ডাকাত , গুহা , দেবী হারমা। সকলে বিস্মিত হয়ে তার কথা শুনলো। প্রমাণ স্বরূপ আকলা তার ছেড়া , জরাজীর্ণ সেই পোশাকটা দেখালো। সেখানে এখনো বীর্যের দাগ লেগে রয়েছে।
কথাটা পুরো গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। তারা পিশাচ দেবী হারমা সম্পর্কে এমন অনেক কথা শুনেছিল। তবে সবই পুরোনো কাহিনী হিসাবে। এখনো বনে এখনো দেবী রয়েছেন জেনে সবাই কৌতূহলী আর উদ্বিগ্ন। ঘন্টা দুয়েক পরেই গোষ্ঠী প্রধান আকলার ঘরের সামনে হাজির হলেন। বৃদ্ধের বয়স ৭০ এর ওপরে। আকলা তার দোরগোড়ায় গোষ্ঠী প্রধান মানজা বু কে দেখে অবাক হলো। কোনো প্রয়োজনে গোষ্ঠী প্রধান মানুষদের ডেকে আনেন। নিজে আসেন না।
মানজা বু চকিতে বসতেই আকলা হাটু গেড়ে মেঝেতে বসলো। মানজা বু কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই বয়সেও তার চোখের নজর তীক্ষ্ণ। পড়তে চেষ্টা করছে মেয়েটার মন।
আকলা , প্রিয় মা। তুমি কী জানো তুমি কী করছো ?
আকলা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে আরো চুপসে গেল। বৃদ্ধ :
এটা কি ঠিক হচ্ছে তুমি পুরো গোষ্ঠীতে একজন পিশাচ শয়তানের মহত্ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছ? তুমি কী জানো না আমাদের গোষ্ঠীতে এই পিশাচের নাম নেয়াও মহাপাপ। পিশাচ সাধনার কারণে আমরা আমাদের কত পূর্ব-পুরুষ , আত্মীয় , ভাই হারিয়েছি ? কত রক্তপাত ঘটেছে। সেই সব কাহিনী কী সব মিথ্যা মনে করো তুমি?
কিন্তু বু , আমি বানিয়ে কিছুই বলছি না। যা আমার সাথে ঘটেছে তাই বলছি। সত্যিটা!
মায়ার জগতে সত্য , মিথ্যা বলে কিছু নেই , মা আকলা। এর সবটাই মিথ্যা। এই পিশাচের ভয়ঙ্কর মায়া সম্পর্কে কিইবা জানো তুমি ? আমি আমার বাবা , ভাই, দুই সন্তানকে হারিয়েছি এই পিশাচের কারণে। তুমি যে বললে ডাকাতের কথা , তাদের অত্যাচারের কথা। কিন্তু তোমার গায়ে কী কোনো দাগ আছে ?
আমি বলেছি বু , ওই কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করার পর সব কষ্টের সাথে দাগগুলোও মুছে গেছে।
বোকা বানানো হয়েছে তোমাকে। ফাঁদে ফেলা হয়েছে। মায়ার ফাঁদ! তুমি ভাবছো তুমি ডাকাত দলটাকে বোকা বানিয়ে মায়ার জগতে আটকে দিয়েছ পিশাচটার সাহায্যে। কিন্তু হতেও তো পারে এই ডাকাতের দলটাও মায়ার একটা অংশ। তাদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমিই মায়ায় আটকে গেছ। তোমার যা মনে হচ্ছে রাতে ঘটেছে , তার কিছুই ঘটেনি।
কিন্তু এই ছেড়া কাপড়, লেগে থাকা দাগ! একই রকম নতুন কাপড় পিঁড়ি থেকে আমিই পরেছি। এই দেখুন এখনো আমার পরনে!
এই রকম কাপড় এই গোষ্ঠীতে অন্তত পঞ্চাশ ঘরে পাওয়া যাবে। তুমি জঙ্গলে পেয়েছিলে এই গোষ্ঠীরই কারো ফেলে দেওয়া পুরোনো ছেড়া কাপড় , তুমি যেই কাপড় পরে জঙ্গলে ঢুকেছিলে আর এখন যে কাপড় পরে রয়েছে , দুটো একই। পোশাক পাল্টানোর প্রয়োজন হয়নি তোমার। মায়া তোমাকে ভুল বোঝাচ্ছে!
আকলার কিছুতেই বু এর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বু তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। আর বলেন :
এইভাবেই প্রতিবার শুরু হয় তার আগমন। একজন সরল মানুষকে ফাঁদে ফেলে। সে তার কথা ছড়িয়ে দেয় গোষ্ঠীতে। এরপর শুরু হয় অনাচার, হত্যা , ধ্বংস। তোমাকে বুঝতে হবে আমার সাহায্য ছাড়া তুমি এতদিন এই বসতিতে থাকতে পারতে না। বাবার পরিচয় হীন একটা মেয়েকে বসতিতে রাখার নিয়ম নেই। তবুও আমি সদয় হয়েছি। কিন্তু পিশাচ শয়তানটাকে নিয়ে আর একটুও কথা হলে ধরে নেব তুমি এই বসতি ছেড়ে চলে যেতে চাইছ। এই নোংরা , কাপড়টা এখনই পুড়িয়ে ফেল , আমার হুকুম।
এই বলেই মানজা বু ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। ঘরের মাঝখানেই একটা পাতিলে আগুনে পুড়ছে সেই কাপড়টা যা গত রাতের তার ওপর হওয়া অত্যাচারের আর দেবীর দয়ার একমাত্র প্রমান। সে যে পিতৃপরিচয়হীন এটা মনে করিয়ে দেওয়ায় তার মনটা খারাপ হয়ে এলো। সে পিতৃপরিচয়হীন না। আসল কথা হলো তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীর আর কেউ না জানলেও আকলা নিজে জানে। এই বুড়ো গোষ্ঠী প্রধানই তার পিতা। বুড়ো নিজেও জানে না আকলার মা মরার আগে কানে ফিসফিস করে তার বাবার নাম প্রসঙ্গে প্রধান মানজা বু এর নাম নিয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে যদিও সে বুঝতে পারতো লোকটা তার প্রতি একটা টান অনুভব করেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর পিতার দাবি নিয়ে সে কখনো মানজা বু এর কাছে যায়নি । কী লাভ ? কী প্রমাণ আছে তার ? উল্টো গোষ্ঠী ছাড়া হবে সে।
গোষ্ঠী প্রধানের লাঠিয়াল লোক পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। পিশাচ শয়তান হারমা এর নাম যে মুখে আনবে বা আলোচনা করবে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের চাবুক পেটা করা হবে। গোষ্ঠীর কেউ তাই প্রকাশ্যে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ করে দিল। কিন্তু তাদের মনের ভেতরের এই ঘটনার ছাপ মোছার ক্ষমতা কোনো গোষ্ঠী প্ৰধানের নেই।
এক প্রকার নজরবন্দি করেই রাখা হলো আকলাকে। সে টয়লেটে গেলেও যে তার ওপর কেউ নজর রাখছে তা বুঝতে পারে সে। ঘরের সামনেই মাটির চুলো। কাঠের জোগাড় করে দিয়েছেন বু এর লোক।
সারাদিন সেই রাতের জঙ্গলের কাহিনী স্মরণ করেছে আকলা। ভয়ংকর অনুভূতি গুলো এতই তাজা যে সে এখনও নিশ্চিত তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কোনো মায়া না। দেবী হারমা সত্যিই তাকে রক্ষা করেছেন। আপন মনেই ভক্তি জাগলো দেবীর প্রতি। শ্রদ্ধার সাথে তার নাম জপতে জপতে শুয়ে পড়লো আকলা।
সে বুঝতে পারছে সে স্বপ্ন দেখছে। তবুও এত বাস্তব সবকিছু ! সে একটা মাটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। জোৎস্নায় ফকফকে চারপাশ। এই জায়গায় সে আগে আসেনি। হঠাৎ একটা মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা খিলখিল হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠলো সে। প্রথমে মনে হলো শব্দটা মাটির ঘর থেকে আসছে। পরবর্তীতে বুঝতে পারলো উঠানের সামনে ঝোপের পেছন থেকে শব্দটা আসছে। সে ঝোপের ভেতর গলে সামনে বেরিয়ে গেল।
চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে পুকুরের পানি। সেই পুকুরে অপরূপ রূপবতী একটা মেয়ে গোসল করছে। এত ফর্সা গায়ের রং , টানা চোখ , লম্বা চুলের মেয়ে আগে কখনো দেখেনি আকলা। পুরো দেবী!মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে পানিতে নামতে ইশারা করলো। আকলা পানিতে নামতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারা দুজন দুজনের দিকে।
হঠাৎ খেয়াল করলো আকলা, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ মেয়েটা আসলে তারই প্রতিবিম্ব। হুবহু তার মুখায়ব। শুধু আরো সুন্দর। আকলার শ্যামা রং , দুধে আলতা মিশিয়ে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়বিড় করে প্রতিবিম্ব বলল :
মাথা নোয়া দেবীর সামনে আশীর্বাদ পেতে।
কে দেবী !
আমাকে চিনতে পারছিস না! যে তোর লজ্জা লুকাল , তোর সতিত্ত্ব ফিরিয়ে দিল। তাকে ভুললে চলবে ?
আপনি দেবী হারমা ?
তোর কী মনে হয় ?
আপনি আমার মতো দেখতে!
আমিতো তোদের সবার মতই দেখতে। আমি যে তোদের মা। তোদের সবার ভেতরে আমার বাস।
সবাই যে বলে আপনিতো অভিশপ্ত ! আর ডাকলেও আসতে পারবেন না কারো সামনে!
তোরাই আমাকে পরিত্যাগ করেছিস! রক্ত, সম্পদ , ক্ষমতা উন্নতির পথ বন্ধ করে অভিশপ্ত পথ বেছে নিয়েছিস। খেত, খামার করে, ঔষধ বিক্রি করে কোনোমতে বেঁচে আছিস। তোরা কী তোদের পূর্ব পুরুষের উন্নতির , সাহসের , গর্বের গল্প শুনিসনি? আমার দয়া ছাড়া আর কে তোদের গোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ উন্নতিতে পৌঁছে দিয়েছিল। কে না তোদের গোষ্ঠীর লোককে না চিনতো? তাদের দেখলেই মাথা নত করে পালাতো সবাই। আমি এমন কোন ইচ্ছা আছে যা পূরণ করিনা! তবুও কেন আমায় পরিত্যাগ করলো সবাই ?
আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।
কতযুগ পর কেউ আমার নাম এমন বিশ্বাসের সাথে স্বরণ করলো! আমাকে মুক্ত করলো অভিশাপ থেকে। তাইতো তোকে আমার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলাম। তোর কাছে এলাম। তুইই এখন ফিরিয়ে আনতে পারবি তোর গোষ্ঠীর মর্যাদা আমাকে তোদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করে।
কিন্তু , ওরা সবাই যে বলে আপনি ডাইনি!
আমার ক্ষুধার কারণে বলে। কার ক্ষুধা নেই বল ? আমি তোদের সব দিব । তার বদলে তোরা আমার ক্ষুধা মিটাবি না! আমার পূজা করবি না! বিনিময় দিবি না?
বিনিময়!
তোর প্রাণ বাঁচালাম। তোর সব রক্ষা করলাম। তুই কী কৃতজ্ঞ না? তুই তার মূল্য দিবি না? আমার যে খুব ক্ষুধা!
আপনি কী চান?
যা তোরা অপচয় করিস। মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তা প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন আমার।
কিন্তু দেবী….।
হঠাৎ করেই আকলা বুঝতে পারে তার নিয়ন্ত্রণ তার কাছে নেই। সে মাথা ঝুকিয়ে পানির নিচে বসে পড়েছে। ভাসা ভাসা ভাবে দেখা দেবীর পা দেখে স্পর্শ করল। দেবীর হাত তার মাথায় স্পর্শ করতেই ঘুম ভেঙে গেল তার ।
হতভম্ব হয়ে নিজের ভেজা কাপড়, শরীর আর ভেজা বিছানা হাতড়াতে থাকে । সে এমন ভাবে ভিজে আছে যে মনে হচ্ছে মাত্র পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে বিছানায় শুয়েছে কাপড় না পাল্টে। অথচ পুরোটাইতো স্বপ্নে ঘটলো ! ……………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.