#পিশাচ পুরুষ
৩য় পর্ব
সেরাতে লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়িতে পাওয়া টমির ভয়ানক, বীভৎস ছিন্নভিন শরীর দেখে গ্রামের মানুষেরা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। কী জানি কী হয় অনুভূতি তাদের গিলে খেতে লাগলো। জন্তুটা সব সময় হুংকার ছেড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে এবং শিকার করে। কিন্তু গত রাতে কোনো হুঙ্কার তারা শোনেনি বা অন্য কোনো পশুর উপর হামলাও চালায়নি ওই জন্তুটা। তাহলে কী প্রতিশোধ নিতে কেবল টমিকে মারতে এসেছিল! এত সতর্ক কী কোনো জন্তু হতে পারে! টমির ঘেউঘেউ কিংবা আর্তনাদের শব্দও ব্যাপারী বাড়ির কেউ পায়নি। মাথায় কিছুই ঢুকে না কারো ভেতর আতঙ্ক ছাড়া।
লিয়াকত ব্যাপারীর পরিবারের লোকদেরই ভয় সবচেয়ে বেশি বেড়ে গেল। না জানি ওটা সেই রাতের ক্ষোভে এবার এই বাড়ির মানুষের উপর আক্রমণ চালায় অন্য কোনো রাতে! কারো মাথাতেই এটা আসে না কোনো মানুষ এমন বীভৎস কিছু করতে পারে। গ্রামের মেয়ে সকিনা কুকুরটার মৃত্যুর খবর রাখে না। কিন্তু বারবার তার কল্পনায় ভেসে ওঠে সুদর্শন যুবকের মুখটা।
গ্রামের অনেকেই দূরের গ্রাম গুলোতে চলে যায়। সন্ধান করতে থাকে কুকুরের। যেখানেই কুকুর পায় পোষ মানিয়ে যানে করে তাদের এই গ্রামে নিয়ে আসে। তারা অন্তত এই টুকু বুঝতে পারলো ওই ভয়ানক জন্তুটার কুকুরভীতি রয়েছে এবং কুকুরও জন্তুটাকে দেখে অসাধারণ সাহসী হয়ে ওঠে। কয়টা কুকুর মারবে ওটা? তাই কুকুরের সান্নিধ্যে মনে অনেকটা সাহস যোগায় তাদের। পুরো গ্রাম জুড়ে প্রায় কয়েক’শ কুকুর আনা হলো। লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়িতেই আছে ৮টা!
জঙ্গলের গভীর একটা অংশ। ভুল করেও এদিকে কোনো মানুষের পা পরেনা। বিশাল অদ্ভুত দেখতে ডাল আর পাতাবিহীন, লম্বা , মোটা একটা গাছের নিচের গোড়ার দিকে একটা বড় গর্ত দেখা যাচ্ছে। গর্তের এই পথ দিয়ে চললে যেন দেখা পাওয়া যাবে এক অন্য , অপরিচিত জগতের। নিয়ে যাবে ভিন্ন এক রাজত্বে। যেখানে মানুষ বলে কিছু নেই। ওটার ভেতর থেকে কেমন খচখচ একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। পরমুহূর্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একজন বিবস্ত্র যুবক।
সূর্যের আলোয় এখন উত্তপ্ত দুপুর। এখানে গাছগুলো ও ঘন নয় এবং যে কয়টি গাছ আছে সেগুলোতেও তেমন ডালপালা বা পাতা নেই যে আলোর প্রবেশে বাধা পাবে। তবুও কোনো এক কারণে স্বচ্ছ আলো এখানে পৌছায় না। দিনেও কেমন একটা আঁধার ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। গর্ত থেকে বেরিয়ে, উল্টো ঘুরে মাথা উঁচু করে যুবক একবার বিশাল আকৃতির গাছটার দিকে তাকালো। বুকটা তার কেঁপে উঠলো আতঙ্কে।
পুরো মন জুড়ে বাসা বেঁধে আছে ভয়। সে জানে এটা কোনো সাধারণ গাছ নয়। সন্ধ্যা হতেই জেগে উঠবে গাছটা। প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলবে তাকে। সে কী কৈফিয়ত দেবে! সে তার কথামতো কোনো কাজই করতে পারছে না। বৃক্ষের শিকড়ের সাথে যে গর্ত রয়েছে ওখানে দুজন নারীর মৃত শরীর পড়ে আছে। তাদের দুইজনকেই আমরা চিনি, একজন সেই বছর খানেক আগে যে মেয়েটি একটি জন্তু জন্ম দিয়েছিল সে অর্থ্যাৎ যুবকটির মা। সে যেদিন এখানে আশ্রয় নিয়েছিল লোকালয় থেকে পালিয়ে সেদিনই কোনো এক অশুভ শক্তির প্রভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় এই গর্তের ভেতর। জন্তুটাকে বড় করার দায়িত্বও নেয় সেই অশুভ শক্তি। অর্থাৎ এই বৃক্ষ পিশাচ। আরেকটা গ্রামের বৃদ্ধা নারী পরীমনির লাশ। কিছুদিন আগে যাকে মোহে আবৃত করে এই জঙ্গলে এনেছিল সে। তবে লাশ দুটোর শরীরে সামান্য পচনও ধরেনি। এই গর্তে কিছুরই পতন ধরে না।
মাত্র দুটো নারী শরীরে সন্তুষ্ট নয় পিশাচটা। যুবককে সেই দানবটি বলেছিল এই গর্তে শতাধিক নারীর শরীর থাকতে হবে। তবেই দানবটা তার সব শক্তি ফিরে পাবে। এবং লক্ষ্য পূরণ হবে। কিন্তু সে নিজের খাবার শিকারই ঠিকমতো করতে পারছে না আর শত নারীর লক্ষ্যত অনেক দূর। কাজটা করতে হবে ধীরে। গ্রামের মানুষ গুলো যদি একবার বুঝে যায় গ্রামের নারীদের নিখোঁজের পেছনে এই জন্তুটা দায়ী তাহলে তারা একেবারে সতর্ক হয়ে যাবে। যার ফলে তার একার পক্ষে শত নারীকে এখানে আনা অসম্ভব। আর সে যদি কাজটা না করতে পারে তবে পিশাচ দানবটার উপর থেকে নেমে আসবে ভয়ানক শাস্তি। তার ভেতরের জন্তু থেকে মানুষ, মানুষ থেকে জন্তু হওয়ার ক্ষমতাটা কেড়ে নেবে যা তাকে একই সাথে মানুষের মতো বুদ্ধিমান এবং জন্তুর মতো ক্ষিপ্রতা দান করেছে।
হয়তো যখন পিশাচটা বুঝতে পারবে তাকে দিয়ে কাজটা হবে না। তখন তাকে হত্যা করে ফেলবে। এবং গ্রামের অন্য একটা নারীকে ধরে এনে তার ভেতর তার আরেক সন্তানকে জন্ম দেবে এবং তাকে দিয়েই নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করাবে। হ্যা, সে নিজেও সেই দানব আকৃতির পিশাচ গাছটারই সন্তান!
সূর্য যখন অস্ত গেল তখন জঙ্গলের এই আধার অংশ আরো আধারে পরিণত হলো। জঙ্গলে প্রথমে শুরু হলো মৃদু বাতাস এরপর সেটার বেগ বাড়তে লাগলো। আশেপাশের সমস্ত গাছ দুলতে লাগলো। যুবক গর্তে ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। তার শরীর ক্রমশ লোমে আবৃত হয়ে উঠলো, নখগুলো সুচালো, দেখতে দেখতে বিশাল আকৃতির একটা সাদা জন্তুতে রূপান্তরিত হলো সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিকট গাছটা এবার ভয়ানক ভাবে নড়াচড়া করতে লাগলো। আতঙ্কে পিছিয়ে গিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো সে। গাছটার ছাল খসে পড়তে লাগলো, ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বিকট আকৃতির কুৎসিত একটা শরীর। কালো কুচকুচে শরীর ভর্তি যেন ঘা হয়ে ফুলে আছে, জায়গায় জায়গায় পুচ জমছে, পঁচে গলে ঝরে পড়ছে মাংস, ভালো করে তাকালে বোঝা যায় ওটার পুরো শরীর জুড়ে কিলবিল করছে হাজার হাজার মাংসাশী পোকা, ওগুলোই ওটার পেশি আর কোষ ,ভয়ানক বাজে দুর্গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ। কয়েক মুহূর্তেই বিকট গাছটা একটা ভয়ানক দানব আকৃতির মাথাবিহীন পিশাচের শরীরে পরিণত হলো। পিশাচটার পাকস্থলির উপর কিলবিল করতে থাকা পোকা গুলো একদিকে সরে যেতে লাগলো। সেখানে উদয় হলো দুটো ক্ষুদ্র চোখ এবং একটি বৃহৎ মুখ।
জন্তুটার শরীর আতঙ্কে কাঁপছে দৃশ্যটা দেখে। এই সেই শক্তিশালী পিশাচ পুরুষ, যার হুকুম এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একদিন এই পৃথিবীর কারো ছিল না! পিশাচটার মুখ দিয়ে ভয়ানক এক হুঙ্কার বেরিয়ে এলো। জন্তুটার দিকে তাকিয়ে চোখ কিছুটা হিংস্র করলো , এরপরেই ফু দিল জোরে। জন্তুটা বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে পিছিয়ে গেল অনেকখানি। হো হো করে হেসে উঠলো পিশাচটা, ‘তুমি শুধু আকারেই বড় হচ্ছ, এইটুকু বাতাস সহ্য করতে পারো না! তুমি আমার সবচাইতে অপদার্থ ছেলে। এতদিনেও নিজের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারো নি, নিজের দক্ষতা , বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ সামলাতে পারো না! লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ! একবার তোমার ভাইদের দিকে তাকাও, নিজের সম্পর্কে জানতে পারবে!’
আশেপাশের সমস্ত ডাল আর পাতাহীন গাছগুলো কেঁপে উঠলো, জন্তুটা আতংক নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। গাছ গুলোর ছাল আর খোলসের ভেতর থেকে যেন বন্ধি অনেকগুলো দানব বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কোনো একটা বাধার মুখে পারছে না। ওইসব গাছগুলো থেকে ভেসে আসছে পৈশাচিক গোঙানি।
বৃহৎ আকৃতির পিশাচটা পুনর্বার হুঙ্কার ছাড়লো। জন্তুটার কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে যেতে নিয়ে অনুভব করলো, সে চলতে অপারক। ছটফট করতে লাগলো। তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। শরীরে থাকা পোকাগুলো ওটার মাংস পচেই জন্ম নিয়েছে আবার ওটার মাংস খেতে খেতেই চামড়ার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এটার ব্যথার ছাপও ওটার মুখে স্পষ্ট। চেঁচিয়ে উঠলো ওটা, ‘দেখতে পারছো তোমার পিতার কষ্ট, তোমার ভাইদের কষ্ট! ওই জগতের মানুষের কুকর্মের ফল পাচ্ছি আমরা, আমাদের নিয়ন্ত্রণ এখন ওদের হাতে। এক নারীর ছলনা আমাদের এই দুর্দশা সৃষ্টি করেছে, এখন শত নারীর বিসর্জন আমাদের পুনরুত্থিত করবে। তোমার ক্ষমতার পরিচয় তুমি খোঁজ করো। মুক্ত করো পিতা এবং ভাইদের। যে পিতা তোমাকে এক বছরে এতটা শক্তিশালী করে দিয়েছে সে পিতার ক্ষমতা সম্পর্কে খোঁজ করো। লক্ষ্য থেকে সরে যেয় না। এগিয়ে আসো আমার দিকে।’
জন্তুটা ভয়ে সংকুচিত হয়ে ধীরে ধীরে বীভৎস পিশাচটার একদম কাছে পৌঁছে গেল। পিশাচটার মুখ বিকট হা হয়ে গেল, ওটার শরীরের যত পোকা ছিল সব ছুটে সেই বিকট মুখ ভর্তি করে ফেলছে, পিশাচটা চাবিয়ে খাচ্ছে যেন ওগুলো, ওগুলোর রস মুখে জমা করলো, বিশ্রী ভয়ানক গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। পিশাচটা এবার তার মুখে জমে থাকা সব রস বমি করে ঢেলে দিল জন্তুটার গায়ে। এসিড পড়লে মানুষ যেমন ছটফট করে, জন্তুটাও ছটফট করতে করতে ডিগবাজি খেয়ে পেছাতে লাগলো, মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো, ফসফস, গড়ড় গড় আওয়াজ বেরিয়ে আসছে ওটার গলা থেকে।
দেখতে দেখতে পিশাচ পুরুষটার পেট থেকে চোখ মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল, ছাল মাটি থেকে উঠে ওটার পুরো শরীর আবৃত করে ফেললো আবার, থেমেগেলো ওটার নড়াচড়া। ওটা এখন আবার বিকট আকৃতির ডাল-পালা, পাতাবিহীন একটা বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। জন্তুটা নড়েচড়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। তার শরীরে বমির বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। ওগুলো লোম, চামড়া ভেদ করে তার শরীরের একেবারে ভেতরে চলে গিয়েছে। জন্তুটা খেয়াল করলো তার আকৃতি আর শক্তি আগের থেকে আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিকট একটা হুংকার ছেড়ে সে ছুটলো গ্রামের দিকে। আগে ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে পরে ওই পিশাচটার আদেশ মতো কাজ করার কথা ভাববে সে। ওটাকে ওর মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে পিতার লক্ষ্য পূরণে তার ভূমিকা রাখতে হবে।……………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana