#ইলমা_বেহেরোজ
আমিরের কথায় সস্তি ফিরে পেল, চমকে গেল। কী করে বুঝল আমির? সে নিজের বিস্ময় লুকিয়ে ম্লান হেসে বলল, ‘কী দরকার মায়া বাড়ানোর। এখানেই থাকি।’ আমির দ্বিতীয়বার একই কথা বলল না।
ঘুম ভাঙার পর থেকে পদ্মজার অনুশোচনা হচ্ছে। সে ভাবছে, ‘ওভাবে উনাকে দূরে রাখা ঠিক হয়নি! ইশ, না জানি মনে কতটা আঘাত পেয়েছে।’
আক্ষেপে ওর চোখমুখ শুকনো হয়ে যায়। টেবিলের উপর একটা চিরকুট দেখতে পায়। চিরকুটটি হাতে নিয়ে দেখে সেখানে লেখা বাজারে যাচ্ছি। মাছ নিয়ে আসব। মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট খেতে ইচ্ছে করছে। কেউ যদি মুড়িঘন্ট রেঁধে দেয়, তাহলে তার প্রতি আমার কোনো রাগ থাকবে না। মিলে যাব।
পদ্মজা হেসে ফেলল। ভাবল, ‘আপনি আমাকে এত বুঝেন! ঠিক বুঝে গেছেন, ঘুম থেকে উঠার পর আমার অনুশোচনা হবে!’
সে চপল পায়ে রান্নাঘরে যায়। প্লেটে সকালের খাবার
সাজানো দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায়, বিমোহিত
হয়। রুটিগুলো গোল হয়নি, কোনোটা মানচিত্রের
মতো, কোনোটা চতুর্ভুজ কিংবা ত্রিভুজ। অথচ
খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, অমৃত। এতো ভালো কেন
লাগবে? ভালোবাসা মেশানো ছিল বলে?
ভুবনকে নিজের ভাগের অর্ধেক খাবার দিয়ে দ্রুত হাতে মুড়িঘন্ট রাঁধার সব উপকরণ প্রস্তুত করে জানালা দিয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল আমিরের অপেক্ষায়।
রৌদ্রস্নাত শুকতারাতে প্রবেশ করে রোজিনা, তার দুই ছেলেমেয়ে ও অপরিচিত এক মহিলা। মহিলাটিকে দেখে মনে হচ্ছে, বনেদি পরিবারের। রোজিনা পদ্মজার রুমে গিয়ে গালভরে হেসে প্রশ্ন করে, ‘শইলডা ভালা আপা?’
পদ্মজা মাথা নাড়াল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?’ ‘আপনেরার দয়ায় ভালো আছি।’
পিছনের মহিলার দিকে জিজ্ঞাসুক হয়ে তাকালে রোজিনা পূর্বের গদগদ সুরেই বলল, ‘মহুয়া আপা। আমারে যে বাড়িতে ভাইজানে রাখছে হেই বাড়ির মালিকের বউ। আপনেরে দেখতে আইছে।’
মহুয়া বিমুগ্ধ নয়নে পদ্মজাকে দর্শন করছে।
রোজিনার কাছে এই নারীর এতো প্রশংসা শুনেছে
যে দেখতে চলেই এসেছে। ভেবেছিল, সাহায্য করায়
রোজিনা বানিয়ে বানিয়ে অতিরিক্ত প্রশংসা করছে
কিন্তু সামনাসামনি দেখে মহুয়ার ভুল ভেঙে গেল। তার নিজের রূপ নিয়ে অহংকার ছিল, পদ্মজাকে দেখার পর সেই অহংকার ধূলায় পরিণত হয়। পদ্মজা হেসে বলে, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না।’ ও চেয়ার এগিয়ে দেয়।
মহুয়া বসে চারপাশ দেখতে দেখতে বলে, ‘এই বাড়িটা কি আপনাদের? আগে কখনো তো দেখিনি।’ পদ্মজা বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘উনার বন্ধুর দাঙ্গাবাড়ী এটা।
আমরা কিছুদিনের জন্য এসেছি।’
মহুয়া ভ্রু নাঁচাল, ‘ও। আপনার বাড়ি কোন দেশে?’
পদ্মজা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারল না। জেলা বলতে গিয়ে দেশ বলল নাকি? পদ্মজা জেলা ভেবে বলল, ‘বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি দুটোই নেত্রকোনা।’
মহুয়া অবাক হয়ে বলল, ‘ময়মনসিংহ বিভাগের?”
‘জি।’
‘বাবা-মা দুজনই কি বাঙালি?’
এবার পদাজা বুঝতে পারল, মহুয়ার প্রশ্নের কারণ। তার ব্যতিক্রমী চেহারার জন্য মহুয়া তাকে ভিন্ন
দেশের ভাবছে।পদ্মজা হেসে বলল, ‘দুজনই বাঙালি।’
‘মা কি খুব সুন্দর?’
পদ্মজার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে, শ্যামবর্ণের এক সংগ্রামী নারীর চেহারা। যার গভীর, বড় বড় দুটি কালো চোখ। পাতলা, মসৃণ ঠোঁট। ঘন চুলের খোঁপায় এক আকাশ কালো মেঘ। শাড়ির কুচির ভাজে আভিজাত্য লুকোনো। যখন সেই নারী তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকায়, তখন মনে হয়, বিরাট বড় রাজত্বের রানী তাঁর পূর্বপুরুষের ক্ষমতা প্রকাশ করছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। এতকিছু যার আছে সে ই তো সুন্দর… সবচেয়ে বেশি সুন্দর।
পদ্মজা বলল, ‘হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর।’
মহুয়া এই কথায় ধরে নেয় পদ্মজার মা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিল তাই পদ্মজাও এমন রূপবতী হয়েছে। কিছুক্ষণের আলাপে পদ্মজা বুঝতে পারে, মহুয়া ঠোঁট কাটা স্বভাবের। এই ধরনের মানুষরা ঝামেলার।
কথায় কথায় মহুয়া প্রশ্ন করল, ‘বিয়ের কয় বছর হলো?’
‘সাড়ে পাঁচ বছর।’
‘তা ছেলেমেয়ে ক’টা? কাউকে দেখছি না তো।’গতকালের দগদগে ঘায়ে যেন গরম ছ্যাঁকা লাগে এমনভাবে ছ্যাৎ করে উঠে পদ্মজার বুকের ভেতরটা। ওর চেহারার উজ্জ্বলতা সরে যাওয়াটা স্পষ্ট হয়। পদ্মজা বলল, ‘একটা মেয়ে হয়েছিল, এখন নেই।’
‘নিঃসন্তান?’
কী নিষ্ঠুর শব্দ ‘নিঃসন্তান’। পদ্মজা হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করল, ‘আল্লাহ যা ভালো বুঝেন তাই হচ্ছে। নিশ্চয়ই এতে মঙ্গল আছে।’
মহুয়া পদ্মজার রূপ দেখে যতটা হিংসে করেছিল ততটা শান্তি পায় পদ্মজার ছেলেমেয়ে নেই জেনে। এত রূপ যে পেয়েছে তার আবার সন্তানের কী দরকার? সব সুখ কেন একজনের ভাগ্যে থাকবে? মহুয়া অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, ‘সুন্দর চেহারা কুঁচকে যায় কিন্তু সন্তান সারাজীবন থাকে। এত বছরেও বাচ্চা না হওয়াটা দুঃখজনক ব্যাপার। কবিরাজ দেখিয়েছেন?’
10:23
এসব নিয়ে আলোচনা করতে পদ্মজার ভালো লাগছে না। সে কিছু বলার আগে মহুয়া বলল, ‘আমার চেনা এক কবিরাজ আছে, আপনি আর আপনার জামাই দুজন মিলে একদিন দেখা করতে পারেন। উনি চেহারা দেখেই বলে দিবে সমস্যাটা কার আর কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে। যদিও এসব ক্ষেত্রে পুরুষদেরই সমস্যা হয়। আপনার স্বামীকে-
পদ্মজা কথার মাঝে বাধা দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ‘সমস্যা আমার। আমি কখনো মা হতে পারব না। আর আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।’
হঠাৎ এমন প্রতিক্রিয়ায় মহুয়া ভড়কে যায় তবে দমে গেল না।
আফসোসের সুরে বলন, ‘একজন পুরুষ পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! নিশ্চয়ই উনার এটা নিয়ে কষ্ট হয়।’
অতিথির সঙ্গে খারাপ আচরণ করার মেয়ে নয় পদদ্মজা। তাই চুপ করে রইল। মহুয়া বলল, ‘আপনি উনাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিন। বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে পুরুষ মানুষের মন একসময় সংসার থেকে অতিথির সঙ্গে খারাপ আচরণ করার মেয়ে নয় পদদ্মজা। তাই চুপ করে রইল। মহুয়া বলল, ‘আপনি উনাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিন। বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে পুরুষ মানুষের মন একসময় সংসার থেকে উঠে যায়। ঘরে সতিন থাকলেও স্বামী তো ঘরে থাকবে….
আমির বড় মাছ নিয়ে রুমে ঢুকল। রোজিনা দৌড়ে গিয়ে ওব হাত থেকে মাছ নিয়ে পদ্মজাকে বলল, ‘আমি কাইট্যা দিতাছি।’ সে রান্নাঘরে চলে যায়। আমির ছাদের দিকে হেঁটে গেল। মহুয়া চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘ওমা এতো সুন্দর মেয়ের জামাই দেখি কালো।’
এই পর্যায়ে পদ্মজার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। প্রথম দেখায় একটা মানুষ অপর মানুষ সম্পর্কে এতো দ্রুত কী করে সমালোচনা করতে পারে! কে কি করল, কে কেমন, সেটা নিয়ে খুঁটি নাটি দোষ খুঁজে বের করা মানুষরা কীসের তৈরি? ওদের বিবেকবোধ নেই? পদ্মজা নরম কণ্ঠে বলার চেষ্টা
করল, ‘আমার কাজ আছে। আপনি আসুন। আর হ্যাঁ,
উনি আমার নজর ফোঁটা।’ সে মৃদু হাসল।
বাড়ি ফেরার সময় রোজিনাকে কয়েক টুকরো মাছ
দিয়ে দেয় পদ্মজা। রোজিনা মাছ পেয়ে খুব খুশি হয়ে
যায়। সে পদ্মজার দুই পা ধরে সালাম করে কৃতজ্ঞতাজানায়। পদাজা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, সমবয়সী মেয়ে পায়ে ধরে সালাম করছে! সে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রোজিনাকে পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। মহুয়া যাবার আগে বলে যায়, ‘কবিরাজের দরকার পড়লে আমার কাছে আসবেন। আমি ঠিকানা দিয়ে দেব।’
পদ্মজা প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। সে চুপচাপ রান্না করতে থাকে। মহুয়া অনর্থক কিছু বলেনি, ঠিকই তো তার জন্য আমির বাবা হতে পারছে না। সে ভাবে, নিশ্চয়ই উনি মনে মনে সন্তান কামনা করে। কখনো কী আরেকটা বিয়ের কথাও ভেবেছে?’ ভাবতেই বুকে ব্যথা শুরু হয় তার। স্বামীর বুকে অন্য নারী না, এটা ভাবাও সম্ভব নয়। কিন্তু সে যদি স্ত্রী হিসেবে সন্তান দিতে না পারে, আমির আরেকজন স্ত্রীর কামনা করতেই পারে। ইসলামে অনুমতি আছে। হয়তো সে কষ্ট পাবে ভেবে বলে না। প্রতিটি পুরুষই বাবা হতে চায়। পদ্মজা ছটফট করতে থাকে।
আমির খালি গায়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হয়। তার
উপস্থিতি টের। পেয়ে পদ্মজা স্থির হওয়ার ভান ধরো
আমির পেছন থেকে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে
কাঁধে মাথা রেখে বলে, ‘মন ভালো হয়েছে?”ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না দেখে পদ্মজা যান্ত্রিক সুরে বলল, ‘আমি আপনাকে আরেকটা বিয়ে করাব।’
এই কথাটা সে বলেছে আমিরের মুখ থেকে গুনতে, আমির
বিয়ে করতে চায় কি না। এহেন কথায় বিমূঢ় হয়ে গেল আমির। পদ্মজাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে? পদ্মজা তাকাল, ‘হ্যাঁ, আপনাকে। আপনার উত্তরাধিকার দরকার। আমিতো পারব না -‘
আমির রেগে গেল, ‘এখনো ওটা নিয়ে পড়ে আছো?” আমির রেগে গেল, ‘এখনো ওটা নিয়ে পড়ে আছো?’
আমিরকে রেগে যেতে দেখে পদ্মজা চুপসে গেল। সে অন্যদিকে ফিরে নাক টানতে থাকে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, কী বলছে, কেন কী করছে, কী করা উচিত কিছু বুঝতে পারছে না। পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে কৈফিয়ত দিতে বলল, ‘আমার জন্য আপনি কেন পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন? আপনারও তো বাবা হতে ইচ্ছে করে। আমি কষ্ট পাব ভেবে আর নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। আপনি বললে আমি আপনার জন্য পাত্রী খুঁজে বের করব। আমার থেকেও গুণী, সুন্দরী।’বলতে বলতে কাঁদছে সে। আমির হতভম্ব। কখনো ভাবেনি পদ্মজা এমন কিছু উচ্চারণ করবে। পদ্মজা পুনরায় বলল, ‘তাছাড়া চার বিয়ের অধিকার আছে আপনার। করে ফেলুন। আমার জন্য আপনি বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত এই আত্মগ্লানি নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। তার থেকে সতীনের ঘর করা ভালো।’
আমির ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। পদ্মজা ভাবে, তাহলে সত্যি উনি মনে মনে আরেকটা বিয়ে করতে চান!’
তার কাছে পুরো পৃথিবী নিষ্ঠুর ও বিস্বাদ ঠেকে।
বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বাতাস হচ্ছে। যখন আমির মাছ নিয়ে ফিরেছিল তখনই রোদ সরে গিয়ে হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বর্ষাকালে যখন-তখন বৃষ্টি নেমে আসে ধরনীতে।
পদ্মজা ভাতের মাড় গলিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হতে নিলে আমির আবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। এবার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি সবসময় তোমাকেই চাই। তুমিই আমার উত্তরাধিকার। যেদিন তুমি থাকবে না সেদিন পৃথিবীতে আমার বলতে আর কিছুই থাকবে না।’পদ্মজার হৃদয় শীতল হয়ে উঠে। সে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে
আমিরকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। আমির বলল, ‘সন্তানই কি সব? ভালোবাসা কিছু নয়? সন্তানের সঙ্গে জীবন কাটানো আনন্দের কিন্তু সব নয়। আমার আনন্দ তো তোমার মধ্যেই আছে। যখন তুমি আমার জন্য রান্না করো সেখানে আনন্দ থাকে, আমার জন্য অপেক্ষা করো সেখানে আনন্দ থাকে, আমার ভালো-মন্দের যত্ন নাও তাতে আনন্দ থাকে, দুজন মিলে যখন একসঙ্গে চাঁদ দেখি সেখানে আনন্দ থাকে; যখন তুমি আমার বুকে ঘুমাও, আমার সঙ্গে যখন বৃষ্টিতে ভিজো, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে চাও, কাক ডাকা ভোরে ভেজা চুলে সামনে এসে দাঁড়াও, অভিমান করো সবকিছুতে আনন্দ থাকে আনন্দের কী শেষ আছে? কতশত আনন্দ আমার জীবনে। এতো এতো আনন্দ থাকতে সন্তানের আনন্দ এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন হবে? তুমি যদি নিজের জন্য সন্তান চাও তাহলে আমি সেটাকে
সমর্থন করব, তোমার কষ্ট দূর করতে পারব না কিন্তু সাময়িক আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করব কিন্তু আমি সন্তানের জন্য কষ্ট পাচ্ছি এসব ভেবে নিজেকে দায়ী করো না। এটা মোটেও সত্য নয়। আমি তোমাকে নিয়ে খুশি, সারাজীবন তোমাকেই লাগবে। আর কিছু চাই না। তোমার জন্যই আমি পূর্ণ। তুমি কেন শুধু আমাকে নিয়ে পূর্ণ নও পদদ্মবতী?’
আমিরের কথাগুলো এমনভাবে পদ্মজাকে প্রভাবিত করে যে তার সর্বশরীর সুখে কেঁপে উঠে। আমিরকে দুই হাতে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে যাওয়ার তীব্র স্পৃহা জাগে। এই হীরে ও হারাতে চায় না। কখনো হারিয়ে ফেললে বাঁচতে পারবে না, জীবন থমকে যাবে। আবেগপ্রবণ হয়ে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না। আর কখনো এসব বলব না। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।’
আমির পদ্মজার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, ‘বৃষ্টি কমলে মেলায় যাব। এখন চলো বৃষ্টিতে গোসল করি।’
পদ্মজা তটস্থ হবার আগেই আমির তাকে টেনে নিয়ে যায় উঠানে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। মুহূর্তে পদ্মজার পুরো শরীর ভিজে যায়। বৃষ্টির জলে তার দুটি ঘোলা চোখের সৌন্দর্য দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তার ফর্সা, মসৃণ ত্বক বেয়ে নামা জল আমিরের বুকে তাণ্ডব তুলে দেয়। পদ্মজার শরীরের প্রতিটি বাঁক নতুন করে আকৃষ্ট করে সাক। আমিরকে ওভাবে
তাকিয়ে থাকতে দেখে, পদাজা লজ্জা পায়, হাসে।
তার চোখ
দুটিও হেসে উঠে। আমির এগিয়ে গেলে পদ্মজা সতর্ক
করে, ‘ভুবন আছে।’
পাখিরা আকুল স্বরে সম্ভাষণ জানাচ্ছে সন্ধ্যাকে। নিঃশব্দ
ছায়াময়ী সেই সন্ধ্যাকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরছে পদ্মজা- আমির। তারা পড়ন্ত বিকেলে মেলায় গিয়েছিল। পূর্ণা ও প্রেমার জন্য নানারকম জিনিসপত্র কেনাকাটা করেছে পদ্মজা। নিজের জন্য কিছু মাটির জিনিস ছাড়া আর কিছুই নেয়নি। নাগরদোলা দেখার সময় তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। প্রেমা, পূর্ণাকে মেলায় নাগরদোলা চড়াতে নিয়ে গেলেও তাকে নিয়ে যেত না মোর্শেদ। পদ্মজা কান্নাকাটি করত না ঠিক, তবে খুব মন খারাপ হতো। তখন হেমলতা বোরকা পরে মেয়েকে নিয়ে দুই ঘন্টার পথ হেঁটে মেলায় যেতেন। মুরগির ডিম বিক্রি করে যে কয় টাকা পেতেন সেটুকু দিয়ে পদ্মজাকে এটা-ওটা কিনে দিতেন, নাগরদোলা চড়াতেন। তার জীবনটা শুধু মা নিয়েই ছিল।
যতক্ষণ মেলায় ছিল পুরোটা সময় আমিরের মনে
হচ্ছিল, কেউ একজন ওদের অনুসরণ করছে। সে
চট করে পিছনে তাকায় কিন্তু এতো এতো মানুষ
চারপাশে যে বুঝতে পারে না আসলে কে অনুসরণ
করছে। নাকি সবটাই মনের ভ্রম। আমির। ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেছে। কেউ খোঁজ পেয়ে যায়নি তো?
গায়করা সমস্বরে বাউল গান গাইছে। বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের জীবন ফুটে ওঠে বাউল গানে, থাকে সাম্য ও মানবতার বাণী। এ কারণে গানের আসরে নানা শ্রেণি- পেশার শত শত গানপ্রেমী মানুষের সমাগম ঘটেছে। মাইকের মাধ্যমে গানের শব্দমালা ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। বাড়িতে কথা বললেও জোরে জোরে বলতে হয় নয়তো শোনা যায় না। প্রতিদিন বিকেল থেকে শেষ রাত অবধি গানের আসর চলে। নামায আদায় করতে সমস্যা হয় পদ্মজার। সে কানে তুলা ঢুকিয়ে এশার নামায আদায় করে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ বগলের চিপায় পাটি নিয়ে আবির্ভাব ঘটে আমিরের। সে পদ্মজার হাত ধরে বলল, ‘ছাদে চলো। অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে।’
উচ্চস্বরে গান বাজছে বিধায় কথাটি মাঝপথেই মৃত্যুবরণ করল। রাত বাড়লেই গানবাজনা বেড়ে যায়। আসর সাতদিনব্যাপী চলবে; এর প্রচলন করেছিলেন এই এলাকার জমিদার শাহজাহান মুরাদ।
পদ্মজা জোরে বলল, ‘কী বললেন? শুনিনি।’ আমির ওর কানের কাছে এসে চিৎকার করে বলল, ‘ছাদে চলো। অনেক বড় চাঁদ উঠেছে।’
পদ্মজা গলার স্বর উচিয়ে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করুন।’
আমির অপেক্ষা করল না। পদ্মজাকে টেনে ছাদের দিকে নিয়ে গেল। চাঁদ নিজের লাবণ্য ছড়িয়ে দিয়েছে গগণে। ধরণী চকমক করছে। আমির একসময় চাঁদ পছন্দ করত না, পদ্মজা তার জীবনে এসে সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। চাঁদ উঠলেই পদ্মজা তাকে টেনে ছাদে নিয়ে গিয়ে একটা স্থায়ী অভ্যাস গড়ে তুলেছে। তাই চাঁদ উঠলেই আমির অভ্যাসবশত পদ্মজাকে নিয়ে ছাদে চলে আসে। চাঁদনি রাত সকল মলিনতা মুছে দিয়ে পদ্মজার মনে আনে প্রশান্তি।
#চলবে
সম্পূর্ণ গল্প