ইলমা_বেহেরোজ
টিভিতে লিখন শাহের সিনেমা চলছে। সে কপাল কুঁচকে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। বিড়বিড় করে, ‘শালা, আমার পিছুই ছাড়ে না। ঠাডা পড়ে মর।’
পথে সেদিন রাতের কোঁকড়াচুলোর সঙ্গে দেখা হয়। আমির ডেকে বলল, ‘তোর নাম কী?’
কোঁকড়াচুলো আগ্রহ নিয়ে আমিরকে দেখল। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলল, ‘আগুন।’
আমির শ্রাগ করে বলল, ‘বিরাট নাম! চল কোথাও বসি।’
এবার আগুন মেজাজ দেখাল, ‘আমি কেউয়ের হুকুম মানি না।’
‘হুকুম!’ আমির অবাক হবার ভান ধরল। ‘আমার কি সেই সাহস আছে?”
আগুন বিভ্রান্ত হচ্ছে। বুঝতে পারছে না এই লোককে কোন কাতারে ফেলবে, কেমন রহস্যময়!
কোনো এক অদ্ভুত কারণে লোকটাকে সে ভেতরে ভেতরে ভয় পায়, কেন ভয় পায় তা জানে না। না চাইতেও আমিরের সঙ্গে একটা টং দোকানে গিয়ে বসল। আমির তার কাজের খুব প্রশংসা করল। সেদিন ছুরি ধরার পদক্ষেপ একটু ভুল ছিল সেটা কীভাবে ধরতে হয় তা শিখিয়ে দিল। আগুন হতভম্ব হয়ে শুধু দেখে আর শুনে। কার পাল্লাতে পড়ল?
পদ্মজা রুমে আয়নায় নিজের পেট দেখে ভাবছে, সত্যি কেউ আছে এখানে? কোনো মীরাক্কেল কী ঘটবে?
ও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। তিনি চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। পদ্মজার ভাবতে ভালো লাগছে, তার ঘর আলো করে কেউ আসবে। যদিও সে নিশ্চিত না, শুধুমাত্র ধারণা। এই ধারণাতেও যে সুখ। ও জীবনে আরেকবার মাতৃত্বের পারিজা তো মা স্বাদ পেতে চায়। শুনতে চায় মা ডাক। পারি ডাকার আগেই পাড়ি জমিয়েছিল। ‘মা’ শব্দটি এক অক্ষরের হলেও এর তাৎপর্য অতুলনীয়। কেউ মা ডাকছে – ভেবেই পদ্মজা শিহরিত হয়। সুখে ভেসে যায়।
বাইরে কাঠ কাটার খটখট শব্দ হচ্ছে। পদ্মজা শাড়ি ঠিক করে নিচ তলায় নামে। ভুবন কাঠ কাটছে।
সে প্রতিবন্ধী। রকেল বলে। কথাবার্তা একেবারে
কম বলে, বুঝে কম। শুধু হাসে। সরল সোজা হলেও
কর্মঠ। পদ্মজা ভুবনকে খুব আদর করে। সবচেয়ে বড়
মাছ, মাংসের টুকরোটা খেতে দেয়। ভুবনও পদ্মজার মায়ায় পড়ে গেছে। বুবু বলে যখন ডাকে পদ্মজা অনুভব করতে পারে কতটা ভালোবাসা নিয়ে বুবু ডাকছে ভুবন। সুরুজের থেকে শুনেছে, ভুবন আগে অনেকটা সুস্থ ছিল। যখন ওর এগারো বছর তখন ওর সামনে ওর বড় বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় – মানসিক আঘাত পেয়ে সেদিন থেকে চুপচাপ হয়ে গেছে ছেলেটা। এরপর থেকে সহজে ভুলে যায়, কোনো পরিস্থিতি দ্রুত ধরতে পারে না। অত্যাতঙ্ক আক্রমণ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত সে। ডিসওর্ডারেও ভুগে। হঠাত্ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে যায় এবং ভয় পেতে থাকে। মাঝেমধ্যে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে।
পদ্মজা সিঁড়িতে বসে বলল, ‘এতো কাঠ কেটে কী হবে?’
ভুবন ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘তুমি লানবা।’
‘তুই এতো কাঠ কেটেছিস যে আগামী এক সপ্তাহ রান্না করা যাবে। এরপরও কেটেই যাচ্ছিস। ক্লান্ত লাগে না?’
ভুবন মাথা ঝাঁকায়। ওর ক্লান্ত লাগে না। হঠাৎ মনে
পড়ায় পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘তুই না বলছিলি, পাশের বাড়ির মহিলা আমাকে দেখতে আসবো আসেনি তো।’
ভুবন আবারও মন ভুলানো হাসি হাসল। বলল, ‘কাম কইলাই কূল পায় না।’
ভুবন হাসতে হাসতে কাঠ কাটছে। পদ্মজা বলল, ‘গেইটটা লাগিয়ে দে। কেউ ঢুকে পড়বে।’
‘আমি থাকতে তোমালে কেউ কিচ্ছু কলব না।’
‘ওরে আমার বীর পুরুষরে। ক্ষুধা লাগছে? কিছু খাবি?’
‘না, তয় গলাভা শুকায়া গেছে। পানি খামু।’
পদ্মজা সরু সিঁড়ি মাড়িয়ে পানি আনতে যায়। ভুবন সিঁড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার কথপোকথন থেকে সে শুনেছে, কেউ পদ্মজাকে খুন করতে চায় তাই তারা এখানে এসেছে। ভুবন সবসময় চারিদিক খেয়াল রাখে। সে সতর্ক। কিছুতেই পদ্মজা… ওর বুবুর কিছু হতে দিবে না। পদ্মজা পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে আসে। গ্লাস ভরে পানি দিয়ে আবার সিঁড়িতে বসে। একটা জোঁক ঝোপঝাড় থেকে এসে ওর পায়ের উপর উঠে। পদ্মজা প্রথমে আঁতকে উঠলেও পরে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামে কত জোঁকে ধরেছে! ভুবন কুড়াল রেখে পদ্মজার পা থেকে জোঁক ছাড়িয়ে দিয়ে দুই হাতের দুই আঙুলে টেনে ধরে জোঁকটিকে।
পদ্মজার গা রি রি করে উঠে। সে একটু দূরে সরে যায়।
ভুবন হাসছে। জোঁকটিকে নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। পদ্মজা ধমকায়, ‘ফেল ওটা।’
ভুবনের হাসি বিস্তৃত লাভ করে। তার দাঁতগুলো বড় এবং উঁচু।
সে জোঁকটিকে মাটিতে রাখল। পদ্মজা দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে লবণ নিয়ে আসে।
দুজন খুব আগ্রহ নিয়ে জোঁকটির মৃত্যুবরণ দেখে।
চলবে,,,,,
সম্পূর্ণ গল্প