(সতর্কতা – নিজ দায়িত্বে পর্বটি পড়বেন। এই পর্বে নৃশংস খুনের বর্ণনা রয়েছে।)
আমি পদ্মজা পর্ব ৯০
_________
চাঁদটা ঠিক মাথার উপরে। চারিদিকে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। জোনাকি পোকা ও রাতের প্যাঁচা কারোর মুখে রা নেই। এমনকি বাতাসের নিজস্ব শব্দও থমকে গিয়েছে। শুধু শোনা যাচ্ছে তাণ্ডবলীলার আহবান। গাছের ডালপালার আড়াল থেকে নিশাচর পাখিরা চেয়ে আছে। তারা তেজস্বী পদ্মজার আগমন দেখছে। পদ্মজার একেকটা কদম নিশাচর পাখিদের মনে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানছে। তার সাদা শাড়ি থেকে বিচ্ছুরিত সাদা রঙ নিশাচরদের চোখ ঝলসে দিচ্ছে। পদ্মজার এক হাতে রাম দা অন্যহাতে দঁড়ি। দঁড়ি দিয়ে বাঁধা তিনটে নেড়ি কুকুর! আচমকা কুকুরগুলো চিৎকার করে উঠলো। নিশাচর পাখিরা ভয় পেয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে গেল। গাছের ডালপালা নড়ে উঠাতে পদ্মজাসহ তিনটে কুকুর আড়চোখে উপরে তাকালো। চার জোড়া হিংস্র চোখ
জ্বলজ্বল করছে! কুকুরগুলোর চোখের চেয়ে মানবসন্তান পদ্মজার চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর! যেন চোখ নয় আগ্নেয়গিরি! এক্ষুনি আগুন ছড়িয়ে দিয়ে চারপাশ ভস্ম করে দিবে! পদ্মজা পায়ে হেঁটে ঘাস পেরিয়ে একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের জল কুচকুচে কালো। পুকুরের চেয়ে কিছুটা দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় রেইনট্রি গাছ । গাছগুলোর শত বছর বয়স। রেইনট্রি গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় ঘুমাচ্ছে মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি।
পদ্মজা পাশ থেকে ছোট চৌকিখাট টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসলো। তার শরীরের রক্ত বুদবুদ করে ফুটছে! ঘুমন্ত অমানুষগুলোকে দেখে তার ঠোঁটে তিরস্কারের মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। যখন চোখ খুলে আমির ও তার দলবল আবিষ্কার করবে, তারা বন্দী! আর সামনে তিনটে কুকুরের সাথে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা! তখন তাদের কেমন অনুভূতি হবে?
__________
সাত ঘন্টা পূর্বে, তখন শেষপ্রহরের বিকেল। পদ্মজা লতিফাকে পানি আনতে পাঠিয়েছে। সে রান্নাঘরে রান্না করছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখতে পেল। আমির আলগ ঘরে প্রবেশ করেছে মাত্র। লতিফা কলসি রেখে আমিরের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু দুই কদম হেঁটে এসে সে থমকে দাঁড়ায়। দ্রুত উল্টো ঘুরে কলপাড়ে চলে আসে। কলপাড়ে খালি কলসিটা স্থির হয়ে আছে। লতিফা কলসির উপর চোখ নিবদ্ধ রেখে কপাল কুঁচকায়। নূরজাহানের ঘর থেকে তিনদিন আগেই ঘুমের ঔষধ সংগ্রহ করে রেখেছিল পদ্মজা। আজ রাতের খাবার পরিবেশন করার পূর্বে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়া হবে। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন পদ্মজা আক্রমণ করবে! এই পরিকল্পনাই লতিফাকে জানানো হয়েছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখে দূর্বল হয়ে পড়ে। তার বলে দিতে ইচ্ছে হয়,আমির যেন রাতের খাবার না খায়! কিন্তু যখন মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো সে থেমে গেল।
আজ লতিফার একখানা বড় কাজ আছে। রিনুকে নিয়ে তার পালাতে হবে! এই বাড়িতে কিশোরী রিনু এসেছে গতবছর। তার আগেও অন্দরমহলে রিনু নামে একজন কাজের মহিলা ছিল। তিনি ডায়রিয়ায় গত হয়েছেন দুই বছর আগে। এতিম লতিফা প্রথম যখন এই বাড়িতে এসেছিল,মজিদ ও খলিলের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। তারপর লতিফা ফরিনাকে সব জানায়। ফরিনা প্রতিবাদ করায় আমির সব শুনলো। আমির তার বাপ-চাচাকে নিষেধ করে লতিফাকে নির্যাতন করতে। সে চায়,তার মায়ের সেবা করা মানুষগুলো নিরাপদ থাকুক।
এরপর প্রায় দুই-তিনবছর নিরাপদে কেটে গেলেও পনেরো বছর বয়সে রিদওয়ানের মাধ্যমে লতিফা ধর্ষিতা হয়। ধর্ষণের পর লতিফা পালানোর জন্য ছটফট করেছে। দরজা বন্ধ করে দিনের পর দিন লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারপর বেশ কয়েকবার মজিদ ও খলিলের থাবার শিকার হতে হয়েছে। দিনগুলো বিষাক্ত ছিল। পালানোর মতো জায়গা ছিল না। তাই একসময় লতিফা ভাগ্যকে মেনে নিল। সহ্য করে নিল সবকিছু। অন্দরমহলের পাশাপাশি পাতালঘরের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে উঠলো। তবে গত চার বছর ধরে সে মজিদ,খলিল আর রিদওয়ানের থাবা থেকে মুক্ত। এর পিছনেও কাহিনি রয়েছে। ফরিনার প্রতি লতিফার ভালোবাসা এবং সম্মান দেখে আমির লতিফার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তার হুমকিতে থেমে যায় লতিফার কালরাত্রিগুলো।
লতিফা বিশ্বস্ততার সাথে আমিরের গোপন আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলে। পদ্মজা, রূম্পা ও হেমলতাকে চোখে চোখে রাখা ছিল লতিফার দায়িত্ব। গত বছর কিশোরী রিনু নতুন এসেছে অন্দরমহলে। সে এ বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানে না। মজিদ হাওলাদার উদারতা দেখিয়ে এতিম রিনুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। যেহেতু রিনুকে উদারতার জন্য আনা তাই রিনুকে দেখেশুনে রাখা হয়। বিয়ের জন্য পাত্রও খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু লতিফা দেখেছে,রিদওয়ানের কু-দৃষ্টি রিনুর উপরে আছে। রিনুর সাথে একই বিছানায় থাকতে থাকতে লতিফা রিনুকে আপন ছোট বোন ভাবা শুরু করেছে। সে রিনুকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। রিনুকে অভিশপ্ত নিখুঁত যন্ত্রণাময় কালরাত্রিগুলো থেকে বাঁচাতে লতিফা দ্রুত পালাতে চায়। তাই আমিরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা সত্ত্বেও গোপন পরিকল্পনার কথা বলতে পারলো না। দমে গেল! সে কলসি রেখে দ্রুতপায়ে অন্দরমহলে চলে যায়।
রান্নাঘরে পা রাখতেই পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সে পাথরের মতো স্থির! লতিফার হাত খালি দেখে যান্ত্রিক স্বরে বললো,’ পানি কোথায়?’
লতিফা নিজের হাতে নিজের কপাল চাপড়ালো। সে কলসি রেখে চলে এসেছে। লতিফা টান টান করে হেসে বললো,’ এহনি আনতাছি। খাড়াও। ‘
লতিফা কলসি আনতে চলে গেল। পদ্মজা এক এক করে পাতিলে মশলা ঢাললো। মুরগি কষানো হবে। পুলিশ ভোরে পূর্ণার লাশ ফেরত দিয়েছে। বাসন্তী নাকি রাতে স্বপ্ন দেখেছেন,পূর্ণা লাহাড়ি ঘরের পাশে কবর খুঁড়ছে। তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন,পূর্ণার কবর যেন লাহাড়ি ঘরের পাশে গোলাপ গাছটির নিচে হয়। বাসন্তীর কথা রাখা হয়৷ পূর্ণা তার প্রিয় গোলাপ গাছটির নিচে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা আজও কাঁদলো না। সে চুপচাপ কোরান শরীফ পড়েছে। তারপর পূর্ণাকে কবর দেয়া হলে অন্দরমহলে ফিরে এসেছে। এ নিয়ে সমাজে নানান কথা হচ্ছে৷ পদ্মজার ব্যবহারে অবাক হয়েছে প্রেমা,বাসন্তী ও প্রান্ত। মৃদুলের অবস্থা নাজেহাল। তাকে হাজার টেনেও পূর্ণার কবর থেকে সরানো যাচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। মৃদুলের মা জুলেখা বানু ছেলের পাগলামি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মোড়ল বাড়ির অবস্থা করুণ! পদ্মজা ভাবনা ছেড়ে কাজে মন দিল। লতিফা কলসি নিয়ে দৌড়ে আসে। তারপর মেঝেতে কলসি রেখে বললো,’ লও পানি।’
পদ্মজা পূর্বের স্বরেই বললো,’ যা যা আনতে বলেছিলাম,আনা হয়েছে?’
‘হ,আনছি।’
‘রিনু ব্যাগ গুছিয়েছে?’
‘হ,গুছাইছে।’
‘রিনুকে ডাকো।’
লতিফা রান্নাঘর থেকে গলা উঁচু করে ডাকলো,’ রিনুরে…ওই রিনু।’
রিনু আশেপাশেই ছিল। লতিফার ডাক শুনে দ্রুত হেঁটে আসে। সে গতকাল থেকে আতঙ্কে আছে। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেনি। রিনুর সামনের দাঁতগুলো উঁচু। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কিন্তু মনটা সাদা। সরল-সহজ একটা মেয়ে। রিনু এসে বললো,’ হ, আপা?’
পদ্মজা বললো,’ রাতে বের হয়ে যাবি লুতু বুবুর সাথে। পথে একদম ভয় পাবি না। আমি লুতু বুবুকে কিছু টাকা দিয়েছি আর একটা ঠিকানা দিয়েছি। আল্লাহ সহায় আছেন। বিসমিল্লাহ বলে বের হবি। পথে আল্লাহকে স্মরণ করবি বেশি বেশি। ইনশাআল্লাহ কোনো ক্ষতি হবে না।’
রিনু বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। লতিফা পদ্মজাকে বললো,’ তোমারে ওরা কিচ্ছু যদি করে?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। লতিফা উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বললো,’ আমার ঘর থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে পুকুরপাড়ের আশেপাশে কোথাও রেখে আসো। এখন আরেকটু পেঁয়াজ, রসুন বাটো।’
‘রাইখা আইছি। সব কাম শেষ। গোয়ালঘরের পিছনে তিনডা কুত্তা বান্ধা আছে। চিল্লাইছে অনেকক্ষণ, খাওন দিছি এরপরে থামছে। আর ওইযে আলমারিডার পিছনে একটা বৈয়াম আছে। ওইডার ভিতরে রিনু বিষ পিঁপড়া ভরছে। এইডাও একটু পরে রাইখা আমুনে।’
‘মরে যাবে না?’
‘না। বৈয়ামের মুখ কাপড় দিয়া বাইন্ধা রাখছি। ভিত্রে(ভিতরে)মাডিও আছে।’ বললো রিনু।
পদ্মজা,লতিফা ও রিনু তিনজনে মিলে রান্নাবান্না শেষ করলো। আমিনা সদর ঘরে আলোকে নিয়ে খেলছেন। তার জীবন আলোতে সীমাবদ্ধ। আর কিছুতে পরোয়া করেন না। আগে ঘরের ব্যাপারে হলেও কথা বলতেন। এখন তাও করেন না। সারাদিন আলোর সাথে কথা বলেন। মনের ব্যথা আলোকে শোনান। আলো কিছু বুঝে না। শুধু হাসে। আলোর হাসিটাই আমিনার সঙ্গী। রিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মাঝে দৌড়ে ফিরে আসে। পদ্মজাকে জানায়,’ রিদওয়ান ভাইজানে আইতাছে। লগে একটা ছেড়ি।’
পদ্মজার হাত থেমে যায়! তাহলে সেই নারী? যে পূর্ণাকে হত্যা করতে সাহায্য করেছে! রিনু এক হাত দিয়ে অন্য হাত চুলকাতে থাকলো। সে রিদওয়ানকে আগে ভয় পেত,এখন নাম শুনলেই কাঁপে। লতিফা রিনুর অস্বস্তি,ভয় খেয়াল করে বললো,’ রিনু ঘরে যা। দরজাডা লাগায়া দিবি।’
লতিফার বলতে দেরি হয়,রিনুর ঘরে চলে যেতে দেরি হয় না।
রিদওয়ান সদর ঘরে প্রবেশ করে আসমানিকে বললো,’ আমার লগে থাকবা না অন্য ঘর লইবা?’
রিদওয়ানকে দেখেই আমিনা আলোকে নিয়ে ঘরে চলে যান। আসমানি নিকাব তুলে চোখ বড় বড় করে বললো,’ বাড়ির ভিত্রে(ভিতরে) তোমার লগে থাকুম? আইছি যে এইডাই বেশি। এমনিতে ডর লাগতাছে আমার।’
‘তখন রানি,কাকি এরা ছিল। এখন তো নাই। যারা আছে এরা থাকা আর না থাকা সমান।’
আসমানি চারপাশ দেখে বললো,’ পদ্মজা কই?’
আসমানির চোখমুখ দেখে দাত কেলিয়ে হাসলো রিদওয়ান। বললো,’ বাবুর বউ পাগল হইছে। মাথা ঠিক নাই। ভয় পেও না।’
আসমানি চারপাশ দেখতে দেখতে বললো,’ মাথা ঠিক নাই দেইখাই তো ডর বেশি।’
রিদওয়ান আসমানির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। বললো,’ আজিদ ফিরবে কোনদিন?’
‘মা রে লইয়া শহরে গেছে। আইতে চাইর-পাঁচদিন তো লাগবই।’
‘তাহলে কয়দিন আমার সাথে থাকো।’
আসমানি রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। আসমানি বললো,’পদ্মজা যদি জিগায়,আমি কার কী লাগি?’
‘তোমাকে চিনে না? বাড়ির কাছে থাকো,আজিদের বউ হিসেবে দেখেনি কখনো?’
‘না।’
‘তাইলে কিছু বলার দরকার নাই। প্রশ্ন করলে উত্তর দিও না।’
‘সন্দেহ করলে?’
‘সন্দেহ করলেই কী? না করলেই কী? পদ্মজার দাম আছে আর?’
‘আইচ্ছা ছাড়ো,আমি পদ্মজারে দেইখা আইতাছি।’
আসমানি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সে চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে। এই বাড়িতে আসার অনেক ইচ্ছে ছিল তার। কখনো আসতে পারেনি। এই প্রথম আসতে পেরেছে। অন্যবার সোজা পাতালঘরে যেত। লুকোচুরি লুকোচুরি খেলাটা কমেছে বলে ভালো লাগছে। এখন হয়তো প্রতিনিয়ত অন্দরমহলে আসা হবে! লুকিয়ে ভাঙা ফটক দিয়ে পাতালঘরে যেতে হবে না।
আমির ধানের বস্তায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। ঘরের অর্ধেক অংশ জুড়ে ধানের বস্তা রাখা হয়েছে। বস্তাগুলো বাঁশের মাচার উপর। মাটি স্যাঁতসেঁতে। এই ঘরটায় খুব দরকার ছাড়া কেউ আসে না। আবছা অন্ধকারে আমিরের মুখটা অস্পষ্ট। তার হাতে পদ্মজার বেনারসি। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। আর মাত্র কয়টা ঘণ্টা! ইশ,যদি থেকে যাওয়া যেত! আফসোসে বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো পথ নেই। সব পথ বন্ধ। হয় আগুনে ঝলসে যেতে থাকো নয় মৃত্যু গ্রহণ করো। কী নিষ্ঠুর শর্ত! আমির পদ্মজার বেনারসির দিকে তাকালো। ধূলোর আস্তরণে বন্দী হয়ে গেছে সব স্বপ্ন-আশা! চোখে ছবির মতোন দৃশ্যমান হয়,পদ্মজার লাজুক মুখখানা। তার দুধে আলতা ছিমছিমে গড়নে খয়েরী রঙটা কী ভীষণ মানাতো! বর্ষাকালের শুক্রবার মানেই ছিল, বৃষ্টিতে ভেজা। আমির ঘন্টার পর ঘন্টা পদ্মজাকে একধ্যানে দেখেছে। মুখস্থ করে নিয়েছে তার প্রতিটি পশমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। আমির কল্পনা থেকে বেরিয়ে বেনারসিতে চুমু দিল। সীমাহীন যন্ত্রণা থেকে বললো,’যখন তোমার কথা ভাবি, তখন আমার শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা বাজতে থাকে। আমাদের পথটা কি আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না?’
আমির উত্তরের আশায় বেনারসির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ঠোঁট দুটো বাচ্চাদের মতো ভেঙে আসে। একটু কথা বলুক না…বেনারসিটি একটু কথা বলুক! আমির ভেজা গলায় আবার বললো,’তোমার জন্য বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। তোমায় ছোঁয়ার সাধ্যি,দেখার সাধ্যি কেন নেই আমার?’
বেনারসি নিশ্চুপ! সে বোবা,প্রাণহীন। আমির চোখ বুজে বস্তায় হেলান দিল। গত কয়দিনে পদ্মজার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ কানে বাজছে। যখন পদ্মজার বলা, ‘ একবার…একবার নিজের মা-বোনকে মেয়েগুলোর জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভাবুন। একবার আমাকে মেয়েগুলোর জায়গায় ভেবে দেখুন।’ কথাগুলো কানে বাজলো তখন চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পদ্মজার নগ্ন শরীর। তার সারা শরীরে ছোপ ছোপ দাগ। একটা ছায়া পদ্মজার শরীরে চাবুক মারছে। পদ্মজা আর্তনাদ করার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। শুধু গলা কাটা গরুর মতো কাতরাচ্ছে।
আমির ছায়াটির গলা চেপে ধরার জন্য হাত বাড়ায়৷ কিন্তু একি! ছায়াটিকে ছোঁয়া যাচ্ছে না! আমির দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। তার মুখ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণ হয়,পদ্মজা! আমির চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর আগুন লেগে গেছে৷ ভেতরটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। শরীর দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শরীরের শিরা-উপশিরায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। এই যন্ত্রণা আমির নিতে পারে না। সেই দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরলো। বিগত দিনগুলো তাকে নরকীয় শাস্তি দিয়েই চলেছে। চোখগুলো আজেবাজে দেখছে৷ মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন আজেবাজে ভাবছে। পদ্মজা,পদ্মজা,পদ্মজা…এই পদ্মজাতে কী শক্তি লুকিয়ে আছে? এই একটিমাত্র নাম তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিষাক্ত করে তুলেছে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস। আমির টিনের দেয়ালে এক হাত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
মজিদ ক্লান্ত হয়ে আলগ ঘরে বসলেন। এখানে প্রচুর আলো-বাতাস আসে। লতিফা মজিদকে আসতে দেখে,দ্রুত শরবত আর পান-সুপারি নিয়ে আসে। মজিদের সামনে এসে বসে রিদওয়ান ও খলিল। মজিদ শরবত পান করে লতিফাকে প্রশ্ন করলেন,’পদ্মজা কথাবার্তা বলছে?’
লতিফা নতজানু অবস্থায় উত্তর দিল,’হ,কইছে।’
রিদওয়ান লতিফাকে বললো,’যে মেয়েটা আসছে দেখে রাখবি। যত্ন নিবি।’
লতিফা বাধ্যের মতো বললো,’আইচ্ছা,ভাইজান।’
খলিল বললেন,’ আসিদপুর থাইকা যে বড় পাটিডা আনছিলাম, পুশকুনিপাড়ে ওইডা বিছাবি।’
‘বিছাইছি খালু। এশারের আযানডার পরে সব খাওনদাওন দিয়া আমু।’
‘ভালা করছস।’ খলিল পান মুখ পুরে বললেন।
লতিফা শরবতের খালি গ্লাস নিয়ে চলে গেল। মজিদ আরো দুই গ্লাস পানি পান করলেন। তিনি ভীষণ ক্লান্ত। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলেন। রিদওয়ানের ভুল আপাতত মগার উপর ঘুরে গিয়েছে। মগা গতকাল থেকে বাড়িতে নেই। আবার শেষবার মগার সাথে পূর্ণা ছিল। সবার জবানবন্দির ভিত্তিতে আপাতদৃষ্টিতে মগা খুনি! পুলিশ হাওলাদার বাড়ির দারোয়ানকে খুঁজেছে। মোড়ল বাড়িতে পুলিশ এসেছে শুনেই রিদওয়ান দারোয়ান মুত্তালিবকে হত্যা করেছিল। তাই পুলিশ মুত্তালিবকে পেল না। মজিদ হাওলাদার পুলিশকে বলেছেন,তিনি ধারণা করছেন দারোয়ান ও মগা পরিকল্পনা করে পূর্ণালে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। পুলিশ এখন দারোয়ান মুত্তালিব ও মগাকে খুঁজছে।
রিদওয়ান নিরাপদে আছে। খলিল মজিদকে বললেন,’ ভাইজান, কিছু ভাবছেন?’
‘কী নিয়ে?’ মজিদের নির্বিকার স্বর।
রিদওয়ানের ভ্রুকুটি হয়ে গেল। সে চারপাশ দেখে বললো,’ আপনি এতো নির্বিকার কেন চাচা? আজ আমিরকে খুন করার কথা ছিল।’
মজিদ এক হাত তুলে রিদওয়ানকে চুপ করতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন,’বাবু যদি আমাদের কথা না শুনে তখন ব্যবস্থা নেব। তার আগে না।’
রিদওয়ানের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে নাছোড়বান্দা স্বরে বললো,’ আমির কখনোই পদ্মজাকে খুন করবে না,শেকল বন্দীও করবে না!’
মজিদ গম্ভীর স্বরে বললেন,’দেখা যাবে।’
রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকালো। তারপর অধৈর্য্য হয়ে মজিদকে বললো,’ আমিরের জন্য আমাদের ক্ষতি না হয়ে যায়!’
মজিদ খলিলকে বললেন,’ দেখ তো আশেপাশে কেউ আছে নাকি। ঘরগুলোও দেখবি।’
আমির মাত্র বের হতে যাচ্ছিল। মজিদের শেষ কথাটা কানে আসতেই সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। খলিল আলগ ঘরের প্রথম দুটো ঘর দেখে এসে বললেন,’কেউ নাই।’
তারপর চেয়ারে বসলেন। রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মজিদকে বুঝাতে। খলিল মজিদের আরেকটু কাছে এসে বসলেন। তারপর বললেন,’রিদু কিন্তু হাচা কইতাছে ভাইজান। বাবুরে দিয়া আর ভরসা নাই।’
মজিদ রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস? বাবু আমাদের খুন করে পদ্মজাকে নিয়ে সংসার করতে চাইবে?’
রিদওয়ান তড়িৎ গতিতে বললো,’এটা কি সম্ভব না কাকা? আলমগীর ভাই কী করলো?’
মজিদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে খলিলকে বললেন,’ খলিল,তোর ছেলের বুদ্ধি এখনো হাঁটুতে আছে।’
রিদওয়ান উঠে দাঁড়ায়। তার মাথা চড়ে যাচ্ছে। মজিদ বললেন,’তুই আমার পাশে বস। তোর মাথায় কিছু কথা ঢোকাতে হবে।’
রিদওয়ান মনের বিরুদ্ধে আবার বসলো। মজিদ বললেন,’চুপ করে আমার কথা শোন। আলমগীর আর বাবুর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পাতালঘরের রীতি পূর্বপুরুষ থেকে পেলেও, নারীপাচার চক্রটার সৃষ্টি বাবুর। এই চক্রে আলমগীর, তুই, আমি আর খলিল বাবুর দলের একটা অংশমাত্র। আমরা সরে গেলে আমাদের উপর রাগ একমাত্র বাবুই ঝাড়তে পারবে। কিন্তু এই চক্রের শুরুটা যে করেছে সে হচ্ছে নেতা। গত সপ্তাহে বাবু ঢাকা থেকে একটা খাম নিয়ে আসছে। খামের চিঠিতে স্পষ্ট লেখা আছে,ছয় মাস পর বাবু নিজ দায়িত্বে ষোলটা মেয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠাবে। সার্নার জনের সাথে তিন মাস আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ বাবু। বাবুর সাক্ষর আছে চিঠিতে। বাবু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
রিদওয়ান বললো,’পড়ছি আমি। কিন্তু টাকা কী করছে? আমাদের তো দেয়নি।’
মজিদ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালেন। তিনি কথার মাঝে কথা বলা একদম পছন্দ করেন না। বললেন ‘হয়তো কাজশেষে দিত। আমার পুরো কথা শোন। কথার মাঝে কথা বলবি না।’
রিদওয়ান মাথা নাড়াল। মজিদ বললেন,’এখন বাবু যদি প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করে এর পরিণতি কেমন হবে ধারণা আছে? বিদেশের কত মানুষের সাথে ও কাজ করছে হিসাব আছে? সবার বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রমাণ হলেও বাবুর কাছে আছে। আর এই দেশে কি একমাত্র বাবু মেয়ে পাচার করে? আরো আছে। কম হলেও আট-নয় জন দলনেতার সাথে বাবুর ভালো পরিচয় আছে। যেখানে এই দেশ পরিচালনা করা একজন নেতা এই চক্রের সাথে জড়িত আর বাবুর তার সাথে যোগসূত্র আছে, সেখানে বাবু পালিয়েছে যদি জানতে পারেন তিনি বাবুকে ছেড়ে দিবেন না। সব রকম ব্যবস্থা নিবেন। সম্মানহানির ভয় পাবেন,সব প্রকাশ হওয়ার ভয় পাবেন। বাবুর সাথে পদ্মজার ক্ষতি করবেন। পদ্মজা সুন্দর। বাবুর সামনে পদ্মজার বেইজ্জতি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ আছে। আরো কত ক্ষমতাশীল লোক বাবুর সাথে এই কাজে জড়িত আছে। যতদিন বাবু এই কাজে নিজেকে রাখবে ততদিন ভালো থাকবে। ছাড়তে চাইলেই সর্বনাশ। বাবুর বুদ্ধি তোর মতো না রিদু। ও আর যাই করুক পালিয়ে যাওয়ার মতো বোকামি করবে না। এতোটা বোকা বাবু না। যদি সত্যি বাবু পদ্মজাকে ভালোবেসে থাকে ও ভুলেও পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না। এই চক্রের সাথে জড়িত সবাই একজোট! বাবু পালানোর চেষ্টা করলে ও একা হয়ে যাবে। সবাই ঠিক ধরে ফেলবে বাবুকে। আর বাবু ধরা পড়লে পদ্মজাও ধরা পড়বে। পদ্মজা একবার ধরা পড়লে চোখের পলকে ভোগের বস্তু হয়ে যাবে।’
‘পালিয়ে কোথাও না গিয়ে পুলিশকে সব খুলে বললেই তো ও নিরাপত্তা পেয়ে যাবে! আর ফেঁসে যাবো আমরা আর অন্যরা!’
মজিদ বোকা রিদওয়ানের পিঠ চাপড়ে বললেন,’ পুলিশ কয়জনকে ধরবে? আমির নিজেও পুলিশের হাতে ধরা পড়বে। ফাঁসিও হবে। নিজের মৃত্যু নিজে টেনে আনবে। তো কী হলো? কিছু কিছু কাজ আছে,যেগুলোতে একবার প্রবেশ করে ঘাঁটি সৃষ্টি করে ফেললে আর সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। বাবু তেমনই চিপায় আছে। যদি পালাতে চায় নিজের সাথে পদ্মজার ইজ্জত আর জীবন হারাবে। এই ঝুঁকি নেয়ার সাহস বাবুর হবে না। আমি নিজের চোখে ঢাকায় দেখেছি, পদ্মজা অসুস্থ হয়ে ঘরে ঘুমাচ্ছে আর আমির বাড়ির সব কাজ করছে। পদ্মজার জন্য হলেও বাবু পাতালঘর আর আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখবে ।’
‘দেশে কি জায়গার অভাব আছে? কোথাও না কোথাও ঠিক লুকিয়ে থাকতে পারবে।’
‘ওর কাজ করতে হবে না? ঘরে বসে খাবে? তুই নিজ চোখে দেখেছিস, আমির কীভাবে মাত্র দশ দিনে আলীকে রাজশাহী থেকে ধরেছে। আলীর পালিয়ে যাওয়া আমিরের জন্য হুমকি ছিল। তাই চিরুনি অভিযান চালিয়ে ঠিক খুঁজে বের করছে। আমিরের অভিজ্ঞতা আছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে এতো বড় ঝুঁকি নিবে না। আমির চিনে তার পেশার রক্ত কেমন! এতদিন অন্য মেয়েদের পিটিয়েছে। তখন নিজের বউকে পিটাতে দেখবে।’
মজিদ থামলেন,দাঁত বের করে হাসলেন। এতো কথাতেও রিদওয়ানের মনে শান্তি এলো না। সে দুইহাত তুলে বললো,’ আচ্ছা ধরলাম,আমির পালাবে না। কিন্তু পদ্মজাকে বেইজ্জতি করার জন্য আমাদের খুন করবে না তার নিশ্চয়তা আছে?’
মজিদ হাওলাদার এবার রেগে গেলেন। বললেন,’বাবুর যখন এই কাজের সাথে থাকতেই হবে তখন আমাদের খুন করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে না। খলিল তোর ছেলেরে নিয়ে যা। তারপর গোয়ালঘর থেকে কতোটা গোবর খাইয়ে দে।’
অপমানে রিদওয়ানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকলো। আমিরের জায়গাটা সে কিছুতেই দখল করতে পারছে না!ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। রিদওয়ান চেয়ারে লাথি দিয়ে, চলে গেল। খলিল বললেন,’ ভাইজান,আসমানিরে আনা কি ঠিক কাম হইলো?’
‘একদম না। রিদওয়ান আবার আরেকটা ভুল করলো। বাড়িতে কেউ নাই বলে,ঝুঁকি নিয়ে যা ইচ্ছে করছে। আবার বিপদে পড়লে আমার পা যেন না চাটে বলে দিস।’
খলিল মুখ থেকে পানের পিচকিরি ফেলে বাইরে চোখ নিবদ্ধ করলেন।
ক্রোধে-আক্রোশে আমিরের কপালের রগ ভেসে উঠে। চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। সে রাগে এক হাতে দরজা চেপে ধরলো। তার দূর্বলতা ধরতে পেরে মজিদের আনন্দ হচ্ছে! মজিদের হাসি দেখে আমিরের গা জ্বলে যাচ্ছে। সে একবার ভাবলো এক্ষুনি গিয়ে মজিদের গলা চেপে ধরবে। কিন্তু পরক্ষণে কী ভেবে থেমে গেল। চলে এলো ধান রাখার ঘরে। ধানের মাচার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো,চাপাতি আর রাম দা ঠিকঠাক আছে নাকি। হ্যাঁ,ঠিকঠাক আছে! আমির স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই বিকেলের রঙহীন ধূসর কুয়াশা চোখে পড়ে।
পদ্মজা পালঙ্কের উপর গাঁট হয়ে বসে আছে। এশারের নামায আদায় করে মাত্রই উঠেছে। তার পরনে সাদা শাড়ি৷ লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পদ্মজাকে জানালো,সে পুকুরপাড়ে খাবার রেখে এসেছে। বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারপাশ। মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি এখুনি যাবে৷ পদ্মজা নিস্তেজ গলায় বললো,’ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে ডেকো।’
তার শান্ত স্বর ! কথা শুনে মনে হচ্ছে,পদ্মজা লতিফাকে ঘর ঝাড়ুর জন্য অথবা রান্না করার জন্য ডাকতে বলেছে! লতিফা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। মনে হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। এ তো সত্যিই যুদ্ধ! লতিফার ঘাম হচ্ছে।চাপা একটা আনন্দও কাজ করছে! কী অদ্ভুত!
রান্নাঘরে আসমানি গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পদ্মজাকে কথা বলাতে পারেনি৷ পদ্মজা একটাও জবাব দেয়নি। সে আসমানিকে পুরোদমে এড়িয়ে গিয়েছে। আসমানি নিরাশ হয়ে বেরিয়ে যায়৷ তারপর আর তাদের দেখা হয়নি। পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে শক্ত করে হাত খোঁপা করলো। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার পায়ের উপর পড়ে। নিখুঁত কালো রাতকে চাঁদ তার নরম আলোয় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পদ্মজা চাঁদের আলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ছোঁয়া গেল ঠিকই অনুভব করা গেল না। পদ্মজার কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাতাস উড়ে যায়। সে বাতাসের শীতলতাকে আগুনের আঁচের মতো অনুভব করছে!
তারা পাঁচ জন গোল হয়ে বসেছে। খাবারের সুন্দর ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রান্নার ঘ্রাণ শুনেই আমির বুঝে গেল,সব পদ্মজা রান্না করেছে! সে নিজেকে সামলাতে পারলো না। সবার আগে খাওয়া শুরু করলো। আগে তাদের হালকা-পাতলা আলোচনা করার কথা ছিল। তারপর খাওয়া দাওয়া করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করবে। কিন্তু আমির নিয়ম ভঙ্গ করে শুরুতেই খাওয়া শুরু করে। অগত্যা বাকিরাও খাওয়া শুরু করলো। তাদের চেয়ে কয়েক হাত দূরে টলটলে জলের বিশাল পুকুর। জলের রঙ কালো। আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ আছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে৷ কালো জলের পুকুরটির পঁচিশটি সিঁড়ি। এই পুকুর নিয়ে অনেক গুজব রয়েছে। যদিও সব মিথ্যে৷ বাড়ির মেয়েরা এদিকটায় কখনো আসেনি। মজিদ হাওলাদারের ভীষণ প্রিয় এই জায়গাটা। তার দাদা এই জায়গাটাতে সবসময় ভোজ আসর করতেন। মজিদের ইচ্ছে ছিল চাঁদের রাতে পুকুরের পাশে বসে ভোজ আসর উপভোগ করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি! মজিদ হাওলাদারের দাদা নিজের বউকে ভূতে ধরা পাগল প্রমাণ করার জন্য গুজব রটিয়ে দেন। সেই গুজব ধরে রাখতে মজিদ হাওলাদারও এদিকটায় আসেননি কখনো। আজ বাড়ি খালি হওয়াতে সেই সুযোগ মিলেছে৷ তিনি গতকালই দুজন লোক দিয়ে জায়গাটা সুন্দর করে পরিষ্কার করেছেন। চোখ জুড়িয়ে দেয়ার মতো দৃশ্য হয়েছে!
একটু দূরেই ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা উড়ছে৷ মাথার উপর চাঁদের আলো। চারপাশে চারটি হারিকেন। চমৎকার পরিবেশ। খলিল মুরগির রানে কামড় দিয়ে বললেন,’ বাবু,সারাদিন কই থাহছ?’
আমির ছোট করে উত্তর দিল,’এখানেই।’
মজিদ আমিরকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে বললেন,’কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস?’
‘না,আব্বা।’ বললো আমির।
রিদওয়ান কিছু বলতে আগ্রহী নয়। সে চুপচাপ খাচ্ছে। তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। আসমানি আমিরের পাশ ঘেঁষে বসলো। বললো,’ পরের কামে কয়দিনের সময় দিছে?’
‘অনেকদিন।’
‘এইবার ভৈরবে নিশানা রাইখো। ওইহানে সুযোগ সুবিধা আছে অনেক।’
মজিদ আসমানির সাথে তাল মেলালেন,’আমিও ভৈরবের কথা বলতাম।’
আমির রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,’এই কাজ রিদওয়ান নিক। আজিদ আর হাবুরে নিয়ে কয়দিনের জন্য ট্রলার নিয়ে ভৈরবে চলে যাবে।’
রিদওয়ান না চাইতেও সম্মতি জানালো। আমির আড়চোখে পিছনে তাকালো। তার চেয়ে পাঁচ হাত দূরে একটা রেইনট্রি গাছ। গাছটির পিছনে সে চাপাতি আর রাম দা রেখেছে। আরেকটু রাত বাড়লে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে যাবে,নেশা করবে তখন সে আক্রমণ করবে। দুই হাতে দুই অস্ত্র নিয়ে রিদওয়ান ও মজিদকে আঘাত করা তার লক্ষ্য। তারপর খলিল ও আসমানি বাঁ হাতের খেল! আমির চুপচাপ প্রহর গুণতে থাকে।
খাওয়া শেষে প্লেটগুলো দূরে রাখা হয়। প্লেটগুলো সরানোর জন্য মজিদ চারপাশে চোখ বুলিয়ে লতিফাকে খুঁজলেন। লতিফা আশেপাশে নেই।
অন্যবার তো থাকে। আজ কোথায়? মজিদ বিরক্ত হলেন। তিনি মনে মনে লতিফাকে একটা নোংরা গালি দিলেন। তারপর পরবর্তী ডিল নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। কীভাবে এগোতে হবে কোন এলাকায় যেতে হবে,বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়। এসব নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। রিদওয়ান চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। মজিদ হাওলাদার আমিরকে কী প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন। তাও করছে না। এই বুড়ো আবার গুটি পাল্টে দিয়েছে। আমির কথা কম বলছে। সে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়! কিন্তু তার সুযোগ আসার পূর্বেই সে এবং বাকিরা ঘুমের কাছে হেরে যায়। এতোই ঘুম পেয়েছিল যে,তাদের শরীর অন্দরমহলে যাওয়া অবধি ইচ্ছেশক্তি পায়নি।
লতিফা কিছুটা দূরে অন্ধকারে লেবু গাছের আড়ালে বসে ছিল। মশা কামড়ে তার হাত-পা বিষিয়ে দিয়েছে। যখনই দেখলো ভোজ আসরের পাঁচজনই ঘুমিয়ে পড়েছে,তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে ছুটে যায় অন্দরমহলে। পদ্মজা সদর ঘরে শান্ত হয়ে বসেছিল। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে সব জানালো। তারপর তারা লুকিয়ে রাখা দঁড়ি আর ওড়না নিয়ে চলে আসে পুকুরপাড়ে। পদ্মজা, লতিফা ও রিনু মিলে ঠান্ডা মাথায় মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান এবং আসমানির হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেললো। তারপর এক এক করে টেনে নিয়ে গেল রেইনট্রি গাছের সামনে। পাঁচজনকে পাঁচটি গাছের সাথে বেঁধে তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
লতিফা,রিনু ঘেমে একাকার। রিনু তো ভয়ে তরতর করে কাঁপছে। এমন একটি দুঃসাহসিক কাজে অংশগ্রহণ করে সে হতভম্ব! পদ্মজা বললো,’ এবার তোমরা বেরিয়ে যাও।’
লতফা ও রিনু দুজনের গায়েই বোরকা ছিল। তারা ব্যাগ নেয়ার জন্য অন্দরমহলে দৌড়ে যায়। পদ্মজা বিদায় জানাতে অন্দরমহলে আসে। বের হওয়ার পূর্বে রিনু ও লতিফা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। লতিফা বিষণ্ণ গলায় বললো,’ আবার দেখা হইবো তো পদ্ম?’
‘আল্লাহ চাইলে,আবার আমাদের দেখা হবে বুবু।’
‘সামলাইতে পারবা সব?’
‘পারবো। তুমি বেরিয়ে যাও। আর দেরি করো না।’
লতিফা এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে রিনুর হাত ধরলো। তারপর ছলছল চোখে পদ্মজাকে একবার দেখে বেরিয়ে পড়লো অচেনা গন্তব্যে। আমিনা সদর ঘর থেকে সবকিছু দেখেছেন। এতদিনের পুরনো কাজের মেয়ে চলে যাচ্ছে কেন? তিনি প্রবল আগ্রহ থেকে পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন,’ লুতু কই যাইতাছে?’
পদ্মজা শান্ত স্বরে বললো,’ শহরে যাচ্ছে।’
‘ওমা! কার কাছে?’
‘আপনি ঘরে যান। সকাল হওয়া অবধি বের হবেন না।’
আমিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,’কেরে?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো,বললো,’ এতদিন যেরকম নির্জীব ছিলেন আজও থাকুন।’
পদ্মজা রান্নাঘর থেকে হাতে রাম দা তুলে নিল। তারপর আমিনাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করার আগে আমিনার উদ্দেশ্যে বললো,’যদি কোনো শব্দ করেন আপনার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।’
তারপর পদ্মজা রাম দা নিয়ে গোয়ালঘরে গেল। সেখান থেকে তিনটে নেড়ি কুকুর নিয়ে পুকুরপাড়ের পথ ধরলো।
__________
নিশীথে পাঁচজন মানুষ বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকে ঘুমাচ্ছে। আর সামনে রাম দা নিয়ে এক রূপসী বসে আছে। পাশে তিনটে কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটি ভয়ংকর। সুনসান নীরবতায় কেটে যায় ক্ষণ মুহূর্ত। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তারা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মৃত্যু উপভোগ না করে অমানুষগুলো মরে যাক পদ্মজা চায় না। সে দুই জগ পানি পাঁচ জনের মাথার উপর ঢেলে দিল। তাতেও তাদের ঘুম ভাঙলো না। পদ্মজা রাম দার শেষ প্রান্ত দিয়ে পর পর পাঁচজনের পায়ের তালুতে আঘাত করলো। এতে কাজ হয়। তারা সক্রিয় হয়। পাঁচ জনই আধবোজা চোখে তাকায়। তাদের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি। মাথা ভারী হয়ে আছে। ভনভন করছে। পদ্মজা চৌকিখাটের উপর গিয়ে বসলো। রিদওয়ান পদ্মজাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখছে।
সে চোখ বুজে আবার তাকালো। পদ্মজার হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে। তার হাতে রাম দা। জ্বলজ্বল করছে পদ্মজার পাশের তিনটে কুকুরের চোখ! রিদওয়ান চমকে গেল। মজিদ,খলিল এবং আসমানি যখন পরিস্থিতি বুঝতে পারলো তারাও চমকে যায়। তারা কথা বলতে গেলে ‘উউউ’ আওয়াজ বের হয়। উঠতে গেলে টের পায় তাদের হাত-পা বাঁধা। ঘুম উবে যায়। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। রিদওয়ান অবাক চোখে মজিদের দিকে তাকায়। মজিদও তাকালেন। তারা ছোটার জন্য ছটফট করলো। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। আমির পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে। সে সবসময় বলে,পদ্মজার নাকি নিজস্ব আলো আছে! এইযে এখন তার মনে হচ্ছে,অন্ধকারাচ্ছন্ন অতলে যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন পদ্মজা এসে আলোর মিছিলে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনের উঠান!
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক