ইলমা বেহেরোজ
ওই টাকা আমার দরকার আছে। কক্সবাজারে বাংলো করব।’ বলেই ও নিচে নেমে যাচ্ছিল, আলমগীর পিছন থেকে বলল, ‘রফিক মারা যায়নি।’ আমির চমকে পিছনে তাকায়।
চোখ খুলেই প্রথমে ডাক্তারকে দেখতে পেল রফিক। নিজেকে আবিষ্কার করল একটি হাসপাতালের বিছানায়। ডাক্তার প্রশ্ন করল, ‘দেখতে পাচ্ছেন রফিক সাহেব?’ রফিক এক চোখে ঝাপসা দেখছে, অন্য চোখে অন্ধকার। তার মনে পড়ে গেল, দুর্ঘটনার কথা। এক চোখ কী নষ্ট হয়ে গেছে? ভেবেই আঁতকে উঠল সে, ‘আমার ডান চোখে কী হয়েছে? কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?’ ‘আপনি একটি চোখ হারিয়েছেন।’ রফিক হতবাক হয়ে গেল। কথাটি তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে বিছানা থেকে নামতে চাইল। শরীরে কী অসহ্য বেদনা। হাতে, পায়ে, মাথায় ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলল, ‘আপনার শরীরের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধকল গেছে। এখন কোথাও যাবার চেষ্টা করবেন না, বিশ্রাম নিন।’ ‘আমি কতক্ষন ধরে এখানে?” ‘তিনদিন।’ রফিক অবাক হলো। ডাক্তার বলল, ‘আপনার স্ত্রী জুনি সারাক্ষণ আপনার সঙ্গে ছিলেন, সেবা করেছেন। আজ বাড়ি গেছেন।’ ‘আর কেউ ছিল না?’ ‘পুলিশ ইন্সপেক্টর হাকিম সাহেব বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছেন।’ রফিক ভাবছে, ‘কুতুবউদ্দিন কী আসেনি তাকে দেখতে?” জুনি ঢুকছে ঘরে। সে বলল, ‘তিন দিন ধরে কুতুবউদ্দিন স্যার নিখোঁজ। পাওয়া যাচ্ছে না।’ এমন ভয়ংকর কথা কখনো শুনেনি এমনভাবে তাকাল রফিক। জুনি বলল, ‘হঠাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তারপর আর খোঁজ মেলেনি।’ রফিক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছো ভুনি রফিককে শুতে সাহায্য করল। রফিক ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে ভাবছে, কী হয়েছে তাদের সাথে? কুতুবউদ্দিন কী বেঁচে আছে? রফিক চোখ বুজল। অনেকক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইল। এই কাজ একমাত্র আমির করতে পারে। কিন্তু কীভাবে কী করেছে? কীভাবে পারল ও? বাসনকোসনের শব্দে চোখ মেলে চাইল সে। জুমি ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এসেছে। হেসে বলল, ‘খেয়ে নাও।’ খাবার দেখেই রফিক বুঝতে পারল সে কতটা ক্ষুধার্ত। গপগপ করে খেয়ে শেষ করে সব খাবার। জুনি বলে, ‘আস্তে খাও, গলায় খাবার আটকাবে।’ রফিক খেয়ে আবেগঘন গলায় বলল, ‘তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।’ ‘কেন?’ ‘এইযে, তিনদিন তুমি আমার সেবা করলে।’ জুনি রফিকের গালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমার বরের সেবা আমি করব না তো কে করবে?’ রফিক খুশি হয়ে জুনির হাতে চুমু খায়। পরদিন সকালে রুমে এসে ঢুকে ইন্সপেক্টর হাকিম। তাকে দেখে রফিক উঠে বসল। ‘কেমন আছেন?’ হাস্যোজ্বল মুখে বলল হাকিম। রফিক হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘যে সবেমাত্র চোখ হারিয়েছে সে কী করে ভালো থাকবে?’ ‘ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। এটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ছিল। বাঁচবেন যে সেটা কেউ ভাবিনি। স্বয়ং আল্লাহ রক্ষা করেছেন।’ ‘এটা দুর্ঘটনা নয়, কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।’ ‘কেন এরকম মনে হচ্ছে?’ ‘আমি জানি।’ ‘সেরকম কোনো আলামত আমরা খুঁজে পাইনি।’ ‘দুর্ঘটনা নয় খুন। ওরা হয়তো আবার আমার উপর আক্রমণ করবে।’ ‘এটা শুধুমাত্র দূর্ঘটনা ছিল। আপনি ব্যালেন্স হারিয়েছিলেন।’ প্রতিবাদ করে বলল হাকিম। রফিক আর কথা বাড়াল না। হাকিম সাহেব বলল, ‘নিজের যত্ন নিন, আর চিন্তামুক্ত থাকুন। এখানে আপনি নিরাপদ।’ রফিক মাথা ঝাঁকাল। হাকিম চলে যেতেই জুনি বলল, ‘এটা সত্যি দূর্ঘটনা ছিল না?’ রফিক কাতর স্বরে বলল, ‘বিশ্বাস করো জুনি, আমি ব্যালেন্স হারাইনি। কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।’ ‘আমি বিশ্বাস করি। তোমার ক্ষতি করার জন্য গতকাল দুজন লোক এখানে ঢুকেছিল।’ এ কথা শুনে রফিক ভড়কে যায়। চিৎকার করে উঠে, ‘তুমি এ কথা পুলিশকে বলোনি কেন?” ‘হাকিম সাহেব জানে। তবুও উনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছেন।’ রফিক বিড়বিড় করল, ‘ওরা সব এক দলে…সব।’ জুনি রফিকের মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিল, ‘আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।’ রফিকের হঠাৎ মনে হয় জানালার পাশ থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই মানুষটা সরে যায়। রফিক ভয়ে ঢোক গিলল। জুনিকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমরা রাতেই এখান থেকে চলে যাব। নয়তো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ ‘তুমি এখনো সুস্থ হওনি।’ রফিক জুনির হাত চেপে ধরে, অনুনয়ের চোখে তাকায়। ওর পাশে কেউ নেই। কুতুবউদ্দিন নিখোঁজ। হাসপাতালের পরিবেশ ঠিক লাগছে না। বাধ্য হয়ে জুনি রফিকের কথাতে সায় দিল। সেদিন রাতেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাউকে না জানিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় রফিক। রাস্তায় একটা ট্যাক্সি দেখে উঠে পড়ে ওরা। রফিকের গিটে, গিটে ব্যথা। যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে কলিজা। জুনি বলল, ‘আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজো। ততক্ষণে পৌঁছে যাব আমরা।’ জুনির স্নেহার্দ্র আচরণে রফিক মুগ্ধা সে জুনির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল টেরই পেল না। চোখ খুলে পাশে জুনিকে দেখতে না পেয়ে রফিক জানালার বাইরে তাকাল। হাওড়ের মাঝে গাড়ি! রফিক চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। ড্রাইভার চুপচাপ বসে আছে। রফিক ঠোঁট ভিজিয়ে কোনোমতে বলল, ‘জুনি…আ… আমার পাশে যে-‘ কথা শেষ করার পূর্বেই ড্রাইভার ঘুরে তাকাল। মানুষটিকে দেখে রফিকের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে যায়। রগে রগে পড়ে টান। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, ‘তুই!’ আমির দাঁত বের করে হাসল। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়
চলবে,,,,
পদ্মমির ৩০
ইলমা বেহেরোজ
গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জুনি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আলমগীর ও মজিদ হাওলাদার। রফিকের কাছে সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়। জুনি প্রতারণা করেছে। ছলনা করে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছে। পুলিশ আমিরের পক্ষে নয় বরং নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। যা ভুল হবার হয়ে গেছো আমির হিসহিসিয়ে বলল, ‘ভালোই হলো তখন মরিসনি। নিজের হাতে মেরে যে সুখ পাব, তা তখন মরে গেলে পেতাম না।’
রফিককে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ও ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে সেই হাওড়েই মাটিচাপা দিয়ে দেয়া হয়। চিরতরে গুন হয়ে যায় রফিক।
পদ্মনীড়ে প্রবেশ করতেই বেলি ফুলের ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। গতকাল তারা বাড়ি ফিরেছে। আমির কয়টা ফুল ছিড়ে শার্টের বুক পকেটে ভরে নিল।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলল পদ্মজা। আমির বুকপকেট থেকে ফুলগুলো এগিয়ে দিল পদ্মজার হাতে।
পদ্মজা ঘ্রাণ এঁকে বলল, ‘আব্বাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছেন?’
‘দিয়েছি।’ আমির অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
পদ্মজা আমিরকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল।
‘আলমগীর ভাইও চলে গেছে।’
‘ওমা! উনার না কিছুদিন থাকার কথা ছিল।’
আমির কিছু বলল না। আজ সে মিথ্যে বলতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ঠেকতেই আমির পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘শুভ জন্মদিন পদ্মবতী। শত বছর বাঁচো আর আমার হয়ে থাকো। তোমার জন্মদিনেও আমি আমার জন্য তোমাকে চাই। কত স্বার্থপর আমি তাই না?’
পদ্মজার মনেই ছিল না আজ তার জন্মদিন। সে আমিরের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, ‘হ্যাঁ, ভীষণ। আর এমনই থাকবেন, স্বার্থপর। শুধু আমাকে চাইবেন।’
আমিরের দুই চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। কুতুবউদ্দিন, রফিক তাকে কত আতঙ্কে রেখেছে তবুও ভেঙে যায়নি। অথচ আজ যখন সব বিপদ শেষ তার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পদ্মজাকে হারিয়ে ফেললে কীভাবে বাঁচত সে?
পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?”
আমির হাসল। বলল, ‘জানি না। কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরে নাও। আলো ফুটতেই আমরা বেরিয়ে যাব।’
‘আবার কোথায়?’
‘স্বপ্নের জগতে।’ আমির চোখ টিপল। বোট তৈরি। আগামী
দশদিন ওরা পদ্মা নদীতে কাটাবে।
পরিশিষ্টঃ
‘মিষ্টি রানি দুই রাজাকে তার অপকর্মের জন্য হত্যা করেছিল। তাই রানির কারাবাস হয়। তারপর কী হয়? এই গল্পের বাকি অংশ কোথায় জানব আপা?’ আলিয়া ঠোঁট উল্টে বলল।
নুড়ি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বলল, ‘মা জানে।’
‘মা তো বলে না।’
‘হয়তো গল্প শেষ, রানী এখনো কারাগারে আছে।’
‘কিন্তু মা তো বলল, গল্প বাকি।’
নুড়ি বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ওর বয়স ঘোল। মেদহীন, একহারা গড়ন। চোখজোড়া কালো, স্বপ্নময়। কালো রঙা কোঁকড়া চুল কোমর ছাপিয়েছে। ও বলল, ‘তাহলে অপেক্ষা কর, মা নিশ্চয়ই একদিন বাকি গল্প বলবে।’
আলিয়া কার্থী মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। নুড়ি আনমনা হয়ে ভাবে, ‘মা যতদিন না বলছে আমি তোদের কিছু বলতে পারব না, সেই দুষ্ট রাজা আমাদের বাবা আর মিষ্টি রানি আমাদের মা। আমি কেন সব জেনে গেলাম বলতো? মায়ের কষ্ট যে আমার সহ্য হয় না।’
আজ আমির হাওলাদারের মৃত্যুবার্ষিকী। এই রাতটা পদ্মজা একা একা পাহাড়ের চূড়ায় বসে কাটায়। তীব্র জ্বরের কারণে আজ যেতে পারেনি। সন্ধ্যা থেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কর্ণগোচরে এলো, দরজায় ঠকঠক শব্দ। এই নিশি রাতে কে ডাকে?
জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে পদ্মজা জানালার দ্বার খুলল। চাঁদের আলো লুটিয়ে গড়ে ওর গায়ে।একটা ভারী কন্ঠ বাতাসে ভেসে এলো, ‘আজ কেন আসোনি?’
পদ্মজার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। দ্রুত চোখে চশমা পরে দেখল, জানালার পাশে আমির দাঁড়িয়ে আছে। ওর পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। মাথার উপর চাঁদ। যেন চাঁদটা তার সঙ্গী।
পদ্মজা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘আপনি এসেছেন!’
‘না এসে থাকি কী করে? তোমায় ছাড়া কখনো থেকেছি আমি?”
পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙে এলো, ‘আমাকে ছাড়াই তো থাকেন।’
‘আমি সবসময় তোমার সঙ্গে থাকি। কখনো ছেড়ে যাই না।’
‘তাহলে সামনে কেন আসেন না? আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে? আপনি তো এমন ছিলেন না।’
‘ক্ষমা করে দাও। আর লুকিয়ে থাকব না।’
‘এবার কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।’
নুড়ি পিছনে এসে দাঁড়ায়। পদ্মজাকে একা একা কথা বলতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠে। জ্বর বাড়লেই পদ্মজার হ্যালুসিনেশন হয়। তখন একা একা বকবক করে, তার অদৃশ্য শ্রোতা হয় আমির হাওলাদার। নুড়িকে দেখে পদ্মজা হাসল, ‘দেখ, তোর বাবা এসেছো আমাকে নিয়ে যাবে।
চলবে,,,,
পদ্মমির : শেষ পার্ট
ইলমা বেহেরোজ
পদ্মজার শরীর কাঁপছে। সে সম্পূর্ণভাবে জ্বরের নিয়ন্ত্রণে। নুড়ি পদ্মজার পায়ের কাছে বসে অনুনয় করে বলল, ‘ও কথা বলো না মা, তুমি চলে গেলে আমাদের কী হবে? আমরা কোথায় যাব?’
পদ্মজা নুড়ির মাথায় হাত রেখে আমিরকে অনুরোধ করে বলল, ‘আচ্ছা, কিছুদিন পরই যাব। আপনি কিন্তু আমাকে রেখে যাবেন না।’
নুড়ি বাইরে শুধু আকাশের চাঁদটাই দেখতে পাচ্ছে। সে পদ্মজাকে প্রশ্ন করল, ‘বাবা দেখতে কেমন মা?’
পদ্মজা মোহগ্রস্তের মতো ‘আমিরের দিকে তাকাল। আমির চোখ টিপতেই পদ্মজা হাসল, ‘সুদর্শন। ঘন কালো চুল, অন্তর্ভেদী কালো চোখ, থুতনিতে কাঁটা দাগ, বলিষ্ঠ শরীর, ধবধবে সাদা দাঁত আর ভীষণ রসিক – –
সমাপ্ত।
শেষ হয়ে গেলো পদ্মমির ,,,,
সম্পূর্ণ গল্প