###পরগাছা ৬ষ্ঠ পর্ব
###লাকি রশীদ
সেদিন বাসায় এসেই ভাইয়াকে ফোন দেই। সে আমার প্রান্ত থেকে অনেকটা দূর প্রান্তে থাকায়, সময়ের হিসেবে পিছিয়ে আছে। তাদের এখন ভোরবেলা। আমি আজ এতো কিছু ভাবতেই চাই না। ঘুম ভেঙ্গে ধরেই বলছে, কি হয়েছে খোকা? কোন সমস্যা, মা কেমন আছে? আমি হেসে বলি,
সবসময় কি দুঃখের কথা শুনতে হবে? আজ ভালো কিছু শোনো। কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফোন এসেছে আমার চাকরি হয়ে গেছে। ভাইয়া খুশি হয়ে কনগ্ৰ্যাচুলেশনস বলছে। তারপর খুশি গলায় বলল, আমার ইদানিং তোর একটা কথা খুব মনে পড়ে খোকা। আগে সবসময় তুই বলতি,
সুখের দিন আসবেই ভাইয়া। দোয়া করো শুধু মা যেন দেখে যেতে পারে। একটা সুখ অলরেডি মা পেয়ে গেছে, বাকিটুকু পেলেই হলো। আমি জানি এখন কিছুক্ষণ ভাইয়া কাঁদবে।
মা ৫ কেজি চিকন চাল ও ৫টা মুরগি এনে দিতে বলছে। মোরগ পোলাও করে পাশের এতিমখানা তে দিবে। আমি বলি, এক্ষুনি দিবে কেন? আমি বেতন পাওয়ার পর দিতে না হয়। বিরক্তি নিয়ে বললো, তখন আবার দিবো। এখন দয়া করে যা লিখেছি তা নিয়ে আয়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সবার হাসিমুখ দেখে মনে হচ্ছে একটা খুশির সংবাদে সারাটা পরিবার কেমন চনমনে হয়ে আছে। মনে হল অনেক দিন ধরে মাঝনদীতে
আটকে থাকা জাহাজ এবার কূলে ভেড়ার সুযোগ
পেয়েছে যেন।
আজ বাসা থেকে একবারও বের হইনি। কি এক অদ্ভুত আলসেমিতে পেয়েছে যেন। সারা বিকেল ঘুমিয়ে উঠলাম। বড়ফুপু তার ননদের বাড়িতে ২ রাত থাকবেন বলে গিয়েছেন। ইচ্ছে ছিল নীতু কে নিয়ে যাবেন। ও যায়নি। শেষে খালার মেয়ে কে নিয়ে গেছেন। বাবা রাতে খেতে বসে নীতু কে বলছেন, কি ঠিক করলি? এই প্রস্তাবটি তো ভালো ছিল। তোদের কোনো কিছুই পছন্দ লাগে না। নীতু বললো, না করলাম কখন? ভেবে দেখব বলেছি। বাবা বলছে, এতো দিন ধরে তোর ভাবতে হয়? ওদের কি পাত্রীর অভাব? চলে গেলে তখন তো
আফসোস করে কোনো লাভ হবে না। নীতু এবার বলছে, চলে গেলে কি আর করা !!! এই কথা শুনে বাবা প্রচন্ড রেগে গেছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, যেরকম মা সেরকম ছা ই তো হবে। ভালো হবে কোত্থেকে? বিন্দু সাথে সাথেই বলছে, শোকর
আদায় করো মায়ের মতো হয়েছে। তোমার মতো আপু হলে না লেখাপড়া, না কিছু করার যোগ্যতা থাকতো বাবা। যা ই বলো অন্তত মাকে নিয়ে কিছু বলতে যেও না। এই সংসার ভেসে যায়নি এখনো,
একমাত্র মায়ের কারণে।
শুরু হলো চাকরি জীবন। বেশ ভালো অঙ্কের বেতন। তাছাড়া প্রবেশনারি পিরিয়ড এক বছর পেরোলে, আরো বাড়বে। নীতু অবশেষে হ্যা বলেছে। বাবা ইন্জিনিয়ার চাচার সাথে কথা বলেছেন। উনার একমাত্র মেয়ে ইংল্যান্ড এ থাকে। ২ মাস পর আসবে। তখন বিয়ে হবে। মা কয়েক দিন ধরে ভাইয়ার জন্য কাঁদছে।আমার ছেলেটা মনে হয় বিয়েতে থাকতে পারবে না……… এই এক আফসোস কথায় কথায় ঝরে পড়ছে। ভাইয়া কেন যেন ইদানিং ফোন করাও কমিয়ে দিয়েছে।
মামুন ভাই এর পরিবার থেকে জানানো হয়েছে,
বিয়েতে কোনো কিছু যেন না দেয়া হয়। কিন্তু আমার ২ ফুপু বলছেন, এটা আবার কেমন করে হয? তার পরেই বড়ফুপু ছোটফুপু কে বলছেন, আমাদের মেয়ে কি ওদের ফার্ণিচার ব্যবহার করবে না কি? এ আবার কি রকম কথা হলো? এক কাজ করা যাক্,সব ফার্ণিচার ও বাসন আমি কিনে দেই আর হল ভাড়া, মেহমানদের খাওয়া খরচ তুই দিয়ে দে। আনুষঙ্গিক যা থাকে মেঝ কিনে দিবে। ৩ বোন ৩ টা দিলে গায়ে লাগবে না।
আমরা সবাই বসে আছি এখানে,মা এবার স্পষ্টস্বরে বলে উঠলো, বেয়াদবি নিবেন না বুবুরা। আমি তো সারাজীবন কোনো মতামত দিয়ে হালে পানি পাইনি। এবার মেয়ের বিয়েতে একটু বলি। আপনারা আমাদের জন্য শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক করেছেন। আমি ভেবে দেখেছি নীতুর বিয়েতে আমি কিছু দিবো না। বিয়ে বাসাতেই হবে।ওদেরকে ৫০/৬০ জনের বেশি বরযাত্রী আনতে মানা করে দেবো। মামুনের বাবা, মা দুজনেই আমাকে ফোনে বলে দিয়েছেন, মেয়ে ছাড়া তারা আর কিছুই চান না। সুতরাং ওর বিয়ে এভাবেই সাদামাটা ভাবে হবে।যেসব বিয়েতে খরচ কম হয় তাতে অনেক বরকত থাকে।
বড়ফুপু এবার চেঁচিয়ে উঠেন, আমাদের বাড়ির মেয়েরা কখনো পরের বিছানায় থাকেনি বিনু। বেড,ম্যাট্রেস,লেপ,বালিশ, সামান্য বাসনপত্র এগুলো তো ভিক্ষুকও দেয়। মা নম্র অথচ স্পষ্ট স্বরে বলল, পরের ছেলের কাছে মেয়ে দিচ্ছি আর
পরের বিছানায় থাকতে সমস্যা কি? বড়ফুপু এবার অন্যপথ ধরলেন। গলার আওয়াজ কান্না কান্না করে বললেন, আমি জানি বিনু সেদিন আমি উল্টা পাল্টা কথা বলায় তুমি দুঃখ পেয়ে এসব বলছো। অহংকার আমার মনে বাসা বেঁধে ছিল।
মা তার কথাতেই অনঢ়। ছোট ফুপু বলছেন,আপা
না বুঝে অনেক কড়া কথা বলে ফেলেছে। এসব মনেও রেখো না। আমাদেরকে আমাদের দ্বায়িত্ব করতে দাও। মা কিছু না বলে চূপচাপ বসে আছে দেখে এবার বাবা রেগে বলল, বেশি বাড়াবাড়ি করো না কিন্তু। মেয়ে কি শুধু তোমার একার না কি? বুবু দের উপর কথা বলো? আমি মামুনের বাবার সাথে কথা বলবো। খাট, বিছানা নিতে হবে।
মায়ের অনমনীয় মনোভাব দেখে আমার বুদ্ধিমতী
ছোট ফুপু এবার মায়ের পাশে এসে বসলেন। গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছেন, আমি জানি খুব
কষ্ট বুকে নিয়ে বাচ্চাদের মুখ চেয়ে ৩২ বছর তুমি চলেছো। তোমার সেই ত্যাগ বিফলে যায়নি। বাচ্চা
গুলো মা বলতে হয়রান। বড়মেয়ের বিয়ে, ওর বিয়েতে আমাদেরও তো দাবি আছে। দেখো তো
এটা কেমন হয়…… আপা বিছানা ও বাসনপত্র দিল আর আমি……. এতটুকু বলতেই আমি বলি,
ফূপু আমাকে তোমাদের দলে রাখো। ফুপু হেসে বলে, অবশ্যই বাপ। তাহলে তুই খাওয়া খরচ দে।
আমি বরের পোশাক ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র, পরিবারের সবার পোশাক এগুলো দিয়ে দেই।
যদি আমার বিনু খুশিমনে রাজি হয়। আমার বোন
বিনুর কথার অন্যথা আমি কখনোই করবো না।
আমার মা আর কি বলবে? মাথা নেড়ে বললো, ঠিক আছে বুবু। আপনারা যা ভালো বুঝেন তা করেন। কিন্তু মামুনের বাবা, মাকে আবার কিভাবে এসব বলি? ছোট ফুপু সব মুশকিল আসানের মতো বললেন,বেয়াই সাহেবের সাথে আমি কথা বলবো। এমন ভাবে রাজি হবেন,দেখো তোমাকে
উল্টো ফোন করে জানাবেন। এতোক্ষণের চিন্তা দুর হতেই বড়ফুপু তার বাটা খুলে পান মুখে পুরে দিলেন।
অফিসে যতোক্ষণ থাকি কাজে ব্যস্ত থাকি, ভালো থাকি। এরপরের সময় গুলোতে বুকটা হু হু করতে
থাকে ভাইয়ার জন্য। আমি খেয়াল করে দেখেছি,
আমার চাকরি পাওয়ার পর থেকে ভাইয়া ফোনে কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। বারবার শুধু মনে হচ্ছে, ভাইয়া ফ্রাষ্টেশনে ভুগছে না কি ছোট ভাইয়ের চাকরির কথা শুনে। আমার ভার্সিটির এক স্যার বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে দ্বৈত সত্তা আছে। একই ঘটনায় মন ভালো ও খারাপ দুটোই হতে পারে।
আমি ভেবেছিলাম ভালো সময় এলে, মানুষের আবেগ হয়তো কমে যায়। কিন্তু, কালকে রাতে অনেকক্ষণ ভাইয়ার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করেছি। মা কয়েক দিন ধরে ‘আমার সায়েম’ বলে আর বাক্য শেষ করতে পারে না। চোখে আঁচল দেয়। বাবা এসব দেখতে দেখতে গতকাল বিরক্ত হয়ে বলছে, ওখানে থেকেই বা সায়েম কি এমন হাতিঘোড়া উল্টাচ্ছে? এতো এতো কাঁদার থেকে
বলো না কেন চলে আসতে? আমি একটা ব্যবস্থা
করে দেবো না হয়। মা এবার লাল চোখ তুলে বলছে, তোমার ব্যবস্থা করা মানে তো বোনের কাছে হাত পাতা। তারচেয়ে এভাবেই চলুক। বাবা এবার বলছে, তাহলে দয়া করে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করা বাদ দাও।
বিয়ের আর মাত্র ২ সপ্তাহ বাকি আছে। নীতু কে মা দুই মাস ধরে সব টিউশনি ছাড়িয়েছে। নীতুর জন্য বিষয়টি মানা এতো সহজ ছিল না। কিন্তু,
মায়ের কোনো কথা ই আমরা ফেলতে পারি না।
প্রতিদিন খালাকে দিয়ে কাঁচা হলুদ বাটায়। পরে বলে গায়ে, মুখে মেখে গোসল কর। নীতু ভেবেছে
২/৩ দিন দিয়ে মনে হয় শেষ হবে এই যন্ত্রণা। কিন্তু মা নাকি প্রতিদিন ই বলে। রাগে সেদিন বলেছে,
আমার বিয়ে না হলে না হোক তবু আমি আর এই
হলুদ বাটা মাখবো না। কতো কিছু যে মা করছে।
সেদিন অফিসে যাবার আগে নাস্তা করছি, মা এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বলছে, ভালো দেখে এক বক্স মাখন এনে দিতে পারবি বাবা? আমি বলি এটা একটা কথা হলো মা? কেন পারবো না?
তোমার খেতে ইচ্ছে করছে এতেই আমি অনেক খুশি। মা বলে, আমি কি এসব খাই না কি,নীতুর জন্য আনাচ্ছি। এতোটা বছর মেয়েটা উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে করতে চেহারাটা কি রকম একটা চোয়াড়ে হয়ে গেছে। মেয়েরা একটু লাবণ্যময়ী না
হলে কি ভালো দেখায় বাপ? সাথে আজকের ফ্রেশ একটা ব্রেড আনবি। খেতে না চাইলেও বকে বকে খাওয়াতে হবে ওকে। আমি মনে মনে ভাবছি, নীতু জানলে খাবেই না। বললাম,মা এখন মেয়েরা লাবন্যময়ী কি না সেটা কেউ ভাবে না।
দেখছো না পুরুষের সাথে সমান দক্ষতায় ঘরে বাইরে সবকিছু সামলাচ্ছে ওরা। মা এবার বলছে,
তাই বলে কমনীয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে না? আমি তখন আবার ভাবছি,আর কিছু বললে
কখন আবার ধমক খেতে হয়। মা তার ধারণা,তার
বিশ্বাস নিয়েই ভালো থাকুক না।
ও বাড়ি থেকে বরপক্ষ খবর পাঠালেন, বিয়ের শাড়ি গহনা কিনতে বরের সাথে যদি নীতু যেতে চায় যেতে পারে। নীতু সাথে সাথেই বলল,যাবে না
সে। তাদের ইচ্ছেমতো কিনতে পারেন। এবার বরের ভাবি নীতু কে ফোন করে বললেন, ভয় নেই। উনিও যাবেন। চাইলে নীতু বিন্দুকেও সাথে নিতে পারে। নীতু হেসে বলছে,ভয় পেলে কি আর
বিয়ে করতে রাজি হই ভাবি? আমি নিশ্চিত আপনারা আমার জন্য যা কিনবেন খুব সুন্দর হবে, আমার ভীষণ পছন্দ হবে। বিন্দু এবার রেগে গেল, কি সুন্দর শপিং নিজের পছন্দ মতো করতে পারতে। তা না, তোমার মতো কাঠখোট্টা, নিরামিষ মানুষ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আমি এসব শুনে গান ধরেছি,যার বিয়া তার খবর নাই,পাড়া পড়শীর ঘুম নাই। বিন্দু কঠিন চোখে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
বিয়ে ঠিক হওয়ার এ ২মাসে নীতু ৩টা ইন্টারভিউ
ফেস করেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্টারভিউ কালকে পড়েছে। এখন মা বলছে, রোদের মধ্যে যাবি না কি? আর যায় কোথায়,রাগে ফেটে পড়ে
কি ব্যাপার মা, ওরা কি তোমাকে কিছু বলেছে? হলুদ লাগা,মাখন খা, দুধের সর খা, এখন আবার রোদে পুড়ে যাবি……সিরিয়াসলি কি ব্যাপার শুনি।
মা এবার বলছে,ঘাট হয়েছে বাবা। যা খুশি কর।
মা তো এখন পুরনো দিনের মানুষ হয়ে গেছি।
ওদিকে বড়ফুপু সবকিছু বেশি বেশি কিনছেন। বেড কিনতে গিয়ে পুরো বেডরুম সেট কিনে,মার
ভয়ে সরাসরি নীতুর শশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বাসন কিনতে গিয়ে ফ্রাইপ্যান দুটো কিনেছেন। একটা না কি রুটি সেঁকার,অন্যটা মাছ ভাজির। বিন্দু তার সাথে ছিল, এসে বেশি বকবক করতে গিয়ে নীতুর কানে চলে গেছে। নীতু রেগে বলছে, আমি ভেবেছিলাম বিয়ের আগে পরিবারের কারো সাথে ঝগড়া করব না। কিন্তু তোমরা যেন আমাকে রাগানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছো। ফুপু ওরা কি
এতো ই দরিদ্র যে মাছ ভাজার ফ্রাইপ্যান নেই। ২টা ফ্রাইপ্যান কিনে দিতে হবে? তোমরা নিজেরাই
তোমাদের মেয়েদের নীচে নামাও। আমরা কি ফালতু না কি,এসব সাথে দিতে হবে? ফুপু হার মেনে বলেছেন,আর এরকম ভুল হবে না রে মা।
বিয়ের এক সপ্তাহ আগে এক শুক্রবার ভোরে ভাইয়া ফোন দিয়েছে। আমি বলি, সত্যি করে বলতো তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? লিগ্যাল হতে না পারলে দেশে চলে এসো। একটা ব্যবস্থা হবেই।
ভাইয়া এসব ভালো করে না শুনেই বলে, আমি তো সেকথা বলবো বলেই ফোন করেছি খোকা।এই ২মাস বেশি ফোন দেইনি কারণ মা বুঝে যাবে
আমি খুশি আছি। আমি লিগ্যাল হয়ে গেছি খোকা। নীতুর বিয়ের ঠিক এক দিন আগে আমি ইনশাআল্লাহ দেশে আসছি। কিন্তু খবরদার, তুই এসব কাউকে বলবি না। বাড়িতে পা দেয়ার আগে পর্যন্ত কেউ যেন জানতে না পারে। তুই অবশ্যই এয়ারপোর্টে যাবি। আমি বলি, কি সব শর্ত দিচ্ছ,
খুশির খবর শুনে একটা চিৎকার দিবো তারও উপায় নেই।
সবাই বিয়েতে নতুন কাপড় কিনলেও মাকে কিনতে রাজি করানো যাচ্ছে না। একই কথা বার বার বলছেন, আমার সায়েম কতো মনোকষ্টে আছে আর তোরা আছিস নতুন কাপড় কিনা নিয়ে। আমি মনে মনে বলি,আর মোটে ৫দিন কষ্ট সহ্য করো মা। তোমার সায়েম তোমার কোলেই ফিরে আসছে। বিয়ে শুক্রবার দুপুরে, বুধবার সকাল ৮টায় ভাইয়া আসার কথা।আমি সিকলিভ নিলাম,কারণ এতো দিন পরে এসে আমাকে এয়ারপোর্টে ভাইয়া যদি না দেখে বিশ্রী দেখাবে জিনিসটা। সকাল ৭টায় মাকে মিথ্যে কথা বলে বের হয়েছি। কিন্তু এসে দেখি ফ্লাইট এক ঘন্টা ডিলে। অপেক্ষার প্রহর এতো কষ্টকর হয় তখন বুঝলাম। কিচ্ছু খাইনি সকালে,তাই এখানে বসে স্যান্ডউইচ ও কফি খেলাম।
ঘড়ির হিসেবে কতোক্ষণ জানি না আমার হিসেবে অনন্তকাল ধরে যেন অপেক্ষা করছি। অবশেষে,
হাসিমুখে ভাইয়াকে লাগেজ ঠেলে বের হতে দেখলাম। খোকা বলে এতো জোরে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আমি যেন তার বুকের টুবটাব শব্দ
শুনতে পাচ্ছি। উবার কল করে বসতেই ড্রাইভার
ভাইকে বললাম,এক ছেলে সহস্র রজনী কেঁদে মা এর কাছে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। আপনি খুব খুব
সাবধানে চালান। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। ভাইয়া কে বলি তুমিও আয়াতুল কুরসি পড়ো আমিও পড়ছি। ভাইয়া হেসে বলল,ভয় লাগিয়ে দিচ্ছিস খোকা।
বাসার কিছু দূরে গাড়ি থেকে নেমে দুজন বাসায় ঢুকলাম। প্রথমেই লিভিং রুম,এর পাশের রুম আমারটা। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি এখানে কেউ নেই। ভাইয়া কে চট করে আমার বিছানায় বসিয়ে বলি, কোনো কথা না বলে এখানে বসে থাকো। মা
কে পাঠাচ্ছি। কিচেনে গিয়ে দেখি মা ডিমপোচ করে নীতু কে সাধছে,খা নারে মা। ভালো লাগবে
দেখিস। যথারীতি নীতু চেঁচিয়ে উঠলো, মা বলেছি
না আমি খাবো না। এই পর্ব খুব জলদি শেষ হবে না ভেবে আমি গিয়ে বলি, দেখো মা আমার বিছানায় পোকা বসে আছে। ভয়ে যেতে পারছি না। একটু ফেলে দিয়ে যাও না প্লিজ। মা এবার রেগে গেছে, পোকাকে ভয় পেতে হয় না খোকা। কিচ্ছু একটা দিয়ে নিচে ফেলে দে। আমি এবার চেঁচাচ্ছি, দেরি হয়ে যাবে অফিসে যেতে আসো না কেন? মা বকতে বকতে রুমে ঢুকে এতো বড় পোকা দেখতে পেয়ে ‘আমার বাবা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। মুহুর্তেই নীতু,বিন্দু, ফুপু সকলে হাজির। কান্না হাসির অদ্ভুত সুন্দর এক দোলাচলে দুলছে এই কামরার হাওয়া। বেগুনি শাড়ি পরা আমার মাকে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ।
জীবনে এই প্রথম বড়ফুপু বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। জোরে জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলছেন, কবে আর তোর বুদ্ধি হবে বলতো? এক তো বিয়ের একদিন আগে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস,
আরেকটা কি সেটা নিজে গিয়ে দেখ। বাবা ভেবেছে নিত্যদিনের কোনো ঘটনা হবে। ফ্রেশ হয়ে আসতেই ভাইয়া সালাম করতে যাবে, ওর হাত খপ করে ধরে বুকে টেনে নিল।ভাইয়া কান্নাজড়িত
কন্ঠে বলল, কেমন আছো বাবা? আমি তোমাদের অনেক মিস করেছি।
নীতুর মেহেদী দেয়া হবে রাতে। সন্ধ্যায় ফুপুরা সহ সবাই চা খাচ্ছি। হঠাৎ ভাইয়া নীতুকে বলে, তোর দুটো বড়ভাই থাকতেও এই সংসারে অনেক কষ্ট করে গেছিস। বিন্দুর হয়তো এর এক চতুর্থাংশ কষ্টও করতে হবে না। আমাদের ক্ষমা করে দিস বোন। আল্লাহ তোকে অনেক সুখী করবেন ইনশাআল্লাহ।
নীতু কিছু না বলে ভাইয়ার পিঠে মুখ ঠেকিয়ে বসে আছে। ভাইয়া বলে যাচ্ছে, আগামী মাসে তোমার নতুন ভাড়াটে বাসায় তুমি যাচ্ছ মা। বেশি দূরে নয়
এই পাড়াতেই। কবিরদের বাসা ভাড়া নিয়েছি। ওরা তো বাইরে থাকে। আমি ৩ মাস থাকবো, তোমাকে সবকিছু একদম সেট করে দিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। আর একটা বড় রুম আমার ফুপুদের। তারা যখন আসবে, তখন ইচ্ছে খুশি থাকবে। সাথে সাথে ই আমার দুই ফুপুর মুখে
রাজ্যজয়ের হাসি। আর আমার মার দুচোখ দিয়ে
অবিরাম অশ্রু ঝরছে। কিন্তু এবারের অশ্রু সুখের,
এবারের অশ্রু দিন বদলের।
ছাদ ঠান্ডা হবার পর নীতু কে মেহেদী দেয়া হলো।নিমন্ত্রিত অতিথি খুব কম। ওর কিছু বন্ধু, আর ফুপুর পরিবার। নয়টায় ই শেষ। খালা ঝাড়ু দিয়ে যাবার পর দুই ভাই শুন্যে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া
নীরবতা ভাঙ্গলো, সবকিছু কেমন যেন সিনেমার মতো লাগছে তাইনা? আমি হেসে বলি,হ্যা কিন্তু
হ্যাপী এন্ডিং হবার আগের কষ্টের দিনগুলো মনে করে দেখো। ভাইয়া মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা
এমনি কি আর বলেছেন,”নিশ্চয়ই কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে”। শুধু দোয়া করিস খোকা, আমাদের মাথার উপর যেন আমাদের বাবা মা অনেক কাল
ছায়া হয়ে থাকেন। দুই ভাইয়ের অশ্রুসিক্ত চোখের
সেই প্রার্থনাটুকু যেন বিশাল আকাশ শুষে নিচ্ছে।
(সমাপ্ত)
চার আনার জীবন গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/four/
জীবন যখন যেমন