এক সমুদ্র প্রেম পর্ব ২৭
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৭)
পুষ্পর সরু নাক লালিত। একটু পরপর ফুলছে কান্নায়। ঠোঁটদ্বয় চেপে রেখেছে। মলিন চেহারা আর ভেজা দুটো চোখ চেয়ে আছে গেইটের দিকে। যেখান থেকে এইমাত্র গত হলো সৈকতদের গাড়ি। পুষ্পর চোখ ভরে ওঠে ফের। বর্ষা আর সে একইবয়সী। ছোট থেকে ছুটেছে এদিক সেদিক। নানু বাড়ি আসার একটি মুখ্য কারণ ছিল বর্ষা। খেলতো,ঘুরত, ঘুমাতোও একসাথে। বাড়ির ভেতর পাঁকা ওয়াশরুম থাকা সত্ত্বেও দুজন হুটোপুটি করে গোসল করত পুকুরে। সাতরে সাতরে ঘোলা বানাত পরিষ্কার জল। ব*কে, ধ*মকেও ওঠানো যেতোনা দুটোকে। একে-অন্যের জামা পরত ভাগাভাগি করে। শীতের সময় দুপুরে ছাদে গিয়ে চুল শুকানো,চুলে তেল লাগানো এসব তো আর হবে না! হবেনা সেই পুরোনো হৈচৈ। মেয়ে মানুষের জীবনটাই এরকম। দুদিন পরেতো তার ও বিয়ে হবে। দুজন দুদিকে সংসারী হবে। এইভাবে গল্প,আড্ডা, হৈহল্লা এসব শুধুই অতীত। পুষ্পর কা*ন্না বাড়ল। বাড়ল অশ্রু গড়ানোর মাত্রা। সে শব্দ আটকাচ্ছে ঠোঁট টিপে। ইকবাল দূরে দাঁড়িয়ে খেয়াল করতেই এগিয়ে আসে, পাশে দাঁড়ায়। কথা না বলে পকেট থেকে রুমাল নিয়ে এগিয়ে দেয়। পুষ্প তাকাল। ফোলা নেত্রযূগল ইকবালকে কষ্ট দেয়। অনুরোধ করল,
‘ কেঁ*দোনা প্লিজ! ‘
পুষ্প আশেপাশে তাকাল। ইকবাল বলল,
‘ ভয় পেওনা। ধূসর, তোমার বাবা, কেউই নেই এখানে।
পুষ্প আস্বস্ত হলো। মাথা নামিয়ে বলল,
‘ বর্ষা আমার মামাতো বোন কম,বন্ধু বেশি। আর দেখা হবে না ওর সাথে। ‘
‘ কে বলেছে হবেনা? আল্লাহ চাইলে সব হয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এভাবে কা*ন্নাকা*টি করা ঠিক হচ্ছে? ‘
‘ তুমি বুঝবেনা।’
ইকবাল বলল ‘ আমি হয়ত বুঝবনা। কিন্তু তোমাকে কাঁদ*তে দেখলে যে আরও একটা মানুষের বুকে ব্য*থা হয় সেটুকু তো বোঝো! তাও কাঁ*দছো কেন? তোমার সুন্দর চোখে যে অশ্রু মানায়না পুষ্পরানি। ‘
পুষ্প চোখ তুলল। ক*ষ্টে বুক ভারী হচ্ছে খুব। সামনের মানুষ টাকে একবার জড়িয়ে ধরার বেহায়া প্রয়াস জাগল মনে। পরমুহূর্তে পিছিয়ে নিলো ইচ্ছেদের। ইকবাল রুমাল ইশারা করল ‘ নাও।’
পুষ্প নিলো। চোখে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছতে গেল আগে,অথচ বাঁধ সাধল ইকবাল। বলল,
‘ কাজল থাক। শুধু চোখের পানিটুকু মোছো।’
পুষ্প বুঝতে না পেরে বলল ‘ কেন?’
ইকবাল হাসল একটু। নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার কাজল কালো নয়নমনি,সে যে আমার হৃদয়হরনী।’
পুষ্পর বুক ধ্বক করে ওঠে। বিস্ফো*রিত নজরে আশপাশ দেখে চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ কেউ শুনে ফেলবে!’
‘ শুনবেনা, তোমার বাপ- চাচা- ভাই সব মেইন রাস্তার দিকে গিয়েছে। আপাতত যারা আছে,তারা আমাদের সন্দেহ করবেনা আশা করি।’
পুষ্প বলল না কিছু। সে আবার বলল,
‘ কিন্তু বর্ষার বর ওরকম আনরোমান্টিক কেন? কেমন গাধা টাইপের!’
পুষ্প হতভম্ব হয়ে বলল ‘ সে আবার তোমাকে কী করল?’
‘ আমাকে কী করবে? ওই যে দেখলেনা,বর্ষা অজ্ঞান হয়ে গেল, আর তোমার মামা নিয়ে গেল ধরে ধরে!’
‘ তো এতে সমস্যা কী?’
‘ সমস্যা কী মানে? আরে ওর বউ, অজ্ঞান হলো,ও তাকে কোলে তুলল না কেন?’
পুষ্প ভ্রুঁ কপালে উঠিয়ে বলল ‘ কোলে তুলবে? অত মানুষের মধ্যে? সভাপতি মশাই,এটা গ্রাম,এখানে একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা পর্যন্ত বলেনা। আর সেখানে বউকে কোলে ওঠানো বোঝো?’
ইকবাল মন দিয়ে পুরো কথা শুনল। পুষ্প থামতেই ফিচেল কণ্ঠে বলল
‘ আমাদের বিয়ের দিন,আমি কিন্তু কোনও কিছু মানবনা। সোজা কোলে তুলে নেব,তাতে অজ্ঞান হও বা না হও।’
পুষ্প লতিয়ে পরে কুণ্ঠায়। আই-ঢাই করে বলে ‘ তুমি থামবে ইকবাল? কীসের মধ্যে কী ঢোকাচ্ছে, উফ!’
‘আরে আমিত….’
পথিমধ্যে ইকবাল কথা থামাল। চেয়ে রইল সামনে। পুষ্প তার চোখ অনুসরন করে পেছনে তাকায়। সাদিফকে আসতে দেখে ভ*য় পেল। আত*ঙ্কিত চেহারা দেখে ইকবাল বিড়বিড় করে বলল,
‘ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো মাই লাভ,ছোটাছুটি করলে সমন্ধি বাবু সন্দেহ করবে।’
সাদিফ এলো। দীর্ঘ হেসে ইকবাল কে বলল,
‘ আরে ইকবাল ভাই আপনি কখন এলেন? দেখলামই না।’
বলতে বলতে ডান হাতটাও এগিয়ে দিলো সে। ইকবাল হাত মিলিয়ে বলল,
‘ এইত ভাইয়া কিছুক্ষন হবে। তোমার কী খবর?’
‘ চলছে ভালোই। ‘
‘ জব নিয়েছো শুনলাম?’
‘ হ্যাঁ নিয়েছি একটা। এত্ত প্রেশার কাজের! এই যে ছুটি পেলাম তাই ভাগ্য!’
‘ সব কাজেই ভীষণ চাপ। আমাকেই দেখো। তবে ভাই ধূসর যে কী করে দুদিক সামলায় কে জানে!’
সাদিফ দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল,
‘ আর বলবেন না! ভাইয়া হচ্ছে লিজেন্ড!’
ওদের কথার মধ্যেই পুষ্প মিনমিন করে বলল ‘
‘ তোমরা গল্প করো ভাইয়া,আমি আসি?’
বলতে দেরী,তবে প্রস্থানে দেরী হলোনা। সে লম্বা লম্বা কদম ফেলে বাড়ির দিকে এগোলো। এক কথায় সাদিফের সন্দেহ থেকে নিশ্চিত করল নিরাপত্তা। ওরা দুজন মশগুল হলো গল্পে। সাদিফ প্রস্তাব রাখল,
‘ চলুন ভাই, আপনাকে বাজারটা ঘুরিয়ে আনি।’
‘ বাজার?’
‘ হ্যাঁ, এখানকার বাজারটা একদম ইউনিক। আমিত গ্রামে এলাম প্রথম বার। ভালো লেগেছে। বাজারের পাশে আবার একটা বিরাট নদী। পরশু দেখলাম একজন নদী থেকে জ্যান্ত মাছ তুলেই বিক্রি করে ফেলল।’
‘ ইন্টারেস্টিং তো। চলো তাহলে দেখে আসি।’
দুজন হেঁটে হেঁটে গেইট পার হয়। সাদিফ হঠাৎ শুধাল,
‘ আপনি সিগারেট খান ইকবাল ভাই?’
ইকবাল চমকাল। চোখ ছোট করে বলল
‘ কেন বলোতো?’
‘ স্মেল পাচ্ছি।’
ইকবাল জ্বিভ কে*টে, লজ্জিত কণ্ঠে বলল
‘ চলে একটু আকটু। তুমি খাও?’
‘ না না। আমি মেয়েদের মত গন্ধও নিতে পারিনা। হা হা হা।’
সাদিফ হেসে উঠলেও ইকবাল পড়ে গেল চিন্তায়। বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়ির লোক তার বদভ্যেস সম্পর্কে জেনে গেল। এখন মেয়ে দিতে গাঁইগুঁই করবে নাতো?
****
পিউয়ের নিঃ*শ্বাস আটকে আছে। শ্বাসনালীতে তুফান। অক্ষিপল্লব কাঁ*পছে তিরতির করে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখের সামনে পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে থেমেছে। পা আটকেছে জমিনে। একটু নড়ার শক্তি যেন নেই। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সম্মুখে। মারিয়া কাঁ*দছে। অল্প স্বল্প আসছে তার কা*ন্নার শব্দ। মাথাটা ঠেকিয়ে ধূসরের কোমড়ে। আর তার দুইহাত পেচিয়ে রাখা সেই-সমস্ত জায়গা জুড়ে। পিউয়ের মস্তিষ্কর প্রতিটি নিউরন কেঁ*পে ওঠে। বোধবুদ্ধি সবটা এলোমেলো। স্তব্ধ সে কথা বলতে ভুলে গিয়েছে।
আচমকা ধূসরের চোখ পড়ল এ দিকে। শিথিল ভ্রুঁ গুছিয়ে এলো এক জায়গায়। অথচ সাবলীলতা পাল্টাল না, এক বিন্দুও না। মারিয়ার মাথার ওপরে রাখা হাতটা অবধি সরাল না সে। চেষ্টাও করল না দুরুত্ব বাড়ানোর। সে অটল দাঁড়িয়ে, অবিচল তার অক্ষিপট। একদম তীরের মত সূচাল দৃষ্টিতে দেখছে পিউয়ের মুখ। চিবুক শ*ক্ত,তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পিউ তখনও হা করে তাকিয়ে। তার মাথা ফাঁকা। ইতিবাচক, নেতিবাচক কোনও ভাবনাই হাতড়ে পাচ্ছেনা ভেতরে।
মারিয়া কেঁ*দে কেঁ*দে হঠাৎ চোখ খুলল। চৌকাঠে দুটো পা দেখে মুখ বরাবর তাকাল। পিউকে দেখতেই তার কা*ন্না শেষ। ধূসরকে ধরে আছে সে,কথাটা খেয়াল হতেই তড়িৎ বেগে সরে গেল।
ধূসর শ*ক্ত পাথর তখনও। ঠান্ডা দৃষ্টি ঘুরছে পিউয়েতেই। মারিয়া অস্থির ভঙিতে চেয়ার রেখে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ মুছে হাসার প্রচেষ্টা করে। সহজ গলায় বলল ‘ ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন পিউ? ‘
সম্বিৎ ফিরল মেয়েটার।
ধ্যানমুক্ত হলো। ধূসরের তামাটে মুখ থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল মারিয়ার দিকে। টু শব্দ করলনা,নড়লওনা। মারিয়া চিন্তিত ভঙিতে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। পিউয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই এগিয়ে গেল ওর দিকে। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ বর্ষা চলে যাওয়ায় এত ক*ষ্ট হচ্ছিল, ধূসর ভাইকে পেয়ে সব কা*ন্না উগলে দিয়েছি। ‘
পিউয়ের মুখভঙ্গির বদল হলোনা। শান্ত লোঁচনে পর্যবেক্ষণ করল তাকে,একবার ধূসরকে। পরমুহূর্তে নীচের দিক চেয়ে দূর্বোধ্য ক্ষীন হাসল। কাউকে কিছু না বলেই পা বাড়াল সামনে। নিশ্চুপ ভাবে সিড়ি বেয়ে উঠে গেল।
মারিয়া আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। তার মস্তিষ্কে ঢুকল না পিউয়ের অভিব্যক্তি। উদ্বিগ্ন হয়ে ধূসরকে বলক,
‘ এখন কী হবে ভাইয়া? পিউ ভুল বুঝলে? আমি বরং একবার ওর কাছে যাই।’
ধূসরের পাথুরে হাবভাব অপরিবর্তিত । সে সটান দাঁড়িয়ে তখনও। কথাটায় নিরেট চাউনীতে একবার ওপরের দিক তাকাল। মারিয়া যেতে নিলে বাঁ*ধা দিয়ে বলল,
‘ দরকার নেই। আমিও দেখি, তার বিশ্বাসের দৌড় কতটা!’
****
আজকের রাত নিস্তব্ধ,নির্জীব। গতকালের হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকা মজুমদার বাড়ির একাংশও নেই। মৈত্রী ঘরে বসে,মারিয়া-পুষ্পও নির্লিপ্ত। শান্তা-সুপ্তি কেউ-ই নেই বাড়িতে। পিউ শুয়ে আছে বিছানায়। তার চোখমুখ গম্ভীর, অন্তঃপুর আষাঢ়ে ছেঁয়ে। সেই যে ওপরে উঠেছিল,এখন অবধি নামেনি। দেখাও হয়নি ধূসরের সঙ্গে। লোকটা এত গুলো ঘন্টায় খোঁজ পর্যন্ত নিলোনা তার। পিউয়ের বুক ভাঙ*ল দুঃ*খে। বেরিয়ে এলো খণ্ড খণ্ড দীর্ঘশ্বাস।
তার গভীর ভাবনার সুতো ছিড়ল সাদিফের হাঁক শুনে। ওর নাম ধরে ডাকছে সে। পিউ উঠে পরল শোয়া থেকে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও রুম থেকে বের হলো। নীচে এসে পেলো মারিয়া,পুষ্প,রাদিফ আর রিক্তকে। নিরব দৃষ্টি বোলাল আশেপাশে। মনে মনে খুঁজল একটি কাঙ্ক্ষিত মুখ। প্রশ্ন জাগল ‘ মানুষটা কোথায়?’
সাদিফ প্রশ্ন করল ‘ কই ছিলিস?’
পিউ ছোট করে জানায়,
‘ ঘরে।’
সাদিফ কোকের বোতল এগিয়ে দিলো,
‘ নে।’
পিউ চকচকে বোতলের দিক দেখল একবার। পরপর খেয়াল পরল মেঝেতে কার্টুন ভর্তি কোকের বোতল। অবাক হয়ে বলল,
‘ এত কোক?’
‘ ট্রিট দিচ্ছি সবাইকে।’
‘ হঠাৎ? ‘
‘ ভাবলাম দুপুরে এত হেবিই খাবার খেল,এখন হজমে সুবিধা হবে। তুই প্রশ্ন না করে ধর।’
পিউ হাতে নিলো। কাঁচের বোতলের ছিপি গুলো বড্ড শ*ক্ত থাকে। হাত দিয়ে খোলা যায়না বিধায় সাদিফ আগেই খুলে রেখেছিল। পিউয়ের আর ক*ষ্ট করতে হলোনা।
সাদিফ প্রথমে বোতল গুনল,তারপর মানুষ। একজন মিসিং সেখানে। অনেকক্ষন ভেবে বার করল মৈত্রী অনুপস্থিত। সাদিফ চাইল ডাকবেনা ,কিন্তু হার মানল সৌজন্যেবোধের কাছে। সে পুষ্পকে বলল ‘ মৈত্রী আছেনা? ওনাকে ডেকে তো। ‘
পুষ্প অত শত জানেনা। বলা মাত্র বসে থেকেই উচু কণ্ঠে ডাক ছুড়ল। সাথে যোগ করল ‘ সাদিফ ভাইয়া ডাকছেন।’
সাদিফ বিরক্তিতে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করল। ওইটুকু কি বলতে বলেছে ওকে?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মৈত্রীকে নামতে দেখে। নিমিষে ব্যস্ততা দেখাল কাজে। মৈত্রী অবাক হয়েছে। চোখেমুখে লেপ্টে বিস্ময়। সাদিফ ডাকবে তাকে?
ওকে দেখতেই পিউয়ের কালো মুখ আর কয়েক ধাপ কালো হয়। দুপুরের কথা মনে পড়ে। মেয়েটা কী ক*ষ্টই না পেয়েছে,আহারে!
মৈত্রী এসে দাঁড়াতেই সাদিফ একইরকম বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল ‘ নিন,আমার তরফ থেকে ছোট্ট ট্রিট।’
মৈত্রী তার দিক চেয়ে থেকেই হাত বাড়াল। এত কাছ থেকে সাদিফের সাদাটে মুখ দেখার সুযোগ পেল আরেকবার। এই সুযোগের সমাপ্তি এখানেই। কালই তো চলে যাবে সবাই। হয়ত এটাই শেষ দেখা। আর কোনও দিন মুখোমুখি হবেনা দুজন। তার প্রথম প্রেম রয়ে যাবে আড়ালে,অগোচরে। কেউ জানবেনা, টের পাবেনা ঘুনাক্ষরেও। মৈত্রীর আক্ষেপ হলো ভীষণ। এই মানুষটা তার হলে খুব কী ক্ষ*তি হতো?
সাদিফ আর একবারও ফিরল না। ঘুরে তাকে দেখল অবধি না।
কাজে লেগে পরল। বোতল পরিবেশনে ব্যস্ত হলো। পুষ্পকে দেয়ার সময় বলল,
‘ ছিপি খুলেই দিয়েছি। তোর ক*ষ্ট করে টানাটানি করতে হবেনা।’
মেয়েটা গদগদ হয়ে বলল ‘ থ্যাংকিউ।’
অন্যান্য সময় পিউ খুশি হয় এসব দেখে। কিন্তু এখন একটুও ভালো লাগেনি। সে ব্য*থাতুর নয়নে মৈত্রীকে দেখল। মেয়েটার চেহারার পরতে পরতে বিষ*ন্নতা। এই ঘটনায় যেটুকু প্রকট হয়েছে আরো।
মারিয়া এতক্ষন এসব দেখেও না দেখার ভাণ করছিল। সে মুখ ঘুরিয়ে চেয়েছিল টেলিভিশনের দিকে। সাদিফকে তার সহ্য হয়না,ওর কাজবাজ তো আরও না। ভেবেছিল ও অবধি আসবেনা ছেলেটা। অথচ সাদিফ নির্দ্বিধায় তার দিকে বোতল ধরে বলল,
‘ এটা আপনার জন্যে।’
তার অত্যধিক সুনম্র আওয়াজ, মারিয়া এই প্রথম শুনেছে। সে সন্দেহী চোখে ফিরে তাকায়। সাদিফ চমৎকার হেসে বলল,
‘ না করবেন না। ঝগ*ড়ার জায়গায় ঝ*গড়া। ট্রিটের জায়গায় ট্রিট। এটা আনন্দ,আর আনন্দে সবার ভাগীদার হওয়া উচিত।’
গোছানো, মার্জিত কথাবার্তায় মারিয়ার মেজাজ শান্ত হয়। না করল না, নিয়ে নিল। মনে মনে ভাবল ‘লোকটা ভদ্র আছে। ‘
এই বোতলের ছিপিটাও খোলা। সবারটাই খুলে রেখেছে তাহলে ? মারিয়া আগেপিছু না ভেবে চুমুক বসাল। সাদিফ পরিবেশনের ফাঁকে আড়চোখে একবার দেখে নিল তাকে। সামনে ফিরে রহস্য হাসল। মনে মনে বলল,
‘ খান মিস ম্যালেরিয়া,ভালো করে খান। একটু পরেই টের পাবেন সাদিফ কি জিনিস!’
এর মধ্যে মুত্তালিব,আনিস,ইকবাল আর ধূসরের প্রবেশ ঘটল বাড়িতে। চারজন কথা বলতে বলতে ঢুকলেন। বসার ঘরে ছোটদের ভিড় দেখে মুত্তালিব আর আনিস বসলেন না। নিজেদের মত ঘরে চললেন। ইকবাল এসেই বলল,
‘ কী ব্যাপার! কী চলছে এখানে?’
সাদিফ বলল,
‘ কোক ট্রিট!’
‘ আমরাও পাব না কি? ‘
‘ অবশ্যই।’
ধূসরের চক্ষুদ্বয় পিউতে নিবদ্ধ। তার সুচ্যগ্র চাউনী পরোখ করছে ওর ছোট্ট-খাট্টো আদোল। পিউ বসতে যাচ্ছিল পুষ্পর পাশে। ধূসরকে দেখে আর বসেনি। একবার তাকাওনি। কোক হাতে ধরেই চুপচাপ পা বাড়াল ঘরের দিকে। সাদিফ শুধাল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ ভালো লাগছেনা,শোব।’
‘ আচ্ছা যা।’
পিউয়ের প্রস্থান দেখে ধূসর দাঁত পি*ষে ধরলো,রা*গ হলো। মারিয়ার নির্গত হলো অসহায় শ্বাস। পিউ কি উল্টোপাল্টা ভেবেছে? মেয়েটা এত নিস্তব্ধ হয়ে পরল কেন? তার নিজের প্রতিই বিরক্ত লাগল,কেন যে হুশ খুইয়ে ধূসরকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিল?
এখানে তারই বা দোষ কোথায়? রওনাক মা*রা যাওয়ার পর থেকে এই ধূসর,ইকবাল এরাইত পাশে ছিল। বড় ভাইয়ের মত সাহারা দিয়েছে সব সময়। প্রতি সপ্তাহে পার্লামেন্ট থেকে চাঁদা ওঠাত ওরা।লোক দিয়ে বাজার করিয়ে পৌঁছে দিত বাড়িতে।
সাদিফের কোক নিলোনা ধূসর। ‘ ভালো লাগছেনা ‘বলে চলে গেল ঘরে।
মারিয়ার মনঃস্তা*প দ্বিগুন হলো এতে। সে আফসোস,আর অনুশোচনায় নিঃশে*ষ হয়ে যাচ্ছে। সে যখন হাবুডু*বু খাচ্ছিল ক্ষুন্ন*তায়,
আচমকা পেট মুচড়ে উঠল। ভেতরে সব দোল খাচ্ছে যেন। মারিয়া তটস্থ হয়ে বসল। মোচ*ড়ানো বাড়ছে ধীরে ধীরে। সে ভ্রুঁ কুঁচকে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করল। প্রাকৃতিক বেগ টের পেতেই আধ-খাওয়া কোক রেখে দিল। দ্রুত পায়ে চলল ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে। সাদিফ কী বুঝল কে জানে! তার যাওয়ার দিক চেয়ে চেয়ে ক্রু*র হাসল সে।
মারিয়া সেই যে ওয়াশরুম যাওয়া শুরু করেছে, শেষ হওয়ার নাম নেই। ছুটতে ছুটতে দুরাবস্থা তার। এসে বসতেও পারছেনা,আবার দৌড়াচ্ছে সাথে সাথে। টানা এক ঘন্টায় কয়েকবার চলল এমন। শরীর নেতিয়ে গেল অথচ পেট কাম*ড়াচ্ছে তখনও। শেষমেষ বিধ্ব*স্ত হয়ে লতিয়ে পরল বিছানায়। হাঁটার শক্তিটুকুও নেই। পুষ্প ঘরে ঢুকে এই অবস্থা দেখেই ত্রস্ত গেল রাশিদকে জানাতে। ওনার তলবে ওই রাতেই এলাকার অভিজ্ঞ ডাক্তার এসে দেখে গেলেন মারিয়াকে। একটা বড় স্যালাইন পু*শ হলো তার শরীরে। প্রত্যেকের খা*রাপ লাগল মারিয়ার অবস্থায়। অথচ সাদিফ পেল পৈ*শাচিক আনন্দ। সকলে ধারনা করল, বিয়ে বাড়ির খাবার দাবারের জন্যেই হয়ত এরকম হলো। একমাত্র সাদিফ সত্যিটা সম্পর্কে অবগত ছিল! তার অধর জুড়ে বক্র হাসি খেলছে। কোকের ট্রিটতো ছিল কেবলই ছুঁতো। নাটক ছিল মারিয়ার সাথে করা সুন্দর আচরন টাও। এর আঁড়ালের আসল উদ্দেশ্য পূরন হয়েছে তার। নিজেকে করা শপথ রাখল তাহলে! ঠিক যেইভাবে মেয়েটা তাকে বিচুটি পাতা দিয়ে নাজেহাল করেছিল, সুদ সমেত ফিরিয়ে দিল সেও । এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়?
সকলের চিন্তিত মুখের ভিড়ে সাদিফ হেলেদুলে বেরিয়ে গেল।
আস্তেধীরে মারিয়ার অবস্থা স্বাভাবিক হয়। একে একে ঘর ছাড়ল বাকীরাও। শুধু পুষ্প-পিউ রয়ে গেল কাছে,ওরা আজ এখানেই শোবে।
***
সেই রাত বিদ্যুৎ বেগে কা*টল। যেন রাত নামতে না নামতেই পলক ফেলার পূর্বে চলে এলো ভোর। উঠল নতুন সূর্য।
কমতে থাকল অতিথিদের ভীড়। সকাল হতে না হতেই সবার আগে বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে নামল মৈত্রীরা। বিদায় নিতে যখন পিউয়ের কাছে গেল, সেই এক ফোঁটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এলো তার। সাদিফ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে মেয়েটা। আরো কিছু সময় লোকটাকে চোখের সামনে রেখে পরিতাপ বাড়ানোর ইচ্ছে হয়নি। যেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই,সেখানে যে মায়া কাটাতে শিখতে হয়!
****
মারিয়া ফিরবে না আজ। বর্ষা বৌভাত কাটিয়ে এলে এক্কেবারে ওর সাথে দেখা করেই যাবে। নাহলে একবার ঢাকামুখী হলে কবে দেখা হবে কে জানে! এবারইত সাক্ষাৎ হলো দীর্ঘ দুই বছর পরে। সে ছাড়াও অনেকেই রয়ে যাচ্ছে। যাদের কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা জোড়াল, রওনা করবেন তারাই। সেই দলে পরেছে সিকদাররাও। আজ আঠাশ তারিখ, আগামী মাসের দুই তারিখ থেকে পিউয়ের টেস্ট পরীক্ষা শুরু। ওদিকে বাড়ির ব্যবসা,আনিস -সাদিফের চাকরী, বাচ্চাদের স্কুল সবই রয়েছে।
রাশিদ -ময়মুনার শুকনো চেহারা আরও শুকিয়েছে। ভদ্রমহিলা কাল থেকে কেঁ*দেকে*টে কাহিল। চোখমুখ ফোলা,গলা বসে গেছে। শরীরটাও দূর্বল। অথচ তাও গেটে এলো সবাইকে বিদায় দিতে। আত্মীয় স্বজন একে একে চলে যাচ্ছে,বাড়ি হচ্ছে ফাঁকা। মেয়েটাও নেই। কেমন খাঁ খাঁ করছে সব। রাশিদ শেষ বার আমজাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘ আর কদিন থাকা যায়না দুলাভাই?’
আমজাদ বললেন,
‘ না রাশিদ। বোঝোইত,পারলে কী এত বলতে হতো বলো?’
‘ আবার আসবেন কবে?’
‘ আল্লাহ বাঁচালে খুব শীঘ্রই। তোমরা যাবে কিন্তু… ‘
‘ ইনশাআল্লাহ। ‘
কাছের মানুষ সবাই ভিড় করেছে দরজায়। তিন গাড়ি ভর্তি করে রওনা করবেন সিকদার পরিবার। মারিয়াও আছে এখানে। শরীর মোটামুটি ভালো এখন। হঠাৎ সাদিফ পাশে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনার শরীর এখন কেমন মিস ম্যালেরিয়া?’
সম্বোধন শুনে চোখ গোছাল সে। তবে জবাব দেয়,’ভালো।’
সাদিফকে ওষ্ঠ বেঁকে হাসতে দেখে বলল
‘ হাসছেন কেন?’
‘ এমনিই।’
মারিয়া ভ্রুঁ কুঁচকে রেখেই সামনে তাকায়। চেহারায় অল্প স্বল্প বির*ক্তি। আচমকা সাদিফের মুখটা কানের পাশে চলে এলো। ফিসফিসে কণ্ঠে বলল,
‘ বিচুটিপাতার চেয়েও জোলাপের ক্ষমতা বেশি সাংঘা*তিক। কাল রাতে প্রমাণ পেয়েছেন ? আশা তো করছি আমার সঙ্গে লড়া*ইয়ের সব জোর আপনার ওয়াশরুমেই চলে গেছে। এখনও সময় আছে ম্যালেরিয়া,ভালো হতে কিন্তু পয়সা লাগেনা। ‘
মারিয়া হতভম্ব হয়ে তাকাল।
সাদিফ আবার বলল,
‘ যদি এতেও কাজ না হয়,তবে জানাবেন,জোলাপের চেয়েও ভালো ভালো আইডিয়া আছে আমার মাথায়। সূযোগ পেলে সেটারও সদ্ব্যবহার করব। কেমন? ‘
মারিয়া বিস্ময়াহত হয়ে বলল ‘ তার মানে আপনি…’
সাদিফ কথা কে*ড়ে নেয় মাঝপথে। অকপট স্বীকারোক্তি দেয়, ‘ ইয়াপ। যা ভাবছেন তাই। আমিই সে যার জন্যে মাঝরাতে আপনার স্যালাইন নিতে হয়েছে।’
মারিয়া বিমুঢ় নেত্রে চেয়ে রইল। সাদিফ পাত্তাই দেখালোনা তাতে। শীষ বাজিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। মারিয়া রা*গে কিড়*মিড় করে গা*লি দিল। সাথে বিড়বিড় করল ‘ অমা*নুষ কোথাকারে!’
****
ইকবাল গাড়ি নিয়ে আগেভাগে তৈরী । গতকাল রেখে এসেছিল মেইন রোডের একটা দোকানের সামনে। ভেবেছিল,গ্রামের রাস্তা, সরু হলে? বিপদ হবে। কিন্তু ভেতরেও পিচ ঢালাই করা থাকবে বোঝেনি। পরে গিয়ে নিয়ে এলো তাই। তার ইচ্ছে আজকেও চারজন মিলে যাবে। পুষ্প,পিউ,ধূসর আর সে। ঠিক ওই উচ্ছ্বল দিনটার মতোন। যেদিন পিউ কুকুরের দৌড়ানি খেল! দৃশ্যটা মনে পড়তেই ইকবাল ফিক করে হেসে ফেলল। পরপর সিরিয়াস হলো। পিউ জানলে দুঃ*খে কথাই বলবেনা। কেঁ*দেও ফেলতে পারে! আর পুষ্প? সেতো তেলে-বেগুনে জ্ব*লে বলবে ‘ ছি ইকবাল! আমার বোনকে নিয়ে তুমি হাসছো?
রইল বাকী ধূসর। সে ব্যাটা জানলে ঘু*ষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবে তার। বলবে….
কথাটুকু আর ভাবল না ইকবাল। দেয়ালের ও কান আছে। মনের কথা শুনে ফেলতে পারে। আর সে যখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তখন বো*মা মার*লেও কথা বের হবে না।
ইকবাল ড্রাইভিং সিটে বসে পা নাড়াচ্ছে। একটু পরপর চারপাশে দেখছে। ধূসর আর পিউ এই গাড়িতে আসবে কনফার্ম। কারণ, ধূসর যেখানে পিউও সেখানে। কিন্তু তার পুষ্পরানি? সে কোথায়? ইকবাল এপাশের জানলায় এসে উঁকি দিল। পুষ্প কাঁধব্যাগ নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা দোটানায় পরেছে, কোন গাড়িতে উঠবে সেই নিয়ে। মন তো চাইছে অনেক কিছু। সে ইকবালের কোলে বসে যেতেও প্রস্তুত। কিন্তু ওর গাড়িতে উঠলেই যদি কেউ সন্দেহ করে,তখন ?
ইকবালের দিক চোখ পড়তেই ও ইশারা করল আসতে। পুষ্প ঠোঁট উলটে দাঁড়িয়ে থাকল তাও। কী করবে, কী করবেনা মনঃদ্বিধায় ভুগল। তখন ধূসর তৈরী হয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। হাতা গোটাতে গোটাতে পাশ থেকে যাওয়ার সময় বলল,
‘ পিউকে নিয়ে ইকবালের গাড়িতে ওঠ। ‘
মুহুর্ত মধ্যে, পুষ্প খুশি হয়ে গেল। সব গুলো দাঁত ঠোঁটগহ্বর থেকে বেরিয়ে এলো। ধূসরের প্রতি মনে মনে হলো কৃতজ্ঞ। তারপর স্ফূর্ত নজরে খুঁজল পিউকে।
সেদিন আসার সময় মিনা বেগম হাজার বলে কয়েও যে মেয়েকে পাশে বসাতে পারলেন না, আজ সে-ই যেঁচে পাশ ঘেঁষে বসে গেল তার। মিনা বেগম অবাক হলেন একটু। নিশ্চিত হতে শুধালেন,
‘ তুই এই গাড়িতে যাবি?’
পিউয়ের সংক্ষিপ্ত জবাব ‘ হু।’
আর কোনও কথা নেই। সে মনম*রা হয়ে জানলা দিয়ে তাকাল রাশিদদের তিনতলা দালানের দিকে। শেষ চারটে দিন স্বপ্নের মত কেটেছে এখানে। তার সতের বছরের জীবনে, শ্রেষ্ঠ মুহুর্তটাও এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বন্দী।” ধূসর ভাইয়ের প্রথম স্পর্শ”! পিউ এক ধ্যানে পুরো বাড়িটা নিরীক্ষন করে আওড়াল,
‘ নানুবাড়ি! আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।’
সুস্থির ভঙিতে ওপর থেকে নীচের দিকে চোখ আনতেই বিঁধল মারিয়া। সে দাঁড়িয়ে একপাশে। সাথে ময়মুনারাও রয়েছেন। সবাই মিলে বিদায় জানাচ্ছেন ওদের। রুবায়দা বেগম ব্যাগ নিয়ে বের হলেন সবার শেষে। ভদ্রমহিলা চটপটে কম। ওনার তৈরি হতে বরাবর দেরি হয়। আজও হলো। গাড়ির দিক যেতে নিয়েও তিনি মারিয়াকে দেখে দাঁড়ালেন। হাসলেন দীর্ঘ। ওনার নির্মল হাসিটা দেখতেই সাদিফের প্রতি রা*গটা টুপ করে পরে গেল মারিয়ার। উত্তরে সেও হাসে। এগিয়ে গেল কাছে । রুবায়দা বললেন,
” চলে যাচ্ছি,সাবধানে থেকো।’
মারিয়া ওনার এক হাত ধরে বলল,
‘ আন্টি এভাবে বলবেন না,আমার খা*রাপ লাগছে। মনে হচ্ছে আর দেখা হবেনা।’
‘ বালাই শাট! হবে না কেন? নিশ্চয়ই হবে। তুমিতো আসছোই ঢাকায়।’
‘ জি।’
‘ বিয়ে বাড়ির এত ঝুট-ঝামে*লার ভেতর তোমার সঙ্গে দুটো কথাও হলো না। আমার কিন্তু তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে,সেই প্রথম দিন থেকেই।’
‘ আমারও আপনাকে ভালো লাগে আন্টি। আসলে,আপনারা সবাই -ই খুব ভালো। ‘
রুবায়দা বেগম সন্তুষ্ট হেসে কোমল চোখে তাকালেন। যবে থেকে মেয়েটির দূর্দ*শা সম্পর্কে জেনেছেন, তখন থেকেই ওর প্রতি প্রবল মায়া কাজ করে। দেখলেই নরম হয় আসে মন । ফুটফুটে মেয়েটা এইটুকু বয়সে কত ক*ষ্টই না করছে! তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ আসি তাহলে? ‘
‘ জ্বি, সাবধানে যাবেন।’
রুবায়দা বেগম এসে গাড়িতে বসল। এতক্ষনের এই সবটা দেখেছে পিউ। শিউলী বেগমের সাথে চোখাচোখি হলে তিনি হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। পিউ মৃদূ হাসল। মনে হলো হাসিটা জোর করে টে*নে বের করল ভেতর থেকে। তক্ষুনি ধূসর হাজির হলো সেখানে। মারিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পিউয়ের সবে সবে জেগে ওঠা হাসি মুছে গেল ওমনি। ধূসর ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল। মারিয়া কথাটা শুনে মুচকি হাসল। ধূসর আরেকবার তার মাথায় হাত রাখে, অনেক কিছু বলে।
পিউয়ের কানে একটা কথাও ঢুকলোনা। সে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। দুজনের ঠোঁট ভর্তি হাসি বিনিময়ের এই আলাপ,ভেতরটায় তূখো*ড় ঝ*ড় বইয়ে দেয়। সে পরপর কতগুলো ঢোক গি*লল। হুট করে চোখ ফিরিয়ে আনল। ব্যস্ত হাতে উঠিয়ে দিল জানলার কাঁচ। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো কয়েকবার। স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের চেয়েও, বুকের ওঠানামার গতি জোড়াল হয়। আবারও যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। শরীর খা*রাপ লাগছে,অশা*ন্ত -অ*স্থির অনুভূতি। পিউ চোখ বুজে মাথাটা এলিয়ে দিল মায়ের কাঁধে। মিনা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
‘ কী হয়েছে?’
পিউ মনে মনে বলল,
‘ ভেতরটা ব্য*থায় ছি*ড়ে যাচ্ছে আম্মু! বুকটা এফোড় ওফোড় হচ্ছে যন্ত্র*নায়। অথচ চোখের কোনে এক ফোঁটা জল ও আসছেনা। এই অসহনীয় পী*ড়া থেকে মুক্তি পাই কী করে?’
অথচ মুখে জানাল ‘ গাড়ি ছাড়তে বলো,খারা*প লাগছে!’
‘ হ্যাঁ বলছি,তুই আয়, আমার কোলে রাখ মাথাটা।’
পিউ তাই করল। যতটুকু সাধ্য কাত হয়ে মায়ের কোলে শুলো। মিনা বেগম বলাতে সিরিয়াল ভে*ঙেই
গাড়ি ছাড়া হয়। সবার আগে ধেঁয়ে চলে সেটা।
ধূসর মারিয়ার সাথে কথা শেষ করে,মুত্তালিবের থেকে বিদায় নিলো। দুজনের মিলেছিল খুব। তিনি মন খা*রাপ করলেন ওর যাওয়া নিয়ে। কিন্তু বাস্তব না মেনে উপায় নেই। সে যে সারাজীবন থাকতেও আসেনি এখানে।
বিদায় পর্ব শেষ করে গাড়ির কাছে এলো ধূসর। সামনের দরজা খুলে উঠতে গিয়ে খেয়াল হলো পিউ নেই। পুষ্পকে শুধাল,
‘ পিউ কোথায়? ‘
পুষ্প ছোট কণ্ঠে বলল ‘ ও বাবার গাড়িতে চলে গেছে।’
ধূসর বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে তাকাল। সে সহ,ইকবালের তাজ্জব দৃষ্টি আছ*ড়ে পরল পুষ্পর ওপর। ধূসর কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ পিউ অন্য গাড়িতে গিয়েছে? তুই নিশ্চিত?’
পুষ্প ঈষৎ বেগে মাথা নাড়ল।
‘ বলিসনি আমি এই গাড়িতে আসতে বলেছি?
‘ বলেছিলাম তো। শোনামাত্র জানিয়ে দিল আসবেনা।’
ধূসর হতবাক,হতচেতন। ইকবাল ও তাই। সব তার মস্তক পার করে চলে যাচ্ছে। ধূসর ডাকল, পিউ আসবেনা? এও সম্ভব?
ধূসরের চেহারায় ঘন আমাব*স্যা নামল। ঘুটঘুটে তিঁমির উঁকি দিল সেথায়। যে মেয়ে ওকে ছাড়া এক পা-ও নড়তে চায়না সে আজ ডাকার পরেও এলোনা?
চলবে…………………
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/somudro/