প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প .
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১৪|
ফাল্গুনের গোধূলি বিকেল। প্রাণচঞ্চল শহরটিতে কপোত-কপোতীদের ঢল। সার্কিট হাউজের নির্জন পথ, পার্কের বিস্তৃত নদীর পাড় সর্বত্রই প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণীর উচ্ছল হুল্লোড়। কোথাও গিটার হাতে বসে থাকা বাউন্ডুলে বন্ধুমহল। কোথাও আবার চায়ের কাপে ডুবে থাকা বেকারদের রাজমহল। বিকেলের মরে আসা রোদে সদ্য প্রেমে পড়া লাজুক কিশোরী মুখ। কোথাও বা মান-অভিমানের সন্ধি চলা দীর্ঘ তর্কভাস। পার্কের মাঝামাঝি ইট বাঁধানো মসৃণ এক বেঞ্চিতে বসে আছি আমি। খোলা চুলগুলো মৃদু হুল্লোড় তুলছে বাতাসে। কোলের উপর পড়ে থাকা ফোনটির দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে থেকে থেকে। মন মেজাজের চূড়ান্ত অসন্তোষ ঘটিয়ে ফোনটা বাজল আরও মিনিট দশেক পর। আমার থেকে হাত পাঁচেক ওপাশে, বেঞ্চিতে বসে থাকা প্রিয়তা প্রায় ফিসফিসিয়েই বলল,
‘ রাগ করেছিস জান?’
মনের বিরক্তিটুকু গিলে ফেলে মৃদু নিঃশ্বাস ফেললাম। কাঠ কাঠ কন্ঠে বললাম,
‘ রাগব কেন? তোদের প্রেম পর্ব শেষ হলে বাসায় ফিরতে পারি? সন্ধ্যা হলো প্রায়!’
প্রিয়তা একটু ইতস্তত করে বলল,
‘ ও না একটু নদীর পাড় ধরে হাঁটার বায়না ধরছে। আবহাওয়াটা কী সুন্দর! রাগ করিস না জান। তুইও চল না আমাদের সাথে।’
শেষ বাক্যটা বেশ উৎসুক্যের সাথে বলল প্রিয়তা। আমার ভেতরটা বিরক্তিতে জ্বলে গেলেও চুপ করে রইলাম। দীর্ঘ অবসন্নতার পর খোলা হাওয়া পেতেই প্রিয়তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম তখন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে। অন্যের প্রেমে পাহারাদারের মতো বসে থাকার মতো অবসন্নতা আর কী কিছু হতে পারে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ তোরা যা। আমি এদিকটাই হাঁটাহাঁটি করব। একা থাকতে ভালো লাগছে।’
আমার উত্তরে প্রিয়তা খুশি হলো নাকি নাখোশ, বুঝা গেল না। তবে থেমে থেমে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
‘ তুই শিওর?’
‘ হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট।’
প্রিয়তা ফোন কাটল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দেখলাম। মরে আসা রোদে প্রিয়তার আরক্ত সুন্দর মুখ। বাতাসে হুল্লোড় তোলা রেশম কেশরাশি। তার পাশেই সুন্দর দেখতে একটি যুবক। প্রিয়তার বর্তমান প্রেমিককে এর আগে কখনো দেখিনি আমি। প্রিয়তার কোনো প্রেমিকের সাথেই ঘটা করে পরিচয় থাকে না আমার। কর্পোরেট পৃথিবীর ভদ্রতাসূচক হাই/হ্যালোও না। তবে এই প্রেমিকটা বোধহয় অন্যরকম। একটু বেশিই লাজুক কী? আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। বুকের ভেতর বসে থাকা শিশু মনটা ঠোঁট উল্টালো। বুকের পাটাতনে পা দুলিয়ে বসে বলল,
‘ এতো এতো বসে থাকা যায়? যা না একটু হেঁটে আয়। কী সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে চারপাশ।’
মনরাজ্ঞীর আবদারটা বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলেও ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম ইটের সরু পথ ধরে। ফেব্রুয়ারীর শেষ। হাওয়ায় হাওয়ায় ঝরে পড়ছে শুকনো পাতার ঝাড়। বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে মুক্তকেশী মাথার উপর। পায়ের নিচে স্তুপ হয়ে থাকা শুকনো পাতা মড়মড় শব্দ তুলছে। ফুসকার দোকানে বসে থাকা উচ্ছল প্রেমিকার হাসির মতোই ছাড়া ছাড়া, সুশ্রী আওয়াজ তার। আমার অপ্রস্তুতভাব কেটে গেল। আশেপাশের মানুষ আমায় দেখছে, কী ভাবছে সকল চিন্তা শুকনো পাতার মতোই উড়ে গেল বহুদূরে। বন্ধনহীন চুলগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে। ঠোঁটের কোণে অকারণ মৃদু হাসি নিয়ে মেঘলা আকাশ, ঝরা পাতা আর ন্যাড়া গাছের ছবি তুলতে তুলতেই এগিয়ে গেলাম কিছুটা। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো গিটারের শব্দ। আমি চোখ ফেরালাম। নদীর পাড়ের দীর্ঘ এক কাঠের বেঞ্চিতে চোখ বোজে গিটার বাজাচ্ছে এক যুবক। তাকে ঘিরে বসে আছে উৎস্যুক বন্ধুমহল। আমি সেদিকটাই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একরকম আনমনা হয়েই আরেকটু দূরের এক বেঞ্চির দিকে চাইতেই অপরিচিত এক চোখে চোখ আটকাল। সেকেন্ডের চোখাচোখিতেই ছেলেটি নির্মল হেসে পাশের কাউকে ইশারা করল। আমি তখনও গোটা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলাম না। অপ্রস্তুত হয়ে জায়গাটা ছেড়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কেউ একজন সম্বোধন ছুঁড়লো,
‘ আরে, নিশু আপু না? কেমন আছো ছোট আপু?’
আমি চমকে চাইলাম। ভালো করে চেয়ে বুঝলাম, এদের কাউকেই আমি চিনি না। ইহজীবনে দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না। বুকের ভেতরটা ঝুপ করেই অস্বস্তির সাগরে ডুবে গেল। আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম। কী বলব, কী করব বুঝতে না পেড়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলাম। এতোগুলো যুবকের উৎসুক দৃষ্টিতে কিছুটা এলোমেলো হয়েই উত্তর দিলাম,
‘ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।’
তারা আমার অপ্রস্তুতভাবটা ধরতে পারল কি-না বুঝা গেল না। আমি জায়গাটা থেকে সরে পড়ব কিনা সেও বুঝতে পারলাম না। মান্ধাতার আমলের ভীষণ স্লো মস্তিষ্ককে সেকেন্ডে প্রশ্ন ছুঁড়লাম, এবার কী করব? গিভ মি আ গুড আন্সার। মস্তিষ্ক ‘গুড আন্সার’ দিলো না। কোনোরকম উত্তর না দিয়ে ঝিম ধরে বসে রইলো। আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। মান্ধাতার আমলের ভীষণ বেয়াদব মস্তিষ্ককে কঠিন কিছু গালি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, কেটে পড়ব। ঠিক সেই সময়টাতেই প্রস্তাব এলো,
‘ আপু, আমাদের সাথে আসো না। এক কাপ চা বড় ভাইয়াদের পক্ষ থেকে।’
আমার গলা শুকিয়ে গেল। এই আট-দশজন যুবকের মাঝে একটি মুখ দেখেই অমীমাংসীত সমীকরণটা পানির মতো সহজ হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হলো। বুকের ভেতরের তীব্র ক্ষোভটা মাথা চাঁড়া দিলো। তবুও মুখে সরল অভিব্যক্তি নিয়ে বললাম,
‘ না ভাইয়া, ঠিক আছে। অন্য কোনোদিন।’
আমার এই প্রত্যাখান খুব আন্তরিকতার সাথেই এড়িয়ে গেল তারা। সরল হেসে বলল,
‘ অন্য কোনোদিন ইকুয়াল টু কোনোদিনই নয়। কোনোদিনই নয় এর থেকে এখনই ভালো নয়? চলে আসো। যত কাপ চা খেতে পারো। ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। আজকের চায়ের বিল দিবে ধ্রুব।’
কথাটা বলেই ধ্রুবর দিকে চাইল সবাই। ঠোঁটের কোণে ইঙ্গিতমূলক হাসি চেপে ফোঁড়ন কাটল,
‘ কী ধ্রুব সাহেব? দিবেন না?’
ধ্রুব একবার চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। গভীর, শান্ত চোখদুটো নিরুত্তর ভাবেই নেমে গেল সেকেন্ড কয়েক পর। কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চুমুক দিলো চায়ের কাপে। ধ্রুবর বন্ধুদের জোরাজুরি এবার মাথায় উঠল। এরা প্রত্যেকেই পরিণত। পরিণত তাদের ব্যবহার। তাদের জোরাজুরির ধরনও ভিন্নরকম। হুট করে প্রত্যাখান করা যায় না। তাদের এই অজস্র বিনয় যে কেবল ধ্রুবর জন্যই তা বুঝা গেলেও সরাসরি ধ্রুবময় সম্বোধন না টানায় প্রতিবাদ করা যায় না। আবিরের মতো হুটহাট ‘ভাবী’ নয়। একদম মাপা মাপা তাদের সম্বোধন। তাদের এই পীড়াপীড়িতে হার মানতে বাধ্য হলাম আমি। তিনটা বেঞ্চি দখল করে বসে থাকা ছেলেদের একটা বেঞ্চি ফাঁকা হয়ে গেল ফটাফট। একটু দূর থেকে আরেকটা বেঞ্চি তুলে এনে তাতে চেপে বসল বাকি ক’জন।
গোটা বেঞ্চিতে ধ্রুবকে একা, একলা, অসহায় করে দিয়ে তারা আমাকে ঠিক তার পাশটিতে বসারই অদৃশ্য আহ্বান জানালো। ধ্রুব ফাঁকা বেঞ্চিটির এক কোণায় চুপচাপ বসে থেকে চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। তার শান্ত, গভীর দৃষ্টিতে শিরশির করে উঠল দেহ। বুকের ভেতরটাই উথাল পাথাল ঢেউ উঠলো। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ অনুভূতিতে দমবন্ধ হয়ে এলো। আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চির আরেক কোণায় বসলাম। দুজনের মাঝখানে প্রায় হাত তিনেক ব্যবধান। এতটুকু সময়ে ধ্রুব টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। তার বন্ধুরা আমাদের এই অসম দূরত্ব নিয়ে আকার ইঙ্গিতে প্রাণঢালা মজা লুটলো। আমি অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেলেও ধ্রুব নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো একের পর এক। প্রায় মিনিট দশেক পর অস্বস্তিতে হাঁপিয়ে উঠেই প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম আমি। ফোন ধরতেই নিচু কন্ঠে বললাম,
‘ কোথায় তুই? আকাশে মেঘ করেছে। সন্ধ্যা নামলো বলে। বাসায় ফিরবি না?’
প্রিয়তা তার থেকেও নিচু কন্ঠে বলল,
‘ দোস্ত! প্লীজ রাগ করিস না! দিস ইজ দ্য লাস্ট টাইম। আরেকটু পরে যাই? ও আমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। প্লীজ! প্লীজ!’
বিরক্তিতে মাথা ধরে গেল আমার। তেতো হয়ে উঠল কন্ঠনালী। বিরক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ তুই থাক তবে, আমি চলে যাই।’
প্রিয়তা অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ রাগ করলি?’
‘ রাগ করিনি। আমার ভালো লাগছে না। ফিরে যাচ্ছি। তুই কাজ শেষে ফিরে আসিস। সমস্যা নেই।’
ফোন কেটে চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে পাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বিব্রত কন্ঠে বললাম,
‘ আমি আসছি। আমার বন্ধু অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফিরতে হবে।’
সবাই এক পলক ধ্রুবর দিকে চেয়ে থেকে আমায় বিদায় দিলো। ধ্রুব তখনও নির্বিকার, নিরুত্তর। সেখান থেকে সরে এসে যেন শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম আমি। ধরফর করতে থাকা বুকের উপর হাত রেখে বুঝতে পারলাম বুকের সাথে সাথে হাতটাও কাঁপছে। পা’টাও কাঁপছে কী? আকাশে তখন খুব মেঘ। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। প্রিয়তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় বিরক্ত হয়ে পার্কের গেইট পর্যন্ত আসতেই মনে পড়লো, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পার্স আনা হয়নি। কী সাংঘাতিক! এই সন্ধ্যায় হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে নাকি? কপালে চিন্তার ভাঁজটা আরও একটু দৃঢ় করতেই যেন আচমকা আষাঢ়ের মতো ঝমঝমিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। পায়ের জোরটা বাড়িয়ে, অনেকটা দৌঁড়েই সার্কিট হাউজের পাশে একটি ছাউনির নিচে দাঁড়ালাম। কাঁধ ও চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম। একবার, দুইবার, তিনবারের মাথাতেও লাইন পাওয়া গেল না। আমার চিন্তা গাঢ় হলো। আধঘন্টার ব্যবধানেই প্রাণের শহরটা ঝুপ করে তলিয়ে গেল বিষণ্ণ এক সন্ধ্যায়। অবিরল বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তব্ধ, শান্ত পরিবেশ। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। প্রিয়তাকে আবারও ফোন লাগালাম। একবার, দুইবার, একে একে অনেকবার। লাইন পাওয়া গেল না। মুঠো ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু বৃষ্টি থামলেই বা কী? কী করে যাব এতোটা পথ একা? সার্কিট হাউজের পেছনের রাস্তাটা বরাবরই নির্জন, নিস্তব্ধ। দুশ্চিন্তায় ঝিম ধরে এলো মস্তিষ্ক। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বৃষ্টির গতি বাড়লো বই কমলো না। জলের ছাঁটে ভিজে গেল আমার সফেদ সালোয়ার। চারদিকে ভয় ধরানো অন্ধকার। আমার ঠিক মাথার উপর ঝুলছে হলদেটে স্ট্রিট ল্যাম্প। ঠান্ডা হাওয়ায় থেকে থেকেই কামড়ে ধরছে শরীর। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতেই চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক চাইলাম। অপেক্ষায় রইলাম। কীসের অপেক্ষা, কার অপেক্ষা জানা নেই। কেবল জানি, অপেক্ষায় রইলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো, আমাকে একদম চমকে দিয়ে, ভাগ্যবিধাতা আমার অপেক্ষার এক অপ্রত্যাশিত অবসান ঘটালেন। কোথা থেকে একটা রিকশা এসে থামল আমার পায়ের কাছে। রিকশার অন্ধকার থেকে মুখ এগিয়ে ঝংকার তোলা এক কন্ঠ শুধাল,
‘ নিশু! এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন নিশু?’
এই প্রথম বুঝি নিজ থেকে কথা বলল ধ্রুব। আমি চোখ তুলে চাইলাম। ধ্রুব একটু ভেবে বলল,
‘ রিকশা পাচ্ছো না?’
আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব অবশ্য আমার উত্তরের অপেক্ষাও করল না। রিকশা থেকে নেমে, এক ছুটে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ঝাকড়া চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘ এই রিকশা করে চলে যাও।’
আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কঠিন কন্ঠে বললাম,
‘ লাগবে না।’
‘ এই রাস্তায় এখন আর রিকশা পাবে না,নিশু।’
আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব আমাকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল,
‘ পার্স আনোনি। রিকশা ভাড়া নেই? সেটা তো বাসায় ফিরেও দিতে পারো।’
ধ্রুবর কথায় সূক্ষ্ম মেজাজ খারাপ হলেও মাথায় ভর করল অন্য এক চিন্তা। বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠল। চট করে মনে পড়ে গেল, আমার কাছে তো ঘরের চাবি নেই। পার্স আনিনি। টাকা আর চাবি সবই তো প্রিয়তার ব্যাগে। সর্বনাশ! আমি অস্থির মনে প্রিয়তাকে ফোন লাগালাম। এবারও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ধ্রুব আমাকেই খেয়াল করছিল। বলল,
‘ কোনো সমস্যা? তুমি বললে, আমি রিকশা ভাড়াটা মিটিয়ে দিতে পারি।’
আমি রক্তিম চোখে চাইলাম। ধ্রুব চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ তুমিই ব্যতিক্রম? নাকি সব লেখিকাদেরই এমন তেজ?’
আমি চিড়চিড়ে মেজাজ নিয়ে বললাম,
‘ সমস্যা কী আপনার? এখানে অযথা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
ধ্রুবর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি,
‘ তোমার জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি।’
আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম,
‘ কেন? আমি বলেছি?’
‘ উঁহু। বলোনি। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায় তোমায় একা ফেলে যেতে বিবেকে বাঁধছে।’
আমি কিছুক্ষণ গজগজ করে বললাম,
‘ এতোটুকু বিবেকবোধ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। আপনি যেতে পারেন।’
ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে হাসল। একদম সরল প্রশ্ন নিয়ে বলল,
‘ আমার প্রতি তোমার এতো রাগ কেন? কী করেছি? কী চাও তুমি?’
আমি থমকালাম। মনের আনাচে-কানাচে সত্য কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর আকাশের দিকে চেয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলল,
‘ আমার এক্ষুনি বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। বৃষ্টিটা খুব সহজে থামবে বলে মনে হয় না। আমরা একই রিকশায় যেতে পারি। আমি বাসার একটু আগেই নেমে যাব।’
ধ্রুবর কথায় চাপা এক অভিমান ফুঁসে উঠল বুকে। নিজের অজান্তেই অভিমান ঢেলে দিয়ে আস্ত এক ভুল কথা বলে বসলাম, খুব ভুল এক মানুষকে,
‘ কেন? আমার সাথে কেউ দেখে নিলে আপনার বিয়ে ভেঙে যাবে বলে?
ধ্রুব এবার পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল। একটু হেসে বলল,
‘ সম্ভবনাটা খুব মিথ্যে নয়।’
আমি চোখ ফিরিয়ে চুপ করে রইলাম। নিজের মনটাকে গলা টিপে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করল। আবিরের থেকে শোনা ছোট্ট কথাটা সেদিন যতটা হালকা মনে হয়েছিল। আজ ততটাই গভীর হয়ে বিস্ফোরণ ঘটালো৷ মনটাকে কেটেকুটে রক্তাক্ত করে তুললো চোখের পলকে। ধ্রুব নামক মানুষটিকে সটান একটি চড় বসিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘গেট লস্ট’। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই হৃদয়বিদারক নিস্তব্ধতাকে আমার কোমল হৃদয়ের মতোই ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বেজে উঠল ধ্রুবর ফোন। ধ্রুব অপ্রস্তুত চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে ফোন তুললো। গম্ভীর, শান্ত স্বরে বলল,
‘ হ্যালো।’
বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ওপাশের আওয়াজ পাওয়া গেল না। ধ্রুব গলার স্বর নিচু করে বলল,
‘ বেশি দেরী হবে না। আমি আসছি।’
তারপর একটু চুপ থেকে আবার বলল,
‘ আমার টেবিলের উপরই রেখে এসেছি ছবিগুলো। সবাই-ই তো সুন্দর। সব ছবি আমার কাছে এক রকমই লাগে। তুমি তোমার পছন্দ মতো সিলেক্ট করে নাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
মন কী বুঝলো, জানি না। অদ্ভুত এক ব্যথায় টন টন করে উঠল গোটা বুক। ধ্রুব একবার আমার দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ বললাম তো তোমার ইচ্ছে। আমি আসছি। বাসায় এসে আলোচনা করি?’
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফিরবো। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। ধ্রুব ফোন কেটে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তুমি যাচ্ছো আমার সাথে?’
আমার নিষ্কম্প উত্তর,
‘ না।’
‘ আমার সাথে যাবে না? নাকি আমার সাহায্যই নিবে না?’
ধ্রুবর মন পড়ে ফেলার ক্ষমতায় কিছু চমকালাম আমি। কঠিন কন্ঠে বললাম,
‘ দুটোই। আই ক্যান ম্যানেজ।’
ধ্রুব আমার দিকে অপলক চেয়ে রইল। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ এমন একটা মুহূর্তে জেদ ধরাটা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ?’
#চলবে……