প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প .
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১৭|
মাসুম জীবনটাকে কাদা-জল খাইয়ে কোর্স ফাইনাল শেষ হলো। পরীক্ষার খাতায় কী লিখেছি তা নিয়ে যতটা না ভাবনা হলো, তার থেকেও বেশি স্বস্তি পেলাম পরীক্ষা শেষ হলো এই ভেবে। আমি আর প্রিয়তা বসন্তের হাওয়ার মতো উড়তে লাগলাম। রজনীগন্ধার সুতীব্র ঘ্রাণের মতোই সুতীব্র আনন্দ হলো! ক্যাম্পাস থেকে ফিরেই রুটিন বিহীন ঘুম দিলাম।
সারাদিন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে, চোখ-মুখ ফুলিয়ে, বিকেলের চায়ের কাপটা হাতে তুলতেই ঘোষণা দিল প্রিয়তা, ‘জীবন সুন্দর! এই সুন্দর জীবন পেয়ে আমরা আপ্লুত। চল, আজ ছাদে গিয়ে চা খাই। সুন্দর জীবন পেয়ে যে আমরা আপ্লুত, তা ছাদ-চা দিয়ে সেলিব্রেট করি।’ আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। এই সুন্দর জীবনের, সুন্দর সেলিব্রেশনের বিনিময়েও যে আমি ধ্রুবর মুখোমুখি হতে চাই না। তা জানিয়ে এক নিঃশ্বাসে নিষেধ করব বলে ভাবলাম। প্রিয়তা বোধহয় আমার মনোবাসনা বুঝতে পারল। চট করেই আদুরে বিড়ালের মতো আদুরে করে ফেলল তার মুখ। মধুর কন্ঠে বুঝাল,
‘ বাসার খোঁজ তো চলছে, জান। আজ বাদে কাল চলেই যাব। কী হয় একবার ছাদে গেলে? চল না যাই? প্লিজ! প্লিজ!’
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। বুকের ভেতর জন্মগত নিমকহারাম মনটির ভয়ানক ঠেলাঠেলিতে রাজি হতে একরকম বাধ্য হলাম৷ প্রিয়তা আনন্দে দুলতে দুলতে নতুন করে চা বানাল। দু’কাপ চা নিয়ে ছাদের পথে হাঁটা দিতেই কালো বিড়ালের পথ কাটার মতোই সামনে এসে দাঁড়ালেন মূর্তমান এক আতঙ্ক। ধ্রুবর সুন্দরী মা। লম্বা, একহারা দেহ। পানপাতার মতো ঢলঢলে শ্যামলা মুখ। মুখের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ভরা যৌবনের লাবণ্য। দেহ-মনে কোথাও বাড়তি বয়সের ছাপ নেই। চোখের দৃষ্টিটা বাড়াবাড়ি রকমের তীক্ষ্ণ। গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো শক্ত। আমি আর প্রিয়তা কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে পড়লেও সামলে নিলাম। ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টিতে আঁকা সেই দূরত্ব প্রাচীর ভেদ করে সালামটুকু দেওয়ার সাহস হয়ে উঠল না। সুতরাং উনাকে এড়িয়ে গিয়ে ছাদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ধ্রুবদের ছাদটা বিশাল। শাক-সবজি, ফুল-লতার গাছ লাগিয়েও বেশ ফাঁকা ফাঁকা চারপাশ। প্রিয়তা চারদিকে চেয়ে চাপা কন্ঠে বলল,
‘ট্রাস্ট মি দোস্ত! আমি ছেলে হলে তোর শাশুড়ীকে পটানোর জন্য জীবন দিয়ে দিতাম। এই মহিলার এমন ধামড়া ধামড়া ছেলে আছে ভেবে তো আমারই কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তাহলে ছেলেদের অবস্থাটা ভাব? আহারে! ইশ!’
আমি গরম চোখে চাইলাম। চাপা ধমক দিয়ে বললাম,
‘ বখাটেদের মতো কথাবার্তা বলবি না প্রিয়। ট্রাই টু বি আ লিটল মোর পুলাইট।’
প্রিয়তা আত্মা ফাঁটা আফসোস নিয়ে বলল,
‘ সম্ভব না। এই মহিলাকে দেখে আমার আত্মা ফেঁটে যাচ্ছে। হুয়াই অ্যাম আই নট আ বয়, নিশু? হুয়াই ইজ দিজ ইমপ্যাকেবল বিউটি ইজ নট মাই গার্ল?’
আমি হতাশ চোখে চাইলাম। প্রিয়তা দুষ্ট হাসল। কানের কাছে মুখ এনে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ তোর অ-প্রেমিকের বোন কেন নেই তা আজ বুঝতে পারছি, জান। এদের দুই ভাইয়ের তো মাকে দেখে রাখতে রাখতেই বেহাল দশা হওয়ার কথা। বোনকে দেখে রাখার সময় কই? আল্লাহ এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোও খেয়াল করেছে দেখেছিস? আহহা! আল্লাহ তুমি সত্যিই গ্রেড। লাভ ইউ!’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। আমার বিরক্তি প্রিয়তার উৎসাহকে ইঞ্চি খানেক টলাতে পারল বলেও মনে হলো না। সে মনের সুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। আশেপাশে দেখতে দেখতে হঠাৎ আনন্দ ঝলমলে কন্ঠে ডাকল,
‘ এই চুচু? কী করছ? সাতার কাটছ?’
প্রিয়তার ডাকে চোখ ফিরিয়ে সামনে চাইলাম আমি। চিওমিও ছাদের মাঝ বরাবর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। প্রিয়তার ডাকে মাথাটা হালকা উঁচু করল। চোখ পিটপিট করে আশপাশটা দেখে নিয়ে আবারও মাথা এলিয়ে দিল। অর্থাৎ, প্রিয়তার ডাক সে শুনেনি। এই দুনিয়াধারি সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এখন তার মন খারাপ। আমি হেসে ফেললাম। এরা তিন ভাই-ই মায়ের মতো চেহারা পেয়েছে। তবে চিওমিওয়ের গায়ের রঙটা হয়েছি একদম তার বাবার মতো। এতো মিষ্টি! আমি আর দূরে সরে থাকতে পারলাম না। কয়েক পা এগিয়ে চিওমিওয়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম। ওর মুখের উপর ঝুঁকে হাসলাম। বললাম,
‘ হ্যালো চিওমিও! মন খারাপ?’
চিওমিও ভাইয়ের মতোই গম্ভীর চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এ যেন ধ্রুবরই কার্বন কপি। আমি হেসে ফেললাম। বুকের ভেতর নরম এক অনুভূতির হুল্লোড় উঠল। গোলাপের মিহি সুগন্ধের মতোই ছড়িয়ে পড়ল প্রেম প্রেম মিষ্টি সুবাস। সেই সুবাসে ভেসেই দ্বিতীয়বারের মতো উপলব্ধি করলাম, আমি ধ্রুবর প্রেমে পড়েছি। ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর প্রেম পড়েছি। চিওমিও বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিছুটা নিঃসংশয় হলো। আমাকে বোধহয় বিচার দেওয়া যায়, বুঝতে পেরে ঠোঁট ফুলাল। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল,
‘ আবির আমার সাথে খেলে না। তুমি ওকে মারবে।’
আমি আবিরকে শাসন করতে পারি, এই ধারণা তার কেন হলো? এই নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মৃদু হাসলাম। হাত বাড়িয়ে বললাম,
‘ আমি তোমার সাথে খেলব। খেলবে আমার সাথে?’
চিওমিও সেকথার উত্তর দিল না। গম্ভীর চোখে চেয়ে বলল,
‘ আবির আমাকে জোড়ে মেরেছে। কান টেনে দিয়েছে। ছাদ থেকে ফেলে দিবে, দিয়ে ফেলে দিবে বলেছে।’
আমি হেসে ফেললাম। ঠিক তখনই যমদূতের মতো কাছে এসে দাঁড়ালেন ধ্রুবর মা। চোখের দৃষ্টিতেই মোটা দাগের এক পাঁচিল টেনে চিওমিওকে ডাকলেন,
‘ কল্প উঠো। বাসায় যাব।’
চিওমিওয়ের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। বুঝা গেল, তার রাগ আপাতত মায়ের উপর৷ মায়ের সাথে কথাবার্তা বলবে না। ভদ্রমহিলা এবার একটু বিরক্ত হলেন। আমাদের দিকে ভদ্রতা স্বরূপও চেয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করলেন না। কঠিন কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি তাহলে শুয়ে থাকো। ধ্রুব চলে এসেছে। ধ্রুবকে ডাকছি।’
চিওমিও এবার নড়েচড়ে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড মরার মতো পড়ে থেকে লক্ষ্মী ছেলেটির মতো উঠে বসলো। আমি আর প্রিয়তা এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনের সুপ্ত এক কুঠরে খুব সন্তপর্ণে উপলব্ধি করলাম, ‘অদ্ভুত কোনো কারণে ধ্রুবর মা আমাকে পছন্দ করেন না। শুধু পছন্দ করেন না, তেমন নয়। ভদ্রমহিলা আমাকে একেবারেই পছন্দ করেন না।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে মনে বুঝলাম, এই ভদ্রমহিলার অমতে সুদূর ভবিষ্যতেও ধ্রুবর সাথে আমার এমন-তেমন কিছু সম্ভব না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি কারো অপছন্দের কারণ ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল। ছাদ থেকে নেমে এসেই মুখ গুমরা করে বসে পড়লাম। মন খারাপ থেকেই ধীরে ধীরে চিরচিরে হলো মেজাজ। দগদগে মেজাজ খারাপ নিয়ে বললাম,
‘ তোর মনে হয় না? তোর ক্রাশ একটু বেশিই রিজার্ভড? জীবনেও হাসে বলে তো মনে হয় না।’
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
‘ আমার ক্রাশ? আমার তো অসংখ্য ক্রাশ। তুই কার কথা বলছিস?’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ বাড়িওয়ালার বউ।’
প্রিয়তা হেসে ফেলল। আমার পাশে বসে বলল,
‘ বাড়িওয়ালার বউ বলছিস কেন? শাশুড়ী বল। তোর না শাশুড়ী হয়?’
আমি ধমক দিয়ে বললাম,
‘ ফাজলামো করবি না।’
‘ আচ্ছা, যা। করব না ফাজলামো। ভদ্রমহিলা আসলেই একটু রিজার্ভড। জন্মের পর মধু টধু দেয়নি বোধহয় কেউ। মধু দেওয়ার আগেই মধুর ডিব্বা চুরি হয়ে গিয়েছে। এজন্য বেচারীর মন খারাপ। সর্বদা মন খারাপ। একে বলে জন্মগত মন খারাপ।’
প্রিয়তার উলট-পালট কথায় বিরক্ত চোখে চাইলাম আমি। সেই বিরক্তিকে কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিতেই উদয় হলো জমিলা আপা। চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে বলল,
‘ চুরি! কী চুরি গেছে গো বড় আফা? চুরের কী কৌলজা! বড় ভাইজানের বাড়িত চুরি করে! আফনে তাত্তাড়ি বড় ভাইজানকে খবর দেন। বড় ভাইজান তুড়ি মাইরা সব সলোভ কইরা দিব।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ কেন? আপনার বড় ভাইজান কী ফকির দরবেশ? জাদু-টোনা জানে?’
জমিলা আপা অবাক হয়ে বলল,
‘ জাদু-টোনা জানব ক্যান? বড় ভাইজান তো থানার বড় অফিসার। কত বুদ্ধি মাতাত।’
আমি আর প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে চাইলাম। একে অপরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফেলে আবারও জমিলা আপার দিকে চাইলাম। সন্দিহান কন্ঠে শুধালাম,
‘ আপনার বড় ভাইজান থানায় বড় অফিসার?’
জমিলা আপা মাথা নাড়লেন। রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে করতে অবাক হয়ে বললেন,
‘ হ তো। কেন, আফনে জানেন না? ওমা! বড় ভাইজানের লগে না আপনার ইটিশপিটিশ সম্পর্ক? বড় ভাইজান তো বড় পরীক্ষা, বিবিসি পরীক্ষা দিয়া থানার বড় অফিসার হইছে। আফনে জানেন না ক্যান? না জাইন্যা প্রেম করছেন? কী আচান্নক কতা!’
জমিলা আপার কথায় মাথার উপরের বিশাল নীলাভ আকাশটা টুপ করে ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা জমিলা আপাকে কিছুটা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘ ওটা বিবিসি নয় জমিলা আপা বিসিএস পরীক্ষা।’
জমিলা আপা প্রিয়তার ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় কিছুটা বিরক্ত হলেন। আর আমি বিরক্ত হলাম ধ্রুবর চাকরির কথা চিন্তা করে। মেজাজ খারাপটাও তরতর করে বেড়ে গেল। থানার বড় অফিসার মানে কী? ধ্রুব কী পুলিশ অফিসার? ইয়া মা’বুদ! বলে কী? কী আশ্চর্য! এই পৃথিবীতে এতো এতো চাকরী বাকরী রেখে এই বদমাইশ লোকটিকে পুলিশই হতে হবে কেন? বদমাইশটা কী কলেজের প্রফেসর হতে পারতো না? অথবা ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার? আমার মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। অদূর ভবিষ্যতে ‘হলেও হতে পারতো’ একটি প্রেম কাহিনীর অকাল মৃত্যুতে বুক ফেঁটে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ধ্রুবর প্রতি প্রেম প্রেম ভাবটা এক গ্লাস পানির সাথে প্যারাসিটামলের মতো গিলে ফেললাম। প্রিয়তাও চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে চাইল। আগে যে আশঙ্কাটা একপাক্ষিক ছিল। এবার সেই আশঙ্কা দ্বিপাক্ষিক হতেই ঠোঁট উল্টাল। বলল,
‘ তুই বরং তোর না হওয়া প্রেমিকের ছোট ভাইকেই বিয়ে করে ফেল নিশু। দেবর যখন বর, অস্থির সীন। ডাক্তার আছে। ঝামেলা নাই। বাসুর মহাশয় পুলিশ হতে পারবে না, এমন তো কোনো শর্তও নাই। রাস্তা ফকফকা।’
আমি উত্তর দিলাম না। এই অসম প্রেমের গল্পটা এখানেই শেষ করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু গল্প শেষ হলো না। সেদিন সন্ধ্যায়, ক্যাম্পাসের ফেসবুক গ্রুপে নতুন এক নোটিশের মাধ্যমে গল্পটা যেন নতুন রূপ নিলো। আরও একটু সরস হলো। রস এলো। গল্পটা একপাক্ষিক থেকে দুইপাক্ষিক হওয়ার রাস্তা পেল।
#চলবে……