প্রেমিক অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|৬|
সিঁড়ির নিচে ঝাপসা অন্ধকার। জমিয়ে রাখা পরিত্যক্ত জিনিসগুলোতে ছাড়পোকার গন্ধ। আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আমার থেকে হাত দুয়েক দূরে। দুজনের মাঝেই আকাশ সমান নীরবতা। কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছি না। আমার গা অন্ধকারে অদৃশ্য প্রায়। ধ্রুবর গায়ে এসে পড়ছে এক মুঠো স্বচ্ছ আলো। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ধ্রুব একমনে সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে সে আর এই আবছা সিঁড়ি ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। আমার অস্তিত্ব সেখানে কল্পনা মাত্র। মনে মনে আমি অত্যন্ত সাহসী বালিকা। চট করে রেগে যেতে পারি। কিন্তু ধ্রুবর সামনে রাগ দেখানো যাচ্ছে না। ধ্রুব অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কথা বলে মেপে মেপে। চোখের দৃষ্টি শান্ত। ভাবখানা এই, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে রেগে যাওয়াও চলবে না। সেই রাগ সে বরদাস্ত করবে না। আমি কয়েক মিনিট স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে উশখুশ করে উঠলাম। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই ধ্রুব আমার দিকে চাইল। আবির যতটা সরল দৃষ্টিতে তাকায় ঠিক ততটাই জটিল দৃষ্টি দিয়ে সে আমায় পর্যবেক্ষণ করল। ডান ভ্রুটা ঈষৎ উঁচু করে নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
‘ তুমি বেশ সুন্দরী। কিন্তু আমি প্রেমিকা হিসেবে সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করি না।’
আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। ভ্রু জোড়াতে ঈষৎ সন্দেহী ভাঁজ। ধ্রুব দুই পা এগিয়ে আমার থেকে সচেতন দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমি তোমার প্রেমিক হলাম কী করে? উঠতে বসতে, ক্যাম্পাসে, রাস্তায়, টং দোকানে সব জায়গায় তোমার আমার প্রেম কাহিনির চর্চা। ব্যাপারটা কী? কাজটা কী তুমি ঠিক করেছ?’
আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম। হতভম্ব চোখে চেয়ে থেকে বললাম,
‘ কী আশ্চর্য! আমি করেছি মানে! কী করেছি আমি? আমার অবস্থা আপনার থেকেও গুরুতর। আমি মাত্র সেদিন জানলাম আপনি আমার প্রেমিক। এখন এই খবর আমার বাবা না জানলেই হলো। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, বাবা কতটা ভয়ঙ্কর।’
আমার বাবা ঘটিত চিন্তা ধ্রুবকে খুব একটা চিন্তিত করল বলে মনে হলো না। সে আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ মেয়ের জামাই হিসেবে তোমার বাবাকে আমার নিজ দায়িত্বে জানিয়ে আসা উচিত। তাকে জানানো উচিত, তার আদরের মেয়ে আমার সাথে নাজমা বোর্ডিং-এ যায়। আমি একা সাফার করব আর তুমি আনন্দে নাচবে তা তো হতে পারে না। তোমার কোনো ধারণা আছে কত বড় ক্ষতি করেছ আমার? আমি লজ্জায় বাবার সামনে মুখ দেখাতে পারছি না।’
ধ্রুবর মুখে নাজমা বোর্ডিং এর নাম শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। বাড়ির বড় ছেলেরা নাকি আদব-আয়দা, ভদ্রতা- সভ্যতার জ্বলজ্বলে প্রতিমা? কিন্তু এ তো দেখি মহা ফাজিল। চরম বেয়াদব। এই অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদব, ভয়ানক ইতর ছেলেটিকে এতোদিন ধোয়া তুলশী পাতা ভেবেছি বলে খুব দুঃখ হলো। যে ছেলে জলের মতো সহজ ভঙ্গিতে এতোবড় খারাপ কথা বলে ফেলতে পারে। সে কখনোই ধোয়া তুলশী পাতা হতে পারে না। সে হবে অত্যন্ত অসভ্য একটা ছেলে। আমার মতো সভ্য মেয়ের উচিত এমন অসভ্য ছেলে দেখলেই রেগে যাওয়া। আমি রেগে গেলাম। বললাম,
‘ আপনি অত্যন্ত অসভ্য একজন মানুষ।’
ধ্রুবর মুখে কোনো রাগের প্রকাশ নেই। তার কন্ঠ চমৎকার। ছাড়া ছাড়া, সুন্দর প্রতিটি উচ্চারণ। মানুষকে মধুর স্বরে অপমান করার শিক্ষাও তার জন্মগত। সে মধুর কন্ঠে বলল,
‘ জোর করে আমার প্রেমিকা হলে তুমি আর অসভ্য হলাম আমি? আশ্চর্য!’
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ফোঁসে উঠে বললাম,
‘ নিজেকে আপনি কী মনে করেন, বলুন তো? প্রিন্স অব দ্য টাউন? শহরের সব মেয়ে আপনার প্রেমিকা হওয়ার জন্য মরে যাচ্ছে?’
ধ্রুব রাগল না। দুয়েক পা এগিয়ে সচেতন দূরত্বটুকু মিটিয়ে দাঁড়াল। ঘড়ি পরা ডানহাতটা আমার মাথার পেছনে রঙ চটা দেয়ালের উপর রেখে সহজ কন্ঠে বলল,
‘ আর কেউ যাচ্ছে কি-না বলতে পারি না। আমি মেয়েদের খুব একটা খেয়াল করি না। কিন্তু তুমি তো খুব যাচ্ছ।’
ধ্রুব হঠাৎ কাছে আসায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। প্রচন্ড ভয় আর অস্বস্তিতে থিতিয়ে গেল আত্মবিশ্বাস। এক সমুদ্দুর রাগটা টুপ করে ছোট্ট ডোবায় রূপ নিলো। আমি রাগ প্রকাশের যথাসাধ্য চেষ্টা করে বললাম,
‘ বাজে কথা! আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও ইন্টারেস্ট নেই। পথ ছাড়ুন।’
ধ্রুবর মাঝে পথ ছাড়ার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। সে বামহাতটা পকেটে গুঁজে চুপচাপ চেয়ে আছে। ছাড়পোকার গন্ধগুলো মিলিয়ে গিয়ে চারপাশটা ধীরে ধীরে ধ্রুবময় সুবাসে ভেসে যাচ্ছে। ধ্রুব উদাস কন্ঠে বলল,
‘ দেখো নিশু। আমি তোমার সাথে কোনো রকম ঝামেলা করতে চাইছি না। তুমি নিজে ঝামেলা পাকিয়েছ। তোমার উচিত ঝামেলাটা সল্ভ করা। গত দু’দিন আগেও আমি তোমার নাম জানতাম না। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলাম, নিশু নামের অত্যন্ত সুন্দরী একটা মেয়ে আমার প্রেমিকা। অথচ এই সুন্দরী প্রেমিকাকে আমি চিনি না। বাসায় ফিরে শুনলাম আমার ছোট ভাই হঠাৎ তার ভাবী পেয়ে গিয়েছে। ভাবীকে তার পছন্দ হয়েছে। সুতরাং তার টাকা প্রয়োজন। বন্ধুদের ট্রিট দিবে। অথচ তার একমাত্র বড় ভাই হয়ে, তার ভাবী সম্পর্কে আমার কোনো ধারণায় নেই। ক্যাম্পাসে একটা কাজে গিয়ে দেখি বন্ধুরা আনন্দে অভিভূত। প্রাক্তন স্যারদের ঠোঁটেও মিটিমিটি হাসি। এই পুরো ঘটনাগুলো আমাকে নিয়ে ঘটছে অথচ আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তার থেকেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল আজ সকালে। বাবার সাথে বাজারে গিয়েছি। ফেরার পথে গলির মোড়ের পরিচিত মনিহারী দোকানদার বাবার সামনেই ডেকে বললেন, “মামা, মামী কিন্তু এক নাম্বার।” চিন্তা করতে পারছ পরিস্থিতি? আমি এই মুহূর্তে বাবার সামনে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমার জায়গায় আবির হলেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমি! মাই গড! আমি তো নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না!’
ধ্রুবর বিশাল দুঃখকথন শোনে আমার খুব দুঃখ হলো। আবেগে গলে গিয়ে তার জন্য বড্ড মায়া হলো। আহারে! বেচারা! তার অবস্থা আমার থেকেও ভয়াবহ। কিন্তু আমার মায়া মায়া ভাব বেশিক্ষণ টিকল না। ধ্রুব জলের মতো সহজ কন্ঠে হুমকি দিয়ে ফেলল,
‘ আমার এই যাবতীয় সমস্যাটা শুরু হয়েছে তোমার থেকে। তুমি আমার জীবনে এসে, গোটা জীবনটাকে একটা আতঙ্ক বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছ। এজন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে। হয় আমার জীবনটা আগের মতো করে দাও, নাহয় তুমিও অশান্তিতে ডুবে মরে যাও।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ মানে?’
‘ মানেটা সহজ। তুমি এই ঝামেলাগুলোর সমাধান টানতে না পারলে আমি তোমার শ্রদ্ধেয় বাবার কাছে সমাধান চাইব।’
আমি হতবাক,
‘ কীসের সমাধান?’
ধ্রুব এবার এক অবিশ্বাস্য কথা বলে ফেলল। খুবই সহজ সাবলীল ভাষায়, একদম ভালো মানুষটির মতো বলে ফেলল,
‘ তুমি যে তার ভয়ে আমাদের বাচ্চাটাকে এবোর্ট করে ফেললে, তাতে আমি কতটা দুঃখিত। মর্মাহত। সেটা তাকে জানাতে হবে না? আমি এর সমাধান চাই। আমার বাচ্চার ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে।’
আমি স্তব্ধ চোখে নিজের উদরের দিকে চাইলাম। ডানহাতটা নিজের পেটের উপর রেখে হতভম্ব চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব খুব ভালো মানুষটির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার ভদ্র, নম্র, আদুরে মুখটি দেখে পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র মানুষ ভেবে ভুল হয়ে যাওয়ার মতো ভালো মানুষ। আমি কয়েক সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে স্তম্ভিত কন্ঠে উঠলাম,
‘ বাচ্চা! কীসের বাচ্চা! কীসের এবোরশন! আপনি এতো খারাপ!’
ধ্রুব মৃদু হাসল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ধরে রেখে আমার জীবনের সবচেয়ে আনসল্ভড সমীকরণটা বুঝিয়ে দিল,
‘ আমি যেমন তোমার প্রেমিক না হয়েও প্রেমিক? তুমি যেমন আমার প্রেমিকা না হয়েও প্রেমিকা? ঠিক তেমনই আমাদের বাচ্চা না হয়েও বাচ্চা। এবোরশন না হয়েও এবোরশন। বুঝেছ প্রিয়তমা?’
আমি শুকনো মুখে মাথা নাড়লাম। আকস্মিক ঘটনাসমূহে আমার মান্ধাতার আমলের স্লো মস্তিষ্কটা সুযোগ বুঝে আরও একটু স্লো হয়ে গেল। মাথাটা হঠাৎ করে পুরোনো দিনের টেলিভিশনের মতো ঝিরঝির করে উঠল। ধ্রুব ভুবন ভুলানো হাসি হেসে সমবেদনা দিল,
‘ তোমাকে আমি বুদ্ধিমতি ভেবে ভুল করেছি। তুমি আসলে ভয়াবহ গাধা প্রজাতির মেয়ে। গাধা বলেছি বলে কষ্ট পেও না। গর্দভ টাইপের রমণীদের ইন শর্ট গাধা বলা যেতে পারে। তোমার স্লো মস্তিষ্ক নিয়ে এতো চিন্তা করার দরকার নেই। এই ফর্মূলাটা তোমার বাবার জন্য। তিনি বুঝলেই হবে।’
আমি মুখ কালো করে চাইলাম। এতোবড় অপমানের পরও চুপ করে বসে থাকা চলে না। ভয়াবহ প্রতিবাদের ডাক দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমি অত্যন্ত চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। মনে মনে গণঅভ্যুত্থানের মতো ভয়াবহ আন্দোলন করে ফেললেও কারো সামনে ‘অ তে অসভ্য’ পর্যন্ত বলতে পারি না। সেক্ষেত্রে প্রিয়তা আমার ডানহাত। একাই একশো পুরুষকে হাওয়াই উড়িয়ে দেওয়ার মতো দূর্দান্ত প্রতিভা তার আছে। এই মুহূর্তে প্রিয়তার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রিয়তাটা পাশে থাকলে বেশ হতো! জব্বর একটা জবাব দেওয়া যেতো। আমি হতাশ কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি খুব খারাপ মানুষ।’
ধ্রুব উত্তর দিল না। আমার মুখের উপর ঝুঁকে কিছু একটা বলবে তার আগেই সিঁড়ির রেলিঙে আরেকজন ধ্রুবর চেহারা দেখা গেল। চেহারাটি রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া তুমি সিঁড়ির তলায় কী করছ?’
ধ্রুব মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে সরে দাঁড়াল। আমাকে আড়াল করার চেষ্টা করে গম্ভীর, শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। উত্তর দিল না। আবির তার ভাইয়ের থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে। ভাইয়ের শক্ত চাহনি পুরোপুরি উপেক্ষা করে, গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! ভাইয়া- ভাবী তোমরা দু’জনে সিঁড়ির তলায় কী করছ?’
ধ্রুব দু’হাত পকেটে গুঁজে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ হা-ডু-ডু খেলছি। তোর এখানে কী? ঘরে যা।’
আবির প্রত্যুত্তর করার আগেই আবিরের দুই পায়ের ফাঁক গেলে সিঁড়ির দুই শিকের মাঝ দিয়ে ছোট্ট গোলগাল এক মাথা বেরিয়ে এলো। বড় বড় চোখদুটোতে এক ঝাঁক বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আমিও হাডু হাডু খেলব বয়ো ভাইয়া।’
ধ্রুব চিওমিওকে দেখে স্তম্ভিত চোখে চাইল। শীতল চোখে চেয়ে তার থেকেও শীতল কন্ঠে ডাকল,
‘ আবির!’
আবিরের মুখ নিমিষেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার দুই পায়ের ফাঁকে শুয়ে থাকা চিওমিওকে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল,
‘ আমি একে আনিনি। ও একা একাই আমার পিছু পিছু চলে এসেছে। এই উঠ।’
চিওমিও দুইহাতে সিঁড়ির দুটো শিক ধরে থেকে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ আমি হাডু হাডু খেলব। খেলবই।’
আমি স্তম্ভিত চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমার ছোট দেবর।’
দেবর! কীসের দেবর! আমি বিস্মিত চোখে চাইলাম। আমার থেকেও বিস্মিত কন্ঠ ভেসে এলো দু’তলার সিঁড়ির গোড়া থেকে,
‘ ইয়া আল্লাহ! মাঝ সিঁড়িতে শুয়ে এমন ব্যালি ডান্স কেন করছ চুচু? চুচু পুপুদের ব্যালি ডান্স করতে হয় না।’
চিওমিও ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। শিকের ভেতর থেকে মাথা বের করে প্রিয়তাকে দেখলো। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ আমাকে চুচু ডাকবে না।’
সিঁড়ির নিচ থেকে প্রিয়তার মুখভঙ্গি ঠিক বুঝা গেল না। তবে ব্যর্থ অবিশ্রান্ত আবির তাকে আর প্রত্যুত্তরের সুযোগ দিল না। হাঁপ ধরা কন্ঠে বলল,
‘ একে একটু ধরো তো ঝগড়াঝাঁটি। একে টেনে তুলতে পারলে তোমাকে পাঁচ টাকা বকশিস দেওয়া হবে।’
প্রিয়তার ফুঁসে উঠা কন্ঠস্বর,
‘ আপনি আমাকে ঝগড়াঝাঁটি কেন ডাকছেন? আমার নাম ঝগড়াঝাঁটি? তাছাড়া আমি এখন ফুল মুডে আছি। প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। এসব পাঁচ টাকা ফাঁচ টাকায় আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনার চুচুকে একটু তুলে ধরুন। আমি চলে যাই।’
চিওমিও এতোক্ষণ শান্ত হয়ে বসেছিল। আবির তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করতেই আবারও শিকের ভেতর মাথা ডুকিয়ে চিল্লাচিল্লি জুড়ে দিল,
‘ আমি হাডু হাডু খেলব। খেলবই।’
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
‘ হাডু! এটা আবার কেমন খেলা? হাঁটুতে হাঁটুতে বাড়ি দিয়ে খেলে নাকি? চুচু? আসো, আমি দিয়ে দিচ্ছি তোমার হাঁটুতে বাড়ি।’
এ পর্যায়ে আঁচলখানা কোমরে পেঁচিয়ে আবিরের সাথে সাথে প্রিয়তাকেও কাজে লেগে যেতে দেখা গেল। আবির অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ আরে বাপ! ভাইয়া এখানে হাডু হাডু খেলছে না। বউ বউ খেলছে। বউ বউ খেলতে বউ লাগে। ভাইয়ার বউ আছে। তোর তো নেই।’
চিওমিও এবার বিষয়ের গভীরতা বুঝতে পেরে বিজ্ঞ চোখে ধ্রুব আর আমার দিকে চাইল। হাত উল্টে ঠোঁট উল্টাল,
‘ আমার বউ নাই। আমার বউ কেন নাই?’
ঠিক তখনই প্রিয়তার চোখ পড়ল নিচে দাঁড়ানো আমার উপর। আমাকে দেখা মাত্র চোখ বড় বড় করে চাপা আর্তনাদ করে উঠল সে,
‘ নিশু! তুই এমন চিপাই চুপাই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ইয়া আল্লাহ! কি করছিস তুই সেখানে? ইয়া খোদা! এমন অশ্লীল অশ্লীল চিন্তা আসছে কেন আমার! তুই এই লোকটাকে চুমু টুমু খেয়ে ফেলিসনি তো নিশু?’
ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে চাইল। আমি অস্বস্তিতে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ঠোঁটে মৃদু হাসি টানার চেষ্টা করলাম। ধ্রুব সিঁড়ির নিচ থেকে সরে গিয়ে আবিরদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। চিওমিও এর দিকে চেয়ে আচমকা ধমকে উঠল,
‘ উঠো! এই মুহূর্তে উঠবে।’
ধমক খেয়ে চিওমিওের কান্না বন্ধ হয়ে গেল। ধ্রুব নামক বড় ভাইয়াকেই বোধহয় সে একমাত্র ভয় পায়। তবে খুব একটা হেলদোল দেখাল না। স্টিলের মতো সোজা হয়ে বসে অভিমানী চেহারা নিয়ে থম ধরে বসে রইল। কান্না করার সাহস যেমন পেলো না। উঠে যাওয়ার সাহসও যেন হলো না। ধ্রুব তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবিরের দিকে তাকাল। আবির মিনমিন করে বলল,
‘ আমি কী করেছি? আমি কী জানতাম তুমি ওখানে রোমান্স করছ? জানলে কী আসতাম? আমাকে বকলে কিন্তু আমি মাকে বলে দেব…..’
সিঁড়ির ধাপের সাথে সাথে ওদের কথাবার্তার স্বরও মিলিয়ে গেল খানিকবাদেই। প্রিয়তা সিঁড়ির উপর মর্মাহতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘ আমিও জেঠুকে বলে দেব। তুই আমাকে না বলেই ব্রেকিং নিউজ ঘটিয়ে ফেলেছিস! চুমু খেয়ে ফেলেছিস! উফ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
আমি অসহায় দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সিঁড়ির নিচের অন্ধকার থেকে সরে এসে সিঁড়ির উপর পা ফেলতেই অপরিচিত নাম্বার থেকে ক্ষুদে বার্তা এলো,
‘ তোমাকে বাহাত্তর ঘন্টা দেওয়া হলো। ইউর টাইম স্টার্টস্ নাও। ডু অর ডাই।’
#চলবে….