#পর্ব-২১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
‘আমি আপনার বাগদত্তা নই রুদ্র ভাই। আপনার আমার মধ্যে কিছু নেই। ভবিষ্যতে হবে কি না তার-ও কোনো গেরান্টি নেই। আমি আগে ছোট ছিলাম। কিন্তু এখন বড়ো হয়েছি। সবকিছুই বুঝি। আপনার মনে আমাকে নিয়ে অনুভুতি রয়েছে সেটাও বুঝি। আপনি আর সব প্রেমিক পুরুষদের মতো বাগদত্তা বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু সেটা আমার সামনে। বাহিরের কেউ জানতে পারছে না। আর আজকের যুগে ছেলেরা এমন অহরহ কথা বলে থাকে মেয়েদের পটাতে। আমি একদমই সে-ই মেয়েদের কাতারে পড়ি না। আপনাদের কাছে আমি হয়তো অবুঝ, কিন্তু বয়সের সাথে সাথে আমার বুদ্ধি, বুঝার ক্ষমতা সবই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি আপনজনদের কাছে ছোট বাচ্চা থাকতেই পছন্দ করি। সবার কেয়ার পাবার জন্য আপনজনের কাছে পুরনো তুমিই রয়ে গেছি। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে আমারও সবকিছুর চেঞ্জ এসেছে।
রুদ্র হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো তটিণী-কে।
‘আমি কি তোর কাছে তোর বয়সের সাথে বুঝদার হওয়ার রচনা শুনতে চেয়েছি?
‘না চান নি, কিন্তু অন্যসব মেয়েদের মতো ভাবছেন। আমি কাজে বিশ্বাসী কথাতে ন-ই। আপনি আসতে পারেন।’
রুদ্র নিজের কোমড়ে দু-হাত ভর করে মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
‘ঠিক আছে, তবে তাই হবে। রুদ্র ইরফানের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নে। দেখা গেলো সবকিছু প্রস্তুত কিন্তু তুই-ই প্রস্তুত থাকলি না।’
রুদ্র তটিণী-র রুম ত্যাগ করলো। তটিনীর কেমন যেনো শান্তি শান্তি লাগছে। মনে যা ছিল তা বলে দিতে পারার মতো শান্তি হয়তো কিছুতে হয়না। এবং সে সঠিক মানুষের কাছেই মনের কথা জ্ঞাপন করেছে। রুদ্র তার কথাগুলোকে পজিটিভলি’ই নিয়েছে। এবং সে জানে সে খুব শীগ্রই নতুন সম্পর্কে জড়াতে যাচ্ছে।’
রাত দুটোর পর তটিনী ঘুমে তলিয়ে গেলো। ঈদের দিনটা আনন্দে কাটলেও রাতটা কিছুটা মন খারাপ ও কিছুটা বেখেয়ালে কেটেছে তার।
*
তটিণী-র অগোচরে না ঘুমিয়ে কি থেকে কি করে ফেললো রুদ্র। দু’টো বেনী দু’দিকে, উস্কখুস্ক চুল। টিশার্ট ও প্লাজু কুঁচকে রয়েছে। চোখ ঘুমের কারণে ফুলে আছে। টুথব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে দাঁত ব্রাশ করার মধ্যে ঘরে এলেন রোবা নাহার ও ঈশানী। চট করে বললেন, ‘রুদ্রকে বিয়ে করবি তো মা?’
তটিনী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালে। দাঁত ব্রাশ করতে করতেই কবুল বলে হয়ে গেলো রুদ্রের অর্ধাঙ্গিনী। রুদ্র সত্যিই তটিণীকে গন্ডির ভিতরে আবদ্ধ করে দিলো। নিজের কথা রাখলো।
রুদ্র ও তটিণী-র ইসলামিক নিয়মে বিয়ে হয়ে গেলো। আইনগত হবে তখন যখন রুদ্র বিদেশ থেকে ফিরে আসবে। সুতরাং তটিনী সিঙ্গেল বাচ্চার মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে সদ্য বিবাহিত বউ। বিয়ের ব্যাপারটা পরিবারের বাহিরে কেউ জানে না। মোট কথা বিয়েটা শুধুমাত্র একটি হালাল সম্পর্কের জন্য ও মজবুত করতে করা। তটিণী-র কথাগুলো পজিটিভ ভাবে নিলেও রুদ্র বুঝতে পেরেছে তটিনী আজকের যুগের মেয়ে সুতরাং বিশ্বাস করলেও অন্ধ বিশ্বাস করবে না তাকে। রুদ্র চায় তটিনী তাকে অন্ধ বিশ্বাস করুক। চিৎকার করে গর্ব করে বলুক, ‘দেখো পৃথিবী, তোমার বুকে কত-শত প্রেমিক-প্রেমিকা বিশ্বাস করে ঠকে যায়। কিন্তু আমি তাকে অন্ধ বিশ্বাস করে ঠকিনি, বরং সে আমাকে জিতিয়ে দিচ্ছে বার-বার।’
প্রতিদিনের মতোই নাস্তার টেবিলে সবাই জড়ো হয়েছে। রোবা নাহার ও ঈশানী সবাইকে নাস্তা দিচ্ছেন। তটিনী মুখে নাস্তা নিয়ে রুদ্রের দিকে আড়চোখে তাকালো। কিন্তু সে বুঝতে পারলো বিয়ে করে রুদ্রের ভাব বেড়ে গেছে। বিয়ে তো হয়েই গেছে, পাত্তা দিলেও তার না দিলেও তার। রুদ্রের ভাবে পানি ঢেলে দিয়ে তটিনী টেবিলের নিচ দিয়ে রুদ্রের পায়ে গুঁতো দিলো। রুদ্র কেশে উঠলো তৎক্ষনাৎ। ঈশানী পানি এগিয়ে দিলেন। রুদ্র পানি খেয়ে চোখ বড়বড় করে তাকালো। অমনি তটিনী চোখ মেরে চুলে হাত ভুলিয়ে ভাব নিয়ে সেই যে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করেছে। রুদ্রের হাজার ইশারাতেও তাকালো না। ভাবটা এমন, ‘নাস্তার দিক থেকে যদি চোখ ফেরানো হয় তো নাস্তা বাবাজি তাকেই খেয়ে ফেলবে।’
হতাশ হয়ে রুদ্র ইশারা করা বন্ধ করলো। টেবিলের নিচ দিয়ে পায়ে পা লাগিয়েও লাভ হলো না।’
*
রুপান্তরের মাথায় যেনো আস্ত আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভিডিও কলে থেকে পারছে না মোবাইলের ভিতরে ঢুকে তটিণী-র চুল ছিঁড়ে ফেলে। রুপান্তর হা হুতাশ করতে লাগলো।
‘তুই এটা কিভাবে করতে পারলি তটিনী? এই ছিল তোর মনে? দেখানো বন্ধুত্ব করেছিস আমার সাথে। বিয়ে করে নিলি জানালি না। বাচ্চা পয়দা করে বসে থাকবি জানতেও পারবো না। হায় খুদা তুমি কেন আমাদের এই স্বার্থপর দুনিয়ায় পাঠালে।’
রুপান্তরের আহাজারি মনোযোগ দিয়ে শুনছে তটিনী। তার ভাবনা মতে, ‘তার হুট করে বিয়ে হয়েছে। সবাই হা-হুতাশ করবে স্বাভাবিক, বরং না করলেই অস্বাভাবিক মনে হতো। সুতরাং সে একদমই হা-হুতাশ করতে রুপান্তরকে বাঁধা দিচ্ছে না। বরং উৎসাহ দিয়ে বলছে, ‘আরও ভালো করে কর, এভাবে কর। ওটা ওভার হয়ে যাচ্ছে। এমন করে কর।
রুপান্তর সত্যিকারের হা-হুতাশ ভুলে মজা করা শুরু করলো।
‘বাসর টাসর করে ফেলেছিস? নাকি আমাকে জানিয়ে করবি বলে বসে আছিস?’
তটিনী নাক ছিটকালো।
‘বাসর টাসর হতে হলে সামাজিক ভাবে বিয়ে হওয়া আবশ্যক। এটা কোনো বিয়ে হলো? একটা সম্পর্কে আবদ্ধ করতেই জাস্ট হলো আরকি। আর তুই কি অশ্লীল রে, আমি কি তোকে তোর বিয়ের পর বাসরের কথা জিজ্ঞেস করেছি? দুজনেরই তো তাড়াহুড়োর বিয়ে।’
রুপান্তর মন খারাপ করে বলল, ‘আমারটা সামাজিক হলে ভালো হতো রে।’
তটিনী ভ্রু কুঁচকালো, ‘হঠাৎ অপছন্দের বিয়েটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি যে? মিনহাজ চৌধুরীর সাথে কি চলে আজকাল?’
রুপান্তর চোখের চশমা ঠিক করলো। দু’দিকে মাথা ঘুরিয়ে হেসে নিলো।
‘কিছুই চলছে না। আপাতত প্রেম হবে হবে ভাব।’
তটিনী ঠোঁট উল্টালো, ‘রুদ্র ভাই প্রেম কি বুঝে না মনে হয়। কি জানি বুঝলেও বুঝতে পারে। এমন রসকষহীন মানুষ!
রুপান্তরকে এই কথা বললেও তটিনী মনে মনে বলল, ‘রসকষহীন না ছাই। গতকাল আমার রুমে বারান্দা টপকে ঢুকে গেছিলো। এই বেটার রস তো বেয়ে বেয়ে পড়ে।’
তওবা করে তটিনী ভাবা বন্ধ করলো। রুপান্তর তটিনীকে লক্ষ করেছে এতোক্ষণ।
‘কি ভাবলি রে? তোর মুখের রিয়াকশন চেঞ্জ হলো কেন? কি লুকিয়েছিস বল।’
‘কিছু না ভাই, কি লুকাবো? লুকোনোর কি কিছু আছে? কিছু লুকালে তো জেনেই যাবি। তোর সোর্স তো বড়। দ্যা গ্রেট রুদ্র ভাইয়ের সাথে কন্ট্রাক্ট করিস।’
রুপান্তর চুল পেছনে ঠেলে ভাব নিলো।
‘অবশ্যই আমার সোর্স অনেক বড়। সম্মান টম্মান করিস, যতোই হোক পাওয়ার আছে।’
তটিনী বিরবির করলো, ‘তোর ব্যাঙের সোর্স, সেজন্য নিজের জামাইয়ের সম্পূর্ণ নামটাই জানলি গতকাল।
রুপান্তর চোখ বড়বড় করলো, ‘কি বলছিস আমাকে নিয়ে বিরবির করে?
তটিনী জিহ্বাতে কামড় দিলো।
‘কিছুই না রে। রুদ্র ভাইয়ের তো ভিসা কমপ্লিট। চলে যাবে দু’তিন দিনের ভেতরে। এটাই বলা বাকি ছিল তোকে।’
রুপান্তর তটিণী-র দিকে দুঃখী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস কর দোস্ত, এই দুঃখে আমি চোখে পানি আনতে চেষ্টা করছি। রুদ্র ভাই বিদেশে চলে যাবে সেটা তোর জন্য অবশ্যই মন খারাপি একটি ঘটনা হবে নিশ্চয়ই? আমি অনেক চেষ্টা করেও তোর দুঃখে দুঃখী হয়ে চোখে পানি আনতে পারছি।
রুপান্তর ওয়াটার বোতল থেকে চোখে পানি দিলো।
‘এই দেখ চোখের পানির সমাধান করেছি৷ আয় এবার দুঃখ বিলাস করি।’
তটিনী মুখের উপর ডিসকানেকটেড হয়ে গেলো। রুপান্তর তাকে নিয়ে রীতিমতো মজা নিচ্ছে। দ্যা গ্রেট ভাব ওয়ালীকে নিয়ে মজা করা! সে অবশ্যই সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিবে।
(চলবে)