#পর্ব-২২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে প্রকৃতি মেতেছে। জানালার ফাঁক গলিয়ে কিছু শুভ্ররঙা আলো রুদ্রের চোখেমুখে লাগছে। রুদ্র চট করে উঠে বসলো৷ ঘড়িতে সময় সাড়ে পাঁচ টা। অজু করে নামাজ পড়ে নিলো। তারপর নিজেকে বাহিরের পোশাকে আবরিত করে বাইক নিয়ে বের হয়ে গেলো। আগামীকাল সে পাড়ি দিবে সবাইকে ছেড়ে অন্য কোনো দেশে। আজ তার সময়টা সে সবার সাথেই কাটাতে চায়। প্রথমে যাবে নিজের মন খারাপের সঙ্গী জায়গাতে। যেখানে মন খারাপের সময় রুদ্র গিয়ে বসে থাকে।
সরোবর, পানির মধ্যে মাঝখানে রয়েছে গোলাপি রঙা শাপলা। রুদ্র সিঁড়িতে বসে জুতা খুললো। পানিতে পা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে রইলো।
আকাশ বাতাস প্রকৃতি দুলছে যেনো। সবাই জানান দিচ্ছে আজ রুদ্রের মন খারাপ। রুদ্রের তানে নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ ভেসে এলো। সে চোখ মেলে পেছন ফিরে তাকালো।
গোলাপি শাড়িতে নিজেতে আবরিত করেছে এক সদ্য বিবাহিত রমনী। পায়ে রুপার নুপুর ঝনঝন করছে হাঁটার তালে তালে। কোমড় সমান স্টেট করা চুল পড়ে আছে পিঠময় ছড়িয়ে। হাতে কাঁচের চুড়ি’রা রিনিঝিনি শব্দ তুলে চলেছে। লাল লিপস্টিক দ্বারা রাঙানো ঠোঁট আওড়িয়ে সে রুদ্রকে নিজের আসার কথা জানিয়ে দিলো।
‘আমি এসেছি।’
রুদ্র উঠে দাঁড়ালো। গোলাপি শাড়ির সর্বনাশীর দিকে এগিয়ে গেলো। হাতে হাত গুঁজে দিলো। সর্বনাশিনী রমনী রুদ্রের সর্বনাশ করতে চোখে চোখ রাখলো। রুদ্র ওই কাজল কালো চোখে ডুবে মোহে পড়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। সর্বনাশিনী’র পিঠ’ময় ছড়িয়ে থাকা চুলের ঘ্রাণ নিলো সর্বশ্র ভরে। তাহার মনে হলো কিছু একটা কমতি রয়ে গেছে। রুদ্র গোলাপি শাড়ির রমনীকে নিয়ে সরোবরের সিঁড়িতে বসলো। গোলাপি রঙের শাপলা ফুল ছিঁড়ে গুঁজে দিলো সর্বনাশিনী’র কানে। চোখ ভরে দেখে নিলো।
‘এবার পরিপূর্ণ লাগছে তোমায়।’
সর্বনাশিনী হাসলো।
‘আপনি পাশে আছেন বলেই আমি পরিপূর্ণ।’
রুদ্র উঠে দাঁড়ালো। নিজের পড়নের নীল শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে নিলো। পকেট থেকে আইফোন বের করে ক্যামেরায় টাইমার লাগিয়ে গাছে সেট করলো। সর্বনাশিনীর সাথে শাপলা বিলে বসে ক্যামেরা বন্দি করলো একের পর এক যুগলবন্দী।’
রুদ্র আচমকা চুমে খেলো সর্বনাশিনীর কপালে।
‘হালাল চুমু, মানা নেই তো?’
সে হাসলো।
‘হালালে আপত্তি থাকবে কেন?’
রুদ্র উস্কে গেলো। ভুলে গেলো জগৎ-সংসারের সব শব্দ। তার কানে শুধু সর্বনাশিনীর গভীর নিশ্বাস উপলব্ধি হলো। ওষ্ঠের ভাজে ওষ্ঠ মিলিয়ে সুখের অনুভুতিতে তলিয়ে গেলো।
নিঃশ্বাস তীব্র থেকে তীব্র হয়ে গেলো। সর্বনাশিনী শ্বাস নিতে পারলো না। অগত্যা ছাড়িয়ে নিলো সমস্ত শক্তি দিয়ে। হাঁপাতে লাগলো পুরোদমে। রুদ্র লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তাকে। পা’গুলো মেলে দিলো সরোবরের পানিতে। সর্বনাশিনীর আসন হলো হালাল প্রেমিকের কোল। রুদ্র নেশাগ্রস্তের মতো ডুব দিলো পুনরায়।’
বেলা গড়ালো। রুদ্র নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেলো। প্রকৃতির নিয়মের বাহিরে যাওয়া যাবে না। সে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। গোলাপি শাড়ির সর্বনাশিনী তখন লজ্জায় টইটম্বুর। মুখশ্রী শাড়ির আঁচল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে সে।
রুদ্র নিজেকে শান্ত করে পাশে বসলো।
‘আগামীকাল চলে যাবো ঐশি, তোমার খারাপ লাগবে না?
ঐশি লজ্জা ভুলে মুখ তুলে তাকালো রুদ্রের মুখপানে। লাজরাঙা মুখশ্রীর গাল বেয়ে নামতে লাগলো অশ্রু’র ধারা। রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম ঐশির চোখে তার জন্য অশ্রু দেখতে পেলো। রুদ্র নিজের দু’হাতের মধ্যে ঐশির মুখশ্রী আগলে নিলো।
‘হুস কাঁদে না, সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না। তোমাকে রেখে ওখানে মন ঠিকবে না। ইন্টারনেটের যোগে যোগাযোগ করার জন্য কোনো সমস্যা হবে না। পারলে সারাদিনই ভিডিও কলে কানেক্ট থাকবো, কেমন? তবুও কেঁদো না প্লিজ।’
সর্বনাশিশীর অশ্রুসিক্ত চোখে দৃষ্টি রাখলো রুদ্র। পড়ে নিতে চাইলো যতো না বলা অনুভূতি। তটিনী মুখ নিচু করলো। রুদ্র কপালের চুল কানে গুঁজে দিয়ে চুম্বন করলো গভীরভাবে। তটিনী কেঁপে উঠলো। রুদ্র নিজের বুকে ঠাঁই দিয়ে পিঠে হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।
‘আপনি ওখানে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবেন না তো?’
রুদ্র হাসলো।
‘যার কারণে আমার সর্বনাশ হলো সেই সর্বনাশিনী’কে ভুলা যে দ্বায় হবে ঐশি।’
তটিনী শার্টের ফাঁক গলিয়ে উন্মুক্ত বুকে চুম্বন করলো। রুদ্র শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো গভীরভাবে।
‘তুমি আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছো ঐশি।’
‘সবসময়ই তো অ-দূর্বল থাকেন, আজ না-হয় একটু দূর্বল হোন।’
রুদ্র হাসলো,
‘তুমি আজকাল নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করে চলেছো নিজের মতো। বাংলা ভাষাবিদ’রা শুনলে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।’
তটিনী বুকে আস্তে হাতের আঘাত করলো।
‘আপনি না বললেই হলো, জানতে পারবে না।’
রুদ্র শব্দ করে হাসলো,
‘যদি বলে দেই?’
তটিণী-র সহজ স্বীকারোক্তি,
‘আপনি বলবেন না।’
রুদ্র নাক ঘষে বলল,
‘তুমি বড্ড বেশি বুঝো পাখি।’
‘ওমা বেশি বুঝবো না? ঠিক আছে এখন থেকে কম কম বুঝবো।’
‘উঁহু তোমাকে বেশি বুঝাইতে মানায়। বড়ো হয়ে গেলে যে বউ।’
রুদ্রের মুখে প্রথম বউ সম্মোধনে তটিণী-র বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো। হাসফাস করতে লাগলো দারুণ ভাবে। রুদ্র সেটা বুঝে নিলো। নিজের উপর টেনে নিলো তটিণী-র সমস্ত অস্তিত্ব। তটিনী চোখ বন্ধ করে নিলো। রুদ্র ওষ্ঠে ডুবে যাওয়ার আগে বলল,
‘আমি আজ পাগল হয়ে যাচ্ছি ঐশি, আমার সর্বনাশ করার জন্য তোমার নামে মামলা ঠুকে দিবো। তোমাকে বন্দি করা হবে রুদ্র ইরফান নামক জেলখানায়।’
তটিনী পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
‘জেলখানা আপনার নামে হলে আমি সারাজীবন বন্দি হতে রাজি।’
*
তটিনী ও রুদ্র একে অপরের হাতের মুঠোয় হাত রেখে হেঁটে চলেছে দুপুরের তপ্ত রুদে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেলো। কিন্তু দুজনের মন এখনো ঘুরে রয়ে গেছে। রুদ্রের ফোনে কল আনছে বার-বার। হেঁটে হেঁটে দুজন বাইকের কাছে আসলো। রুদ্র বাইকে চেপে বসলো। তটিনী রুদ্রকে আবেশে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্র স্প্রিড তুলে হাওয়ার বেগে ছুটে চললো বাড়ির দিকে।
বাড়িতে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল দুজনের জন্য। রোবা নাহার বউ বরণ করার সব আয়োজন করেছেন। তটিনীকে বরণ করে ঘরে তুললেন রুদ্রের বউ হিসেবে। রুদ্রের মুখের হাসি সরছে না। তটিনী রুদ্রের পেছনে মুখ লুকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে।
রোবা নাহার মাথায় হাত রাখলেন।
‘আজ শুধু পরিবারের সবার সামনে বরণ করছি, একদিন আত্নীয় স্বজন সবার সামনে বরণ করে ঘরে তুলবো। আমার রুদ্রের যোগ্য বউ হবি তুই মা।’ আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে সারাজীবন। এর থেকে বড়ো পাওয়া আমার জন্য আর কি হতে পারে?’
ঈশানী চোখের জল মুছলেন,
‘আমি সবসময়ই ওকে নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। চঞ্চল অনেক, কার কপালে জুটবে। ওকে কিভাবে রাখবে। কিন্তু আজ আমার সকল চিন্তা শেষ। যোগ্য ব্যক্তির সাথে জুড়ে দিয়ে শান্তি পাচ্ছি। আমাদের রুদ্র যোগ্য ছেলে। তোকে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে রে মা।’
তটিনী মায়ের বুকে মুখ লুকালো। রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো। তটিণী-র দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকিয়ে উপরে উঠে গেলো।
রোবা নাহার রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
‘ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো সবাই।
খাবার টেবিলে আবারও জমজমাট হলো। এটাই হয়তো রুদ্রের সাথে সবার শেষ এক টেবিলে খাওয়া। আল্লাহ বাচিয়ে রাখলে আবারও বসা হবে এক টেবিলে। ততোদিন শুধু অপেক্ষা।
রুদ্র নিজ মনে এসব ভেবে চলছিল। তন্মধ্যে তটিণী-র কাশি উঠে গেলো। নাকেমুখে খাবার ঢুকে বেচারির অবস্থা খারাপ। রুদ্র পানির গ্লাস ধরেছে সামনে। তটিনী সেটা গিলে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলো। রুদ্র ধমক দিল,
‘খাওয়ার সময় মন কোথায় থাকে?’
তটিনী ফুপিয়ে উঠলো। সবার সামনে রুদ্রের বুকে হামলে পড়লো। বিরবির করে বলল, ‘আপনি হারিয়ে যাবেন না প্লিজ।
(চলবে)