#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
‘আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি সেটা যদি তোমার সামনে প্রকাশ পেয়ে যায় তো তুমি একা থাকার এই যুদ্ধে স্থায়ী হতে পারতে না আমার ইরাবতী! আমি একটু ইশারা করলেই তুমি আবেগি রানীর মতো ঝাপিয়ে পড়বে আমার বুকে। কিন্তু জানো তো ইরাবতী তোমাকে ভালোবাসার সাথে সাথে তোমাকে সম্মান করি! তোমার সম্মানে আঘাত লাগবে এমন কোনো কাজ আমি করতে পারবো না। তোমার ধর্মে আঘাত লাগবে এমন কাজ করা সম্ভব হবে না! আমি ক্লান্ত পথিকের মতো তোমারই অজান্তে কতো অজানা পথ খুঁজে চলেছি। কিভাবে তোমাকে নিজের করা যায়? কোনো পথ নেই! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাঁধা যেটা আমি তুমি আমরা অতিক্রম করতে পারবো না! ইরাবতী তুমি চমৎকার একটি মেয়ে! আমার জন্য নিজেকে একা করে দিবে সেটা আমি মানতে পারছি না। আমার জন্য তুমি সারাজীবন দুঃখ পাবে সেটাও আমি মানতে পারবো না। তাই আমি চাইবো তুমি নতুনত্বের দিকে পা বাড়াও। জানো ইরাবতী? এটা লিখতে আমার কলিজা কাঁপছে! কিন্তু কি করবো বলো? নিয়তির কাছে যে আমি অসহায়! তুমি বরং ভালো থেকো ইরাবতী! হোক সেটা অন্য কারো সাথে! তোমার ভাইয়ের বন্ধু হওয়ার সুবাদে খবর পেলাম তোমার বিয়ের কথা চলছে। আমি চাই তুমি সুখী হও। কিন্তু কেন যেন বুক জ্বালাপোড়া করে, কেন এমন হয় ইরা?’
ডায়েরিটা বন্ধ করলো মাহেন্দ্র। চোখের চশমা খুলে ফেলে রাখলো টেবিলে। হতাশাগ্রস্তের মতো উপরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ!
দিন গেলো। মাসের পর মাস অতিক্রম হলো। মাহেন্দ্র কোনো পথ খুঁজে পেলো না। তারপর হঠাৎ করে তার মাথায় একজন ব্যক্তির নাম এলো। মাহেন্দ্রের হঠাৎ করেই মনে হলো এই ব্যক্তি ছাড়া কেউ তার সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
মাহেন্দ্র সেই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করলো। কফিশপে মিটিং করলো তারা। সবশেষে মাহেন্দ্র সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। মসজিদের হুজুরের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করলো।
তারপর আচমকা আগমনী বৃষ্টির মতো গিয়ে দাঁড়ালো ইরাবতীর সম্মুখে। মেলে দিলো নিজের দুহাত। কোনোকিছুরই পরোয়া করলো না।
‘ধর্মের বাঁধা সমাধান করে দূরত্ব কমানোর সুযোগ এসেছে ইরাবতী। দূরে দাড়িয়ে থেকো না।’
ইরাবতীর চোখমুখ জুড়ে বিস্ময়। যেন সে কোনো ঘোরে আছে। মুখে হাত রেখে টলমল চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো সত্যি?’
মাহেন্দ্র চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়িয়ে হাসলো। নাক টেনে বলল, ‘এবার তো এসো ইরাবতী, আর সইছে না।’
ইরাবতী দূর্বল পায়ে এগিয়ে এলো। তার হাঁটার শক্তি নেই আজ। তার শরীর দুলছে। সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মন কেমন করা বৃষ্টির মতো ঝাপিয়ে পড়লো মাহেন্দ্রের বাহুডোরে। আকাশ চিৎকার করে গর্জন করলো। ভিজে চপচপ হলো দুজন। কিন্তু সরে গেলো না এক চুল ও। ইরাবতী ও মাহেন্দ্র চিৎকার করে কখনো কাঁদছে কখনো হাসছে। ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে। মাঝে মধ্যে ইরাবতী মাথা নাড়াচ্ছে। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় মানুষ নেই। দূরের দোকানের ছাউনিতে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। তারা অবাক হয়ে এদিকেই দেখছে। মাঝে মধ্যে কিছু পথচারীদের দেখা মিলছে৷ সবকিছুকে তুচ্ছ করে একে অপরকে শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে রইলো তারা।
মুসলিম ছেলেদের কিন্তু কিছু একটা করতে হয় মাহেন্দ্র!
ইরাবতীর কথাতে মাহেন্দ্র ফটাফট উত্তর দিলো, ‘করেছি তো।’
‘কই?’
‘এখনই দেখবে নাকি? বিয়ের পর দেখো না-হয়!
ইরাবতী কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলো। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো মাহেন্দ্রের দিকে। মাহেন্দ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এখনই দেখবে? এই রাস্তায়?
ইরাবতী তার বুকে মৃদু জোরে ঘুষি দিলো, ‘অসভ্য!’
অসভ্য বলো না মেয়ে, মোহাম্মদ মাহিদ খান বলবে, ঠিক আছে?’
ইরাবতীর আজ অবাক হওয়ার দিন। মাহেন্দ্র ইরাবতীর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘নামটা পছন্দ হয়নি?’
ইরাবতী মৃদুস্বরে ডাকলো, ‘মাহিদ?’
সে হাসলো, ‘তুমি জানো আমি নামাজ পড়তে পারি। চার কালিমা ও পারি। কোরআন শিখছি ইরা।’
ইরাবতী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, ‘আমার না সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে মাহেন্দ্র। আপনি মজা করছেন না তো?’
মাহিদ চোখ লাল করে তাকালো, ‘আমাদের ধর্ম নিয়ে মজা করা যায় না ইরা। মাহিদ বলে ডাকবে।’
ইরাবতী মাহিদকে পর্যবেক্ষণ করলো। তখনই মাহিদ পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় পড়ে নিলো। বলল, ‘এবার ঠিক আছে ইরা বেগম?
ইরাবতী কেঁদে কেঁদে ও হাসলো। মাহিদ চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘একদম কাঁদবে না ইরা বেগম।’
‘এতো কিছু কিভাবে করলেন?’
মাহিদ হাসলো।
‘আছে কেউ তোমার পরিচিত যার জন্য আমি পথ খুঁজে পেয়েছি। সময় হলে বলবো।’
ইরাবতী মাহিদের পবিত্র হাসি চোখ ভরে দেখলো। এই লোকটা এতো সুন্দর করে হাসে কিভাবে?’
‘ইরা? ইরা? ইরা?’
মাহিদ আদর করে আবারও ডাকলো, ও ইরা?
ইরাবতী তাকিয়ে রইলো। মাহিদ মুখে হাত রেখে হাসলো, ‘তোমাকে ডাকতে আর বাঁধা নেই ইরা। আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না। ইরাবতী তুমি শুনছো তো?
ইরাবতী মাহিদের হাত ধরে হেঁটে চললো পিচঢালা রাস্তা দিয়ে। সময়টা আজ থমকে যাক। এটা যদি স্বপ্ন হয় তো কখনো ভেঙে না যাক। ইরাবতী যদি ঘুমিয়ে থাকে তো এভাবেই সারাজীবন ঘুমিয়ে থাক। তবুও যেনো এই ঘুম না ভাঙে। তার হাত ধরে হেঁটে চলা এই ছেলেটি সারাজীবন তার হয়ে থেকে যাক। মাহেন্দ্র চক্রবর্তী উঁহু মোহাম্মদ মাহিদ খান সারাজীবন ইরাবতী আফনানের হয়ে যাক!
*
ইরাবতীর বাড়িতে চাপা গুঞ্জন। ইরাবতীর বাবার কানে ইতিমধ্যেই খবর এসেছে ইরাবতী সেই ভিন্নধর্মী ছেলেটার সাথে রাস্তায় ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। সাথে সবাই এটাও জেনে গেছেন ভিন্নধর্মী সেই ছেলেটা নিজের নতুন পরিচয় তৈরি করে ফেলেছে! ইরাবতীর বাবা ইরাবতীর ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ইশান মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি এসবের কিছুই জানতাম না আব্বা। মাহেন্দ্র যে এমন কিছু করবে আমি কখনোই ভাবিইনি।’
‘তোমার বোনকে হোস্টেল থেকে বাড়িতে ফিরতে বলবে শীগগির। সমাজে কি আমার সম্মান নেই? আমি তাকে আমার সামনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দেখতে চাই।’
ইশান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। নিজের রুমে গিয়ে মনপ্রাণ খুলে হাসলো। তার হঠাৎ করেই মনে হলো ভালোবাসা সুন্দর! ধরে রাখতে জানলে ভালোবাসা কখনো হারায় না। কখনোই না!
চব্বিশ ঘন্টার ভিতরে মাহিদ ও ইরাবতী হাজির হলো ইশানদের বাড়িতে। ইশানের বাবা গম্ভীর মুখে মাহিদকে পর্যবেক্ষণ করলেন।
‘তুমি আমার মেয়ের জন্য নিজ ধর্ম ত্যাগ করেছো?’
মাহিদ হাসলো, ‘না।’
ইরাবতীর বাবার চোখ ছোটছোট হলো, ‘তাহলে?’
‘আঙ্কেল আমি যদি আপনার মেয়েকে শুধৃ ভালোবেসে ধর্ম পরিবর্তন করে থাকি তো সেটা অন্যায়! আমি সবার আগে ধর্মকে ভালোবেসেছি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেকে পরিপূর্ণ করেছি। সেই সাথে এতোদিন ধরে মনে আটকে থাকা এক বাঁধা অতিক্রম করেছি। সব যন্ত্রণা সরে গিয়ে শান্তিরা উদয় হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে এই ধর্মকে ভালোবাসার কারণে। সেজন্য আমি কখনোই বলবো না যে আপনার মেয়ের জন্য আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। হ্যাঁ আপনার মেয়েও একটা কারণ ছিল, কিন্তু আমি যখন বুঝতে পেরেছি তখন হুজুরের সাথে কথা বলেই মন থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছি।
ইরাবতীর বাবা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পরিবার?’
মাহিদ হাসলো, ‘পরিবার বলতে মা রয়েছেন।
‘কি চাকরি করো?’
‘পাইভেট কোম্পানিতে।’
তোমার ধর্ম গ্রহণ করার ব্যাপারটা আমাকে শিওর হতে হবে। সাথে জানতে হবে তুমি যা বলছো তা সত্যি কি না। আমি তোমাকে ভাববো, তুমি আমার টার্গেটে থাকলে। যদি মিথ্যা হয়! তুমি কখনো আর চোখ মেলে দুনিয়া দেখতে পারবে না!
মাহিদ হাসলো, ‘জ্বি আচ্ছা!’
(চলবে)
( পুরোপুরি সুস্থ হইনি৷ লিখতে হাত কাপে. কিন্তু না লিখেও থাকতে পারি না। দোয়ায় রাখবেন।)