#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
শুক্রবার। আবহাওয়া ঠিক কিরকম সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। হঠাৎ প্রচন্ড হাওয়া তো হঠাৎ রোদ্দুর। হঠাৎ একটা দুটো বৃষ্টির ফোঁটা টপটপ করে পড়ছে মাটিতে। এই জটিল আবহাওয়াতে রুদ্রের সাথে ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে চড়ে বসেছে তটিনী। পড়োনে জিন্স ও ফতোয়া। উপরে জ্যাকেট পড়া। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ভাব নিয়ে গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে সে। রুদ্র নিজের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিয়ে বলল, ‘সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছিস? পরে বলিস না যেনো এটা আনতে ভুলে গেছি ওটা আনতে ভুলে গেছি।’
তটিনী প্রতুত্তরে কিছু বললো না। শুধু ভাব নিয়ে একবার সানগ্লাস হাত দিয়ে নাড়ালো। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন? সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার খুশিতে পা*গল হয়ে গেলি নাকি?’
তটিনী বরাবরের মতো সানগ্লাস নাড়ালো, বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদের শুভ্র চরিত্রের মতো দ্বারুচিনি দ্বীপে যাচ্ছি। ভাব তো থাকবেই। আমি এখন ভাবের কারণে আপনার সাথে কোনো কথাতটা বলতে পারবো না রুদ্র ভাই। সো ডোন্ট আক’স মি এনি কুয়েকশা।’
রুদ্র নাকমুখ কোঁচকে বলল, ‘ইংরেজেরা তোর ইংলিশ শুনলে জ্ঞান হারাতো সেটা তুই জানিস?’
তটিনী সানগ্লাস নাড়িয়ে বলল, ‘সেন্টমার্টিনে ঘুরতে যাচ্ছি সম্মান দিয়ে কথা বলুন। নাহলে আপনাকেই অজ্ঞান করে দিবো।’
রুদ্র থমথমে মুখশ্রী নিয়ে চুপ হয়ে গেলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গাড়িটা তাদের পৌঁছে দিবে সায়দাবাদে। সেখান থেকে বাকি পাঁচ জনের সাথে মিলিত হবে তারা।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে সায়দাবাদ পৌছে তটিনী রুদ্রের হাত ধরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নেমে দাঁড়ালো। তখনই তাদের ঘিরে ধরলো একদল তরুণতরুণী। তটিনী সানগ্লাস নাড়িয়ে বলল, আপনারা কারা? এভাবে ঘিরে ধরেছেন কেন? সরে দাড়ান বলছি উফ বাবা দমবন্ধ হয়ে গেলো আমার।’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সাইলেন্স ঐশি, ওরা আমার বন্ধু হয়। তোমার দু আনার ভাব তোমার কাছেই রাখো আপাতত। নাহলে মানসম্মান নিয়ে যাত্রা করতে পারবে না।’
তটিণী-র হৃদপিণ্ডে লাগলো কথাটি। একটানে সানগ্লাস খুলে বলল, ‘হু আর ইউ? এসব বলার আপনি কে?’
‘আমি তোমার কাজিন হই, তোমাকে আমার দায়িত্বে ছাড়া হয়েছে বাসা থেকে। ভুলে গেছো?’
তটিনীর ভাব পুনরায় ফিরে আসলো। বলল, ‘সেটা বাড়ি থেকে বের হয়েই আমি ভুলে গেছি। আপনিও ভুলে যান। এই মুহুর্তে আমরা কোনো কাজিন নই। শুধুমাত্র যাত্রার সঙ্গী। ওকে?’
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের বন্ধুদের দিকে তাকালো। যারা হা করে তাকিয়ে এতোক্ষণ তটিনীকে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রমি তটিণী-র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বলল, ‘হাই আমি প্রমি আজাদ। রুদ্রের বন্ধু। তুমি আমাদের যাত্রা*সঙ্গী হতে চলেছো।’
তটিনী আলতো করে হাত মিলিয়ে বলল, ‘হ্যালো, আমি তটিনী ইফফাত ঐশি। আপনার যাত্রাপথে সঙ্গী হত৷ পেরে আমারও অনেক ভালো লাগবে।’
প্রমির পাশ থেকে ফয়সাল ফিসফিস করে বলল, ‘স্কুলের ইংরেজি বই থেকে ডায়লগ শিখে এসেছে নাকি?
প্রমি তটিণী-র দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল, ‘চুপ কর শুনে ফেলবে বাচ্চা মেয়ে।’
তটিনী কথাগুলো শুনে ফেললো। তার কান বরাবরই এক্সপার্ট মানুষের কথা শুনতে। কিন্তু সে সেটার বিনিময়ে কোনো উত্তর দিলো না। তিতা হলেও সত্য সে সত্যিই স্কুলের ইংরেজি বই থেকে ডায়লগ মুখস্থ করে এসেছে। যাত্রাপথে ভাব নিতে হবে না?’
এবার হাত বাড়িয়ে দিলো জোনাকি। বলল, ‘কেমন আছো ঐশি? তোমার কথা অনেক শুনি রুদ্রের কাছ থেকে।’
তটিনী হাত মিলিয়ে বলল, ‘আ’ম ফাইন, হোয়াট এবাউট ইউ?’
জোনাকি মুচকি হেসে বলল, ‘আ’ম অলসো ফাইন কিউট গার্ল।’
তারপর হাত বাড়ালো ইশা। বলল, ‘আমি হেই নটি গার্ল? আমি ইশা আহমেদ। রুদ্রের বন্ধু।’
তটিনী এবারও হাসিমুখে হাত মিলিয়ে বলল, ‘আমি রুদ্রের কেউ হই না, আমি তটিনী ইফফাত ঐশি।’
রুদ্রের কানেকানে রাফসান বলল, ‘তোর না কাজিন হয়?’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বাড়ি থেকে বের হবার পর সে আমার কিছু হয়না। আপাতত আমরা অপরিচিত!’
রাফসান হতভম্ব চোখে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েটি এত বাচ্চা!
তটিনী এবার নিজ থেকে এগিয়ে এসে রাফসানের দিকে হাত বাড়ালো। বলল, ‘হ্যালো মিস্টার আ’ম তটিনী ইফফাত ঐশি।
রাফসান হাত মিলিয়ে বলল, ‘আমি আপনার নাম জানি। আপনাকে বলতে হবে না। আশা রাখছি আপনিও আমার নামটা জেনে থাকবেন।’
তটিনী ভাব নিয়ে চোখে সানগ্লাস পড়ে বলল, ‘সবার নাম মনে রাখার মতো সময় আমার নেই। তো চলুন টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়া যাক?’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে নিজের ব্যাগ নিয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগলো। তটিণী নিজের ছোট ছোট পা নিয়ে পিছিয়ে পড়লো। অগত্যা ভাব ছেড়ে দৌড়ে রুদ্রের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। দৌড়ে আসতে গিয়ে ভাবওয়ালা তটিণী-র ভাবওয়ালা সানগ্লাসও খুলে পড়ে গেলো!’
রাত আটটার দিকে এসি বাসে বসে পড়লো তারা। তটিণী-র সিট রুদ্রের পাশেই পড়েছে। রুদ্র নিজেই নিজের পাশে সিট কে*টেছে। যেই মেয়ে কখন না হারিয়ে যায় এদিক সেদিক।
বাসের সিটে বসে তটিনী পায়ের উপর পা তুললো। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘পা নামিয়ে বস। তোর বাপ চাচা কিনে নি বাস।’
তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘বাপ চাচা কিনেনি তো কি হইছে? আপনি টিকিট কা*টেন নি? টাকা দিয়ে বসছি। পারলে সিটের উপর পা তুলে বসবো আমার ইচ্ছে। হুহ!
রুদ্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো যাত্রাপথে আর একটাও বাক্যব্যয় সে এই ভাবওয়ালী ঝগড়ুটে মেয়েটার সাথে করবে না।
বারো ঘন্টার জার্নি। এই বারো ঘন্টা তটিনী একদমই চুপ হয়ে বসে থাকার মতো মেয়ে নয়। রুদ্র নিজ থেকে কথা বলছে না বলে তটিনী নিজ থেকে বলল, ‘বাসে তো বারো ঘন্টা বসে থাকতে হবে। চলুন না কিছু করি?’
রুদ্রের গম্ভীর গলা, ‘কি করতে চাইছিস?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘যা করলে বোরিং লাগবে না।’
রুদ্র নিজের ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে দিলো। তটিনী সেটা হাতে নিয়ে বলল, ‘জার্নিতে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে যাবো। ওয়াও।’
রুদ্র হেডফোন কেঁড়ে নিয়ে বলল, ‘ওটা তোর জন্য না।’
তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘দেন না একটু, গানই তো শুনবো।’
রুদ্র অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এটা দিয়ে গান ছাড়া কি আর কিছু শুনা যায়?’
তটিনী মাথা নাড়িয়ে না করলো। রুদ্র অদ্ভুত চাহনি না পাল্টিয়ে বলল, ‘তাহলে বললি কেন গানই তো শুনবি? অন্য কিছু শুনার ধান্দায় ছিলি নাকি?’
তটিনী ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে অন্য কিছু শুনে রুদ্র ভাই। ‘
রুদ্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে আবারও তাকালো। বলল, ‘কি শুনে?’
তটিনী মুখে হাত চেপে ধরে বলল, ‘জানিনা তো তবে শুনে অন্য কিছু।’
‘তুই না জানলে কেমনে জানলি অন্য কিছু শুনে?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আমার পেছনের সিটে সাথী নামের একটি মেয়ে বসে। ও সারাক্ষণ হেডফোন কানে লাগিয়ে থাকে। ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে ফিসফিস করে।’
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুই শুনিস না কেন?’ তুই ও শুনবি। সেন্টমার্টিন থেকে এসে তোকে আমি ভালো ব্রেন্ডের একটা হেডফোন কিনে দিবো। সেটা দিয়ে সারাক্ষণ তুইও ক্লাসে বসে ফিসফিস করে কথা বলবি। ঠিক আছে?’
তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘কিন্তু আমার মতো বয়ফ্রেন্ড নেই রুদ্র ভাই। ‘
রুদ্র দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘নেই কেন?’
তটিনী অবুঝ বাচ্চার মতো বলল, ‘হবে কিভাবে? যাঁরাই প্রেম করতে আসে তাদেরই তো আপনি টাইট দিয়ে তাড়িয়ে দেন।’
রুদ্র নিজের মাথা চেপে ধরে বলল, ‘চুপ কর। আমার কি খেয়ে কাজ নেই? তুই প্রেম করবি কর আমার কি? আমি কেন হুদাই টাইট দিতে যামু। তোর বিয়েতে কি তোর জামাই আমারে টাকা দিবো তোরে সারাজীবন পাহাড় দিয়ে রাখার জন্য?’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তাহলে রাজ যে বলল আপনি সবাইকে তাড়িয়ে দেন।’
রুদ্র হাতজোড় করে বলল, ‘ক্ষ্যামা দেন মা, আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না।’ বলেই ভাবওয়ালী তটিনীকে ইগনোর করে চোখে সানগ্লাস পড়ে নিলো রুদ্র। ভাবের বিপরীতে ভাব পেয়ে তটিনী দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘ও আচ্ছা আপনি আমাকে এতোক্ষণ নকল করতে চেষ্টা করেছিলেন রুদ্র ভাই? হা হা হা হা!’
(চলবে)