#প্রতিশোধ ৩য় ও শেষ পর্ব
চিন্তাচ্ছন্ন শামীম কলিং বেলের আওয়াজে সচকিত হলো, অল্প পরেই রাজু এসে বললো… সাহেব, আপনার একজন বন্ধু আসছেন, দেখা করতে চায় আপনার সাথে।
এত বিরক্ত লাগলো শামীমের, কিছু করার নেই, বাড়িতে কেউ এলে তাকে চলে যেতে বলা যায় না। বসার ঘরে এসে দেখলো আসাদ বসে আছে, পুরনো বন্ধু, আগেও বাসায় এসেছে, মাঝখানে বহুদিন আর আসেনি।
শামীম জোর করে হাসি আনলো মুখে…. আরে তুমি! কি খবর, কেমন আছো? এতদিন কোথায় ছিলে?
রাজুকে চা নাস্তা আনতে বলে বসলো শামীম। আসাদও হাসিমুখেই জবাব দিলো…. আমি ভালোই আছি, এতদিন আমেরিকায় ছিলাম। তোমরা কেমন আছো? ভাবীকে দেখছি না, কোথায় সে? ডাকো, তার হাতের চায়ের স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি।
— মায়া নেই। সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো শামীম।
— বাইরে গেছে বুঝি, শপিং?
— না, মায়া মারা গেছে।
আঁতকে উঠলো আসাদ — বলছো কি তুমি! কিভাবে?
শীতল স্বরে বললো শামীম — ওকে খুন করা হয়েছিলো…
চমকে উঠলো আসাদ —- খুন! কেন, কে করলো? খুনী ধরা পড়েছে?
গম্ভীর হয়ে গেলো শামীম…. এই প্রসঙ্গ থাক, অন্য কথা বলো, আমেরিকায় কবে গেলে, কিসের জন্য গিয়েছিলে…
আসাদ কথা বলতে লাগলো ঠিকই কিন্তু সেও যেন বির্মষ, অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলো দুই বন্ধু, চা টা খেলো তারপর আসাদ বললো — এত ভালো মেয়েটাকে খুন করলো কে, আশ্চর্য! কাউকে সন্দেহ হয়নি?
শামীম অনিচ্ছার সাথে বললো —- না, কাকে সন্দেহ করবো? কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি, তাছাড়া প্রমাণ ছাড়া…
বলতে বলতে থেমে গেলো শামীম, আসাদ কিন্ত থামলো না, রসিকতার সুরে বলে উঠলো…. এই দেখো, তুমি আবার আমাকেই খুনী ভাবছো না তো?…. এটা যেন সেই প্রচলিত কথা ‘ ঠাকুর ঘরে কে রে…. না আমি তো কলা খাইনি ‘ — বিরক্ত হয়ে শামীম বললো…. কি যা তা বলছো, তোমাকে কেন খুনী ভাববো, কি মুস্কিল….
এরপর ওদের কথা আর জমলো না, কিছুক্ষণ পরে আসাদ চলে গেলো।
সে চলে যাওয়ার পরেই শামীমের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো…. মায়া একদিন বলেছিলো যে আসাদ প্রায়ই নাকি বাসায় আসে, সে সময়টা শামীম বাসায় থাকে না, মায়ার একটুও ভালো লাগে না। অতি ভদ্র, শান্ত মেয়ে মায়া… মানাও করতে পারে না, স্বামীকে বলেছিলো — তুমি ওকে আসতে মানা করে দিয়ো, ওর চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তা ভালো না।
শামীম তখনই ফোন করে আসাদকে মানা করে দেয়…. মায়া পছন্দ করে না, তুমি আর এসো না।
এরপর আসাদ আর আসেনি। মায়ার ওপর আসাদের নজর ছিলো, ওই এই ঘৃণিত কাজ করেনি তো? কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার যে সময়ের কথা আসাদ বললো, সেটা মায়া খুন হওয়ার আগে, সে সময় তো আসাদ দেশেই ছিলো না।
কয়েক দিন পর… শামীম চেম্বারে রোগী দেখছিলো
শফিক এসে জানালো স্যারের বন্ধু আসাদ এসেছেন, শামীম খুব অবাক হলো তারপর বললো… ঠিক আছে, একটু বসতে বলো, আমি এই কাজটা শেষ করেনি, বেশীক্ষণ লাগবে না।
আসাদ চেয়ারে বসতে শামীম বললো… কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ!
অবসন্নভাবে আসাদ উত্তর দিলো… শরীরটা কদিন থেকে খারাপ লাগছে, তুমি থাকতে আর কাছে যাবো।
শামীম কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলো, প্রেশার দেখলো তারপর প্রেসক্রিশন লিখতে লিখতে বললো…. কয়েকটা পরীক্ষা করতে দিলাম, করিয়ে নাও, আন্দাজে তো ওষুধ দেওয়া যায় না, পরীক্ষার পর রিপোর্ট দেখে….
এই সময় একটা ঝমঝম আওয়াজ হতে মুখ তুলে শামীম স্তম্ভিত হয়ে গেলো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না এই অলৌকিক, অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে…. মায়ার কঙ্কালটা হেঁটে আসছে…. আসছে… এসে ঠিক আসাদের পেছনে দাঁড়ালো… গোটা শরীরটা কঙ্কালের কিন্তু মুখটা রক্ত মাংসের মায়ার…. লাবণ্যবতী রূপসী মায়া নয়…. হিংস্র, মোমের মত সাদা মুখ, চোখ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
এদিকে শামীমকে বিস্মিত চোখে তার পেছনে তাকাতে দেখে আসাদ ঘুরে দেখতে গেলো তারপরই আতঙ্কে বীভৎস চিৎকার করে উঠলো।
মায়া দুহাতে আসাদের গলাটা চেপে ধরলো…. শামীম শুধু চিৎকার করে বলতে পারলো ‘ মায়া… না ‘ তারপরই যেন পাথরে পরিণত হলো… বুঝতে পেরেছে সে, অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিলো — পরিচিত কেউ না হলে মায়া সেদিন দরজা খুলতো না, শামীমের নিষেধ ছিলো… কী – হোলে দেখে নিশ্চিত হয়েছে এবং আসাদ তার ইচ্ছা মত আক্রোশ মিটিয়েছে, খুনটাও করেছে পরিকল্পনা করে, কারণ মায়াকে বাঁচিয়ে রাখলে পুলিশ তো বটেই… শামীমও তাকে ছাড়তো না — প্রিয়তমা স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করার জন্য খুন করে ফেলতো আসাদকে।
মুখোশধারী শয়তানটার গলাটা চেপে ধরে অর্পাথিব ভয়াবহ স্বরে বললো মায়া…. ইবলিশ, জানোয়ার, কত মিনতি করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি কিন্তু ছাড়িসনি তুই, এতদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, আমাকে খুন করে তুই বাঁচতে পারবি? আমার সোনার সংসার তোর লালসায় ছারখার করে দিয়েছিস, দিনের পর দিন আমার স্বামী জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছে…. শেষের দিকে মায়ার স্বর করুণ হয়ে এলো।
এদিকে আসাদের অবস্থা কাহিল, দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখ দুটো ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কঙ্কালের হাত দুটো ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে চিৎকার শুনে শফিক ছুটে এসে এই ভয়াবহ অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখে জায়গাতেই জমে গেলো।
যত কষ্ট, বেদনা মায়া পেয়েছিলো আসাদকে ধরে রেখে উশুল করতে লাগলো… অবশেষে বললো…
— আমার স্বামীর কাছে স্বীকার কর সব কিছু নইলে মেরে ফেলবো তোকে।
রুদ্ধস্বরে বললো আসাদ…. বলবো, সব বলবো, আমাকে ছেড়ে দাও মায়া….
কাঁপতে কাঁপতে স্বীকারোক্তি দিলো আসাদ, শামীম ও শফিক শুনলো…. আসাদের কথা শেষ হওয়া মাত্র মায়ার বজ্র কঠিন চাপ আলগা হয়ে গেলো, মৃদু স্বরে বললো মায়া… এতদিন পরে শান্তি পেলাম আমি, মুক্তি হলো আমার আত্মার…. বলেই শামীমের দিকে তাকালো — সেই অপরূপ লাবণ্যবতী মায়া, দুচোখে তার অশ্রু টলমল করছে… একটু হাসলো, বেদনার হাসি তারপরই মিলিয়ে গেলো মায়ার মুখ এবং হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেলো কঙ্কালটা, ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো… কোনো ভাবেই আর জোড়া লাগানো যাবে না। শামীম ধীরে বললো…. শফিক পুলিশকে ফোন করো।
……… আসাদের কথা —
পুলিশ অফিসারদের সামনে বয়ান দিলো অপরাধী, মায়ার খুনী….. হ্যাঁ, আমি শামীমের স্ত্রী মায়াকে র্ধষণ করে গলা টিপে খুন করেছি। মায়ার ওপর আমি অনেক দিন থেকেই আসক্ত কিন্তু জানি আমার আশা কোনো দিনই পূরণ হবে না কারণ অনেক চেষ্টা করেও সতীলক্ষ্মী মায়াকে আমি ভোগ করার সুযোগ পেলাম না, অগত্যা ঠিক করলাম জোরপূর্বক আমার কামনা চরিতার্থ করবো। এরমধ্যে শামীম আমাকে ওদের বাসায় যেতে নিষেধ করায় অপমানে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো…. শামীম কোন সময় বাসায় থাকে না, সেটাতো জানতামই।
সেদিন ওদের ফ্ল্যাটের র্গাডকে ঘুস দিয়ে তার মুখ বন্ধ করেছিলাম… মায়া দরজা খুলতে চায়নি কিন্তু কাতর ভাবে বললাম — খুব পিপাসা পেয়েছে, পানি খেয়েই চলে যাবো, পানির কথা শুনে ও নরম হোলো, দরজা খুলে আমাকে বসতে দিয়ে পানি আনার জন্য ঘুরতেই ওর হাতটা ধরে মিনতি করে বললাম…. মায়া, আমি শামীমের চাইতে কম কিসে? আমার কাছে চলে এসো, রাজরাণী করে রাখবো তোমাকে….
মায়া ঝটকা দিয়ে হাত টেনে নিয়ে বললো… আপনি এই মূহুর্তে চলে যান নইলে বুয়াকে ডাকবো আর শামীমকেও ফোন করে এখনি আসতে বলবো তারপর যা করার ও করবে… শুনেই আমি দেরী না করে মায়াকে জাপটে ধরে প্রথমে ওর মুখে হাত চেপে ধরলাম…. ও হ্যাঁ, ঘরে ঢোকার আগেই আমি দস্তানা পরে নিয়েছিলাম, এরপর র্সবশক্তি দিয়ে ওকে টেনে শোবার ঘরে নিয়ে মুখ হাত পা বেঁধে বিছানায় ফেলে রেখে রান্নাঘরে গেলাম বুয়ার ব্যবস্থা করতে…. মায়া বাঁধা অবস্থায়ও চেষ্টা করেছে নিজেকে রক্ষা করতে কিন্তু আমার সাথে পারবে কেমন করে…. তারপর —
অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আসাদ আবার বলতে লাগলো…. আমি কখনোই আমেরিকায় যাইনি কেবল বহুদিন আত্মগোপন করে ছিলাম। সেদিন শামীমের বাসায় গিয়েছিলাম পরিস্থিতি জানতে, দেখি বাঃ কেউ কিছু ধরতেই পারেনি, আর আহাম্মকটা তো কাউকে সন্দেহই করে নাই, যাক মুখে হায় আফসোস করলাম এবং শামীমের করুণ দশা দেখে অন্তরে উল্লাস বোধ করলাম — কিন্তু তখন জানতাম না যে র্ধমের কল বাতাসে নড়ে….
আর কিছু বলতে চাইলো না সে।
শামীম পুলিশকে কিছু গোপন করেনি, কঙ্কালের কথা সবই ভেঙে বলেছিলো, নইলে আসাদ এত সহজে খুনের কথা স্বীকার করলো কেমন করে — তার কি জবাব দিতো… শফিকও সাক্ষী দিলো তাছাড়া আসাদের গলায় কঙ্কালের হাতের হাড়ের দাগ স্পষ্টই দেখা গেছে।
র্বতমান যুগের মানুষ বিশেষ করে পুলিশ অলৌকিক বা অশরীরি ব্যাপার বিশ্বাস করবে না, নিরেট প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা তদন্ত করে… কিন্তু পৃথিবীতে ব্যাখ্যাহীন অবিশ্বাস্য অনেক রহস্য আছে যার সমাধান হয়নি… মায়ার ঘটনাও এমনই একটি রহস্য।
যাই হোক, পুলিশের বিশেষ বিবেচনায় এবং সহযোগিতায় কঙ্কালের ব্যাপার গোপন রেখে মায়া হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়… খুনী নিজেই যখন তার অপরাধ স্বীকার করেছে তখন আর প্রমাণের দরকার ছিলো না।
বিচারে আসাদের ফাসীর আদেশ হয় এবং খুনীকে সাহায্য করার অপরাধে র্গাডের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
শামীম মায়ার প্রতি অন্যায়ের ন্যায় বিচার হওয়ায় অনেক শান্তি পায়, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন শুরু করে…. বেশ কিছু দিন পরে সে পুনরায় বিয়েও করে, সুন্দরী, বুদ্ধিমতি পিয়া স্বামীর ছায়া হয়ে, অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তার সব বেদনা ভুলিয়ে দেয়।
শামীম দুই সন্তানের পিতা এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর আর্দশ স্বামী…. অত্যন্ত সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করছে।।
সমাপ্ত ****
পিশাচ পুরুষ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/pichas/
আড়ালে কে? গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/aral/
আমি পদ্মজা গল্পের লিংক