একটি রাতের গল্প পর্ব ৪
#_রাতের_কুয়াশা।
#_পর্ব = ০৪
আমি কিছু বলার আগেই সর্দার কল কেটে দিল আর আমি নিরুপায় কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমার সহকর্মীদের মধ্যে কেউ একজন তার কাছে বলেছে সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কে সে?
সাজিদ এর কথা বলে রাখি, সাজিদকে যদি আমি নিষেধ করি তাহলে সে কোনদিন আমার কথা অমান্য করবে না। সাজিদ আমাকে মামা বলে ডাকে আর আমি সহ দলের সদস্য সকলেই তাকে ভাগ্নে বলে ডাকে। অবসরে আমি আর সাজিদ সবসময় গল্প করতে করতে সময় পার করি।
সাজিদের অনেক সাহস, মাস তিনেক আগে একদিন চাঁদপুরের অদূরে নদীতে লঞ্চ ডুবেছে। আমি আর সাজিদ দুজনেই একসাথে একটা ট্রলার ভাড়া করে নদীর তীরে তীরে মোহনায় লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি। মহিলাদের লাশ খুঁজে বেড়াতাম বেশি কারণ তাদের কানে নাকে বা গলায় স্বর্নের জিনিস আছে। তাদের লাশ খুঁজে পেলে গলা আর কান থেকে সেগুলো খুলে নিয়ে লাশের পেট কেটে ডুবিয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে কিছু ইট বা ওজন জাতীয় কিছু একটা ব্যবহার করে লাশ ডুবিয়ে দিতাম।
আমাদের লাভ ছিল দু’দিকে, কারণ লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা টাকা নিতাম। লাশ যত কম পাওয়া যাবে তাদের ক্ষতিপূরণ তত কম দিতে হবে এবং হতাহত সংখ্যা কম উল্লেখ হবে। আমরা লাশ পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিতাম এবং তার সাথে অলংকার হাতিয়ে নিতাম তাই লাভজনক ছিল বিষয়টা। সাজিদ সবসময় আমার সাথে থাকত আর লাশের শরীর থেকে সবকিছু কেড়ে আনা এবং যাবতীয় সবকিছু সাজিদ করতো। সাজিদ আমাকে কিছুদিন আগে বলেছিল, মামা এসব ডাকাতি করতে আর ইচ্ছে করছে না। কত গরীব গরীব মানুষের কষ্ট করে ইনকাম করা টাকা আমরা আত্মসাৎ করি। তাই মাঝে মাঝে মনে চায় সবাই কে পুলিশের হাতে ধরে দিয়ে নিজেও ভালো হয়ে যাই। আমি তখন একটা মুচকি হাসি দিয়ে দু একটা উপদেশ দিয়ে প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করে ফেলি।
ঘাড়ের ওপর কারো হাতের কোমল স্পর্শ অনুভব করতে পারছি, হাতটা মুন্নীর তাতে সন্দেহ নেই। তবে শীতের এই নিস্তব্ধ রাতে তার হাত গরম থাকার কথা নয় কিন্তু এই হাতটা গরম অনুভব হচ্ছে। পিছন থেকে মুন্নী সামনে এসে বললো,
” কেন শুধু শুধু একা কষ্ট নিচ্ছ? সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলো না আমার সাথে! সাদা মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে আকাশ ছাড়িয়ে যাবো। কোন এক অপূর্ব জোৎস্নার রাতে আকাশ ভেঙ্গে প্রকৃতির সাথে হারিয়ে যাবো। “
” বললাম, তোমাকে কেবিনের মধ্যে বন্দী থাকতে হবে কারণ একটা সমস্যা হয়ে গেছে। আপাতত তুমি কেবিন থেকে বের হবে না বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করবে। “
” ডাকাতি না করলে হয় না? “
” আমি ডাকাতি করার জন্য বলছি না, এটা অন্য একটা কারণ আছে। তোমার কথা কে যেন সর্দারকে বলে দিয়েছেন এখন সর্দার ক্ষিপ্ত হয়ে তোমাকে মেরে ফেলতে বলছেন। কারণ তার ধারণা তুমি আইনের কোন একটা মানুষ তাই তিনি বিপদ রাখতে চান না। আমি যেভাবে বলি তুমি সেভাবে কাজ করো আশা করি সমস্যা হবে না। “
” তুমি আমাকে মেরে ফেলবে? “
” ওহহ বলছি তো আপাতত গিয়ে কেবিনে থাকো আমি ততক্ষণে একটা পরিকল্পনা সফল করবো। “
” আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না। “
” এখন তুমি আমি একসাথে থাকা বিপদ। “
” কিন্তু এভাবে কেন হচ্ছে? এতগুলো মানুষের ক্ষতি করতে তোমার খারাপ লাগে না? নিজের ছোট্ট একটা পরিবারের হাসির জন্য এতগুলো মানুষের পরিবারে কষ্ট দিতে খারাপ লাগে না? “
” এসব তর্ক করার উপযুক্ত সময় নেই, আমি একটু পরে কেবিনে আরেকটা ছেলে পাঠাবো তার নাম সাজিদ। যা যা করতে হবে সবকিছু সাজিদের কাছে বলে দেবো তুমি সেগুলো করবে। আর তুমি কেবিনে গিয়ে এই পোশাক পরিবর্তন করে নতুন একটা জামা গায়ে দেবে। তোমাকে যেন পরবর্তীতে আর চেনা না যায় যে তুমি সেই মেয়ে। “
” একটা কথা দিবে? “
” কি? “
” সারাজীবন পাশে থাকবে? “
” আমি মুন্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখের পাপড়ি টিপ টিপ করে আহহ কত সুন্দর মায়া। “
★★
সাজিদের কাছে গিয়ে মোটামুটি সবকিছু খুলে বলা হয়েছে, সাজিদ মুন্নীর কথা জানতো। আমি যখন মুন্নীর সাথে কথা বলতাম তখন মাঝে মাঝে সাজিদ আমার কাছে থাকতো। সাজিদ যখন জানতে পারলো সেই মুন্নী লঞ্চে আছে তখন অবাক হয়ে গিয়ে বললোঃ-
” মামা আমি এখনই তার সাথে দেখা করতে চাই। “
” বললাম, সর্দারের কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন? আমি যেভাবে বলি তুই সেভাবে কাজ কর। “
” কি করতে হবে মামা? “
” তুই এখন ওর কেবিনে গিয়ে অপেক্ষা করবি, আমি যেভাবে হোক লঞ্চের ইলেক্ট্রিসিটি দুই মিনিটের জন্য বন্ধ করার ব্যাবস্থা করবো। তখন মুন্নীকে নিয়ে তুই বেরিয়ে পরবি, আর সর্দারকে কল দিয়ে বলবি কাজ হয়ে গেছে। “
” আমাকে দেখলে মামি ভয় পেতে পারে তারচেয়ে বরং আপনি যান আর আমি ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করতে পারি কিনা দেখি। “
” হুম সেটা হলেও ভালো হয়। “
” একটা কথা বলবো মামা? “
” বল। “
” চলেন আমরা এই কাজ ছেড়ে দিয়ে এদের থেকে বেরিয়ে যাই। মামীকে বিয়ে করে আপনি শহরে গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করেন। আমিও মাঝে মাঝে আপনাদের কাছে গিয়ে একবেলা খেয়ে আসবো। আপনার তো পরিবার মা-বাবা আছে কিন্তু আমার তো কেউ নাই। “
” আজকের এই রাতের কুয়াশার আড়ালে যদি তুই আর আমি মুন্নীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি তাহলে চেষ্টা করবো সবকিছু ছেড়ে দিতে। “
” আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে মামা। “
” কি? “
” যেহেতু লঞ্চ চরে আটকে গেছে তারমানে আমরা কিন্তু যেকোনো একটা নির্দিষ্ট তীরের কাছে আছি। তাই আমরা চাইলে এখনই কিন্তু লঞ্চের সামনের অংশে গিয়ে পানিতে নেমে তীরে উঠতে পারি। “
” ধুর… বাহিরে প্রচুর ঠান্ডা পানিতে নামলে সবাই তখন টাইটানিক জাহাজের মতো ঠান্ডায় মরে যাবো।
” আপনার মনে নেই একবার আমরা ডাকাতি করার সময় পুলিশ আক্রমণ করেছিল, তখন আপনি আমি আরো অনেকে নদী সাঁতরে পাড়ে গেছিলাম? তখন তো প্রচুর ঠান্ডা ছিল, আমরা কি মরেছি? আর তাছাড়া তখন লঞ্চ ছিল নদীর মাঝখানে কিন্তু এখন লঞ্চ চরে আটকে গেছে। “
” আমরা তো পুরুষ কিন্তু মুন্নী? “
” মাত্র দশ মিনিটের মতো ভিজলে কিছু হবে না। “
” তারচেয়ে আমরা লঞ্চে থাকি? “
” থাকাটা বিপজ্জনক হবে মামা। ”
” তাহলে কি করা যায়? ”
” ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে দেবো, তারপর আর চালু করার দরকার নেই। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সেটা ঠিক করতে করতে আমরা লঞ্চ থেকে নেমে যাবো। “
” মুন্নী রাজি হবে? “
” আপনি রাজি করাবেন। “
” আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুই ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করার ব্যবস্থা কর আমি কেবিনের দিকে যাচ্ছি। তুই বন্ধ করার সাথে লঞ্চের সামনে চলে যাবি, তারপর যা কিছু করা দরকার সব করবো। “
” মামা আরেকটা কথা! “
” কি? “
” আমরা ছাড়া বাকি যে পাঁচজন আছে সবগুলোই কিন্তু হারামির দল, একবার টের পেলে আমাদের কিন্তু রক্ষা নেই। সর্দার সহ সবাই তখন আমাদের পিছনে লাগবে, ধরতে পারলে মেরেও ফেলতে পারে। কারণ আমরা বাইরে গিয়ে যদি তাদের সবকিছু পুলিশকে জানিয়ে দেই? “
” সেটা নিয়ে চিন্তা করিস না, যদি বেশি সমস্যা করে তাহলে ওই পাঁচজন চাপা দিয়ে দেবো। “
” ঠিক আছে মামা এখনই শুরু করেন, আমি গেলাম তাহলে? “
” সাবধানে কাজ করবি, সেখানে যে দায়িত্বে আছে তাকে কীভাবে ঘায়েল করতে হবে সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? “
” না মামা সেটা খুব পারবো। “
” আচ্ছা ঠিক আছে। “
★★
ভেবেছিলাম মুন্নী আমার কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে খুব বকাঝকা করবে। কিন্তু আমার ভাবনা সম্পুর্ণ উল্টো করে দিয়ে সে নাচতে লাগলো। আমি হতবাক হয়ে গেলাম কিন্তু মুন্নী আনন্দের সাথে সব গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। মনে হয় যেন ইউরোপের বড় কোন প্রসিদ্ধ শহরে হানিমুনে যাচ্ছি। মনে মনে বললাম, পানিতে নামলেই বুঝতে পারবা কতটুকু ঠান্ডা পানিতে কতটুকু শীত লাগে।
মিনিট দশেক পরে ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ হয়ে গেল, আমি আর মুন্নী তাড়াতাড়ি করে বেড়িয়ে পরলাম। কিন্তু দরজা খুলে দেখি সর্বনাশ, আমাদের সাত জনের একজন বাবুল মোল্লা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ব্যাগটা নিচে রেখে কৌশলে তাকে কেবিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে আমরা আবারও হাঁটা শুরু করলাম। অন্ধকারে মোবাইল টর্চ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ করে বাতি বন্ধ হবার জন্য সবার মাঝে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।
লঞ্চ চরে আটকে যাবার জন্য হৈচৈ শুরু করেছিল এখন বাতি বন্ধ হবার জন্য করছে। বাঙালি সবসময় সমাধান বা কারন জানতে না চেয়ে হৈচৈ বেশি করে। ভিতর থেকে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম লবন নিয়ে চিৎকার করা ব্যক্তি অন্ধকারে চেচাচ্ছে। সামান্য কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে, তিনি তার স্ত্রীকে রেখে বাথরুমে গেছিলেন। আর তখনই বাতি বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি তৎক্ষনাৎ দৌড়ে চলে এসেছেন। দৌড়ে আসার সময় অনেকের সাথে ধাক্কাও লেগেছিল কিন্তু এসে দেখে তার স্ত্রী নেই। তাই তিনি তার স্ত্রী চৌদ্দ পুরুষ গালাগালি করে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন।
লঞ্চের সামনে গিয়ে দেখি সাজিদ একটা মোটা দড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে, প্রথমে ঠান্ডায় শরীর ধাক্কা লাগবে তবুও বিচলিত হলে চলবে না। সবার আগে ব্যাগ নিয়ে আমি নেমে গেলাম, আল্লাহ… এত ঠান্ডা পানি? আজকে বুঝতে পারছি টাইটানিক জাহাজের নায়ক কেন মারা গেছে? যদিও লঞ্চ চরে আটকে গেছে কিন্তু তবুও পানিতে ঠাঁই পাচ্ছি না। আমি দড়ি ধরে পানিতে অপেক্ষা করছি, কিছুক্ষণ পরে মুন্নী নেমে এসেছে। তার শরীরে পানি লাগার সাথে সাথে সে আৎকে উঠেছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। আমি আর মুন্নী সাঁতরে তীরে যেতে লাগলাম উপর থেকে সাজিদকে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছে।
আমরা আরেকটু আসতেই পায়ের নিচে বালু অনুভব করতে পারলাম। আস্তে আস্তে পানি থেকে উঠে গেলাম ঠিক তখন তিন-চারবার বন্ধুকের গুলির শব্দ পেলাম। লঞ্চ থেকে সাজিদকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে, সাজিদ তীরের দিকে এগিয়ে আসছে।
সাজিদের মোবাইল এক হাতে রেখে সে সাঁতার কাটছিলো তাই মোবাইল ভেজেনি। আমার আর মুন্নীর মোবাইল ব্যাগের ভেতর তাই সেটা কি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।
সাজিদ তীরে আসার সাথে সাথে বললো, তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে। সর্দার বুঝতে পেরেছে তাই তাদের লেলিয়ে দিয়েছে এখন যত দ্রুত সম্ভব স্থান ত্যাগ করতে হবে মামা।
সাজিদের মোবাইল বেজে উঠলো, সাজিদ মোবাইলে তাকিয়ে বললো, মামা সর্দার কল করেছে।
” বললাম, রিসিভ কর। “
” সাজিদ রিসিভ করার পরে সর্দার বললো, তোমরা দুজন দলের সাথে বেঈমানী করেছো। আজকে রাতে ডাকাতি করার পরিকল্পনা বাদ, আগে বেঈমানের রক্ত নদীতে ভাসাবো তারপর অন্য কাজ। “
সাজিদ কিছু না বলে কল কেটে দিল। আমরা তিনজন দ্রুত হাঁটতে লাগলাম, ভেজা কাপড়ে ঠান্ডা বেশি লাগছে। ভকবছি একটু সামনে গিয়ে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করতে হবে।
চলবে….
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল এই পেজে পোস্ট করা হবে, তাই চাইলে এড দিয়ে রাখতে পারেন।
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।