এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -১৩
মৃন্ময়ের প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিলো রোজা। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলো,
— আমি তো উড়নচণ্ডী। আমার এসব বদ্ধ খাঁচার আবদ্ধ হাওয়া ভালো লাগে না নায়কসাহেব। আমি সিনেমাই মনোযোগী হতে পারি না। তাই কখনো “হা” করে তাকিয়ে থাকাটাও হয়ে উঠে নি। তবে বান্ধবীদের “হা” হয়ে থাকা মুখটা চোখে পড়েছে বহুবার।
কথাটা বলে ঘাড় ঘুরিয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো রোজা। ওর ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসি। চোখের কাজলটা বৃষ্টিতে ভিজে হয়ে উঠেছে বৃষ্টিরাঙা।এই হালকা ল্যাপ্টানো কাজলে ঢাকা স্নিগ্ধতাময় চোখদুটোতেই তো মৃন্ময় হারাতে পারে যুগের পর যুগ। রোজা আবারও হাতের চোলে বৃষ্টির পানি জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মৃন্ময়ও তার ভাঙা মনের একরাশ আক্ষেপকে সুতোয় গাঁথতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আজ নিজেকে খুবই তুচ্ছ লাগছে তার। এই অনুভূতিটা শুধুমাত্র রোজার সামনেই প্রকটভাবে উপলব্ধি করে সে। কিন্তু কেন? এই উত্তরটা তো জানা নেই তার…!! মানুষের জীবনটা আসলে “কেন” দ্বারা পরিপূর্ণ এক রঙমহল যেখানে “কেন” এর ঘটটা পূর্ণ হলেও উত্তরের ঘটটা একেবারেই শূন্য! হঠাৎ রিক্সাটা থেমে যাওয়ায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে পাশ ফিরে তাকালো মৃন্ময়। ততোক্ষণে নেমে গিয়েছে রোজা। একহাতে শাড়ির কুঁচিগুলো উঁচু করে ধরে অন্যহাতে পায়ের জুতো আঁকড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মৃন্ময় ভাড়া মিটিয়ে রোজার কাছে আসতেই ছুটে গিয়ে মাঠের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পড়লো রোজা। হাতদুটো মেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। যেনো এই বৃষ্টিতেই কতো প্রশান্তী, এই বৃষ্টিতেই কতো সুখ। ওর লম্বা চুলগুলো হাঁটুর নিচে ঝুলে চলেছে ক্রমাগত। গালের ওই টোলটাতেও জমে আছে একবিন্দু জল। ভাঁজ করা ভেজা আঁচলের ফাঁক গেলে বেরিয়ে এসেছে পেটের কিছু অংশ। মৃন্ময়ের চোখটা আটকে গেলো মুহূর্তেই। কয়েকসেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকেই নজর ফিরিয়ে নিলো দ্রুত। মৃন্ময় আশেপাশে তাকাচ্ছে। নদীর পানিতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন অন্য এক সৌন্দর্যের নাম। ঝুম বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া সবুজ এই ঘাসগুলোকে কি ভীষণ জীবন্ত লাগছে আজ। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবারও রোজার দিকে ফিরে তাকালো মৃন্ময়৷ নীল আঁচল আর লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ভেজা ঘাসে শুয়ে আছে রোজা। মৃন্ময় তাকাতেই মিষ্টি হেসে চোখের ইশারায় পাশে শুতে বললো সে। মৃন্ময় কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই রোজার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। এই ২৮ বছরের জীবনে এই প্রথম তার ঘাসের উপর শুয়া। এই প্রথম বৃষ্টির শব্দগুলোকে কানপেতে উপলব্ধি করা। নদীর পাড়ের লম্বা ঘাসের উপর শুয়ে ঘাড়ে হাজারো সুড়সুড়িকে সঙ্গী করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এভাবে বৃষ্টি বিলাসের কথা ভাবতেই পারে নি মৃন্ময়। নদীর বৃষ্টির শব্দ কি উচ্ছ্বল! মৃন্ময়ের কাছে মনে হচ্ছে ঘাসের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে বৃষ্টির রাজ্যে ভাসছে সে। রোজা কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকেই বলে উঠলো,
— আপনার এই বন্ধী জীবন ভালো লাগে নায়কসাহেব? যে জীবনে মন খুলে হাসতে গেলেও ভাবতে হয় সেই জীবনটা কি আলুর সিঙ্গারা থেকে কম কিছু? বাইরে থেকে মনে হয় সবকিছু কতোই না জাঁকজমক কিন্তু ভেতর থেকে সবকিছুই শৃঙ্খলায় আবদ্ধ একগুচ্ছ নিরামিষ আলু ছাড়া কিছুই নয়।
মৃন্ময় হাসলো। বৃষ্টিভেজা সাদা মুখের হাসিটা কতই না মনকড়া। মৃন্ময় একটা হাত মাথার নীচে দিয়ে আরাম করে শুয়ে রোজার দিকে তাকালো। হাসিমুখেই বলে উঠলো,
— আজকে নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবো মিস. রোজা। প্রায় ১৫/ ১৬ বছর পর বৃষ্টিতে ভিজছি আমি। যখন বাবা-মা বেঁচে ছিলেন তখন মা কিছুতেই বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না। বলতেন,” বাবু এসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে নেই। এখন ভিজলে জ্বর হবে।” তবু বাবা আর আমি চুপিচুপি বৃষ্টিতে নেমে যেতাম। বাবা গলা খুলে গান করতেন আর আমি সারা বাগান লাফিয়ে বেড়াতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নিজের খেয়াল নিজে রাখতে হয়েছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে হারিয়ে গেছে এতোগুলো বছর। এখন আমি অভ্যস্ত। জন্ম থেকে যে পাখি খাঁচায় থাকে সে পাখি উড়তে জানে না মিস. রোজা। আমি হলাম সেই খাঁচার পাখি, যে পাখি আপনার মতো মুক্ত আকাশে উড়তে জানে না৷ হাওয়ায় ভাসার ক্ষমতাও তার নেই।
রোজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও আকাশের দিকে ফিরে তাকালো সে। কিছুক্ষণ পরই হুট করেই উঠে বসে বলে উঠলো,
— চলুন। এবার বাড়ি ফেরার পালা। নয়তো সত্যিই আপনার জ্বর হয়ে যাবে। চোখদুটো কেমন লাল হয়ে গেছে আপনার৷ এখনই জ্বর ওঠে নি তো আবার?
কথাটা বলেই ঝুঁকে গিয়ে মৃন্ময়ের কপালে হাত রাখলো রোজা। চুলগুলো এসে পড়লো মৃন্ময়ের মুখে। মাটির খাঁটি গন্ধের সাথে রোজার চুলের এই সুবাস মিলে তৈরি হলো অন্যরকম এক নেশা। রোজা জ্বর চেক করে উঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই নিজের অজান্তেই একটানে তাকে বুকের কাছে এনে ফেললো মৃন্ময়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রোজা। মৃন্ময়ের চোখে মুগ্ধতা। অদ্ভুত এক নেশা। সেই নেশামাখা চোখ নিয়ে ডানহাতটা বাড়িয়ে রোজার চুলে হাত ডুবানোর আগেই যেন চমকে উঠলো সে। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে রোজাকে সরিয়ে দিয়ে হুট করেই উঠে দাঁড়ালো সে। একঝাঁক অস্বস্তি নিয়ে ছোট্ট করে বলে উঠলো,
— সরি! সরি মিস. রোজা। আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।
কথাটা বলেই রাস্তার দিকে হাঁটা দিলো মৃন্ময়। নিজের চুলগুলো টেনে একদম ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। এমন একটা পরিস্থিতি কিভাবে ক্রিয়েট করতে পারলো সে? কিভাবে? আরেকটু হলেই তো….. ছি! আর ভাবতেই পারছে না মৃন্ময়। রোজা নিশ্চয় খুব বাজে ছেলে ভাবছে তাকে? রোজা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মৃন্ময়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই ওঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে চললো মৃন্ময়ের পিছু পিছু। তার মাথাতেও ঘুরছে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কথা।
২৪.
কাল রাতে বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো আরু। দারুন একটা ঘুম হয়েছিলো কাল। যাকে বলে নির্ভেজাল ঘুম। এখন প্রায় বারোটা বাজে। বলতে গেলে ভরদুপুর! এই ভরদুপুরেও এমন মরার মতো ঘুমুচ্ছিলো ভেবে বেশ অবাকই হলো আরু। তার ঘুমোনোর শেষ লিমিট হচ্ছে সকাল সাড়ে আট। এরপর শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও বিছানায় আটকে রাখা যায় না তাকে। তার ধারনা, সাড়ে আটটার পর বিছানায় শুয়ে থাকলে অটোমেটিকলি তার শরীরে একধরনের সুড়সুড়ি শুরু হয়ে যায়৷ এই সুড়সুড়ি থেকেই ঘড়িতে সাড়ে আটটা বেজেছে কিনা তা চট করেই বুঝে যায় আরু। যদিও তার এই ব্যাপারটি কেউই বিশ্বাস করে না। সবাই প্রথমে সন্দেহী চোখে তাকায় তারপর একঝাঁক অবিশ্বাস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে ভাইয়া আর বাবার উত্তেজিত কন্ঠে বিছানা ছাড়লো আরু। তবে কি ভাইয়া অফিসে যায় নি আজ? চুলগুলো খোঁপা করতে করতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দাঁড়ালো সে। সবার দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে। আরু কিছুটা অবাক হলো, ভ্রু কুঁচকে টিভির দিকে তাকালো সে। কোনো একটা বস্তি উচ্ছেদ করা হচ্ছে তারই লাইভ ভিডিও চলছে টিভিতে। মানুষের আহাজারি আর কান্নায় মনটা যেন ভারি হয়ে আছে সবার। আরু ধীর পায়ে বাবার পাশে সোফার হাতলে গিয়ে বসলো। টিভির স্ক্রিনের নিচের দিকে বড় বড় করে লেখা একটা হেডলাইন আসছে বারবার, ” বস্তিবাসীদের বাঁচাতে একজন তরুন পুলিশ অফিসারের মৃত্যু। তিন’বছরের শিশু সন্তান নিয়ে বিচারের দাবি জানিয়েছেন তার স্ত্রী! ” কিছুক্ষণ লাইভ দেখানোর পর টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো মাঝবয়সী একজন লোকের মুখ। মাথায় কাঁচা পাকা চুল। শ্যামলা মুখে বুদ্ধিদিপ্ত দুটো চোখ। আরুর কাছে মনে হচ্ছিল লোকটির সাথে কারো চেহারার ভীষণ মিল আছে। ভীষন রকম মিল। কিন্তু কার সাথে সেটা ঠিক মনে করতে পারছে না সে। লোকটি নিউজ স্টুডিওতে ভারি একটা টেবিলের ওপাশে বসে আছেন চুপচাপ। তারপাশেই বসে আছেন একজন কোট টাই পড়া তরুন সাংবাদিক। সাংবাদিকটার মুখ হাসিহাসি। যেনো মাত্রই কোনো মারাত্মক ধরনের খুশির খবর শুনেছেন তিনি। সাংবাদিকটি হাসি হাসি মুখেই বলে উঠলেন,
— দর্শকবৃন্দ, আজকে আমাদের সাথে আছেন দেশের একজন দুঃসাহসিক জার্নালিস্ট রাদিব আহমেদ। বস্তিবাসীদের এমন পরিণতি এবং সরকারের এই বিষয়ে উদাসীনতা সম্পর্কে উনার মতামতটা কি, সেটাই আমাদের জানার বিষয়। তো স্যার, বস্তীবাসীদের এই উচ্ছেদকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
লোকটির কথায় রাদিব আহমেদ সোজা হয়ে বসলেন। গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন,
— দেখুন, মানুষ ব্যক্তিভেদে আলাদা৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টা কিভাবে দেখছি তার থেকে বিষয়টা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সেটা নিয়ে কথা বলাটা বেশি জরুরি। আমাদের দেশটা গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র মানেই হলো জনগণের শাসন। জনগণ তাদের জীবনটা কিভাবে দেখতে চাইছে সেই ডিসিশনটা নেওয়ার ক্ষমতাটা গণতন্ত্রে জনগণকে দেওয়া হয়েছে। আব্রাহাম লিংকন একটা কথা বলেছেন – “Democracy is a government of the people, by the people and for the people. ” কিন্তু হাস্যকরভাবে ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণই পাল্টে দিয়েছে আমাদের সিস্টেম। এখন আর “Democracy is a government of the people ” নয়, এখন বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে “Democracy is a government of the gang stars” সরকার এখন জনগণকে জবাবদিহি নয় গ্যাংস্টারদের জবাবদিহি করতে বেশি ব্যস্ত। রাফিন চৌধুরীর মতো গ্যাংস্টারদের খুশি রাখতে সরকার জনগণের দুঃখ-কষ্টেরও তোয়াক্কা করছে না। এইযে বস্তিতে হাজার হাজার মানুষ ঘরহারা হচ্ছে, এরা যাবে টা কোথায়? এটা না সরকার ভাবছে না গ্যাংস্টাররা। তারা শুধু জায়গাটা খালি করতে পারলেই বাঁচে। যদিও সম্পূর্ণ ইললিগেল তবুও তারা কিন্তু সরকারী সাপোর্ট পাচ্ছে অথচ ফারাবি রিয়াদের মতো পুলিশ অফিসাররা এসব অন্যায় ঠেকাতে গিয়ে রাতের আঁধারে নৃশংসভাবে খুন হচ্ছে। এই দায়টা আসলে কার? শুধু সরকারের? নাকি জনগণের?
যারা দেশকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে তাদেরকেই যখন আমরা বাঁচাতে পারছি না, সঠিক সম্মান, ন্যায্য বিচারটা দিতে পারছি না সেখানে আমাদের নেক্সট জেনারেশনের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করি কিভাবে? ফারাবি রিয়াদের বাচ্চা ছেলেটাকে আমি দেখেছি। সে এখনও বাবা খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরবে সেই অপেক্ষা করছে সেই বাচ্চাটার কি হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? জন্মানোর তিনবছরের মাথায় সে বুঝে গেলো এই দেশ স্বার্থপর…
এটুকু দেখেই উঠে দাঁড়ালো আরু। চুপচাপ রুমে গিয়ে দরজা লাগালো সে। রাদিবের মুখে রাফিন চৌধুরী নামটা শুনেই বুকটা কেঁপে উঠছিলো তার। বস্তির এতোগুলো মানুষকে এভাবে নিদারুণ যন্ত্রণা দিতে পারছে রাফিন? আর ওই ছোট বাচ্চাটা? সিনেমার ভিলেন নামক হিরোরা তো এমন হয় না। তারা তো খারাপ লোক ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি করে না তাহলে কি রাফিন হিরো নয়? সে কি সত্যিই ভয়ানক ভিলেন? আরু কি ভুল ছিলো তবে? এতোবড় ভুল? রাফিনকে তো এর জবাব দিতেই হবে। সত্যিই কি এমনটা করছে সে? নাকি মিডিয়ার বানানো তত্ত্ব সব? কথাটা ভেবেই জামাটা ছেড়ে কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো আরু। রাফিনকে কোথায় পাবে জানা নেই তার কিন্তু উত্তর যে তার চাই, চাইই চাই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোথায় যাওয়া যায় তাই ভাবছে আরু। হঠাৎ কি মনে করে একটা রিক্সা ডাকলো সে। রিক্সাওয়ালা গন্তব্য জিগ্যেস করতেই বলে উঠলো ,
— শহরের থেকে একটু বাইরে একটা বস্তি উচ্ছেদ চলছে। ওখানে যাবো। যাবেন?
— ওখানে তো গন্ডগোল চলে আফা। রিস্ক আছে।
— থাকুক রিস্ক। আপনি নাহয় কিছুটা দূরেই নামিয়ে দিবেন আমায়। ডাবল ভাড়া দিবো। চলুন না প্লিজ!
রিক্সাওয়ালা রাজি হলো। আরুকে নিয়ে ছুটে চললো এক ভয়ানক গন্তব্যে। এই গন্তব্যটা যে তার জীবনের কতোবড় পরিবর্তন আনতে চলেছে, মনটাকে কতোগুলো টুকরোতে ভাগ করতে চলেছে আদৌ জানা নেই আরুর। নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে কে জানে?
২৫.
বিকেল তিনটা বাজে। একটু আগেই মৃন্ময়ের বাড়িতে ঢুকেছে রোজা। আজ সে রিদের জন্য হাফ ডে এর ছুটি নিয়েছিলো। যার সবটায় মৃন্ময়ের সাথে কাটাতে হয়েছে তাকে। বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে রোজা থেকে এলিনা হয়েই কাজে ফিরেছে সে। তীর্থ জানিয়েছে মৃন্ময় আজ বাড়িতেই আছে। এখনও বের হতে দেখা যায় নি তাকে। এলিনা বাড়িতে ঢুকতেই সোহেল মৃন্ময়ের জন্য এক কাপ কফি পাঠাতে বলে গেলো।যাওয়ার আগে বারবার বলে গেলো কফিটা যেন কোনো কাজের লোক নয় সে নিজে নিয়ে যায়। রোজা বুঝতে পারছে না এমন একটা রিকুয়েষ্টের কারণ কি? মৃন্ময় কি তাকে সন্দেহ করছে? তাকে কি কাছ থেকে ভালো করে পরীক্ষা করার জন্যই এই বাহানা? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের নার্ভাসনেসকে দূরে সরিয়ে মৃন্ময়ের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো রোজা। দরজার কাছাকাছি আসতেই মৃন্ময়ের কন্ঠ কানে এলো। সাথে সাথেই কান খাঁড়া করলো রোজা,
—- টেবিলে দশ লক্ষ টাকার একটা চেইক আছে সোহেল। টেইক ইট। এই টাকা দিয়ে বস্তির মানুষগুলোর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো। এতে না হলে আমাকে জানিও।
সোহেল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ের এসব দয়াময় কান্ড দেখলে চরম বিরক্ত লাগে তার। যেখানে সরকারই মাথা ঘামাচ্ছে না সেখানে যেচে এতোগুলো টাকা খরচ করার আদৌ কোনো মানে আছে কি? আজব! নিজের বিরক্তি ভাবটা কোনোরকম দমন করেই বলে উঠলো সোহেল,
— স্যার? বলছি কি? কি দরকার? সরকার যেখানে চোখও দিচ্ছে না সেখানে এতোগুলো টাকা খরচ করার মানে কি স্যার?
— মানে কিছুই না সোহেল। আবার অনেক কিছু। সরকার নজর দিচ্ছে না তাই আমাদের নজর দিতে হবে। হত দরিদ্র মানুষগুলো তো এভাবে চোখের সামনে মরে যেতে পারে না। আমার যখন আছে তখন দিতে তো সমস্যা নেই।
সোহেল এবার মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। মৃন্ময়ের প্রতি মারাত্মক রাগ লাগছে তার। তবু শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
— স্যার? উচ্ছেদের কাজটা রাফিন চৌধুরীর লোকেরা করছে। ওদের সাথে জড়ালে আপনার বিপদ বাড়তে পারে স্যার!
মৃন্ময় এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সোহেলের গালে ঠাস করে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে তার। নিজের ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখেই বলে উঠলো সে,
— রাফিন চৌধুরীকে আমি ভয় পাই না সোহেল। তোমাকে যা করতে বলেছি তাই করো। আমারটা নাহয় আমি বুঝে নিবো। আর শুনো? আমি স্টুডিও তে যাচ্ছি। আধাঘন্টার মধ্যে ময়নুল রায়হানের বাড়ি থেকে স্ক্রিপ্টটা যেনো পেয়ে যাই আমি। গট ইট?
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো মৃন্ময়। দরজার বাইরে রোজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। হাতের কফির দিকে চোখ রেখে বলে উঠলো সে,
— কফি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে তা নিশ্চয় আমার পর্যন্ত পৌঁছাবে না মিস. এলিনা। নিজের কাজটা সিনসিয়ারলি করাটাই বেশি পছন্দ করি আমি।
কথাটা বলে এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় নি মৃন্ময়। মৃন্ময়ের পেছন পেছন মুখ কালো করে বেরিয়ে গেছে সোহেলও। রোজা কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই কফির কাপটা ফ্লাওয়ার বাজের পাশে রাখলো। ঘড়িটা একবার দেখে নিয়েই দু’তলার তিন নম্বর রুমটার দিকে এগিয়ে গেলো । তালাটা ঝটপট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। ঘড়িতে তিনটা বিশ বাজে। তারমানে তার হাতে আছে মাত্র একঘন্টা চল্লিশ মিনিট। এর মাঝেই যা করার করতে হবে তাকে। দরজাটা ভেতর থেকে চাপিয়ে দিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেয়ালে বড় ফ্রেমের একটা ফ্যামিলি ফটো চোখে পড়লো তার।
# চলবে….