# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -৩৭
৬৮.
গিরিখাতের মতো দু’পাশ বেয়ে উঠে গেছে শক্তপাথরের পাহাড়। পাহাড়ের মাঝের রাস্তায় বড় বড় পাথর, নুড়ি পাথর আর পাহাড়ী ঝর্ণার জমে থাকা পানি। পাহাড়ী গাছ,লতা আর বনু ফুলে চারপাশটা যেন আস্ত এক রহস্যপুরী। হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ছপছপ আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলেছে রোজা। গহীন অরণ্যে পানির এই সাধারণ শব্দটাও পাহাড়ে পাহাড়ে আঘাত হেনে হয়ে উঠছে অসাধারণ। জমে থাকা পানি পেরিয়ে একটা ছোটখাটো পাথরের উপর দাঁড়িয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো রোজা,
—” ওয়াও ঝরনা ! পাহাড়ী ঝরনা। আচ্ছা? এই গহীন জঙ্গলে এই ছোটখাটো ঝরনাগুলোর কি নাম হয়?”
মৃন্ময় রোজার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝরনাটির দিকে তাকালো। পেছন থেকে গাইড বলে উঠলো,
—” এই ঝরনার নাম পদ্ম ঝরনা। এখানে এমন ছোটখাটো আরো অনেক ঝরনা আছে আপু। চলতে চলতে আরো দু-তিনটা ঝরনা ঠিক চোখে পড়বে আমাদের। সব ঝরনার নাম হয় না তবে কিছু কিছু ঝরনার নাম হয় ৷”
—” ওহ! পদ্ম ঝরনা? বাহ্ ঝরনাটার মতো নামটাও ভারি মিষ্টি।”
আবারও এগিয়ে চললো তারা। প্রথম একঘন্টা পরম উৎসাহ নিয়ে হেঁটে চললেও সময়ের সাথে সাথে উৎসাহটা ক্রমেই কমে এলো তাদের। দু’ঘন্টার মাথায় একটা পাথরের উপর ধপ করে বসে পড়লো তীর্থ। ক্যামেরাটা কোলে রেখে দু’হাত পাথরে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো সে। ক্লান্ত গলায় বললো,
—” আর হবে না বস। সেই সকাল ৯ টায় খেয়েছিলাম এখন বাজছে ১২ টা। আস্ত একটা পাহাড় উঠার পর আবার হাঁটা জাস্ট ইম্পসিবল! “
রোজাও পাথরে গিয়ে বসলো। পাশে গজানো কড়া বেগুনী রঙের বনুফুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো,
—” সেইম হেয়ার দোস্ত।”
রোজা-তীর্থকে এভাবে বসে পড়তে দেখে হেসে উঠলো গাইড। রসাত্মক গলায় বললো,
—” একটা পাহাড় উঠেই এই অবস্থা? আরো তিন তিনটা পাহাড় উঠতে হবে। হরিৎচন্দ্র পাড়ায় যেতে যে পাহাড়টা পাড়ি দিতে হবে সেটা তো আরো বিশাল।”
গাইডের কথার খেই ধরেই তাড়া দিয়ে বলে উঠলো মৃন্ময়,
—” জলদি হাঁটো। বসলে চলবে না। আরো অনেক পথ বাকি। এখান থেকে আধঘন্টার মাথায় হয়তো একটা পাড়া আছে। তাই না দাদা?”
গাইড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো,
—” হ্যাঁ। সামনেই রুনাঝুন পাড়া।”
তীর্থ তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। আশাভরা গলায় বললো,
—” ওখানে খাওয়ার মতো কিছু পাওয়া যাবে নাকি দাদা?”
—” হুম। পাউরুটি, কলা এই আরকি।”
তীর্থ বাঁকা হেসে বললো,
—” এটুকু পেলেই বাপের নাম। আম কামিং বেবি!”
ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে রোজাকে হেঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে খোলা গলায় গান ধরলো তীর্থ,
—” এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হবে তুমি বলো তো…?”
____________
হরিৎচন্দ্র পাড়া পেরিয়ে নতুন পাড়ার কাছাকাছি আসতেই হোঁচট খেয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের নখ উল্টে ফেলেছে রোজা। প্রচন্ড ব্যাথা আর তাজা রক্তমাখা আঙ্গুলটি চেপে ধরে চুপচাপ পা ছড়িয়ে বসে আছে সে। এতোটুকু ব্যাথাতেও বিন্দুমাত্র উৎকন্ঠা নেই তার চোখে-মুখে। তিন তিনজন পুরুষ মানুষের সামনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। হালকা ব্যাথায় কান্নায় গা ভাসিয়ে নিজেকে দুর্বল প্রমান করা নেহাতই বোকামি। রোজার থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তীর্থ। একবার পায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে রোজার মুখের দিকে তাকালো সে,
—” ওই? কান্দিস না কেন? কত্তখানি রক্ত পড়তাছে। তুই কি আসলেই মাইয়া? মাইয়া হইলে তো এতোক্ষণে ফিট মারার কথা ছিলো। আমার কিন্তু সন্দেহ সন্দেহ লাগতাছে দোস্ত।”
রোজা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথাটা সহ্য করে নিয়ে তীর্থের দিকে তাকালো। হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
—” চুরের মন পুলিশ পুলিশ। আমার তো তোরে নিয়া সন্দেহ হয়। যেভাবে তেলাপোকা দেখলেই লাফিয়ে কোলে উঠে পড়িস তাতে তো তোকে আমার পঁচিশ পার্সেন্ট মাইয়া বলে মনে হয়।”
তীর্থ উত্তরে কিছু একটা বলবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো মৃন্ময়। এমন একটা পরিস্থিতিতেও দু’জনে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে পারে ভাবতেই অবাক হচ্ছে মৃন্ময়। তার সাথে অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে, ট্রেকিং শু পড়া অবস্থায় পায়ের এমন অবস্থা কি করে হলো? মৃন্ময় রোজার খুলে রাখা জুতোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু একটা ঠিক নেই…কিন্তু কি? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে রোজার পাশে বসলো সে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ক্ষত জায়গাটায় পানি ঢাললো। ক্ষততে পানির ছোঁয়া পড়তেই কেঁপে উঠলো রোজা। আঙ্গুলটা যেন জ্বলে যাচ্ছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে চোখটা বন্ধ করলো রোজা। রোজার কম্পন টের পেয়েই বুকটা কেঁপে উঠলো মৃন্ময়ের। সারাটা বুক জুড়ে বয়ে গেলো তীক্ষ্ণ ব্যাথার শীতল শিহরণ। মাথা তুলে গাইডকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—” দাদা? ব্যাগে টি-প্যাক হবে?”
গাইড মাথা নেড়ে বললো,
—” না। হবে না।”
তীর্থ তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” আমার কাছে হবে কিন্তু এই জঙ্গলে গরম পানি কই পাবেন বস? চা খাওয়ার মগ টগও তো নেই।”
মৃন্ময় বিরক্ত গলায় বললো,
—“শাট আপ তীর্থ। থাকলে তাড়াতাড়ি দাও নয়তো চুপ থাকো।”
তীর্থ মাথা চুলকে ব্যাগ খুলে টি-প্যাক বের করে এগিয়ে দিলো। মৃন্ময় টি-প্যাকটা হাতে নিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে লাগিয়ে দিলো রোজার আঙ্গুলে। রক্তপড়া বন্ধ হলে টি-প্যাকটা সরিয়ে নিয়ে রুমাল দিয়ে আঙ্গুলটা শক্ত করে বেঁধে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মৃন্ময়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—” হাঁটতে পারবেন?”
রোজা হাসার চেষ্টা করে বললো,
—” পারবো।”
মুখে “পারবো” বললেও মাটিতে পা ছোঁয়াতেই কুঁকিয়ে উঠলো সে। তীর্থ খানিকটা এগিয়ে এসে বললো,
—” দোস্ত? হাঁটতে পারবি বলে তো মনে হচ্ছে না। এখন উপায়? এখান থেকে তোকে কোলে করে নিয়ে যাওয়াটা কিন্তু একদমই সম্ভব নয় আমার। পঞ্চাশ কেজি ওজনের মেয়েকে কোলে তুললে মৃত্যু নিশ্চিত।”
তীর্থর কথাকে পাত্তা না দিয়ে ঘড়ি দেখলো মৃন্ময় —- ৪ঃ৩০। আর কিছুক্ষণের মাঝেই সন্ধ্যা নামবে অথচ আরো দু-ঘন্টা হাঁটতে হবে তাদের। রাতের বেলা যুবতী মেয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মৃন্ময়ের ভাবনার মাঝেই গাইডকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো তীর্থ,
—” দাদা? চলুন আমরা বরং এগোই। হিরো যেখানে আছে সেখানে হিরোইনকে নিয়ে আমাদের মতো সাইড ক্যারেক্টারের চিন্তা করার কি কোনো কারণ আছে ? তাই না বস?”
দাঁত কেলিয়ে কথাটা বলেই রোজার দিকে তাকিয়ে ডানচোখ টিপলো তীর্থ। রোজা চোখ রাঙাতেই খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো মৃন্ময়,
—” আমি হেল্প করলে কি খুব বেশি অস্বস্তি ফিল করবেন আপনি? এক্চুয়েলি, এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। তাছাড়া, আপনি এই অবস্থায় হাঁটলেও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবেন না। মে আই?”
রোজা যেন ঘোর অস্বস্তিতে পড়লো এবার।আলো থাকতে এখান থেকে বেরুনোর অন্যকোনো রাস্তা ভেবে না পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়ালো সে। সাথে সাথেই তাকে হেঁচকা টানে কোলে তুলে নিলো মৃন্ময়। কিছুক্ষণ অস্বস্তির সাগরে হাবুডুবু খেয়ে নিজেকে সামলে নিলো রোজা। মুখ দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলে মৃন্ময়ের মুখের দিকে তাকালো। ধূসর টি-শার্টে ঢাকা বুকে মাথা এলিয়ে দিতেই মৃন্ময়ের অবিরাম ছুটে চলা হৃদপিণ্ডের কম্পন কানে এলো তার। শেষ বিকেলের হলুদ আলো পড়ছে মৃন্ময়ের ঘর্মাক্ত মুখটাতে। রোজার শরীর অজানা ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেলো। মৃন্ময়ের গায়ে শরীরের সবটা ওজন ছেড়ে দিয়ে দুষ্টু করে হাসলো সে। মৃন্ময়কে অস্বস্তিতে ফেলতেই গলা ছেড়ে গান ধরলো সে,
—” এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।।
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু।।”
রোজার গান কান যেতেই চেঁচিয়ে উঠলো তীর্থ,
—” উহহো! কিয়া গানা হ্যা দোস্ত। সিচুয়েশনের সাথে পুরোই ম্যাচ। দারুন দারুন…আগে..?
রোজা মুচকি হেসে আবারও গাইতে লাগলো,
—” আমলকি পেয়ালের কুঞ্জে,
কিছু মৌমাছি এখনো যে গুঞ্জে
জানি কোন সুরে
মোরে ভরালে গো বন্ধু।।
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।।
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু।।
আমলকি পেয়ালের কুঞ্জে,
কিছু মৌমাছি এখনো যে গুঞ্জে
জানি কোন সুরে
মোরে ভরালে গো বন্ধু।।”
রোজার হঠাৎ এমন গানে থতমত খেয়ে গেলো মৃন্ময়। শুরুতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও এবার সরাসরি রোজার চোখের দিকে তাকালো সে। রোজার চোখে-মুখে দুষ্টু হাসির ছোঁয়া। মৃন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়েই সাবলিল ভঙ্গিতে গান গাইছে সে,
—” বাতাসের কথা সে তো কথা নয়
রূপকথা ঝরে তার বাঁশিতে।
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
যেন দুটি আঁখি ভরে
রাখে হাসিতে।।
কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়তো তখন তুমি বলবে….”
_______________
বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে আছে রিদ। জানালার পর্দার ফাঁক গেলে হালকা-মৃদু হাওয়া আসছে। রিদের কুকরানো চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে কপালে। ভ্রু দুটো হালকা কুঁচকানো। টিভিতে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ডকুমেন্টারি দেখছে সে। সেখানে একটি প্রশ্ন করা হয়েছে —-” ঘড়ির কাঁটা ৯ টায় থাকলে যদি ৯০ degree হয় তাহলে ঘড়ির কাঁটা ৭ টা ও ৮ টা থাকলে কত degree হবে??” রিদ অনেক চেষ্টা করেও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাপারটাই চরম রকম বিরক্ত সে। রোজা থাকলে বেশ হতো। চট করে কোনো একটা মজার উত্তর পেয়ে যেতো সে। ডকুমেন্টারির মাঝ পথেই খবর শুরু হলো। খবরের শুরুতেই দেখা গেলো শিরোনাম। হেড লাইনে লেখা বেরুলো —- ” বাজেয়াপ্ত বস্তির দুটো পরিবারের লাশ উদ্ধার। সন্দেহে রাফিন চৌধুরী…. ” রিদ টিভির সাউন্ডটা মিউট করে চোখ বন্ধ করলো। টিভিটা আজকেই লাগানো হয়েছে তার ঘরে। আগে পড়াশুনার জন্য টিভি জাতীয় জিনিস তার বা রোজার ঘরে এলাউড ছিলো না। কিন্তু পা ভেঙে যাওয়ার কল্যাণে আজ সকালেই বাবার রুমের টিভিটা রিদের রুমে বসিয়ে দিয়েছেন রাদিব সাহেব। এখন মনে হচ্ছে টিভিটা না থাকলেই ভালো হতো। এটলিস্ট মানুষিক যন্ত্রণাটা তো কমতো! রিদ চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছে কৌতূহলী দুটি চোখ দরজায় উঁকি দিয়ে চলেছে বারবার। রিদ এবার বেশ আগ্রহ নিয়েই বসে রইলো । দরজার বাইরে দাঁড়ানো মানুষটি ভেতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না তার উত্তরটা মনে মনে ভেবে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশকিছুক্ষণ পরও কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে তাকালো রিদ। আজ সকাল থেকেই পর্যায়ক্রমে বিরক্ত হয়ে চলেছে সে। যাকে বলে প্যাটার্ন অনুযায়ী বিরক্ত। রিদ আজকের দিনটির সুন্দর একটি নাম দিয়েছে —- একজাস্টিং ডে। রিদ চোখ ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। ৬ টার ঘন্টা বাজতেই হঠাৎ করেই মনে পড়লো তার, প্রশ্নটা ভুল। কেননা ঘড়িতে ৯ টা বাজলে ৯০ ডিগ্রী হয় না। সেই হিসেবে ঘড়িতে ৮টার সময় ৮০ ডিগ্রী আর ৭টার সময় ৭০ ডিগ্রী নয়, ৮টার সময় ১২০ ডিগ্রী, ৭টার সময় ১৫০ ডিগ্রী হবে। উত্তরটা খুঁজে পেয়ে বেশ শান্তি লাগছে তার। কোমরের ব্যাথাটাতেও কেমন সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। নাহ! আজকের দিনের নামটা “একজাস্টিং ডে” দেওয়া চলবে না। অন্যকিছু দিতে হবে। অসাধারণ সুন্দর কিছু।
৭৯.
ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে আরু। ছাঁদের অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগছে তার। এই অন্ধকারই তো পৃথিবীর আসল রূপ। সকালের আলোটা তো নিছকই অভিনয়। হঠাৎই পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলো আরু। খুব স্পষ্ট আর বাস্তব সেই শব্দ। আরু পেছনে ফিরে তাকাতেই আরিফকে চোখে পড়লো তার। অন্ধকারে আরিফের ভাসা ভাসা মুখটা দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো আরু। ভ্রু দুটো কুঁচকে এলো, এটা কি তার কল্পনা? নাকি বাস্তব? কিছুক্ষণ পর আরিফের পাশে আরমান সাহেবকেও দেখতে পেলো সে। সুস্থ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আরুর মস্তিষ্কের এক অংশ দ্রুত প্রশ্ন ছুড়লো তাকে, ” এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে এতোটা সুস্থ হলো বাবা?” প্রশ্নটাকে পাত্তা না দিয়ে বাবার দিকে ছুটে গেলো আরু। আরমান সাহেবের কাছাকাছি যেতেই পথ আগলে দাঁড়ালো আরিফ। ধারালো গলায় বললো,
—” এগোস না আরু। তুই অপয়া,অলক্ষী। তোর ছোঁয়ায় বাবার ভালো হবে না। আমাদের কারো ভালো হবে না।”
আরু থমকে গেলো। অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” সত্যি!”
—” হ্যাঁ সত্যি। তুই দেখিস নি? তোর জন্যই মা মারা গেলো। বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো। তোর জন্যই লিনার বাচ্চা নষ্ট হলো। দেখিস নি?”
আরুর মস্তিষ্ক দ্রুত গতিতে ছুটছে। সত্যিই তো! তার জন্যই তো সব হলো। সব! সব! আরু অসহায় গলায় বিরবির করে বললো,
—” এখন আমি কি করবো ভাইয়া? কি করবো আমি?”
—” ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড় আরু। এই পৃথিবীতে দুর্বলদের জায়গা নেই। তুই দুর্বল, পরাজিত। তোর বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। তোকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ বিশ্বাস করে না। কেন বাঁচবি তুই? কেন? যা লাফিয়ে পড়। যা…”
আরু কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালো। অনুভূতিহীন চোখ দুটোতে একবার চোখ রেখেই ছাঁদের রেলিঙের দিকে পা বাড়ালো সে।
____________
— “ভাই? দুইটা বাচ্চার লাশও আছে। ওদের মধ্যে বাচ্চা দুইটা কেমনে আইসা পড়ছে বুঝতে পারছি না।”
রাফিন কিছু বলার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
—- “ভাই? ভাবি ছাঁদের রেলিং এর উপর দাঁড়ায় আছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই নিচে পড়ে যাবে ভাই। এখন কি করবো?”
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় গেলো রাফিনের। উঁচু কন্ঠে বলে উঠলো,
—” মানে?”
—” জি ভাই। এখনও দাঁড়ায় আছে। আমি নিচে থেকে স্পষ্ট দেখতাছি। এই বাড়িতে ভাবি ছাড়া তো অন্যকোনো মহিলা নাই। বুয়া তো ছাদে যায় না ভাই।”
রাফিন ফোন ফেলে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। আসিফ কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে রাফিনের পেছনে ছুঁটলো। আরু দু-হাত এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে মস্ত এক চাঁদ উঠেছে আজ। আচ্ছা? চাঁদের পাশের ওই ঝকমকে তারাটাই বুঝি ওর মা? ভাইয়া যখন বলেছে তখন অবশ্যই ওর মা। অবশ্যই ওর মা। কথাগুলো বিরবির করতে করতে ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে হেঁচকা টানে রেলিং থেকে নিজের কোলে টেনে নিলো রাফিন। নিচে দাঁড় করিয়ে রাগের মাথায় মারতে উদ্যত হয়েও মাঝপথেই নামিয়ে নিলো হাত। দুই বাহু ঝাঁকিয়ে গর্জে উঠলো,
—” কি সব পাগলামো শুরু করেছো তুমি? এসব ফালতু নাটক বন্ধ করো এবার। এটা তোমার বাবার বাসা নয় যে সারাদিন কোলে বসিয়ে রাখবো। এক চড়ে সব কটা দাঁত ফেলে দিবো, ফাজিল মেয়ে। তু…”
রাফিনের কথা শেষ না হতেই ডানপাশে হাত ইশারা করে বলে উঠলো আরু,
—” ভাইয়া! আমার ভাইয়া আমাকে…”
এটুকু বলেই রাফিনের বুকে এলিয়ে পড়লো আরু। রাফিন ভ্রু কুঁচকে ডানপাশে তাকালো। কিছুই চোখে পড়লো না তার। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে আরুকে পাঁজাকোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আরুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফোন হাতে সোফায় গিয়ে বসলো সে,
—” হ্যালো, ডক্টর সারা?”
—” ইয়েস স্যার। কোন দরকার ছিলো স্যার..?
—“হ্যাঁ। একটা প্রয়োজনে ফোন দিয়েছি। ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের নাম বলতে পারবেন? যাকে এই মুহূর্তে পাওয়া যেতে পারে।”
ডক্টর সারা বেশ অবাক হলেন। নিজের বিস্ময় আর কৌতূহল চেপে বললেন,
—” জি স্যার। ডক্টর আনোয়ার হোসেন। আপনি হয়তো চিনেন। “
—” ওহ ওকে। উনার নাম্বারটা আমাকে টেক্সট করুন প্লিজ।”
ডক্টর সারা কৌতূহল চেপে রাখতে ব্যর্থ হয়ে হুট করেই বলে উঠলেন,
—” ওকে বাট সাইকিয়াট্রিস্ট কেন স্যার?”
রাফিন বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” কারণটা আপনার না জানলেও চলবে ডক্টর সারা।”
ডক্টর সারা এমন উত্তরই প্রত্যাশা করেছিলেন তবুও মনের কোথাও যেন অপমানের তীক্ষ্ণ ছুঁড়িটা আরেকটু গেঁথে বসলো। মাঝে মাঝে জানা উত্তরটাও বড্ড ভারি শুনায় কানে। বড্ড ভারি!
______________
সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আরু। তার ঠিক সামনে বসে আছেন সাইকিয়াট্রিস্ট আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেনের মুখটি হাসি হাসি। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটোও যেন হাসছে। উনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে আরুকে পর্যবেক্ষন করে নিয়ে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
—” নামটা তো বললেন না। কি নাম আপনার?”
আরু জবাব দিলো না। আনোয়ার হোসেন হাসিমুখে বললেন,
—” তা বেশ, নাম বলতে হবে না। আচ্ছা? আপনি কি বিবাহিত? আপনার পরিবারে কে কে আছেন?”
আরু অদ্ভুত চোখে তাকালো। লোকটির কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছে না তার। আনোয়ার সাহেব রাফিনকে ইশারা করে গলা নামিয়ে বললেন,
—” ওই ছেলেটা কি আপনার স্বামী?”
রাফিন আরুর দিকেই তাকিয়ে আছে। টেবিলে ঠেস দিয়ে হাত ভাজ করে ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরু আড়চোখে রাফিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। আনোয়ার হোসেন অবাক হলেন না। বন্ধুসুলভ গলায় বললেন,
—” সে আপনার হাজবেন্ড নয়? তবে কি আটকে রেখেছে আপনাকে? আপনার হাজবেন্ড কোথায়? কি নাম তার? আমাকে বলুন। আমি আপনার কথা জানাবো তাকে। সে আপনাকে নিয়ে যাবে। বলবেন?”
আরু বার কয়েক চোখ পিটপিট করে নিয়ে বললো,
—” রাফিন। আমার হাজবেন্ডের নাম রাফিন চৌধুরী।”
রাফিন বেশ অবাক হলো। আরুর কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে কি আরু ওকে চিনতে পারছে না? অদ্ভুত! নাম মনে আছে অথচ মানুষ চিনতে পারছে না?
# চলবে….