এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -১৯
৩৪.
মৃন্ময়ের সিক্রেট রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে রোজা। তার দৃষ্টি সামনে দাঁড়ানো মৃন্ময়ের মুখে। মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকে একচোখে ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পরীক্ষা করে চলেছে। এই পর্যন্ত দু’বার রোজাকে চলে যেতে বলা হয়েছে কিন্তু রোজার মধ্যে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটায় মৃন্ময় বিরক্ত হলেও তার মুখে বিরক্তির ছাপ নেই বললেই চলে। মৃন্ময়ের বিহেভিয়ার দেখে মনে হচ্ছে, এই রুমে সে ব্যতীত আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। বিষয়টা খুব অপমানজনক হলেও রোজার কাছে বেশ লাগছে। রোজা দেখতে চায় মৃন্ময় কতোক্ষন তার এই বিরক্তি দমন করে রাখতে পারে। মৃন্ময়ের সেল্ফ কন্ট্রোলিং পাওয়ার চেক করতে গিয়ে রোজা নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠেছে অথচ মৃন্ময়ের চোখে-মুখে কোনো ভাবাবেগ নেই। প্রায় আড়াই ঘন্টা যাবৎ একটা মানুষকে খুবই সুক্ষ্মভাবে ইগনোর করে চলেছে সে। রোজা বিরক্ত হয়ে ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লো। মৃন্ময় ম্যাগনিফাইং গ্লাসে চোখ রেখেই স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলো,
— আপনি যাচ্ছেন না কেন, মিস. রোজা?
রোজা তার থেকেও স্বাভাবিক গলায় বললো,
— আপনাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
রোজার কথায় মৃন্ময়ের কুঁচকানো ভ্রু’জোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো। চিঠি থেকে চোখ উঠিয়ে রোজার দিকে তাকালো। শান্ত কালো চোখদুটো তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়কে তাকাতে দেখেই ফিক করে হেসে উঠলো রোজা। রোজা মজা করেছে! ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও মৃন্ময়ের কোনো ভাবান্তর হলো না। রোজা ইতস্তত করে বলে উঠলো,
— মজা করছিলাম। তবে, আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা শুধু শুধু নয় এর পেছনে কারণ আছে।
— কি কারণ?
— আমি সত্যিই আপনাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছি না তার কারণ আপনার বাবার হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা খুঁজে বের করার সফরে আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। প্লিজ!
রোজার কথাটা শুনে চিঠিটা টেবিলে রাখলো মৃন্ময়। স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিলো,
— আপনি এখন আসতে পারেন, মিস. রোজা। আমি আপনার কথায় ইন্টারেস্টেট নই।
— প্লিজ, মিষ্টার. আরিয়ান। এটাই আমার ফার্স্ট এন্ড লাস্ট চান্স। আপনার বাবার হারিয়ে যাওয়ার গল্প খুঁজে বের করতে পারলেই কেবল স্বপ্নটা পূরণ হবে আমার। আমি ভার্সিটি ক্লাস মিস দিয়ে এই স্টোরিটার পেছনে ছুটছি। এখানে সফল না হলে বাবা আমাকে জার্নালিজমে পড়তে দিবে না। বোঝার চেষ্টা করুন, ইট’স মাই প্যাশন। মাই ড্রিম! আমি আপনার সাথে থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে বলুন? আই প্রমিস, আপনি না চাইলে এটা আমি কাগজে ছাপাবো না শুধু বাবাকে বোঝাবো যে, আমি পেয়েছি। প্লিজ! প্লিজ!
— আপনাকে আমি যেতে বলেছি মিস. রোজা। যান।
— প্লিজজ…
— আই সেইড গো…
রোজা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। স্টোরিটার এন্ডিং পর্যন্ত পৌঁছাতে তো তাকে হবেই। রোজা গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। হুট করে থেমে গিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো সে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিভলভারটা নিয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাক করলো সে। মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রোজার হাতটা মৃদু কাঁপছে। সে হালকা গলায় বলে উঠলো,
— আমাকে সাথে নিতে রাজি হন, নয়তো শুট করবো।
মৃন্ময়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। তবে এবার ভ্রু দুটো কুঁচকে নেই একদম স্বাভাবিক। মৃন্ময়কে এভাবে ভানলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঢোক গিললো রোজা। করুণ কন্ঠে বললো,
— এমন করছেন কেন? আমি তো বললাম, আপনার কোনো নিউজ লিক করবো না আমি। আমি প্রমিজ করলে জীবন দিয়ে হলেও তা রক্ষা করি। বোঝার চেষ্টা করুন, ইট’স এবাউট মাই ক্যারিয়ার। আমার ক্যারিয়ারটা এভাবে নষ্ট করতে পারেন না আপনি।
মৃন্ময় এবারও কিছু বললো না। রোজা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
— নিবেন আমায়? নাকি নিবেন না? ইয়েস অর নট! না নিলে কিন্তু শুট করে দিবো। একদম মাথায়!
মৃন্ময় এবার নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
— ওকে! শুট করুন।
রোজা খানিকটা হতভম্ব গলায় বললো,
— মানে?
— আপনাকে শুট করতে বলছি। শুট মি!
রোজা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে মৃন্ময়কে ভয় দেখাতে চেয়েছিলো কিন্তু মৃন্ময় তো ভয় পাচ্ছেই না উল্টো এমন শান্ত বিহেভিয়ারে রোজাকেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে রোজার। রিভলবার আর হাতের ব্যাগটা টেবিলে শব্দ করে রাখলো সে। টেবিলের উপর রাখা ফাইলগুলো হাতে নিয়ে মৃন্ময়ের দিকে ছুঁড়ে মারলো সে। ঠিক টাইমে সরে দাঁড়ানোর ফলে ফাইলগুলো শরীরে লাগলো না। কিন্তু রোজা থেমে থাকার পাত্রী নয় তেড়ে গিয়ে মৃন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিলো তাকে। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়েও মৃন্ময়কে একচুল নাড়াতে পারলো না। মৃন্ময় রোজার ডানহাত পিঠের সাথে চেপে ধরে স্বাভাবিক গলায় বললো,
— কি হচ্ছে এসব? পাগল হয়ে গেছেন, মিস. রোজা? ইউ নিড সাইকিয়াট্রিস্ট।
— নো। আই নিড পারমিশন। প্লিজ, পারমিশনটা দিয়ে দিন না। প্লিজ! প্লিজ! আপনি খুবই অদ্ভুত একটা মানুষ। আপনি একটা নন আপনার মাঝে অনেকগুলো “আপনি” র বসবাস। আমার দেখা নদীর পাড়ের মৃন্ময়ের সাথে এই মৃন্ময়ের আকাশ-পাতাল তফাৎ। দু’মিনিটের জন্য আগের মৃন্ময় হয়ে আমার রিকুয়েষ্টটা একসেপ্ট করে নিন না। এই, নায়কসাহেব?
মৃন্ময় ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। ওর চোখদুটো রোজার গালের টোলটার ওপর নিবদ্ধ। কথা বলার তালে তালে গালের গর্তটা যেন নৃত্য করছে। মৃন্ময় চোখ বন্ধ করে নিলো। “রোজা” নামক অসুখটা আবারও চাড়া দিচ্ছে মাথায়। মৃন্ময় রোজার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। ডানহাতে কপালে পড়ে থাকে চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলো। পকেটে হাত গুঁজে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো,
— ওকে, বাট আমাকে ওভারকাম করার চেষ্টা করলে আপনাকে পস্তাতে হবে মিস. রোজা।
রোজা তুমুল গতিতে মাথা নাড়লো। খুশিতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। কিন্তু মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো তার। ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠলো,
— আরেকটা কথা বলি?
মৃন্ময় জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সাহস নিয়ে বলে উঠলো রোজা,
— বলছিলাম কি? তীর্থ আমাদের সাথে থাকুক? তীর্থও কিছু লিক করবে না। আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি। ও খুবই ট্রাস্টওরথি একটি ছেলে। আমরা একটা টিম হতে পারে। ইউ নো না? দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। ওর থেকে এক্সট্রা হেল্প পেতে পারেন আপনি। প্লিজ!
রোজা ভেবেছিলো এখনই রাম ধমক খাবে সে অথচ রোজাকে অবাক করে দিয়ে মৃন্ময় খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো,
— ওকে।
— ওয়াও। থেংকিউ সো মাচ মিষ্টার. হিরো। আমার তো সেলিব্রেট করতে মন চাইছে। এনিওয়ে, আপনি কি বিজি?
— কেন?
— বিজি না হলে চলুন না পার্কে যাই। ওই বাচ্চাগুলোকে খাওয়াবো। আজকের খাবারটা আমার পক্ষ থেকে। সেদিন আমি আপনাদের সাথে গেষ্ট হিসেবে ছিলাম, আজকে আপনার পালা। যাবেন?
৩৫.
ভারি টেবিলের ওপাশে গম্ভীর মুখে বসে আছে রাফিন। চোখ দুটো বন্ধ। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ। আসিফ বার বার ঢোক গিলে চলেছে। দু-একবার চোখ পিটপিট করে ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠলো,
— ভাই?
সাথে সাথেই টেবিলের উপর থাকা ফ্লাওয়ার বাজটা ছুড়ে মারলো রাফিন। প্রচন্ড শব্দ কেঁপে উঠলো আসিফ। তার দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। রাফিন যেতে না বলা পর্যন্ত তাকে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কি মুছিবত! রাফিন এবার উঠে দাঁড়ালো,চেয়ারে জোরে একটা লাথি মেরে চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। আসিফ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ডান হাতে কপালের ঘাম মুছে আবারও মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।
— এই রাদিবের সমস্যাটা কি? ওর জন্য আমার কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট ওয়েস্ট হচ্ছে। হোয়াট ডাজ হি ওয়ান্ট? “গরীবদের অধিকার রক্ষা ” হোয়াট রাবিশ। তারওপর এসে জুটেছে আরিয়ান মৃন্ময়! একটা মেঘাস্টারের এসবে জড়ানোর কারণ কি? কি চায় সে?
কথাটা বলে টেবিলে রাখা ফাইলগুলোও ছুঁড়ে ফেললো রাফিন। আসিফ এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রাফিন জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে আসিফের দিকে ফিরে তাকালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
— মৃন্ময় চায় টা কি? টাকা?
আসিফ কাঁচুমাচু কন্ঠে বললো,
— মৃন্ময়ের নিজেরই অনেক টাকা আছে ভাই। সিংগার,হিরো তারসাথে বিজনেসও আছে তাছাড়া…
রাফিন ভ্রু কুঁচকালো।
— তাছাড়া?
— মৃন্ময়ের টাকার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নাই ভাই। নিজের টাকায় ইচ্ছে মতো বিলিয়ে দেয় সে। এখানেও তাই করছে। আমাদের সাথে কোনো শত্রুতার জন্য নয় তার ইচ্ছে হয়েছে তাই বস্তিবাসীদের ফাইনেনশিয়ালি হেল্প করছে। এই কাজটা প্রায়ই করে সে। এতে আপনার লাভ হলেও কিছু যায় আসে না, ক্ষতি হলেও না। আজব ক্যারেক্টার ভাই, আপনি মানা করলে বা ধমকি দিলেও হাসিমুখেই কথা বলবে সে। কিন্তু কাজ থামাবে না, উল্টো বেশি করে করবে। নিজের ইচ্ছের বাইরে হাঁচিও দেয় না সে। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার সাথে আলোচনা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে সর্বোচ্চ শান্ত, ভদ্র এবং নিরীহ। কিন্তু হাত কলার পর্যন্ত চলে গেলে পরের দিন আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় যায়, কিভাবে কি হয়। সে সম্পর্কে কেউ জানে না ভাই। মৃন্ময়ই গুম করে দেয় নাকি অন্যকেউ সেটাও কেউ জানে না ভাই।
— শালার টাকা বেশি হয়েছে নাকি?
— ভাই? শুধু ওকে ঘাঁটিয়ে সময় নষ্ট না করে রাদিবকে নিয়ে ভাবলে হয় না? আমরা কোনো স্টেপ না নিলে আরো লসের মুখে পড়তে হবে ভাই। রাদিব যে ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে আর আমাদের নিয়ে খবর বানাচ্ছে তাতে করে পুরো দেশের মানুষের মধ্যে আগুন জ্বেলে উঠতে বেশি সময় লাগবে না।
— রাদিব! রাদিব! রাদিব! বাস্টার্ড। হি ডিজার্ভ আ টেরিবল ডেথ! ব্রোটালি….
— ভাই? রাদিবকে এখন মারা টা রিস্ক হয়ে যাবে। ও এখন কোনো কারণে মারা গেলে, আমরা মারি বা না মারি সম্পূর্ণ দোষটা অটোমেটিক আমাদের ঘাড়ে চলে আসবে। তার থেকে ওর মেয়েকে মেরে দিলেই ভালো হয় না? মেয়েকে মারা বেশি ইজি হবে। কেউ সন্দেহও করবে না। কেইসটাকে এমনভাবে সাজাবো যেন এটা অর্ডিনারি রেপ কেইসের মতো শো করে। ঢাকায় এমন ঘটনা তো এখন অহরহ ঘটছে…এটা গ্রহণযোগ্য হবে ভাই।
রাফিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সেই চোখের ভাষাটা বোঝার ক্ষমতা আসিফের নেই। না আছে সেদিকে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা।আসিফ
চোখ নামিয়ে নিলো। রাফিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে
থেকেই নজর ফেরালো। কপালে হাত রেখে ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বললো,
— দুপুরের মেয়েটা? নাম কি ওর?
— জি, রোজা। রাদিয়ানা আহমেদ রোজা, ভাই।
নামটা কয়েকবার নিজের মনে বিরবির করলো রাফিন। চেয়ারে বসে স্পষ্ট গলায় বললো,
— মেয়েকে নয় রাদিবের ছেলেটাকে মার।
— ভাই? ছেলের চেয়ে মেয়েটাকে মারা ইজি হবে। আর….
রাফিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— আর হোয়াট?
— বুঝেনই তো ভাই।
রাফিন কিছু বললো না। আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলো। তার মাথায় রোজার নামটা এলার্ম টুনের মতো বেজে চলেছে ক্রমাগত, “রাদিয়ানা আহমেদ রোজা” “রাদিয়ানা আহমেদ রোজা”। হঠাৎ করেই চোখ মেলে তাকালো রাফিন। ভ্রু কুঁচকে আসিফের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো । কুঁচকানো কপালে ব্লেজারটা তুলে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো সে। আসিফ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই রাফিনের আগা-মাথা কিছুই বুঝে না সে, কিচ্ছুটি না। খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে রাফিন। ঠোঁটে জলন্ত সিগারেট। ভ্রু দুটো এমন ভাবে কুঁচকে আছে যেনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ভাবছে সে। রাফিনের মাথায় রোজার সাথে সাথে আরু নামটাও ঘুরছে ব্যাপকভাবে। মেয়েটা ওকে চড় মেরেছিলো তার প্রতিশোধ তো নেওয়া হয় নি তার। নিতে হবে….খুব জলদি চড়ের উল্টো জবাব দিতে হবে তাকে। কিন্তু মেয়েটি কোথায়? মেয়েটির পুরো নামটাই বা কি? রাফিন মনে করতে চেষ্টা করলো কিন্তু সফল হলো না। ব্রেনের সেলগুলোর হয়তো এই মুহূর্তে আরুর নাম নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
৩৬.
পার্কের ব্রেঞ্চে পা দুলিয়ে বসে আছে রোজা। মনটা হালকা খারাপ তার। মন খারাপের মূল কারণ হলো বাচ্চাগুলো। এতো শখ করে তাদের খাওয়াতে এসে কাউকেই খুঁজে পাই নি রোজা। কোথায় গেলো তারা? রোজার চোখগুলো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার ওপাশে একটা কালো ছিপছিপে লোক চানাচুর বিক্রি করছে। কিছুক্ষণ পরপর লোকটি মুখের এমন অবস্থা করছে যেনো তার প্রচুর পেট ব্যাথা করছে। রোজার খুব ইচ্ছে করছে লোকটিকে গিয়ে জিগ্যেস করতে, ” মামা? পেট ব্যাথা করে নাকি?” কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না। আগের মতোই চুপচাপ বসে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো সে। এতোক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে রোজাকে খেয়াল করছিলো মৃন্ময়। এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। হালকা কেশে বলে উঠলো,
— এই যে মিস? মন খারাপ?
রোজা কিছু বললো না। আড়চোখে মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিলো। মৃন্ময় হাসলো। মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
— আপনি কিন্তু অন্যায় করছেন মিস. রোজা। আমাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে এনে চুপচাপ বসে আছেন।
রোজা সরু চোখে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
— এমনভাবে বলছেন যেন। খাওয়ার জন্যই এতোদূর ছুটে এসেছেন।
— অবশ্যই। তবে কেন এলাম?
— তাহলে খাবেন চলুন।
কথাটা বলেই ওঠে দাঁড়ালো রোজা। মৃন্ময় হেসে উঠে বললো,
— আমি টাইম মেইনটেইন করে খাই। এখন টাইমওভার। আমাকে না খাইয়ে রাখার জন্য আপনার পানিশমেন্ট হওয়া উচিত মিস. রোজা।
এবার রোজাও হাসলো। মৃন্ময়ের পাশে বসে বললো,
— সরি!
— সরি দিয়ে কাজ হবে না। পেট ভরতে হবে। আজ খাবারে নয় বাতাসে পেট ভরাবো। শুদ্ধ বাতাস! মিস. রোজা? আপনার সেই মন ভালো করার জায়গায় নিয়ে যাবেন আবারও? আজ হয়তো কারো মন খারাপ।
রোজা হেসে উঠলো। হাসিমুখে বললো,
— অবশ্যই।
— তবে আজ গাড়িতে।
রোজা খানিক ভাবলো তারপর বললো,
— ওকে।
মৃন্ময় গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রোজা সামনের দোকানটাতে কিছু একটা কিনতে গিয়েছে। প্রচন্ড গরম পড়ায় মুখের মাস্ক আর ক্যাপ খুলে দাঁড়াতেই একটা মেয়ের কন্ঠ কানে এলো,
— আপনি আরিয়ান মৃন্ময় তাই না?
মৃন্ময় ফিরে তাকালো। জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
— জি। কিন্তু আপনি?
মেয়েটি উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমি অর্পিতা জামান আরু। আপনার বিশাল বড় ফ্যান । আপনার সব গানই আমার মুখস্ত। মুভিগুলোও দেখেছি। তাছাড়া আপনি যেভাবে বস্তির লোকদের হেল্প করছেন তাতে করে আপনার প্রতি রেসপেক্টটা আরো বেড়ে গেছে। একটা অটোগ্রাফ হবে স্যার?
মৃন্ময় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। তবু মৃদু হেসে বলে উঠলো,
— অবশ্যই।
আরু খুশি মনে ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে মৃন্ময়ের দিকে এগিয়ে দিলো। মুখে বললো,
— এটা আমার প্রিয় বই। প্রিয় বইয়েই প্রিয় মানুষের অটোগ্রাফ চাই।
মৃন্ময় মিষ্টি হেসে বইটা হাতে নিলো। হুট করেই রাস্তার দিকে ইশারা করে বলে উঠলো আরু,
— ওই মেয়েটা বুঝি ম্যাম? অনেক সিম্পল বাট কিউট। আপনাদের বেশ ভালো মানিয়েছে।
অনেকক্ষণ ধরে অবজারভ করছিলাম আপনাদের, তাই বললাম।
মৃন্ময় চোখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। হাতে বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে আসছে রোজা। কয়েকসেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো মৃন্ময়।মিষ্টি হেসে বইটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
— ইউর বুক। নাইস টু মিট ইউ।
আরুও হাসলো। মৃন্ময়কে বিদায় জানিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটা দিলো সে। এক্সাইটমেন্টে বুক কাঁপছে তার। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আরিয়ান মৃন্ময়ের সাথে কথা বলে এলো সে। ভাবা যায়? এতো খুশির মাঝেও হঠাৎ মুখটা কালো হয়ে গেলো আরুর। রাফিনের মুখটা মনে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব ভাবনাকে ঝেড়ে ফেললো সে। মৃন্ময় ততক্ষণে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। খাবারের প্যাকেটগুলো পেছনে রেখে মৃন্ময়ের পাশের সিটে বসতে বসতে রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলে উঠলো রোজা,
— মেয়েটা কে ছিলো? গার্লফ্রেন্ড? নাকি এক্স? তবে দেখতে কিন্তু সেই!
কথাটা বলেই চোখ টিপলো রোজা। মৃন্ময় ড্রায়িভ করতে করতে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,
— ফালতু।
— কে? আপনার ওই এক্স?
— না।
— তাহলে?
— আপনার কথা। কোনো মেয়ের সাথে কথা বললেই সে গার্লফ্রেন্ড হয়ে যায় না মিস. রোজা। এমন ফলিস কথা বললে আমার সাথে ইনভেস্টিগেশনে জয়েন করার কথা ভুলে যান। মেয়েটা একজন ফ্যান ছিলো, নাথিং ইল্স।
রোজা মুখ ফুলিয়ে বললো,
— ওহ! ভালোই তো। হিরোদের কিন্তু বেশ ভালো এডভান্টেজ আছে। সব সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা তাদের ফ্যান হয়। কাউকে পছন্দ হলেই টুপ করে বিয়ে অর ডেট। পটানোর কোনো ঝামেলা নেই, তাই না?
মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— সব সুন্দরী মেয়েরা ফ্যান হয় না। আর যাকে হিরো পছন্দ করে মোষ্ট অফ দি টাইম সে হিরোকে একদমই পছন্দ করে না।
— এমনও হয়?
— হুম। হয় তো, যেমন আপনি।
রোজা কনফিউজড হয়ে বললো,
— মানে?
— মানে! মানে হলো, আপনিও তো হিরোদের পছন্দ করেন না। কোনো হিরো আপনার প্রেমে পড়লে সে তো ফেঁসে যাবে, তাই না?
রোজা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যেনো খুবই মজার কোনো জোক্স শোনানো হয়েছে তাকে। নিজের হাসি কন্ট্রোল করে মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো সে,
— মিষ্টার. হিরো? কোনো হিরো সুন্দরী হিরোইন রেখে আমার মতো মেয়ের প্রেমে পড়তে যাবে কেন শুনি? তাছাড়া, হিরোরা কখনো প্রেমে পড়ে না। ওদের শুধু এট্রাকশন থাকে। আর দুদিন পরেই ফুসস। এজন্যই এতো ঘনঘন ডিবোর্স হয় ওদের। আমার ধারনা এতো এতো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে ওদের অনুভূতি নামক বস্তুটা নষ্ট হয়ে যায়।
মৃন্ময় কেশে উঠলো। আড়চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আপনি কি আমাকেও ইনডিকেট করছেন, মিস. রোজা?
— আপনার শুনতে খারাপ লাগলেও উত্তরটা “ইয়েস”। আপনিও তো হিরো। না জানি
কত্তো কত্তো গার্লফ্রেন্ড ছিলো। যে সুন্দরী সুন্দরী ফ্যান আপনার। দেখেই তো মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা… এই একটু আগে যে মেয়েকে দেখলেন তাকে দেখে আপনার মাথা ঘুরে যায় নি? অসম্ভব সুন্দরী ছিলো মেয়েটা।
মৃন্ময় কিছু বললো না। রাগে শরীর ফেঁটে যাচ্ছে তার। মনে শুধু একটা কথায় চলছে, ” ওহ গড! এই মেয়েটাকে আমি তখন শুট কেন করে দিলাম না? হুয়াই?” মেয়েটাকে শুট করে কাঁচের পেছনে সাজিয়ে রাখলেই তো হতো। চোখের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো, সেটাই বেশ হতো। উফ, কি সব অদ্ভুত কথা ভাবছে মৃন্ময়? এই মেয়েটার সাথে থাকলেই কেমন অদ্ভুত সব চিন্তা করে সে। মেয়েটা তার জীবনে খুব বাজে একটা অসুখ। যে অসুখটা সে সারাতেও পারছে না আবার মেনে নিতেও পারছে না। কি ভয়ানক অবস্থা তার!
# চলবে…