এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -২১
৪০.
আরিফের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে
আরু। ভয়ে বুকটা ধুরুধুরু করছে তার। আরিফের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার। আরিফ আরুকে নীরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করে শান্ত গলায় বলে উঠলো,
— সাইম যা বলেছে তা কি সত্য?
আরু মাথাটা আরেকটু নিচু করে দাঁড়ালো। সাইম আরিফ কে কি বলেছে জানে না আরু। কি উত্তর দেবে সে? আরিফ আবারও প্রশ্ন করলো,
— কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও!
আরু ডান হাতের পিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে ভেতরটা কাঁপছে তার। আরিফ খুব রেগে গেলেই আরুকে তুমি করে সম্বোধন করে। তারমানে তার রাগ এখন বিপদসংকেতের শেষ সীমানায় আছে। আরু আবারও মুখ মুছতে নিলেই ধমকে উঠলো আরিফ,
— কি হলো? চুপ করো আছো কেন? উত্তর দাও। কথাগুলো সত্য না মিথ্যা? ইয়েস অর নো।
আরু ভয় পাওয়া গলায় বললো।
— ভা ভাইয়া? কথাগুলো সত্য কিন্তু…
আর কিছু বলতে পারলো না আরু। সঠিক সত্যটা বলার আগেই ওর গালে চড় বসালো আরিফ। আদরের বোনটার গায়ে জীবনের প্রথম হাত তুলে রাগে কাঁপছে সে। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে আবারও হাত তুলতে গেলে হাতটা আটকে দেয় লিনা। ব্যস্ত হয়ে বলে,
— কি করছো তুমি? এতো বড় বোনের গায়ে হাত তুলছো? পাগল হয়ে গেলে?
— হাত ছাড়ো লিনা। তুমি বলতে না আমি ওকে শাসন করি না। আজ যখন শাসন করছি তখন একটা কথা নয়। একটাও না।
— প্লিজ আরিফ, শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
লিনার কথায় চেতে উঠলো আরিফ। লিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। লিনা নিজেকে কোনোরকম সামলে নিয়ে আবারও এগিয়ে এলো। আরিফ রাগে কাঠের দরজায় ধুমধাম কয়েকটি লাথি দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
— সব ঠিক হয়ে যাবে,তাই না? কিভাবে ঠিক হবে? বলো কিভাবে ঠিক হবে? ওর জন্য বাবা বিছানায় পড়ে আছে।অফিসে যাওয়ার সময় ভরা বাজারে সাইমের ফ্যামিলির থেকে নানা কটুক্তি শুনতে হচ্ছে। এসব কিভাবে ঠিক হবে বলো? তারচেয়ে বরং ওকে বলো বেরিয়ে যেতে। বাবার হত্যাকারীকে বাসায় রাখবো না আমি। কবে দেখা যাবে বাবার সাথে সাথে আমাদের দুজনকেও বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
আরু চট করে মাথা তুলে তাকালো। ভাইয়ের মুখে শোনা প্রতিটি শব্দই আরুর বুকটাকে টুকরো টুকরো করে চলেছে।অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে টলমলে চোখে কান্নামাখা কন্ঠে বলে উঠলো সে,
— ভাইয়া!
— চুপ! একদম চুপ। এই মুখে ভাইয়া ডাকবি না আমায়। আজ যদি বাবার কিছু হয়ে যায় তাহলে তোকেও বাঁচতে দিবো না আমি। আমার চোখের সামনে না দাঁড়িয়ে থেকে যার সাথে ওসব করে বেড়াস তার কাছে যা। একেবারের মতো চলে যা।
লিনা শক্ত গলায় বললো,
— অনেক হয়েছে আরিফ। চুপ করো। আরু? তুই ঘরে যা।
আরু দৌঁড়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। দরজার বাইরে থেকে আরিফ আর লিনার ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আরুর নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। ওর জন্য সবকিছু এতোটা এলোমেলো হয়ে গেলো৷ শুধু ওর জন্য!
কে বলেছিলো রাফিনকে ভালোবাসতে? যে ভালোবাসা বাবাকে মৃত্যুপথযাত্রী করে দেয়, সমাজে কলঙ্কিনী বানিয়ে দেয়, ভাইয়ের চোখে রাস্তার মেয়ে বানিয়ে দেয়, পরিবারের অশান্তির কারণ বানিয়ে দেয় সেই ভালোবাসাকে কি আসলেই ভালোবাসা বলে? তবু চোখ বন্ধ করলে রাফিনের চেহারাটাই ভেসে উঠে আরুর। কেন হয়? কথাটা ভেবেই হাতের কাছের সবকিছুই ছুঁড়ে ফেললো আরু। বিছানায় বসে দু’হাতে বিছানার চাদর চেপে ধরে ছাদের দিকে তাকালো সে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। আজ চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আরুর। কিন্তু কেন জানি চিৎকার করার অধিকারটুকুও জোগাতে পারছে না সে। নিজেকে সত্যিই রাস্তার মেয়ে মনে হচ্ছে তার। আসলেই কি তার বেঁচে থাকা উচিত? সবার অশান্তির কারণ হয়ে কি বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়?
৪১.
মৃন্ময়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোজা। তীর্থ পাশে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মৃন্ময় একটা ফাইলে কিছু একটা লিখছিলো সেদিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,
— আপনি কি কিছু বলতে চান মিস.রোজা?
মৃন্ময় ভেবেছিলো রোজা হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলো রোজা,
— আপনিই ওই ছেলেদেরকে মেরেছেন তাই না?
মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকালো। অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
— কোন ছেলে?
— কাল রাতের ছেলেগুলো। ওদের ছবি আজ পেপারের ফন্ট পেইজে বেরিয়েছে। দেখেছেন নিশ্চয়?
ওদের কথোপকথন শুনে পাবদা মাছের মতো “হা” করে তাকিয়ে আছে তীর্থ। ওদের মাঝে কি নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝতে না পারলেও “রাত” শব্দটা চট করে আঘাত করে গেলো তার মাথায়। রাত? রোজা আর নায়ক ফায়ক রাতে কি করে? অদ্ভুত! তীর্থ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মৃন্ময় বিস্মিত গলায় বললো,
— ওহ্। জার্নালিস্টদের সাথে টিচ করলেও আজকাল খবরের ফন্ট পেইজে চলে আসা যায়, দারুন তো! এইজন্যই আপনাকে বিশ্বাস হয় না আমার। না জানি কবে আমায় নিউজ বানিয়ে দেন। এনিওয়ে, ছেলেদেরকে আমার পক্ষ থেকে কনগ্রাচুলেশন জানাবেন মিস.রোজা। আর আমি খুবই দুঃখিত, আজকের পেপারটা পড়া হয়ে উঠে নি আমার।
— আপনি বুঝাতে চাইছেন, আপনি ওদের মারেন নি?
— অদ্ভুত! আমি ওদের মারতে যাবো কেন? আমার সাথে ওদের কোনো ঝামেলা ছিলো না। ঝামেলা তো আপনার সাথে ছিলো। ওয়েট..আপনি মারেন নি তো মিস. রোজা?
— হোয়াট! আমি? আমি মারলে তো তখনই মারতাম। মাঝরাতের জন্য ওয়েট করতাম কেন শুনি?
মৃৃন্ময় হাসলো। প্রজেক্টরটা ঠিক করতে করতে বললো,
— হয়তো আমি একটা জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ থেকে যাবো তাই আমাকে সরিয়ে আমার অগোচরে কাজটা করেছেন আপনি। সব সন্দেহ তো আপনার দিকেই যাচ্ছে মিস. রোজা। কাজটা কিন্তু ঠিক করেন নি আপনি। এনিওয়ে, কাজের কথায় ফেরা যাক?
কথাটা বলে টেবিল থেকে রিমোটটি উঠিয়ে নিয়ে বোর্ডের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো মৃন্ময়। রাগে ভেতরটা ফেঁটে যাচ্ছে রোজার। কি সুন্দর করে ওর উপরই সব দোষ চাপিয়ে দিলো মৃন্ময়… মৃগী রোগী কোথাকার। তীর্থ রোজার আরেকটু কাছাকাছি এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
— কাহিনী কি দোস্ত? তোরা ডেটিং করছিস নাকি? রাতের বেলা করিস টা কি? ইনকুয়ারি করতে এসে প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?
রোজা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই তীর্থ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে নিয়ে বললো,
— ওকে ফাইন৷ কিছু বলতে হবে না।আই এম কুয়াইট।
রোজা আরেকবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনের দিকে তাকালো। সামনে তাকাতেই রুমের লাইটটা অফ হয়ে প্রজেক্টরের আলো জ্বলে উঠলো। স্কিনে কিছু চা বাগানের ছবিকে ইশারা করে বলে উঠলো মৃন্ময়,
— আমাদের ফার্স্ট গন্তব্য হলো সিলেট। আমাদের টার্গেট মূলত সিলেটের চা বাগান।
তীর্থ কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,
— চা বাগানে কেন? মিষ্টার. আরিয়া চা বাগানে কেন যাবেন? চা পাতা কিনতে?
মৃন্ময় গম্ভীর গলায় বললো,
— লেট মি ফিনিশ তীর্থ। কথার মাঝে কথা বলাটা পছন্দ নয় আমার। যা বলছিলাম, আমাদের টার্গেট সব কটা চা বাগান নয়। সিলেটের ১৩৫ টি চা বাগানের মাঝে শুধুমাত্র একটা চা বাগানকে উদ্দেশ্য করে সিলেট যাবো আমরা। আর তা হলো মালনীছড়া চা বাগান।
রোজা ভ্রু কুঁচকালো,
— চা বাগানে আমাদের কাজটা কি হবে? আমাদের মোটিভটি কি? মিষ্টার আরিয়াকে খোঁজা?
— না। উনাকে নয়। আমাদের মোটিভ হলো শাইয়াম চাং সম্পর্কে ইনফরমেশন কালেক্ট করা।
তীর্থ বললো,
— শাইয়াম চাং কে? মিষ্টার. আরিয়ার সাথে তার কি সম্পর্ক?
মৃন্ময় কিছু বলার আগেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো রোজা,
— তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। করি?
মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকালো। ল্যাপটপের দিকে ঝুঁকে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলে উঠলো,
— কি প্রশ্ন?
— আমার মনে হয় বিষয়টা শুরু থেকে জানা থাকা উচিত আমাদের। নয়তো আমরা দুজন কোনো হেল্পই করতে পারবো না আপনাকে। আমি জানি আমাদের দু’জনকে প্রয়োজন আছে বলেই সাথে রেখেছেন আপনি। এতোদিনে এটুকু তো বুঝেই গিয়েছি আপনি কারণ ছাড়া কিছু করেন না। এনিওয়ে, আমার প্রথম প্রশ্ন হলো- আপনি সেদিন বলেছিলেন মিষ্টার.আরিয়া আপনাকে ফোনে বলেছিলো তিনি জলদি ফিরে আসবেন। উনি যদি সত্যিই ফোন করে থাকে তাহলে আপনি উনাকে উনার লোকেশন জিগ্যেস করেন নি কেন?
মৃন্ময় এবার চোখ তুলে তাকালো। রোজার চোখদুটো আটকে গেলো মৃন্ময়ের চোখে। কি ভারি পল্লব! রোজার মুহূর্তেই মনে হলো, মৃন্ময় ছেলে না হয়ে মেয়ে হলেই বেশ হতো। ওর চোখ দুটোর উপর ভিত্তি করেই হয়তো হাজারো কবিতা রচনা হতো….হাজারও যৌবন এই চোখের মায়ায় হয়ে উঠতো কাব্যিক। কথাগুলো ভেবে নিজের মনেই হাসলো রোজা। মৃন্ময়ের চরিত্রের মতো ওর সৌন্দর্যটাও খুব রহস্যময় লাগে রোজার চোখে। কখনো হলদে ফরসা তো কখনো উজ্জল শ্যামা। কিন্তু সবসময়ই অসম্ভব সুন্দর! রোজা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। মৃন্ময় ল্যাপটপটা সাইডে রাখতে রাখতে বললো,
— গুড কোশ্চেন! আপনাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটা বোকা আপনি নন। ইম্প্রেসিভ!
কথাটা বলে হাসলো মৃন্ময়। দু’হাত পকেটে গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। রোজার প্রশ্নমাখা দৃষ্টিতে স্থিরদৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
— বাবা কখনোই ফোন করেন নি আমায়। বাবা যেদিন বাসা থেকে চলে যান সেদিন আমি মহাস্থানগড় ছিলাম,স্কুলের ট্রিপে। দু’দিন আগে থেকেই উনার সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ ছিলো আমার। বাবার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা কারোরই জানা ছিলো না ইভেন মারও নয়। আর আপনার পাওয়া চিঠিটা মা পর্যন্ত পৌঁছাই নি কখনো। পৌঁছালে হয়তো চারমাসের মাথায় মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তেন না উনি। এনিওয়ে, যা বলছিলাম। বাবা চলে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি আমাদের। ওটা আপনাকে এমনি বলেছিলাম।
রোজা কিছুক্ষণ বিরবির করে বলে উঠলো,
— মিথ্যুক! আপনার কোন কথা বিশ্বাস করবো আমি? এটাও যদি মিথ্যে হয় তো?
মৃন্ময় হাসলো।
— আমি মিথ্যা বলছি নাকি সত্যি সেটা বুঝে নেওয়াটা আপনার রেসপনসেবলিটি নট মাইন। এনিওয়ে, আর কোনো প্রশ্ন?
— হুম। আপনার বাবা যে বান্দরবান যান নি সেই বিষয়ে সিউর কিভাবে হচ্ছেন? আর উনার সাথে যোগাযোগ না থাকলে শাইয়ম চাং সম্পর্কে কি করে জানলেন? উনি কি আপনাদের পূর্বপরিচিত? উনার সাথে মিষ্টার.আরিয়ার সম্পর্কটা কি?
— আপনার অনেক আগেই রুমগুলো সার্চ করেছিলাম আমি। সেখান থেকে তিনটি বান্দরবানের টিকেট পাই। টিকেটের কারণটা প্রথমে গেস করলেও পরবর্তীতে চিঠিটা পেয়ে ব্যাপারটা একদমই পরিষ্কার হয়ে যায়। আপনি যে চিঠিটা পেয়েছিলেন সেটা ক্লিয়ার করেছি আমি। স্ক্রিনে দেখুন…
রোজা আর তীর্থ স্ক্রিনে তাকাতেই স্ক্রিনে একটা চিঠি ভেসে উঠলো। টাইপ করা লেখা,
মালিহা,
আজ আমাদের ১৪ তম বিবাহবার্ষিকী।দ
েখতে দেখতে চৌদ্দটি বছর কেটে গেলো অথচ তোমাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারলাম না। তোমার স্বপ্নের ফ্যামিলি ট্যুরটা আর হলো না। বান্দরবানের তিনটি টিকেট কেটেছিলাম তোমায় সারপ্রাইজ দিবো বলে কিন্তু দেওয়া হলো না। আমায় একাই ছুঁটতে হলো গন্তব্যে। যেখানে যাচ্ছি সেখানে হালকা পাতলা রিস্ক আছে তাই তোমায় আর মৃমুকে সাথে নিচ্ছি না। এই একদম মন খারাপ করবে না। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো। চ্যাম্পকে আমার আদর দিও আর তাকেও মন খারাপ করতে বারণ করো। তার বাবা জলদি ফিরে আসবে। ফিরেই তিনজনে মিলে ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য ছুটবো। সাথে থাকবে একটা সারপ্রাইজ! এবার পাক্কা প্রমিজ করছি। তোমাকে না বলে চলে যাচ্ছি বলে রাগ করো না। সরি সোনা। তুমি তো জানো, যাওয়ার সময় তোমার উদাস চেহারা একদমই নিতে পারি না আমি। এট লাস্ট, “অ্যাঁই সাঁইতে”
তোমার আরিয়া।
চিঠিটা পড়ে রোজা প্রথম যে প্রশ্ন করলো তা হলো,
— মিষ্টার হিরো? অ্যাঁই সাঁইতে অর্থ কি?
মৃন্ময় রোজার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তীর্থ অবাক হয়ে বললো,
— কি?
—অ্যাঁই সাঁইতে অর্থ আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটা রাখাইন ভাষা।
তীর্থ সরু চোখে তাকিয়ে রোজার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
— এর বাপ রাখাইন নাকি দোস্ত? আমি ভাবছিলাম তোরে প্রপোজ করলো। আত্মা তো আকাশে উঠে গিয়েছিলো রে…নায়কের বউ!
রোজা আবারও চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কথাটা মৃন্ময়ের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা বুঝা গেলো না। মৃন্ময় স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
কাম টু দ্যা পয়েন্ট, বাবা যে টিকেটের কথা লিখেছেন সেগুলো আমার কাছে অর্থাৎ এই টিকেটগুলোর একটিও ব্যবহার করা হয় নি। বাবা যেমন মিতব্যয়ী মানুষ তিনি ঘরে তিনটা টিকেট থাকা অবস্থায় নতুন কোনো টিকেট কেটে বান্দরবান যাবেন না। উনার বান্দরবান যাওয়ার হলে এই তিনটি টিকেট থেকেই একটা ব্যবহার করতেন। যেহেতু টিকেটগুলো পরবর্তীতে ব্যবহার করা যাবে না সেহেতু এই টিকেট যত্ন করে সাজিয়ে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। আর শাইয়ম চাং আমাদের পূর্বপরিচিত নয়। আমি কখনো শুনি নি নামটি। কিন্তু বাবার পুরনো ডায়েরী চেইক করতে গিয়ে একটা লেখা চোখে পড়ে আমার।
তীর্থ কৌতূহলী গলায় বলে উঠলো,
— কি লেখা?
মৃন্ময় প্রজেক্টরের দিকে ইশারা করে বললো,
— টেক আ লুক।
রোজা- তীর্থ স্ক্রিনে তাকাতেই সেখানে লেখা ভেসে উঠলো,
— ” শাইয়াম চাং ; মালনীছড়া চা বাগান- ০৭/০৬/২০০৬”
রোজা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
— এই তারিখটাতেই কি আপনার বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন?
— না। বাবা বেরিয়েছিলেন জুনের ৬ তারিখে আর এখানে লেখা জুনের ৭ তারিখ। অর্থাৎ, বাবার গন্তব্যে ছিলো শাইয়ম চাং। এখন আমাদের এই শাইয়ম চাং- কে খুঁজে বের করতে হবে।
মৃন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,
— কাল আমরা সিলেট যাচ্ছি। সকাল ১০ টায় ফ্লাইট। আই থিংক আপনারা ঠিক টাইমে পৌঁছে যাবেন।
রোজা আর তীর্থ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো,
— জি।
বাসায় ফিরে ব্যাগ প্যাক করছিলো রোজা। মাকে কি বাহানা দেওয়া যায় সেসব আইডিয়ায় ঘুরছে মাথায় হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে উঁকি দিলো রিদ। মাথা হেলিয়ে ওর ঝাঁকড়া চুলে হাত চালিয়ে বলে উঠলো,
— আসবো আপু?
রোজা না তাকিয়েই মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— চলে আয়।
রিদ বিছানায় বসলো। আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলো,
— কোথাও যাচ্ছো আপু?
— হুম যাচ্ছি।
— কোথায়?
— ওটা টপ সিক্রেট। বলা যাবে না।
রিদ মুখ কালো করে বললো,
— বলো না আপু। আমি কাউকে বলবো না। প্রমিস!
রোজা এবার রিদের দিকে তাকালো। কোকঁড়ানো চুলগুলো আরেকটু এলোমেলো করে দিয়ে হাসলো রোজা। হাসিমুখে বললো,
— ইনভেস্টিগেশনের কাজে যাচ্ছি। বাবার পার্মিশন আছে বাট মায়ের কানে যাওয়া বারণ।বুঝলি?
রিদ অবাক চোখে তাকালো। কৌতূহলী কন্ঠে বলে উঠলো,
— এডভেঞ্চার? তীর্থ ভাইয়াও সাথে যাচ্ছে? আমাকেও সাথে নাও না আপু। প্লিজ!
— একদম না। আগে বড় হয়ে নে তারপর দুজনে মিলে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। অনেক অনেক কেইস সল্ভ করবো। তারজন্য ঝটপট বড় হতে হবে তোকে।
— প্রমিস?
— একদম।
রিদ মিষ্টি করে হাসলো। হাসিমুখেই বললো,
— আজ কি হয়েছে জানো?
রোজা লাগেজের চেইন লাগাতে লাগাতে বললো,
— এখনো জানি না তবে বললে জানবো। বলে ফেল…
রিদ আগ্রহী কন্ঠে বললো,
— আজ যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম। তখন একটা কুকুরকে গুলি করতে গিয়ে একটা বৃদ্ধার শরীরে লেগেছিলো প্রায়।
রোজা ভ্রু কুঁচকালো,
— কুকুরকে গুলি মানে?
— আমি আর সাদিব রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম কোথা থেকে একটা কুকুর দৌঁড়ে এলো। আমরা ভয় পেয়ে সরে যেতেই আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠলেন। রক্তে পা ভেসে যাচ্ছিলো, জানো? তখন ওই লোকগুলো এসে উনাকে হসপিটালে পাঠালো আর সরি বললো। তারা নাকি সরকারি লোক। কুকুরটা পাগল হয়ে গেছে, সামনের মহল্লায় নাকি কয়েক জনকে কামড়েছে। ইনজেকশন পুষ করা যাচ্ছিলো না তাই শুট করেছে।
রোজা ভ্রু আগের থেকেও কুঁচকে গেলো। বিরবির করে বললো,
— পশু অধিদপ্তরের লোকেরা তো এভাবে শুট করে কুকুর মারে না কখনো। ওদের কাছে ইনজেকশন থাকে। কুকুর ধরার টেকনিক থাকে। এভাবে শহরের মাঝে শুট… ব্যাপারটা কি সন্দেহজনক নয়?
এটুকু ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো রোজার। ফোন রিসিভ করে তীর্থের সাথে কথা বলতে বলতে রিদের “কুকুর টপিক” টা মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো রোজার।
# চলবে…